এটা স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর না কি দেশভাগের প্লাটিনাম জয়ন্তী! কোন উদযাপনের দিন আজ।
স্বাধীন ভারতের সঙ্গে সঙ্গে আমরা পেয়েছিলাম খণ্ডিত এক বাংলা। দেশের স্বাধীনতার উদযাপনের চেয়ে এই ভুখণ্ডের বিরাট অংশের মানুষের কাছে সেদিন দেশভাগের যন্ত্রণা, ব্যথা আর আতঙ্কই বড় হয়ে উঠেছিল। বঙ্গভূমির দুই প্রান্তেই বহু মানুষের কাছেই দেশভাগ ছিল দেশত্যাগেরই নামান্তর। তাদের কাছে স্বাধীনতা ছিল অর্থহীন একটা শব্দমাত্র। স্বাধীনতা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের বাপ পিতমহের ভিটেমাটি আর মাতৃভূমির অনন্ত স্মৃতি পিছনে ফেলে দেশ ছড়ে ভারতে এসেছিল নিরাপদ আশ্রয়ের আশায়। পূর্ব পাকিস্তান থেকে হিন্দু শরনার্থীর এ দেশে আসা, তাদের পুনর্বাসনের সুষ্ঠু বন্দোবস্ত হওয়া বা না-হওয়া নিয়ে দেশে বিদেশে বিস্তর লেখালিখি হয়েছে, বড় বড় গবেষণা সন্দর্ভ রচিত হয়েছে। বই লেখা হয়েছে, গল্প-উপন্যাস-কবিতার সংখ্যাও কম নয়। আজও তা নিয়ে হয়ে চলেছে বিস্তর ‘কাজ’। ‘পার্টিশান স্টাডিজ’ নামে বিভাজনের পাঠ পড়ানোর ভিন্ন বিভাগ গড়ে উঠেছে এ দেশে এবং বিদেশের নামি বিশ্ববিদ্যলয়ে। সে কাজ হচ্ছে মূলত হিন্দু শরণার্থীদের অবস্থা নিয়ে।
দেশভাগের পরে অখণ্ড বাংলার পশ্চিমাংশে হঠাৎ সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়া মুসলমানদের কি হল সে খবর কি রেখেছি আমরা! যারা এ পার বাংলা থেকে পাকিস্তানে চলে গেল তাদের খবর আমরা রাখিনি, এই বাংলায় যারা রয়ে গেল তাদের সম্বন্ধেও সামান্যই জানি আমরা।
দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান হঠাৎ প্রায় কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। অখণ্ড বাংলার পশ্চিমাংশের মুসলমানদের সিংহভাগই শেষ সময় পর্যন্ত জানত না যে দেশ ভাগাভাগির কোন ফল বা পরিণাম তাদের কপালে জুটতে চলেছে। নবচিহ্নিত সীমান্তের কাছাকাছি গ্রামের কিছু গরিব মুসলমান হুজুগে বা ত্রাসে পূর্ব পাকিস্তানে চলে গিয়ে আবার তিন-চার দিন পরে নিজের ভিটেয় ফিরে এসেছিল। ওই অংশের গ্রামীণ বাংলায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বা হানাহানির চিহ্ন না থাকায় দেশভাগের অর্থ বা ভবিষ্যৎ ফলাফল তার পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না। অথচ দেশভাগ তার পরিচিতিই (সংখ্যাগুরু থেকে সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়া) কেবল বদলে দেয়নি, তার ক্ষমতা নির্ভরতার কেন্দ্রটিও নড়বড়ে করে দিয়েছিল। কারণ শিক্ষিত সম্পন্ন অভিজাত মুসলমানদের বেশিরভাগই পূর্ব পাকিস্তানে চলে গিয়ে স্থিত হয়। এ বাংলায় পড়ে থাকে অক্ষরহীন, সম্পদহীন, ক্ষমতাহীন চাষা মুসলমানরা। দিশাহীন নেতৃত্বহীন পশ্চিমবঙ্গের এই মুসলমান সে দিন যে বিপন্নতার মধ্যে পড়েছিল তা তার প্রতিবেশী হিন্দু সমাজ বোঝেনি বা বুঝতে চায়নি। আজও কি বোঝে! আজ মুসলমান সে বিপন্নতা অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে। কিন্তু হয়তো তার আর্থ-সাংস্কৃতিক পশ্চাদপদতার কারণেই পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানের যৌথ স্মৃতির মধ্যে দেশভাগ এবং সেই কারণে সংখ্যালঘু হয়ে পড়ার যন্ত্রণা কোথাও থেকে যায়। সে ভুলতে পারে না যে শাসকের ধর্ম ছিল তার পরম্পরা এবং ক্রমে তাকে ভিনদেশি খ্রিস্টান শাসন এবং ‘নসিবের ফেরে’ আজ তাকে হিন্দু আধিপত্য স্বীকার করে নিতে হচ্ছে।
ভারতে মোট মুসলমান জনসংখ্যার ৩৬% শহরবাসী। পশ্চিমবঙ্গে ১৭%। ভারতে কিন্তু শহরবাসীর জাতীয় গড় ২৮%। এ রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান যে গ্রামে বাস করে তার কতগুলো ঐতিহাসিক কারণ অবশ্যই আছে। ঐতিহাসিক কারণেই শহর কলকাতা কার্যত উর্দুভাষীদের দখলে। স্বাধীনতার আগে কলকাতায় যে বাঙালি মুসলমান বাস করতেন তাঁদের বড় একটা অংশ ছিল সম্পন্ন অভিজাত শিক্ষিত। আগেই বলেছি, দেশভাগ এবং তারপরের কয়েকটি দাঙ্গার জেরে তাঁরা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে চলে যান। পরবর্তীকালে লেখাপড়া এবং চাকরির টানে গ্রাম থেকে যে বাঙালি মুসলমান শহরমুখী হয়েছে তার সংখ্যা এখনও পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য নয়।
