প্রয়াত কোচ অমল দত্ত বরাবর সওয়াল করে এসেছিলেন খেলার মাঠে পেশাদারিত্বের সপক্ষে। পেশাদারিত্বের সঙ্গে বাণিজ্যিকিকরণের নিবিড় যোগাযোগের কথা বলেছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। কিন্তু বাণিজ্যিকিকরণ যখন শুধুই বিনোদনমূলক হয়ে ওঠে তখন খেলাটার অস্তিত্ত্বই সংকটময় হয়ে পড়ে। যেটা বর্তমানে হয়ে চলেছে ভারতীয় ফুটবলের ক্ষেত্রে। ইন্ডিয়ান সুপার লীগের কর্পোরেট চরিত্র ভারতীয় ফুটবলের উপকারে কতটা লাগছে সেই প্রশ্ন করার সময় এসে গেছে।
২০১৪ সালে থেকে শুরু হয়েছে ফ্র্যাঞ্চাইজি কায়দায় এই কর্পোরেট লীগ। রিলায়েন্স পরিবার এই আইএসএলের দন্ডমুন্ডের অধিকারী। ফুটবলকে ব্যবসায়িক পণ্য বানানো শুরু হয়েছে সেই থেকেই। জাতীয় ফুটবল লীগ যখন আই-লীগে পরিণত হয় ২০০৭ সালে তখনই ভারতীয় ঘরোয়া ফুটবল আধা-পেশাদারিত্ব থেকে পেশাদারিত্বের আঙিনাতে প্রবেশ করেছিল। সেই পেশাদার ফুটবল লীগকে সমৃদ্ধ না করে ২০১৪ সালে থেকে নিয়ে আসা হল কর্পোরেট লীগ। সেই লীগ যখন মহাসমারোহে যাত্রা শুরু করেও ভারতীয় ফুটবল প্রেমীদের কাছে হোঁচট খেতে শুরু করল তখন তাকে আবার উজ্জীবিত করে সেই লীগকেই ভারতের ঘরোয়া ফুটবলের প্রধান ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় পরিণত করতে মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গলের মত দুটো বড় নামকে জুড়ে দেওয়া হল এই আইএসএলের সাথে। কর্পোরেট কিন্তু দুই শতাব্দীপ্রাচীন ক্লাবের চরিত্রও পরিবর্তন করে দিল। এটলেটিকো দি কলকাতার সঙ্গে জুড়ে গিয়ে মোহনবাগান হল এটিকে মোহনবাগান আর স্পনশর নামের আগে বসে ইস্টবেঙ্গল হল এসসি ইস্টবেঙ্গল। ১৯৯০-এর দশকের শেষদিকে বিজয় মাল্যের ইউনাইটেড ব্রিউয়ারিস গ্রুপ যখন একসাথে এই দুই ক্লাবের স্পনশরশিপের দায়িত্ব নিয়েছিল তখনও যে পরিস্থিতি তৈরি হয়নি এখন যেন চিত্রটা সেদিকেই এগোচ্ছে। সবুজ মেরুন আর লাল হলুদের লড়াই নিয়ে এত নিরুত্তাপ-নিস্তেজ পরিস্থিতি এর আগে কখনও দেখা গিয়েছে কিনা সন্দেহ। আসলে সমর্থকরা ব্যক্তিগত মালিকানার চাপে ক্লাব সম্বন্ধে নিজেদের অধিকার বিষয়েই সন্দিহান হয়ে পড়েছেন যে।
উৎসব পারেখের উদ্ধত কথাবার্তা আর হরিমোহন বাঙুরের শ্রীসিমেন্ট গ্রুপের দাম্ভিক আচরণ বস্তুত চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এই দুই ক্লাবের কর্মকর্তারা বস্তুত কাঠের পুতুলে পরিণত হচ্ছেন। আর হবেন নাই বা কেন? মুখে যে যাই বলুক সিংহভাগ আর্থিক শেয়ার যাদের দখলে তারা তো কর্তৃত্ব ফলাবেই। সেটাই তো স্বাভাবিক। যার দরুণ শেষ হয়ে যেতে বসেছে বাংলার ফুটবল সংস্কৃতির এক নিরবচ্ছিন্ন অংশ। কিন্তু ব্যবসায়িক লাভটাই যেখানে শেষ কথা সেখানে সাংস্কৃতিক ক্রীড়া বিষয়ক ভাবনার জায়গা কোথায়। সর্বভারতীয় ফুটবল নিয়ামক সংস্থার অবিমৃশ্যকারিতা এবং বিভিন্ন ক্লাবগুলির আভ্যন্তরীণ সংকীর্ণ রাজনীতি আজ ভারতীয় ফুটবলকে এই জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে যে যেখানে ফুটবল পুরোপুরি বাণিজ্যিক বিনোদনমূলক পণ্য বিশেষে পরিণত হয়েছে।
আইএসএল শুরু হওয়ার পর থেকে কি ভারতীয় ফুটবলে বিশাল কিছু উন্নতি হয়েছে। উত্তর নঞর্থক। ভারত এখনও নিজের পাখির চোখ করে রেখেছে সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ আর সাফ কাপকেই। দীর্ঘসময় ধরে এই চলে আসছে। এশিয় মানে ভারতীয় ফুটবল যথেষ্ট তলার দিকে। তাহলে আইএসএল কি দিল ভারতীয় ফুটবলকে? ঝাঁ চকচকে বিপণন। দারুণ সব জার্সি, ঝকঝকে স্টাইলিশ বিদেশী ফুটবলার, বিদেশী কোচ যাদের অধিকাংশই শ্বেতাঙ্গ, মাঠে গ্ল্যামারের ছড়াছড়ি এবং মারাত্মক টেলিভিশন কভারেজ এবং সেইসঙ্গে আন্তর্জাতিক ধারাভাষ্যকারদের আবির্ভাব। অর্থাৎ ঘরে বসে টেলিভিশনের সামনে বা রাস্তায় মেট্রো বা ট্যাক্সিতে