পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

লালবাতি পাড়ার লকডাউন

  • 22 April, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1604 view(s)
  • লিখেছেন : জাহানারা সরকার
খদ্দেরবিহীন বন্ধ ঘরগুলোয় অলস ভাতঘুমের আবহ। তবু শাম্তি নেই। স্বপ্নে চেনা খদ্দেরদের মুখগুলোও ভাসছে। নির্জন খাটের স্বপ্নে আর একটা অবয়বের সান্নিধ্য। লকডাউনে খদ্দের আসা বন্ধ হওয়ার আগে অনেক যৌনকর্মীই খদ্দেরদের কাজের আগে নিয়ম করে সাবানে হাত ধোয়ানো বা হাতে স্যানিটাইজার লেপার দায়িত্ব পালন করছিলেন। কেমন আছেন যৌনকর্মীরা?


অনেক বছর আগে কালীঘাটে চম্পার মায়ের ঘরে এক থালা ভাত খেয়েছিলাম। ঘুপচি ঘর, গরিব মানুষ তা বলে মানুষমাত্রেই কোনওমতে নমো-নমো করে খায় ভাবলে ভুল হবে। ওলভাতে, থোড়, কাচকি মাছ, আরও কী একটা ছোট মাছ...সব পদ এখন খুঁটিয়ে মনে নেই তত। তবে বড় আনন্দ পেয়েছিলাম। ওঁদের তো কাজের লোক নেই। কখন এত রান্নার সময় পায় কে জানে! চম্পাদের দেশের বাড়ি কলকাতা থেকে খানিক দূরের এক জেলায়। সেখানে চম্পার মা টাকা পাঠান। সে-টাকা কাজেও লাগে। তবে চম্পার মা সে-বাড়িতে একদমই স্বাগত নন। চাইলেও পারতপক্ষে যেতে পারেন না। মনে হচ্ছিল, একটা ভরন্ত সংসার নিকোন উঠোন একটা আ-স্ত মফসসল উঠে এসেছে সেই ভাতপাতে।
করোনা দুর্বিপাকে যৌনপল্লির মেয়েদের রেশনের লাইনে বা সরকারি-বেসরকারি ত্রাণের আশায় ভোগান্তির নানা কিসসা শুনে কালীঘাটের সেই দুপুর মনে পড়ছে। আমি জানি, নানা অভাব-লাঞ্ছনা-অপ্রান্তিতেও ওঁরা অনেকেই সচরাচর এক পদে খেতে পারেন না। যৌনপল্লির ঘুপচি ঘরের দুপুরগুলো চারপাশের জঞ্জাল, ঘোলাটে আদিগঙ্গাকে নিয়েও আশ্চর্য ভাতের গন্ধে ভরপুর। উঠোনে হয়তো কেউ মটর ডালের বড়ি দিয়েছেন, কিংবা নোনা ইলিশ শুকোচ্ছেন। হাসতে হাসতে বলেন, শীতকালে যখন কেউ ইলিশ পাবে না, আচ্ছা সে খাব তখন। ফোড়নের ঝাঁঝ, চুড়ির টুংটাং, তেলের ছ্যাঁকছ্যাঁক আর পায়েপায়ে নেওটা বেড়ালের মিউমিউ মিলিয়ে একটা আশ্চর্য জগত। কখনও হয়তো কোনও বাবু মাংসের টাকা দিয়েছেন। সবাই মিলে গোটা বাড়ি জুড়ে সে-দিন উতসব। এখনও ঠিক বিশ্বাস হয় না এই লকডাউন ওই প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর জগতকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার এক বন্ধু এই দুর্যোগে সোনাগাছি-কালীঘাটের কিছু বাচ্চাকে খেলনা দিতে চেয়েছিলেন। ওদের জন্য তো আর অনলাইন ক্লাস নেই। টোটো করে পাড়া বেড়ানো সব বন্ধ। বাচ্চারা রাজি হয়নি। একটু তেলমুড়ি বাদাম চেয়েছে আর বিস্কুট। বাচ্চারা অত ঘোরপ্যাঁচ বোঝে না। খারাপ লাগলে সোজাসাপ্টা বলে দেয়। রেশনের একঘেঁয়ে চালডালে ওইটুকু বাচ্চাদের মুখ মেরে গিয়েছে। মোবাইলে একঘেঁয়ে কার্টুন দেখতেও ওরা ক্লান্ত। সোনাগাছি, কালীঘাটের খুদেরা এখন আঁকার খাতা ভরিয়ে তুলছে রঙে-রঙে।
