পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

করোনা টিকাকরণের ধনী-দরিদ্র

  • 18 September, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1311 view(s)
  • লিখেছেন : সুমন সেনগুপ্ত
রাত জেগে, লাইনে দাঁড়িয়ে, পুলিশের লাঠি খেয়েও টিকা পাচ্ছেন না বহু মানুষ। কাজ-হারানো মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আর ধনী এবং প্রভাবশালীরা নিজেদের সুবিধামতো সময়ে এবং স্থানে টিকা নিচ্ছেন। টিকাকরণের এহেন ধনী-দরিদ্র ভাগাভাগি আগে দেখেনি দেশের মানুষ।

দেশে করোনার টিকা দেওয়া শুরুর পর থেকেই বিভিন্ন আদালতে বেশ কিছু জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছে। সেই মামলাগুলের বিষয় মোটামুটি এই রকম:

১. টিকাকরণে বেসরকারী ক্ষেত্রকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে কেন ?

২. টিকা কেন বাধ্যতামূলক হবে ?

৩. টিকা-শংসাপত্রে প্রধানমন্ত্রীর ছবি কেন থাকবে ?

প্রতিটি ক্ষেত্রেই আদালতে কেন্দ্রীয় সরকারকে সমালোচিত হতে হয়েছে। বিভিন্ন আদালতের টিকাকরণ নিয়ে মামলাগুলো একসঙ্গে শুনানির আবেদন জানালে সুপ্রিম কোর্ট বলেন, সমস্ত মামলা তাঁরাই শুনবেন। তারপর গঙ্গা দিয়ে বহু জল নয়, বহু লাশ ভেসে গেছে কিন্তু টিকাকরণ নিয়ে সমস্যার সমাধান হয়নি। রোজ নতুন নতুন খবর, রোজ নতুন নতুন সমস্যা

সম্প্রতি কেরালা হাইকোর্টের একটি জনস্বার্থ মামলায় রায় দেওয়া হয়েছে, প্রথম টিকার পরে দ্বিতীয় টিকা দেওয়ার সময় ৮৪ দিন থেকে কমিয়ে ২৮ দিন করা হোক। সেই মতো কোউইন মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করারও নির্দেশ দেয় আদালত। তবে, ওই নির্দেশ কোবল তাঁদের জন্য প্রযোজ্য যাঁরা বেসরকারী হাসপাতাল থেকে টিকা নিচ্ছেন। তার মানে কি দাঁড়ালো? যাঁরা টাকা দিয়ে প্রতিষেধক নেবেন, তাঁদের ক্ষেত্রে কোনো নিয়মই নিয়ম নয়, আর যাঁরা রাত জেগে লাইন দিয়ে পুলিশের লাঠি খেয়ে টিকা নিচ্ছেন, তাঁদের জন্যেই যাবতীয় নিয়ম। আদালতের কাছে আর্জি জানানো হয়, টিকার শংসাপত্র না থাকার কারণে বহু মানুষ বিদেশ যেতে পারছেন না, কারণ বেশ কিছু দেশ এই প্রতিষেধক ছাড়পত্রকে বাধ্যতামূলক করেছে। সেই আর্জির ভিত্তিতেই কেরালার আদালত ওই রায় দেয়।

জানুয়ারী মাস থেকে যখন সিরাম ইন্সটিটিউট টিকা উৎপাদন শুরু করে, তখন দুটি ডোজের ব্যবধান ছিল চার থেকে ছয় সপ্তাহ। কিছুদিন পর, তা বাড়িয়ে ৬ থেকে ৮ সপ্তাহ করা হয়। তারপর মে মাসে সেই ব্যবধান এক ধাক্কায় ১২ থেকে ১৬ সপ্তাহ করা হয়। অনেকেই অভিযোগ করেন, টিকার জোগানে সঙ্কটের বিষয়টি ধামাচাপা দিতে এই ব্যবধান বাড়ানো হয়েছে। টিকার কার্যকারিতা কমে যাবে এই আশঙ্কাও করেছিলেন অনেকে, কিন্তু কেন্দ্র কোনো অভিযোগকেই গুরুত্ব না দিয়ে একতরফা ভাবে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়। তাহলে কেরালা হাইকোর্টের রায়ে কী প্রমাণিত হলো? যদি সামাজিক প্রভাব থাকে, বিদেশ যাওয়ার সুযোগ থাকে, তাহলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের নিয়মকানুন অবান্তর

