আমাদের দেশে লকডাউনের শুরুতে প্রতিদিন দিনভর শোনানো হচ্ছিল করোনা অতিমারি রোখার মূল মন্ত্র—লকডাউন লকডাউন লক ডাউন। রাজা যত কহেন, পারিষদগণ কহেন তার শত গুণ। অথচ এখন এই আনলকের সময়ে কিনা সরকারি বাচালতাকে তুড়ি মেরে করোনা সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। না জানি কোভিড টেস্টের বাইরে অতিমারির চেহারা কতটা ভয়াবহ। এদিকে সংবাদ মাধ্যমের খবরাখবর আর সরকারি হাঁকডাকে জনমন প্যানডেমিক ছাড়িয়ে প্যানিকে ব্যতিব্যস্ত।
চার মাস পরেও করোনা পরিস্থিতি বে-লাগাম কেন, এটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন। প্রশ্ন তো আরও। মানুষ কতদিন লকডাউনের বোঝা বইবে? দেশ আর কত ক্ষয়ক্ষতি মানবে? নিম্নবর্গের মানুষজনের এই ধকল সহ্য করার ক্ষমতাটুকুও যে আর অবশিষ্ট নেই।
৩০ জানুয়ারি হু ( বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ) বিশ্বে করোনা পরিস্থিতিকে গ্লোবাল ইমার্জেন্সি ঘোষণা করেছিল। ১০ মার্চ হু করোনা সংক্রমণকে প্যানডেমিক ঘোষণা করে। তখন চিন করোনা সঙ্কট অনেকটা সামলে নিয়েছিল বটে। কিন্তু ইতালি ও স্পেনের অবস্থা করুণ। প্রতিদিন সংক্রমণ ও মৃত্যু লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ব্রিটেন ও আমেরিকায় সংক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। ভারতেও কয়েক জায়গায় সংক্রমণ দেখা গেছে। অথচ আমাদের দেশে কেন্দ্র সরকারের তখনও কোনো হেলদোল নেই। এ নিয়ে বিরোধী দলগুলির প্রশ্নের মুখে ১৩ মার্চ সরকার বিবৃতি দিয়ে জানাল, করোনা ভারতে হেল্থ ইমার্জেন্সি নয়।
ফেব্রুয়ারি-মার্চ দু’মাসে পরিকল্পনা করার অনেক সুযোগ ছিল কেন্দ্র সরকারের সামনে। ফেব্রুয়ারি মাসেই সরকারি পদে আসীন (আইসিএমআর, এইমস প্রভৃতি) এপিডেমিওলজিস্ট ও ভাইরোলজিস্টরা আমাদের দেশে বড় রকমের সংক্রমণের বিপদ সম্পর্কে কেন্দ্র সরকারকে সতর্ক করেছিলেন। তখন থেকেই তারা ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলে আসছিলেন। বিভিন্ন দেশে বিপর্যয়ের ছবিটা তখন স্পষ্ট। কিন্তু সেদিকে মন দেওয়ার থেকে সরকারের কাছে জরুরি ছিল ‘নমস্তে ট্রাম্প’ নিয়ে আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা দেখানো। অবশেষে ১৮ মার্চ সরকার কোভিড টাস্ক ফোর্স গঠন করল। তারপর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো ২৫ মার্চ মধ্যরাত্রি থেকে দেশবাসীর ওপর লকডাউন চাপিয়ে দেওয়া হ’ল।
করোনা ভাইরাস এদেশে সম্পূর্ণভাবে বিদেশ থেকে বাহিত হয়ে আসা। সেসময় যারা বিদেশ থেকে ফিরছিলেন, তাদের আইসোলেশন করা হ’লে সংক্রমণের প্রার্দুভাব হ’ত না। মার্চ মাসে দেশে সংবাদ-মাধ্যমে ও মানুষের মধ্যে করোনা অতিমারি নিয়ে পুরোদমে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মানুষের উদ্বেগ যত বেড়েছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কেন্দ্র সরকার পোষিত রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় সংগঠনগুলো করোনা রোখার নামে কুসংস্কার ও গোঁড়ামির মোচ্ছব