বসে মোবাইলে আইএসএলের খেলায় চোখ রাখলে এক অদ্ভুত ভ্রমের সৃষ্টি হওয়া যে আমরা বোধহয় ইউরোপীয় কোনও লীগ প্রত্যক্ষ করছি। এই ভ্রম সৃষ্টিটাই আইএসএল পরিচালকদের প্রধান উদ্দেশ্য এবং এখানেই তাদের সাফল্য। সমগ্র ভারতীয় ফুটবলটাকেই একটা মরীচিকার মোড়কে ঢেকে দেওয়া। যেটা দেখে আমাদের মনে হবে ভারতীয় ফুটবল নিদারুণ উন্নতির পথে টগবগ করে ছুটে চলেছে। কিন্তু প্রদীপের তলার অন্ধকার ভারতীয় ফুটবল সমর্থকদের চোখ এড়িয়ে যাবে। সেটা প্রকট হয় আই-লীগের দিকে তাকালে যেটাকে ইচ্ছে করে ভারতীয় ফুটবলের দ্বিতীয় সারির প্রতিযোগিতায় পরিণত করা হয়েছে যাতে আসল সত্যিটাকে কর্পোরেট লীগের বাণিজ্যিক মোড়ক দিয়ে ঢেকে রাখা যায়। এখানেই শেষ নয়, ভারতীয় ফুটবলের আসল মান যাতে খুব একটা প্রকট হয়ে না পড়ে সেইজন্য ফেডারেশন কাপের মত স্বল্প দৈর্ঘ্যের মূলত নক-আউট প্রতিযোগিতাকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তার আসল ফল কিন্তু উপলব্ধি হচ্ছে আন্তর্জাতিক স্তরে। ভারতের পুরুষ দল এখন ফিফা র্যাঙ্কিং-এ ১০৪ নম্বরে রয়েছে, এই তথ্যটাই এটা প্রমাণ করতে যথেষ্ঠ। ২০২৬ সালের ফিফা বিশ্বকাপে যখন প্রস্তাবিতভাবে মূলপর্বে ৪৮টি দেশ অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবে তখনও ভারতের ফুটবল বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জনের খুব একটা উজ্জ্বল সম্ভাবনা কিন্তু চোখে পড়ছে না। সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েই আমাদের কলার উঁচিয়ে উল্লম্ফন কিন্তু দেখার মত।
পেশাদারিত্ব নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। ভারতীয় ফুটবলারদের আর্থিক উন্নতি বিষয়েও দ্বিমত পোষণ করার প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু ভারতীয় ফুটবলের মানোন্নয়নের প্রচেষ্টা কই। জুনিয়র এবং বয়স ভিত্তিক ফুটবল স্তরে ভারতীয় খেলোয়াড়রা যে প্রতিভা এবং পারফরম্যান্স দেখায় সিনিয়র স্তরে গিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তা হারিয়ে যায় কেন? ভারতীয় ফুটবলের সাপ্লাই লাইনকেই যে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন ঐতিহ্যশালী ঘরোয়া ফুটবল প্রতিযোগিতাগুলি যেগুলি প্রতিভা উঠে আসার নিদারুণ মঞ্চ ছিল সেগুলো হয় বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে নয়ত গুরুত্বহীন শো পিসে পরিণত হচ্ছে। আর এগুলি সব বলিপ্রদত্ত হচ্ছে আইএসএলের যূপকাষ্ঠতে। অথচ ফ্রাঞ্চাইজি মালিকরা ভারতীয় ফুটবল মান নিয়ে আদৌ ভাবিত নন। বিদেশী খেলোয়াড়দের জোরে ট্রফি জয় করতে আর নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থকে চরিতার্থ করতেই তারা অধিক আগ্রহী। তাদের সঙ্গে তাল দিয়ে চলেছে সর্বভারতীয় ফুটবল নিয়ামক সংস্থা। ফলে ভারতীয় ফুটবল ক্রমেই ব্যবসায়িক স্বার্থের মাকড়সার জালে আরও বেশী করে জড়িয়ে পড়ছে। এটিকে মোহনবাগান এবং এসসি ইস্টবেঙ্গলের বর্তমান অবস্থা এবং মোহন-ইস্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতার এই অদ্ভুত পরিবেশ অবশ্যই কিন্তু একটা অশনি সঙ্কেত। আইএসএল শুধুই বাণিজ্যিক লাভজনক এক বিনোদন যেখানে ফুটবল শুধুই এক পণ্য এবং যে পণ্য আর্থিকভাবে ভীষণ দামী এবং ঝকঝকে হলেও ভারতীয় ফুটবল সংস্কৃতির এক অন্তঃসারশূন্যতা সৃষ্টি করছে যা আদতেই ভারতের ফুটবল ভবিষ্যতের পক্ষে মারাত্মক প্রভাব বয়ে আনতে পারে। অবিলম্বে আইএসএলের এই বাণিজ্যিকরণের ফলাফলের যৌক্তিকতাকে যদি কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন করে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে এর চুলচেরা বিশ্লেষণ না করা হয় তাহলে সময় উত্তীর্ণ হয়ে গেলে কিন্তু হাজার অনুশোচনা করেও কোনও ফললাভ হবে না।