ওই রায়ে আবারও প্রমাণিত হলো, কোভিড সংক্রমণ ধনী-দরিদ্র ভেদাভেদ না করলেও তার প্রতিষেধক কিন্তু ভেদাভেদকে মান্যতা দেয়। কোভিডও কি ধনী-দরিদ্র ভেদাভেদ করেনি? প্রথম সংক্রমণের সময়ে যেভাবে সমাজের একাংশের মানুষ (আজও অনেকে) নিজেদের চারিদিকে প্রাচীর তুলে দিয়ে ভেবেছিলেন যে তাঁরা যথেষ্ট সুরক্ষিত, সেই মানুষদের কি লকডাউন বা সরকার আরোপিত বিধিনিষেধে কিছু এসে গেছে? অসুবিধা হয়েছে তাঁদের, যাঁরা নিত্য ট্রেনে যাতায়াত করে কর্মক্ষেত্রে যেতেন। কাজ হারিয়েছেন মূলত সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষ। কর্ম ক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত হয়েছেন তাঁরাই। ভারতীয় অর্থনীতির দিকে যে সমস্ত সংস্থা লক্ষ্য রাখেন, সেই সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির অন্যতম প্রধান মহেশ ব্যাস গত জুন মাসে জানিয়েছেন, কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে প্রায় এক কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। প্রায় ৯৭ শতাংশ পরিবারের আয় কমেছে।

বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা নির্দেশ দেয়, কর্মীরা দু’ডোজ টিকা নিলে তবেই কাজে যোগ দিতে পারবেন। ওদিকে সরকারী ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট পরিমাণে টিকা না থাকার ফলে বহু মানুষ তাঁর কাজের জায়গায় বহাল হতে পারছেন না। রাত জেগে লাইনে দাঁড়িয়ে লাঠির বাড়ি খেয়ে তাঁরা প্রতিষেধক নিতে মরিয়া। সরকারী নির্দেশিকা ছাড়াই কিন্তু বেসরকারি সংস্থাগুলো এই সব নিয়ম কর্মীদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। আবার যে আদালতের কাছে সবার সমান অধিকার থাকার কথা, যে সংবিধানের ছত্রে ছত্রে সমানাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, সেই বিচারব্যবস্থাই যদি মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টির রায় দেয়, তাহলে মানষ ভরসা করবে কার ওপর? সরকার মানুষের কথা না শুনলে, মানুষ এতোদিন আদালতের দারস্থ হতেন, এখন মানুষ কার কাছে যাবেন?

অতএব গরিব মানুষ টিকার জন্য লড়াই করবেন। রাজ্য সরকারের নির্দেশ, যথেষ্ট টিকাকরণ না হলে লোকাল ট্রেন চলবে না। সাধারণ মানুষ তাই কাজের জায়গায় পৌঁছতে পারবেন না। কাজ-হারানো মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আর ধনী এবং প্রভাবশালীরা নিজেদের সুবিধামতো সময়ে এবং স্থানে টিকা নেবেন। কেউ রাত জেগে, লাইনে দাঁড়িয়ে টিকা নিয়ে ভাবেন, যাক এ যাত্রায় কাজটা বোধহয় টিকে গেল। আবার কেউ প্রতিষেধক নিয়ে নিজস্বী তুলে, সামাজিক মাধ্যমে জানান দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।

টিকাকরণের এহেন ধনী-দরিদ্র ভাগাভাগি আগে দেখেনি দেশের মানুষ। মোদীজি সেটাও করে দেখালেন।

0 Comments

Post Comment