পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

আন্দোলনের ৪০ দিন পরে ফিরে দেখা জাস্টিস

  • 18 September, 2024
  • 1 Comment(s)
  • 1287 view(s)
  • লিখেছেন : ডাঃ অনিন্দ্য সেন
তিলোত্তমার মৃত্যু ঘিরে যারা জাস্টিস দাবী করছেন, এই প্রাইভেটাইজেশনের ব্যাপারটাকে নজরের বাইরে রেখে জাস্টিসের কোন ধারনায় পৌঁছোতে পারবেন না তারা। পারবেন না, কারণ তারা নিজেদের কাছে সৎ। তাই প্রশ্নটা তোলা উচিত এখনই। কারণ ডাক্তাররা তো সিস্টেমের অঙ্গ। সাধারণভাবে সিস্টেম বদলে ফেলার বিপ্লবী অ্যাজেন্ডা এদের স্বাভাবিক জীবনদর্শনের অঙ্গ নয়। শ্রমিক কৃষকের ক্ষেত্রে হয়ত যা স্বাভাবিক, তা এদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক নয়।

দু’দশকের বেশী সময় আগে, বিলকিস বানোর অত্যাচারীদের শাস্তি হয়েছিল - যাবজ্জীবন জেল। জাস্টিস হয়েছিল। আবার এখন সেই লোকগুলো জেল থেকে বেরিয়ে (ঐ কাজগুলো করেছিল বলেই) হিরোর ওয়েলকাম পেল। এবার কি তাহলে জাস্টিস আনডান? তাই হবে নিশ্চয়। হাথরাস - উন্নাও এর ধর্ষক হত্যাকারীদের ধরা ছোঁয়া হয় নি। জাস্টিস অধরা।  

কিন্তু নির্ভয়ার অত্যাচারের দোষীরা সবাই চরম শাস্তিই পেয়েছিল। কিন্তু জাস্টিস? সে এসে থাকলে পরবর্তীতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় কেন? আরও বড় মাপে, বড় সংখ্যায়? কখনো ভেবে দেখেছি কি?

জাস্টিস তো তাহলে অধরাই - নয় কি? কেন অধরা? ভাবা দরকার যে এই সব ঘটনার জন্য আপাতভাবে দায়ী, সেই সব মূল্যবোধ-হীন, ভোগবাদ-মোক্ষলোভী, চিন্তাশক্তিরহিত, জীবনের সূক্ষ্ম-সুন্দর পেলব দিকটির হদিস না পাওয়া মনস্টারদের লাইফ-সাইকলটি কেমন? কোথায় তাদের উৎপত্তি কোথায় কিভাবে তাদের বিলয় (মৃত্যুর কথা হচ্ছে না)? আমরা কি ভেবেছি তা নিয়ে? পুলিশ দিয়ে কোথাও কারও নিরাপত্তা হয় নি, হয় না। আমেরিকাতে হয় না। সেখানে পুলিশ-জনসংখ্যার অনুপাত তো কতই ভালো আমাদের চেয়ে। তবু সেখানে কতশত স্কুল বাচ্চা প্রায়শঃই সহপাঠীদের ব্রাশ ফায়ারিং এর শিকার হয় তার কেই বা হিসেব রাখে? তাই দেশের সর্বোচ্চ আদালতে  তিলোত্তমা মামলার শুনানির সময়ে জুনিয়ার ডাক্তারদের আইনজীবী ইন্দিরা জয় সিং, যখন ১৫০০ পুলিশকর্মী মোতায়েন করার দাবী তোলেন এবং তাতে মহামান্য বিচারপতি সায় দেন, তখন অবাক হতে হয়।  

কিন্তু হিসেব তো জরুরি, আরও জরুরি গোড়ায় পৌঁছানো, তার জন্যে দরকার খানিকটা চেতনায় শান। আমরা রাজি আছি তো?

আমাদের সন্ততি তিলোত্তমা চরম অপমানের শিকার। আমাদের সন্তানরা রোদ-বৃষ্টি-ঝঞ্ঝা মাথায় করে রাস্তায় এক মাসের বেশী সময় ধরে। তাদের প্রতি আমাদের সমর্থন প্রশ্নাতীত। শহর-নাগরিক সমাজের যে সমর্থন তারা পেয়েছেন তাতে এটা অভূতপূর্ব এক জন জাগরণের নজির হয়ে থাকলো। কিন্তু জাস্টিস সম্পর্কে যে প্রশ্নটা দিয়ে শুরু করেছিলাম সে সম্পর্কে কিছু স্বচ্ছতা মিললো কি?

