ঘরে আগুন লেগেছে। কে ঘুমোচ্ছে আর কে-ই বা জেগে আছে? কে আন্দোলন করছে, কেমন আন্দোলন? হুতোম ভারত ভ্রমণে বেরিয়ে যা দেখলেন
সম্পাদকের গোঁসা হয়েচে। বল্লে চাদ্দিকে এত রঙ্গ হচ্চে আর হুতোম নকশা লিকে উঠতে পারচেন না? বসে বসে স্যালারি নেবেন কেবল?
বলি কাকে কী বলচিস সে খেয়াল আচে রে আঁটকুড়ির ব্যাটা? পাল্লে জ্যান্ত সাংবাদিকগুলিকে বিনে পয়সায় খাটিয়ে নিস, আমার মতন জাত ভূতকে স্যালারি দ্যাকাচ্চিস?
বলতেই সম্পাদকের পা মাটিতে পল্ল। এক হাত জিভ কেটে বল্লে, কিছু মনে করবেন না। দিনের মধ্যে দশবার একে তাকে বলতে বলতে অভ্যেস হয়ে গেছে আর কী। খেয়ালই ছিল না আপনি হলেন আপনি। কিন্তু একটু কাইন্ডলি কনসিডার করে দেখুন, লেখার মত কিছুই নেই? কাগজের পাতা ভরাতে যে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছি।
সে কী হে! এত যে আন্দোলন কচ্ছে লোকে! আবার তাদের জব্দ কত্তে পুলিশ দুধের শিশু থেকে মরে ভূত অবধি যাকে দেখচে তাকেই গারদে ভরচে, মারচে ধরচে, দু একটিকে যে বিলকুল নিকেশ করে দিচ্চে না এম্নি নয়। আর তুমি কিনা ছাপার খবর দেখতে পাচ্চো না!
আরে ওসব বেশি ছাপলে কাগজটা তুলে দেবে যে। ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করি, বুঝলেন কিনা? আচ্ছা আমার কথা নয় না-ই ধরলেন, আমার কাগজে যে কয়েকশো এমপ্লয়ি রয়েছে তাদের দিকটা তো ভাবতে হবে। প্রফিটে হাত পড়লেই মালিক ছাঁটাই করতে বলবে না? তখন?
সে নয় বুঝলেম। কিন্তু তোমার ইয়াব্বড় বিজ্ঞাপনগুলো গেল কোথায়? সেই যে সব আধ ন্যাংটা মেয়েমানুষের ছবিওলা বিজ্ঞাপন, নিত্যি নূতন মোটরগাড়ীর বিজ্ঞাপন, গগনে সুইমিং পুলওলা ফ্ল্যাটের বিজ্ঞাপন? সেই যেগুলি আদ্ধেক পাতা জুড়ে ছাপলে পঞ্চাশ লাখ আর গোটা পাতায় ছাপলে কোটি খানেক পকেটস্থ হয় বলেচিলে?
সম্পাদক মুখ ব্যাদান করে বল্লে, সেদিন আর আছে হুতোমবাবু? লোকে বাড়ীও কিনছে না, গাড়ীও কিনছে না। বড় দুর্দিন।
জানতেম সবই, তবে সম্পাদকের মুখ থেকে সত্য কথা শোনার আমোদটি পেতে চাইছিলেম। হতচ্ছাড়া দিন রাত্তির কেবল মিছে কথা বলে আর মিছে কথা লেকে। এক আমার সামনেই অন্য সুর। বালক বয়সে বোধ করি মা জননী পই পই করে বলে দিয়েচিলেন ভূতের কাচে মিছে কথা বল্লে ঘাড় মটকে দেয়।
সে যা হোক, নকশা লেকার মতন রঙ্গ যে মেলাই হচ্চে তাতে সন্দ নেই। অ্যাতো হচ্চে যে কোনটে বাদে কোনটে লিখি ঠিক কত্তে মিছামিছি অনেকগুলি দিন গেল। ইতোমধ্যে কদিন দেশ ভ্রমণে গেলেম। জীবদ্দশায় অ্যাতখানি দেশের কতটুকুন আর দ্যাকা হয়েচে? কাশ্মীর দিয়েই শুরু কল্লেম।