যৌনপল্লির বিকেলসন্ধেও অদ্ভূত ভাবে পাল্টে গিয়েছে এই করোনা-যুদ্ধের লকডাউনে। রাতের চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ ধরে এখনও মাঝেমধ্যে গাড়িতে বাড়ি ফিরতে হয়। তখন গলির মুখের জনহীন চেহারা দেখে কেমন সুররিয়াল লাগে। বিকেলে এখন সাজগোজের তাড়া নেই। ঘরোয়া নাইটিতে প্রসাধনহীন মুখগুলো ঠিক লাইনবাড়ির মনে হয় না ভদ্রলোকসুলভ চোখে। গলির ভেতরের গুচ্ছের ফেরিওয়ালারাই বা কোথায় গেল। নীলমণি মিত্রের ভেতরের কোন গলিতে কাকে দিয়ে একদিন আলুর চপ ভাজিয়েছিল এক ঝাঁক মেয়ে। ওদের তো বরাবরই ওয়র্ক ফ্রম হোম। প্রায় ২৪ ঘণ্টার ডিউটি। এখন বিকেল মানে ছুটির আমেজ। তেলেভাজা হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় বাড়ির চৌকাঠে রোয়াকে বসেছিল মেয়েগুলো। মিথ্যে বলব না, ছুটির আনন্দে করোনা এড়াতে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিংয়ের হাবিজাবি তখন ওদের মাথায় ছিল না।
উত্তর কলকাতায় সোনাগাছির ঘরগুলোর কথাও মনে পড়ার বিশেষ কারণ রয়েছে এই করোনা-আতঙ্কে। বেশির ভাগের ঘরেই বালতি-ভরা জল আর ঝাঁঝরি দেওয়া নর্দমা। কাজ শেষে গা-হাত ধুয়ে নেওয়া দস্তুর। কলকাত্তাওয়ালির কৃপা, সোনাগাছিতে ততটা জলের অভাব নেই। আবহমান কাল ধরে যৌনপল্লির ব্যস্ততম ভাগ্যবতী মেয়েদের জন্য তাই চালু শব্দবন্ধ, ওর তো হাতের জল শুকোয় না। করোনার স্বাস্থ্যবিধি যে ভাবে সংক্রমণ এড়াতে সবাইকে জনে-জনে হাত ধুতে বলছে তাতে যৌনপল্লির সাবেক পরিভাষা এখন ঠাট্টার মতো শোনায়। যৌনপল্লির এই অবসরযাপন জুড়ে নানা আতঙ্ক, ভবিষ্যত ঘিরে আশঙ্কা রয়েছে। সেই দুশ্চিন্তার ভাঁজগুলোকে ওঁরা এখনও যুথবদ্ধতার আমেজেই ঢেকে রেখেছেন।
ঘরছাড়া শ্রমিকদের দুরবস্থার কিসসা এতদিনে খবরের কাগজে উঠে আসছে প্রবল ভাবে। যৌনপল্লিদের মেয়েদের দূর্দশাও কিছু আলাদা নয়। নেপাল থেকে মুর্শিদাবাদ গ্রামের বাড়িতে বুড়ো বাপমা কিংবা সন্তানদের সঙ্গে ভিডিয়োকলে কথা বলছেন কলকাতার গলিতে বন্দি মা। কলকাতার যৌনকর্মীদের একটা বড় অংশই ফ্লাইং। কেউ কেউ ভাড়ার ঘরে দিনেদুপুরে ডিউটি করেও লাস্ট লোকালে ফিরে যান। অনেকেরই বাড়ির লোক জানে না, আসল পেশা। হয়তো বলা আছে, কোনও নার্সিংহোমের আয়া কিংবা বিউটি পার্লারের কর্মী। আচমকা লকডাউনের ধাক্কায় তাঁদের কেউ কেউ সব্জি বা দুধের গাড়িতে করে ফিরে গেলেও অনেকেই ফিরতে পারেননি। কিংবা অনেকেরই মাসান্তে রুটিন ঘরে ফেরাও সম্ভব হয়নি লকডাউনে। বাড়ির লোক কী খেয়ে আছে, সেটাও ভাবতে হচ্ছে এই দুরবস্থায়।
আর সব মিলিয়ে নিজেদের পেশা নিয়েও থাকছে দুশ্চিন্তা। মানুষগুলো তো সোশ্যাল ডিসট্যান্সিংয়ের ঢের আগেই ডিসট্যান্ট। রাতের ভ্রমর হয়ে নিশিপদ্মের মধু খেতে যাওয়া আবহমান কাল থেকে চলেছে, কিন্তু মানুষগুলোকে আমরা বরাবর দূরেই ঠেলে রেখেছি। সেই দুরত্ব কি করোনা-ছায়ায় এ বার অলঙ্ঘ্য হয়ে উঠবে? ভবিষ্যতে কী করে পেট চলবে তাও ভাবতে হচ্ছে যৌনকর্মীদের। আবার ছোঁয়াচে রোগের খপ্পরে পড়ার ভয়টাও কাজ করছে। এডসকে তো কন্ডোম দিয়েই ঠেকিয়ে রাখা যায়! এ ক্ষেত্রে কী হবে!
খদ্দেরবিহীন বন্ধ ঘরগুলোয় অলস ভাতঘুমের আবহ। তবু শাম্তি নেই। স্বপ্নে চেনা খদ্দেরদের মুখগুলোও ভাসছে। নির্জন খাটের স্বপ্নে আর একটা অবয়বের সান্নিধ্য। লকডাউনে খদ্দের আসা বন্ধ হওয়ার আগে অনেক যৌনকর্মীই খদ্দেরদের কাজের আগে নিয়ম করে সাবানে হাত ধোয়ানো বা হাতে স্যানিটাইজার লেপার দায়িত্ব পালন করছিলেন। কাজে ফেরার ফ্যান্টাসিতে এখন অনেকেরই চেতনায় পুরুষসংসর্গ বলতে ডেটলজল আর স্যানিটাইজ়ারের ঘ্রাণই ভেসে আসছে।

0 Comments

Post Comment