গ্রামে বাস করার ফলে মুসলমানের কৃষির উপর নির্ভরতা, দুর্বল স্বাস্থ্য পরিসেবা আর ব্যাপক নিরক্ষরতার কারণে তাদের অক্ষমতা আর বঞ্চনার শিকার হতে হয়। শহরে বাস করলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য পরিষেবা ছাড়াও চাকরি এবং উপার্জনের ক্ষেত্রে কিছু বাড়তি সুবিধা পেয়ে সচ্ছল হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে। তা থেকে তারা বঞ্চিত। ফলে রাজ্যের সামাজিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতির ক্ষেত্রে তাদের যে আনুপাতিক অংশগ্রহণ থাকার কথা তা থাকে না। কারণ সমাজ-রাজনীতির উপরতলায় এই গ্রামীণ বঞ্চিত মানুষদের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ প্রায় নেই, তাই সরকারি নীতিকে নিজেদের অনুকূলে প্রভাবিত করার ক্ষমতাও তাদের কম। দেশজুড়ে ‘সোয়াতন্ত্রতা কি অমৃৎ মহোৎসব’-এর বিপুল উদযাপনের আড়ালে এই সমস্ত তথ্য কিন্তু চাপা পড়েই থাকে।
একটা বিষয় লক্ষণীয়, এই সময় কালে সামগ্রিক ভাবে সরকারি চাকরিতে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বে চোখে পড়ার মতো কোনও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। সংগঠিত ক্ষেত্রে, বিশেষ করে সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের অকিঞ্চিৎকর উপস্থিতির অন্যতম কারণ উচ্চশিক্ষা চত্বরে মুসলমানদের লক্ষণীয় অনুপস্থিতি। শিক্ষালাভের ব্যাপারে আগ্রহ বাড়লেও, সরকারি চাকরি পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা ও দক্ষতা মুসলমান অল্পবয়সি চাকরি-প্রার্থীদের মধ্যে এখনও সুলভ নয়। পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছাত্রছাত্রীদের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, মাত্র ৩-৪% মুসলমান। সরকারি চাকরিতে মুসলমান চাকরি-প্রার্থীদের যোগ্য করার জন্য নাম কা ওয়াস্তে কিছু শহর-কেন্দ্রিক সরকারি চেষ্টা দেখা যাচ্ছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে যে অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে, তার একটা বড় কারণ ‘আল-আমিন মিশন’ বা ‘নাবিবিয়া মিশন’-এর মতো কিছু আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অদম্য চেষ্টা। তাদের উদ্যোগেই চিকিৎসা ও বিজ্ঞান পাঠের ক্ষেত্রে চমকপ্রদ কিছু সাফল্য দেখা গিয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত অন্য সামাজিক গোষ্ঠীর চেয়ে মুসলমানরা গড়ে কম সময় স্কুলে কাটায়। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বা গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠান তৈরির ফলে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে মুসলমানদের সুযোগ বাড়লেও, সামগ্রিক ভাবে রাজ্যে উচ্চশিক্ষায় তাদের অংশগ্রহণ স্নাতক স্তরে ৮ শতাংশ, স্নাতকোত্তরে ৪.২। রাজ্য সরকারের ২০১৬-১৭ স্টাফ সেনসাস অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে মোট ৩২১,০০০ কর্মিবর্গের মধ্যে মাত্র ৬.৮ শতাংশ মুসলমান। ২০১১ সালে সংখ্যাটি ছিল ৫.১৯ শতাংশ, শ্লথ গতিতে সরকারি চাকরিতে তাদের অংশগ্রহণ বাড়লেও জনসংখ্যার অনুপাতে অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতে অন্তত ৫০ বছর লাগবে। ২০১৯-এর হিসেব বলছে, কলকাতা পুরসভায় ২১ হাজারেরও বেশি কর্মীর মধ্যে মুসলমান ৫.২ শতাংশ। কলকাতা পুলিশে প্রায় ২৬ হাজার কর্মীর মধ্যে ১১.১৪ শতাংশ। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি বিভাগের উচ্চপদে তাঁদের উপস্থিতি আণুবীক্ষণিক।
স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তিতে দেশের মুসলমানের সামাজির আবস্থার দিকে একবার ফিরে দেখা দরকার। গরুর মাংস রাখার দায়ে পিটিয়ে হত্যা, বন্দে মাতরম না বলায় প্রকাশ্যে উঠবোস করানো বা মারধর, বুলডোজার চালিয়ে বাড়ি বা মসজিদের একাংশ গুঁড়িয়ে দেওয়া চলছেই— এভাবেই ভারতে আজ মুসলমানকে তার নাগরিক অধিকারগুলো থেকে দূরে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদীরা। বিলকিস বানোর গণ-ধর্ষক এবং শিশু হত্যাকারীদের গুজরাট সরকার জেল থেকে খালাস করে মানা পরিয়ে বরণ করে তাদের স্বাধীনতার অমৃৎ-স্বাদ দেওয়ার জন্য। এর চেয়ে খারাপ দিন কি এসেছিল এ দেশে? বিভাজনের বিষ ছড়িয়ে সংখ্যালঘুদের সংবিধান স্বীকৃত অধিকার কেড়ে নেওয়ার কাজ সরকার ও প্রশাসনের সক্রিয়তা ছাড়া সম্ভব নয়। হচ্ছেও তাই।