যে পাঁচদফা দাবি নিয়ে জুনিয়র ডাক্তাররা মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে গিয়েছিলেন তাদের প্রায় সব দাবীই তো মুখ্যমন্ত্রী মেনে নিলেন। স্বাস্থ্যসচিব ছাড়া ডিএমই, ডিএইচএস, পুলিশ কমিশনার তিনজনকেই তো সরিয়ে দেওয়া হল। জাস্টিস কি মিললো? আমরা তো যে তিমিরে ছিলাম সেখানেই থেকে গেলাম। আর ডাক্তারদের সিকিউরিটি সেফটি এসব কথার কোন অর্থ হয় না। মমতা ব্যানার্জি লক্ষবার প্রতিশ্রুতি দিলেও লাখ জনসংখ্যা প্রতি দেড়শো পুলিশ নিয়ে নিরাপত্তা অসম্ভব - এটা বুঝতে যেটুকু ঘিলু লাগে ডাক্তারদের অবশ্যই সেটা আছে।

কিন্তু তবু এই দাবি আদায় ইতিবাচক। শাসকের নতশির অতি অবশ্যই আন্দোলনকারীদের আত্মবিশ্বাসী করে তোলে, জোগাড় হয় আরো বড় দাবী আদায়ের আন্দোলনের পাথেয়। অতএব ওয়েলকাম।

তার মানে? আমি কি তাহলে আমাদের সন্তানদের ডাক্তারী পড়ালেখা ছেড়ে পথেই থেকে যেতে বলছি? অবশ্যই নয়। কিন্তু অবশ্যই বলছি জাস্টিসের প্রকৃত রূপ এবং অন্তর্বস্তুকে গভীরতায় গিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে।

আমার মতে জাস্টিস কিন্তু একেবারে অধরা নয়। এই যে সব ডাক্তার অধ্যাপকরা - প্রিন্সিপ্যালরা লাগাম ছাড়া নিয়োগ-দুর্নীতি, সর্বত্র পয়সার খেলা সেসব নিয়ে কথা বলছেন। সরকারি ডাক্তারকুলের দুর্বল শিরদাঁড়ার ওপর ভর করে যে সন্ত্রাসের পরিমন্ডল রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আকাশকে ছেয়ে রেখেছিল এতদিন, সব দুষ্কর্মের আড়াল হয়েছিল ভয়ের যে মেঘ, জুনিয়রদের একরোখা জেদ সেই মেঘকে যেন সরিয়ে দিল হঠাৎ। তাদের জেদ যেন বড়দের শিরদাঁড়ায় মালিশের কাজ করেছে। সাহসে ভর করে তারা এখন মুখ খুলছেন - বেরিয়ে আসছে প্রতি দিন নতুন নতুন তথ্য - মিডিয়ার খাদ্য জুটে গেছে এবং এখনও যাচ্ছে, রোজকার ডোজ। যেসব ক্ষমতাবান অধ্যাপক খানিকটা ক্ষমতার সঙ্গে তথাপি সততার মোড়কে রসে বসে ছিলেন, তাদের মধ্যে পদত্যাগের হিড়িক। সব মিলিয়ে একটা ক্লিনজিং হচ্ছে বৈকি। এই অকালে স্বপ্ন দেখার পক্ষে এগুলো খুব কম কেন হবে?

কিন্তু কথা হচ্ছে স্বপ্ন তো দেখতে হবে! তা না হলে জলের উপরিস্তরের তরঙ্গরেখাগুলি অচিরেই নতুন গজানো কচুরিপানায় ঢেকে যাবে আবার। সেই আবরণের নীচে আবার দেখা যাবে শুরু করেছে এমডি থিসিস পেপার আর মৃতদেহের বেসাতি। আবার কোন সাহসিনী কন্যার সম্মান ও জীবন বিপন্ন হবে। না হে না, এসব নিছক সিনিসিজম নয়, নয় কোন কষ্ট কল্পনা। এইসব আবরণের নীচেই তো জন্ম নেয় ঐ সব মনস্টার, ঘাতকের ভূমিকাটা যারা পালন করে মাত্র। কিন্তু ওদের জন্ম-জীবনকাল-মৃত্যু কার উপর, কোন অমোঘ সমাজ বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে? ভেবেছি কি? স্বপ্ন তো ভাবনা থেকেই উৎসারিত হয়। তাই ভাবো বন্ধু, ভাবা প্র্যক্টিস করো।