সে এক আজব দেশ। দেকি পথে কুকুর বেড়াল নেই, লোকের চে মিলিটারি বেশি। যারা বেরিয়েচে তারাও সোজা হেঁটে চলেচে, কারো হাতে মোবাইল নেই। ডাল লেকের ধারে এক কাশ্মীরি ভূতের সাথে আলাপ হল। হতভাগা জনমনিষ্যি নেই এমনি একখানা শিকারায় বসে রবাব বাজাচ্চিল। ভেবেচে ওর জ্যান্ত গিন্নীটি শুনতে পেয়ে পিরীতে আকুল হয়ে ছুটে আসবে। মানুষে মানুষের কান্নাই শুনতে পায় না, এ আবার আশা কচ্ছে ভূতের কান্না শুনতে পাবে। মরণ! তবে ছোকরা বাজায় ভালো। বসে খানিক শুনলেম। পরে দেকি শিকারাগুলি সবই ভূতে ভরে আচে। সাপে কাটা ছানার ভূত, বিয়োবার কালে ডাক্তার না পাওয়া মায়ের ভূত, রোজ খাবার ওষুধ কয়েক মাস না খেয়ে মরা বুড়োর ভূত, গোঁফ না ওঠা নিরুদ্দেশ ছেলের ভূত, বেইজ্জত মেয়ের ভূত --- আর কত বলব? বাজানো শেষ হলে তাদের শুধোলেম সকলে মিলে একানে বসে মতলবটা কী? বল্লে, অপেক্ষা কচ্ছি। কিসের? না সময়ের। সময় হলে কী করবে? সেটি তারা খোলসা কল্লে না। কেবল মিটিমিটি হাসলে। সে হাসি দেখে ভূত হয়েও কেমন গা ছমছম কচ্ছিল। তাই হুতোম বিদায় নিলেন।
কাশ্মীর থেকে আসাম গিয়ে মনে হল বুঝি ভিন দেশে হাজির হলেম। কোথাও পুলিশে ঘর ভাঙচে, কোথাও জনতা গাড়ী ভাঙচে। একদিন দেকি তাদের মুখ্যমন্ত্রী নিজের বাড়ী হতে সদর দরজা দিয়ে বেরোতে পাচ্ছেন না, ছাদের পিছন দিয়ে পালাবার উপক্রম কচ্ছেন। তেনার কানে কানে গিয়ে বল্লেম, গোয়ালপাড়ার ক্যাম্পে চলে যা। উঁচু দেয়াল আচে, পাবলিক ঢুকতে পারবে না, নিশ্চিন্দি। কে বলল দেখতে না পেয়ে মন্ত্রীমশাই মুচ্ছো গেলেন, ভক্তবৃন্দ হায় হায় করে উঠলেন। হুতোম উত্তরপ্রদেশমুখো রওনা দিলেন।
অমন দেশ দুটি নেই। অহিংসা বল্লে পুলিশে ধরে, দাঙ্গা কল্লে মালা পরায়, মেয়েমানুষের বেইজ্জতি কল্লে মন্ত্রী বানায়। মুখ্যমন্ত্রী অবিশ্যি সাধু লোক, দোষের মধ্যে মোছলমানদের দেখতে পারেন না আর অল্পে চটে যান। চটে গেলে খেয়াল থাকে না যে তিনি সাধু, ক্ষমা করাই সাধুর ধম্ম। পুলিশ তেনার বেজায় ভক্ত। একটিবার মুখ খুল্লেই মহল্লা কে মহল্লা মেরে ধরে ভেঙে চুরে নূতন করে আসে, কালেজ ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে বেদম পিটে আসে। ভারী ভালো পুলিশ। মেয়ে মরদের তফাত জানে। মা জননীদের সূয্যি ডুবলে আলো নিবিয়ে তবে মারে। আবার ধরুন আপনি রাত জেগে পড়ে পাশ করা ডাক্তার, দেখচেন কচিকাঁচারা লাইন দিয়ে অক্কা পাচ্চে। এই দেখে যদি “সবই রামের ইচ্ছে” বলে পেন্নাম ঠুকে বাড়ী যেয়ে চাট্টি ভাত খেয়ে শুয়ে পড়তে পারেন তবে কোন গোল নেই। কিন্তুক যদি আপনার প্রাণ কেঁদেচে, যদি নিজের পয়সায় অক্সিজেন কিনে মানবসন্তানগুলিকে বাঁচাতে গিয়েচেন তো মরেচেন। ছয় মাস কি এক বচ্ছর নিজের সন্তানের মুখ দেখতে পাবেন না। উপরি যদি মোছলমান হন তো টেররিস্ট বলেও নাম কত্তে পারেন।
তবে কিনা সাধু মুখ্যমন্ত্রী বড় আতান্তরে পড়েচেন এক দল মহিলাকে নিয়ে। তেনারা সেই যে রাজধানীর মাঝখানটিতে বসে পড়েচেন, আর নড়ানো যাচ্চে না। নরম গরম কোন মন্তরই খাটল না। তা সাধুবাবা বল্লেন মেয়েমানুষের কি অত বুদ্ধি হয়? বাইজোভ দামড়া মরদগুলো ষড় করে পাঠিয়েচে। পুলিশ পাঠালেন, ষণ্ডা পাঠালেন, তবু না পুরুষ মিলল, না মা জননীরা নড়লেন। সাধুবাবার দাঁত কিড়মিড় দেখে হাততালি দিতে দিতে হুতোম চল্লেন দিল্লী।
