পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

বামপন্থার পশ্চাদ অভিসারের এক নতুন দিশা!

  • 05 March, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 3338 view(s)
  • লিখেছেন : অশোক মুখোপাধ্যায়
আমাদের মতো কেশ-শল্যবিদ্যায় পারদর্শী কূটকাচালিকদের মতে, আব্বাস সাহেব যেমন অবশ্যই সেকুলার নন, তেমনই তাঁকে এখনই মৌলবাদী বলে দাগিয়ে দেওয়াও ঠিক হচ্ছে না। এটা বোঝার জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডক্টরেট হতে হয় না যে এই সেকুলার ফ্রন্টের মূল কাজ তৃণমূলের মুসলিম সমর্থক এবং/অথবা ভোটারকুলের মধ্যে খাবলা বসানো। যেটা বামপন্থার ঝাল মশলা দিয়ে এখনও সম্ভব হচ্ছে না, কেন না, এই সব বৃহৎ বামপন্থীরা অনেক দিন ধরেই বাঁদিকের ফুটপাত ধরে আর হাঁটছেন না।

বামপন্থী ছাত্রযুব সংগঠনগুলির ডাকে গত ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ যে নবান্ন অভিযান হয় তাতে পুলিশের ব্যাপক লাঠিচার্জের ফলে অসংখ্য আন্দোলনকারী আহত হন এবং একজন যুবক অটোচালক মইদুল ইসলাম প্রচণ্ড জখম হয়ে পরে হাসপাতালে মারা যান। মা মাটি মানুষের নামে চলা তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত রাজ্য সরকারের আগ্রাসী ভূমিকায় রাজ্যের সমস্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষজন বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। যাঁরা কট্টর সিপিআই (এম)দলের বিরোধী, সেই সমস্ত সাধারণ মানুষ এবং ছোটখাটো র‍্যাডিক্যাল বামপন্থীগ্রুপও এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেন এবং তৃণমূল সরকারকে ধিক্কার জানান।

আমাদের মতো বয়োবৃদ্ধ লোকেরা যারা গত শতকের একটা সময়ে পশ্চিম বাংলার মাটিতে বামপন্থী গণ আন্দোলনের বিভিন্ন ধারার উত্থান দেখে বড় হয়েছে এবং অধঃপতন দেখতে দেখতে বুড়ো হয়েছে, তাদের কাছে এই নবান্ন অভিযান এবং তার পরবর্তীকালে সিপিএম দলের কর্মী সমর্থকদের উৎসাহ ও উল্লাস ছিল চোখে পড়ার মতো। মনে হচ্ছিল, অনেক দিন পরে আবার যেন এই দলের কর্মী সমর্থকরা টাটার ম্যানেজারি, ন্যানোর উমেদারি এবং করপোরেট শিল্পায়নের হকারি করার পুঁজিবাদ পোষক দক্ষিণপন্থী রাজনীতির দুষ্ট চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। তারা এখন চিলি বলিভিয়া ফ্রান্সের সাম্প্রতিক কালের বৃহদায়তন ছাত্রযুব কৃষক শ্রমিকদের অভ্যুত্থানকে স্মরণ করছে, দিল্লির বুকে জাঁকিয়ে মোদী সরকারের হাড় কাঁপানো বিক্ষোভ অবস্থানে মানসিক সান্নিধ্য অনুভব ও উপভোগ করছে, লাল পতাকার বহুকাল ধরে হারানো সম্মান পুনরুদ্ধারে তারা যেন দৃঢ় সঙ্কল্প! সোস্যাল মিডিয়ায় সেই উন্মাদনা লক্ষ করে আমরাও উদ্বুদ্ধ হচ্ছিলাম।

কিন্তু হায়! তার কদিনের মাথাতেই ঘটল কেরালায় সেই দুর্যোগ।১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১।

প্রায় অনুরূপ দাবি সনদ হাতে নিয়ে সেদিন কংগ্রেসের ছাত্রযুবরা কেরালায় এক বিক্ষোভে সামিল হয়েছিল। তাতেও বিজয়ন সরকারের পুলিশ বাহিনী বীভৎস লাঠিচার্জ করে এবং আন্দোলনকারীদের এক বিরাট সংখ্যক লোক নানা মাত্রায় আহত হন। আর ঠিক সেই দিন থেকে চিলি বলিভিয়ার ভারতীয় পার্শ্বাংস সকল সোস্যাল মিডিয়া থেকে সম্পূর্ণ উধাও। কেন না, তখন বাংলার লাল পতাকায় উদ্দীপ্ত কমরেডরা বুঝে নিয়েছেন, তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে জ্ঞাপিত প্রতিটি পোস্টের তলায় এবার আর শুধু ৩৪ বছরের শুঁটকি ভূত নয়, কেরালার তাজা ভূত তাদের তাড়া করে আসবে। ছবির পালটা ছবি সহ। অর্থাৎ, সিপিএম-এর আন্দোলনকারী ভূমিকা যে নিতান্তই ক্ষমতা হারানো দশার পথনাটককর্মসূচি, এর সঙ্গে বাস্তবে যে আর্থসামাজিক সমস্যার কোনো যোগ নেই, সরকারি ক্ষমতায় গেলে সিপিএম আর তৃণমূলে যে মূলে কোনো তফাত নেই, এটা বড্ড চোখে লাগার মতো করে উঠে আসবে।