আমাদের সময় এসব ছিল না আমাদের রাজ্যে - অন্ততঃ এই সব  হাইড্রা-হেডেড মনস্টার। এখন এসব আছে। মাঝে সাড়ে তিন দশক আর অসংখ্য প্রাইভেট কর্পোরেট হাসপাতাল, আছে কয়েক গন্ডা প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ। আমাদের সময় ক্যাপিটেশন ফি ছিল ব্যতিক্রম। বেসরকারি ইকোসিস্টেমে সেটা এখন রুল - আইনসিদ্ধ। সন্তান কে ডাক্তার করে তোলা এখন বড়সড় ইনভেস্টমেন্ট। কোটি টাকারই ব্যাপার। ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট। শিক্ষা ব্যবসা, স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যবসা এবং স্বাস্থ্যও ব্যবসা। সবাই প্রফিট করতে চায়! পড়িয়ে প্রফিট, স্বাস্থ্য বেচে প্রফিট, প্রফিটই মোক্ষ। সুতরাং ঐ লজিকেই নিট কেলেঙ্কারি জায়েজ - কারণ তা ইনেভিটেবল। নিট - আকাশ-বাইজুস থেকে ডাক্তারীতে সাপ্লি ক্লিয়ারেন্স - সর্বত্র যে টাকার খেলা, সেটা কি এই লাগামহীন প্রাইভেটাইজেশন ছাড়া সম্ভব ছিল? হাসপাতাল- ইনসিওরেন্স নেক্সাস যা প্রতিদিন শুষে নিচ্ছে মধ্যবিত্ত মানুষের সঞ্চয়, সেটা কি সম্ভব ছিল স্বাস্থ্যখাতে টাকা কমানো, সরকারের ক্রমিক পিছু হঠা আর "উন্নত" টেকনোলজি নির্ভর স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্রটি প্রাইভেটের জন্য মুক্ত করে দেওয়া - এসব বাদ দিয়ে? সম্ভব ছিল "পরিষেবা" থেকে "বেওসা"য় স্বাস্থ্যব্যবস্থার এই অন্তর্জলীযাত্রা? ভেবে দেখতে হবে না?

কিন্তু আমরা খেয়ে বসে আছি যে প্রাইভেটাইজেশন ছাড়া নান্যোপায়ং। সরকারি ক্ষেত্র আর চিকিৎসা জগতের অত্যাধুনিক প্রকরণ ইনকমপ্যাটিবল। সরকারের পক্ষে আর নতুন মেডিকেল কলেজ তৈরি করা সম্ভব নয়। অতএব তাদের ডাকো যাদের টাকা আছে। ডাকো এবং ভুলে যাও যে তারা এতদিন টাকা করেছে প্রফিটের মাধ্যমে এবং এখানেও তারা প্রফিট করতেই আসছে, খয়রাত বা সেবা করতে নয়। প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ থেকে একজন ছাত্রের ডাক্তার হয়ে বেরোতে ৮০ লক্ষ থেকে এক কোটি টাকা খরচ হয়। 'ভদ্র-সভ্য' পথে ডাক্তারী করে তো ঐ টাকা তুলে ফেলা অসাধ্য। অতএব দুষ্কর্ম, কাট মানির খেলা, তার স্বাভাবিক অনুসঙ্গ ক্রাইম।

এবার কি একটু কচুরিপানার নীচে জলস্তরে ক্রাইমের চাষ কিভাবে তার কিছু কিছু আন্দাজ পাওয়া গেল? আরো অনেক ফ্যাক্টরই আছে। সঞ্জয় রাইরা আছেই কিন্তু মধ্যবিত্ত কলেজ প্রফেসর/প্রিন্সিপ্যালরা যে হঠাৎ বড়লোক হওয়ার সম্ভাবনা আজ দেখতে পায়, চিরকাল সেটা ভাবাই সম্ভব ছিল না। আজকের দিনে অ্যাকাডেমিক থেকে ক্রাইম রিং লিডার হয়ে ওঠার উদাহরণ একটা নয় বহু। এই জার্নিটা সম্ভব করেছে প্রাইভেটাইজেশন।