শুনেচিলেম সেথায় যুদ্ধু বেধে গ্যাচে। গিয়ে দেখি যুদ্ধু না ঘোড়াড্ডিম। পুলিশে লাইব্রেরি ঘরে ঢুকে বীরত্ব দ্যাকাচ্চে, এদিকে গাঁটকাটার দল হোস্টেলে ঢুকে মেয়েদের মাথা ফাটালে পুলিশ রামপ্রসাদী গান গেয়ে আকাশের তারা গুনচে। পরে তাদের কত্তা যে খুকিদের মাথা ফেটেচে তাদের নামই গাঁটকাটার দলে লিখচেন। তবে পুলিশ যে এম্নি মন দিয়ে ছবি তুলতে পারে জানতেম না। এক ইতর আসল বন্দুক নিয়ে রাস্তার উপর বেমালুম খেলা কল্লে, পুলিশ দাঁড়িয়ে চমৎকার ছবি তুল্লে।
এ সওয়ায় দেখলেম দিল্লীর বুড়ি ছুঁড়িরাও পথের মাঝে বসে পড়েচেন, তেনাদের সরাতে অমন দশ মণ বহরের মন্ত্রীমশাই অবধি ঘেমে চান। ওদিকে গুপুস করে ভোটের তোপ পড়ে গেল। সকলে বল্লে প্রধানমন্ত্রীর দল নাকি কিচুতেই জিতবেন না, দিল্লীর মাফলারওলা মুখ্যমন্ত্রী জলের দরে জল বেচে আর বিদ্যুৎ বেচে সক্কলকে কিনে ফেলেচেন। নাকি রংচঙে ইশকুল বানিয়ে ফুলের মতন শিশুদেরও হাত করেচেন।
তা পি এম এসব আদিখ্যেতা সহ্য করার বান্দা নন। তেনারা পাঁচো ইয়ার বলতে লাগলেন ওসব কিচু নয়, আসল কথা মাফলারওলা হল টেররিস্ট। তারই মদতে সব টেররিস্ট মিলে পথ আটকে বসে আচে। গুলিখোর মিনিস্টারে শহর ভরে গেল, যে চত্বরে মা জননীরা বসে আচেন সেকানে নানা ছদ্মবেশে নানা অসুরের আনাগোনা হল। ঠিক যেম্নি বালগোপালকে বধ কত্তে গোকুলে তেনারা ফিরে ফিরে যেতেন। তবে কংসের অসুরের মতন সরকারের অসুরেরাও সুবিধে কত্তে পাল্লেন না। মাফলারের জয় হল, পি এম এইচ এম সকলের ব্লাড প্রেশার নিয়ে ছিনিমিনি খেলে শাহীনবাগ শাহীনবাগেই রইলেন। বাবুরা সুপ্রিম কোর্টে নালিশ জানিয়েও আরাম পেলেন না, বিচারকেরা বল্লেন কাজটা ভাল হচ্চে না, তবে কিনা...।
অ্যাতো রঙ্গ দেখে শখ মিটেচে বলে আপনাদের হুতোম ঘরের ছেলে ঘরে ফিরলেন। আন্দোলন এদিকেও বিস্তর। তবে এগুলি কেরালার মতন নয়। হেথায় সকলের হাঁড়ি আলাদা। যে আন্দোলন কচ্ছে সে-ই বলচে আমারটিই সেরা, যেন গো অ্যাজ ইউ লাইকে নেমেচে। তবে কিনা দিদির উপরে কেউ নন। ভারতমাতা কি জয়, বাংলাদিদি কি জয়। অন্য সব মুভমেন্টই যে বানের জলে ভেসে এসেচে সন্দ নেই। মুভমেন্ট আবার জমিয়ে হচ্চে মোছলমান পাড়ায়, হিঁদু পাড়ায় গাচের পাতাটিও নাড়াতে দেকচি না কাউকে। এক বিদ্রোহীকে শরীর ধারণ করে শুধোলেম, বাছা, যে হিঁদুরা নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্চে তাদের জাগাবে কে? ভূতে? হতভাগা দাড়ি চুলকে বল্লে, কোন চিন্তা করবেন না দাদা। টাইম মত সব ঠিক করে দেব। কাশ্মীরের ভূতেদের মতন এরাও সময়ের অপেক্ষায় আছে!
সময় কবে আসবে জানি নে। হুতোমের এন পি আরের ভয় নেই, এন আর সি তে ঘন্টা, সি এ এ হুতোমের ডানাটিও ছুঁতে পারে না। কারণ হুতোম মনিষ্যি নন। বাবু বিবিরা, আপনাদের কিন্তুক সে সুবিধে নেই। ঘরে আগুন লেগেচে, পাশ ফিরে শোবেন না যেন। উঠে পড়ুন এই বেলা।