অতএব বেশ হইহই করে মইদুলকে ছেড়ে টুম্পা-গীতে প্রবেশ বা অনুপ্রবেশ! এটি একশ শতাংশ নিরাপদ; কেন না, এর কোনো বিপদে ফেলার মতো কেরালা প্রতিভাষ্য আপাতত নেই।

সবে একটা বিতর্ক যখন দানা বাঁধতে শুরু হচ্ছিল—লাটাই আর টুম্পার মধ্যে মাঞ্জা দেওয়া সুতোয় বাঁধা মাখো মাখো সম্পর্কের হৃদ্‌-মাঝারে কোনো পুরুষতন্ত্র ফাঁদ পেতেছে কিনা—সেই সময়, হ্যাঁ, ঠিক সেই সময়েই আসরে এসে গেল এক নতুন মশলা। হুগলী জেলার ফুরফুরাশরিফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকির তৈরি নতুন সংগঠন—ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট। তাদের সঙ্গে অচিরেই জোটবদ্ধ হলেন সিপিএম নেতারা, অবশ্যই পুরনো জোটসঙ্গী কংগ্রেসের সঙ্গে কোনো বাতচিত না করেই। এই নতুন জোটালির আঠা যে কতটা পাকাপোক্ত, পীরজাদা ২৮/২ তারিখের ব্রিগেড মঞ্চে উঠে এসেই বুঝিয়ে দিলেন (কিংবা, কর্মবাচ্যে, বুঝিত হলেন)! অধীরবাবুকে বক্তৃতা মাঝপথে থামিয়ে মাইক ছেড়ে দিতে হল সিদ্দিকি সাহেবের সঙ্গে ময়দানের লাল পতাকাধা বিপ্লবীদের পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য। পীরজাদার সঙ্গে ময়দানে প্রচুর লোক এল এবং সভা চলাকালীন—বস্তুত, সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির ভাষণ প্রদানকালীনই—তাঁর বিদায় গমনের সঙ্গে সঙ্গে সেই লোক প্রাচুর্যের হ্রাস প্রাপ্তি এক ঢিলে, বা এখানে হয়ত ঢিল শব্দটা শোভন নাও হতে পারে, এক চালে রাজ্যবাসীকে বুঝিয়ে দিল, এক একটা ধান থেকে সর্বাধিক কতগুলো চালের দানা বেরতে পারে।

আমাদের মতো কেশ-শল্যবিদ্যায় পারদর্শী কূটকাচালিকদের মতে, আব্বাস সাহেব যেমন অবশ্যই সেকুলার নন, তেমনই তাঁকে এখনই মৌলবাদী বলে দাগিয়ে দেওয়াও ঠিক হচ্ছে না। এটা বোঝার জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডক্টরেট হতে হয় না যে এই সেকুলার ফ্রন্টের মূল কাজ তৃণমূলের মুসলিম সমর্থক এবং/অথবা ভোটারকুলের মধ্যে খাবলা বসানো। যেটা বামপন্থার ঝাল মশলা দিয়ে এখনও সম্ভব হচ্ছে না, কেন না, এই সব বৃহৎ বামপন্থীরা অনেক দিন ধরেই বাঁদিকের ফুটপাত ধরে আর হাঁটছেন না। টাটা-ন্যানো করে আর যাই হোক বামপন্থা সামলানো যায় না। বিজেপি-ও যে এখন সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম প্রশ্নে সিপিএম-এর শিল্প-সুর ভাঁজতে শুরু করেছে, তাতেই এটা মালুম! তাই মুসলমান ধর্মীয় আবেগ দিয়েই—বলে কিংবা না বলে—মুসলমান ভোট ধরার আয়োজন করতে হচ্ছে “ভোট ফর লেফট” থেকে “লেফট ফর ভোট” পরিচয় প্রাপ্ত সিপিআই (এম) দলকে।