সুতরাং তিলোত্তমার মৃত্যু ঘিরে যারা জাস্টিস দাবী করছেন, এই প্রাইভেটাইজেশনের ব্যাপারটাকে নজরের বাইরে রেখে জাস্টিসের কোন ধারনায় পৌঁছোতে পারবেন না তারা। পারবেন না, কারণ তারা নিজেদের কাছে সৎ। তাই প্রশ্নটা তোলা উচিত এখনই। কারণ ডাক্তাররা তো সিস্টেমের অঙ্গ। সাধারণভাবে সিস্টেম বদলে ফেলার বিপ্লবী অ্যাজেন্ডা এদের স্বাভাবিক জীবনদর্শনের অঙ্গ নয়। শ্রমিক কৃষকের ক্ষেত্রে হয়ত যা স্বাভাবিক, তা এদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক নয়।

আন্দোলনের বাস্তব মাটিতেও তাই দেখা গেছে। ইমোটিভ দিকটি যত তীব্র থেকেছে, সিস্টেমের প্রশ্নটি তার শত ভাগের একভাগ তীব্রতা নিয়েও সামনে আসে নি। হয়ত এটাই এই আন্দোলনের অন্যতম সীমাবদ্ধতা হয়ত এটাই সমসময়ের বাস্তবতা। ক'বছর আগের দিল্লীর ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন কৃষি বিল আর এমএসপির কথা জোর দিয়ে তুললেন, কৃষিতে সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির অনুপ্রবেশের কথা আদৌ তুললেন না। এই কম্পার্টমেন্টের রাজনীতিই হয়তো আজকের বাস্তবতা!

এই মাসাধিক কালের প্রতিবাদী কোথাও না কোথাও প্রত্যেকের সামনেই ব্যবস্থা বদলের কথা হাজির করবে নানা রূপে - এটাও তো সত্যি। দেখা যাক আবেগের ওপরে উঠেও আমাদের তরুণ যোদ্ধাদের কতজন এই প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবতে পারেন।

আবার এটাও খুব সত্যি যে সিস্টেম যতই পচাগলা হোক, তার সঙ্গে অঙ্গীভূত হতে তাদের সময় লাগবে না। তাই প্রাইভেটাইজেশন নামক মনস্টার প্রোডিউসিং জলাভূমির স্থায়ী বেনিফিশিয়ারি হয়ে ওঠার আগেই তাদের চেতনায় শান দিতে হবে। ভাবতে এবং বলতে হবে এই জলাভূমি তারা চান না তার উচ্ছেদ চান।

এই প্রশ্নটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে পারার মধ্যে দিয়েই হয়ত সম্ভব জাস্টিসের একটা অর্থ খুঁজে পাওয়া। তিলোত্তমা নিজের বিনিময়ে হয়ত এই অর্থটারই ইঙ্গিত দিয়ে গেল। যেন বলে গেল - তবু সমুদ্র মন্থন হলে কিছু তো অমৃত জাগে। এসো সেই অমৃতের অধিকার নিই।

লেখক পেশায় চিকিৎসক এবং একসময় জুনিয়ার ডাক্তার আন্দোলনের অন্যতম মুখ।

1 Comments

Ranjan Sett

18 September, 2024

লেখার শেষে এখানে রয়েছে "লেখক পেশায় চিকিৎসক এবং একসময় জুনিয়ার ডাক্তার আন্দোলনের অন্যতম মুখ"। তিনি প্রাইভেটাইজেশনের ব্যাপারটা নিয়ে নিশ্চয়ই অনেক দিন ধরেই ভাবছেন এবং সে নিয়ে কিছু কাজও করেছেন আশা করি। কিন্তু লেখায় তার কোনো প্রতিফলন দেখলাম না। যদি লেখক এখনও এই পেশাতেই থেকে থাকেন, তাহলে কি ধরে নেব এটি তার নিজেরই স্বিকারোক্তি, "ডাক্তাররা তো সিস্টেমের অঙ্গ। সাধারণভাবে সিস্টেম বদলে ফেলার বিপ্লবী অ্যাজেন্ডা এদের স্বাভাবিক জীবনদর্শনের অঙ্গ নয়।"

Post Comment