আব্বাস সিদ্দিকি এখন পর্যন্ত এমন কিছু বলেননি যাতে তাঁকে সাম্প্রদায়িক বা মৌলবাদী বলা যায়। অন্তত আমার চোখে তেমন গুহ্য বচন পুঞ্জ আসেনি। কেউ দেখালে এবং আমি ভুল প্রমাণিত হলে খুশি হব। হিন্দু সেন্টিমেন্টে খোঁচাখুঁচি করে দাঙ্গায় প্ররোচনা দেওয়ার মতো বা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের পক্ষে তিনি কিছু বলেছেন বলে শুনিনি। বাকি যা বলেছেন, বিশেষ করে মেয়েদের স্বাধীনতা বা পোশাকের ব্যাপারে, সেই কথাগুলো ধর্মীয় বৃত্তের আন্তরিক মর্মোদ্ভিদ আলাপন। ধর্ম বিশ্বাস যে আধুনিক গণতান্ত্রিক বিচারধারার অনেক পেছনে পড়ে আছে, তা আমরা সকলেই জানি এবং এই সব উদাহরণ দিয়েই তাকে সাব্যস্ত করে থাকি।

আমাদের গণতান্ত্রিক ও বামপন্থী চেতনার দিক থেকে প্রধান আপত্তি ধর্মীয় আবেগকে ব্যবহার করে ভোট ধরার এই হীন কৌশলে। মুসলমানকে কেবল ভোটার বলে ভাবার এই হীন সংকীর্ণ জমিদারি ভাবনাতে। ইমাম মুফতি পীর ধরে সমস্ত মুসলমানকে দলবদ্ধভাবে এক প্রতীকে সামিল করা যায়—এই যুক্তিহীন এবং অনৈতিক চিন্তাতে। কংগ্রেস এই খেলায় এক প্রবীন অমল দত্ত (স্যর মাফ করবেন, আপনার সুনামি নাম ব্যবহার করার জন্য)। সেই মোহনদাস করমচাঁদের আমল থেকেই বহু দশক ধরে সে এই লাইনে কোচিং করে আসছে। তৃণমূল তারই বংশধারায় এই কলাটি সঙ্গে নিয়ে এসেছে। সংখ্যালঘু মুসলিম সমাজের উন্নয়নের কথা বলতে গেলেই তাদের ইমাম মাদ্রাসা আর মাজারের কথাই মনে পড়ে। ভোটার কার্ড ছাড়া মানুষ মুসলমানকে তারা চেনে না। কবি কাজী নজরুল ইসলামও তখন ওদের হাতে সংখ্যালঘুর কবি হয়ে ওঠেন। সিপিএমও খুলে আম সেই খেলায় নেমে পড়ল, প্রায় ধুতির কাছাখোলা অবস্থায়, এতেই বরং আমরা বিস্মিত।

অথবা বিস্মিতই বা কেন হব? মইদুল যাদের কাছে নিতান্তই ভোটের জন্য দরকারি লাশ, কাজ হয়ে গেছে ভেবে কেরালা ঘটনার পরদিন থেকে যাকে দিব্যি ভুলে থাকা যায়, আব্বাস সিদ্দিকিও যে তাদের কাছে ভোটেরই আর একটা কৈলাশ হয়ে দাঁড়াবে—এতে আর অবাক হওয়ার কী আছে? আমাদের বোধ হয় এখন থেকে অবাক হওয়ার মানসিক অ্যাপটাকে ভেতর থেকে আন্‌ইনস্টল করে ফেলতে হবে।

দুঃখের কথা একটাই। এই মুহূর্তে বিজেপি যে ঔদ্ধত্যের সঙ্গে তার ফাসিস্ত কর্মসূচি নিয়ে এগোতে চাইছে, বাংলার রাজনৈতিক রঙ্গভূমিতেও ঢুকতে চাইছে, তার বিরুদ্ধে বামপন্থীদের একটা শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলার দরকার ছিল। সেই কাজ পিছিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, আব্বাস সিদ্দিকিরা ততই বিজেপি-র অনুকূলে মশলা জোগাবেন—জেনে কিংবা না জেনে। শাসকীয় ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করতে নেমে সুবিধাবাদী অনৈতিক জোট করার পরিণাম দাঁড়াবে এই যে রাজ্যের জনগণকে সর্বনাশের কিনারায় ঠেলে দেওয়া হবে।

বামপন্থী কর্মী সমর্থকরা এটা বুঝলে হয়ত এখনও সর্বনাশ ঠেকানোর সময় আছে। “বোঝা”-র মধ্যেই এক অনিরসনীয় দ্বন্দ্ব। মগজের বোঝা দুর্বল হলে মাথার উপরের বোঝা ভারি হয়ে ওঠে।

দেখা যাক, আমরা আগামী দিনে বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগে এই দ্বন্দ্বের সমাধান করতে পারি কিনা!

0 Comments

Post Comment