চালিয়েছে। লকডাউনের সময় থালি-তালি-কাঁসর বাজানো, দিয়া জ্বালানোর ফতোয়া দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। এমনকি দেশে করোনা ছড়ানোর মিথ্যে বদনামে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়েছে সংঘবাহিনী। এদিকে দিন-গুজরানের সমস্যায় অনেক মানুষ অনেক সময় লকডাউন উপেক্ষা করে বাইরে পা বাড়াতে বাধ্য হয়েছে। ভিন রাজ্যে থাকা শ্রমিকদের প্রতি সরকারের অবহেলা ও পীড়ন নামিয়ে আনার ফলে হাজারে হাজারে তারা পথে নামতে বাধ্য হয়েছে।
দেশ জুড়ে লকডাউনে সায় ছিল না বিজ্ঞানীদের। তাঁরা বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন এলাকাভিত্তিক স্ব-কোয়ারেন্টাইন ও স্ব-পর্যবেক্ষণে, যার মূল কথা মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও উদ্যোগ সৃষ্টি। একথা তাঁরা ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই বলে আসছিলেন। এই বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ কেন্দ্রীয় টাস্ক ফোর্সেও যুক্ত । কিন্তু তাঁদের কথায় গুরুত্ব দেওয়া তো হয়ইনি, উপরন্তু লকডাউনকে তুঘলকি ও জবরদস্তিমূলক ব্যাপার করে তোলা হয়েছে। তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতি বেশ কিছু দেশে করোনা অতিমারির রূপ নেয়নি। দেশগুলিতে কোথাও সীমিত লকডাউন করা হয়েছে, কোথাও লকডাউন করা হয়নি। ওইসব দেশে সরকার বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞদের মতামতে আস্থা রেখেছিল। আগাম সতর্কতা অবলম্বন করেছিল।
কেন্দ্র সরকারের কৃতকর্মের পরিণামে তার লকডাউনের ঘোষিত উদ্দেশ্য—করোনা-যুদ্ধে জয়ী হওয়া, তা কার্যত ব্যর্থ। কিন্তু অন্যত্র সম্পূর্ণ সফল। সরকার কয়লা, রেল, বিমা, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে দেশের সম্পদ যথেচ্ছভাবে কর্পোরেট মালিকদের কাছে বিকিয়ে দিচ্ছে। অর্ডিন্যান্স এনে এপিএমসি অ্যাক্ট ও এসেনশিয়াল কমোডিটি অ্যাক্ট বাতিল করা হ’ল, যা কৃষক স্বার্থের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ব্যাঙ্ক জালিয়াত ফেরার পুঁজিপতিদের হাজার হাজার কোটি টাকার খেলাপি দেনা মকুব করে দিল। স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এসব করা ছিল দু:সাধ্য। সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের লাখ লাখ শ্রমিকের জীবনে কর্ম-জগতের অনিশ্চয়তা নেমে এসেছে। এরপর তারা সস্তা শ্রমের বাজারে ভিড় জমাতে বাধ্য হবে। এনআরসি- সিএএ বিরোধী ও ভীমা কোরেগাঁও দলিত আন্দোলনের আগুন-ঝরানো-দিনগুলিতে সামনে দাঁড়ানোর সাহস হ’ল না; লকডাউনকে ঢাল করে আন্দোলনের সামনের সারির কর্মীদের ইউএপিএ, এনএসএ-তে জামিন অযোগ্য ধারায় গারদে ঢোকালো। লকডাউনে সরকারি কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করায় ৫৫ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হ’ল।
অতিমারি সঙ্কটকালে প্রতিবাদের সোজা রাস্তা বন্ধ। বিরোধী দলগুলি সব রকম রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতাকে মান্যতা দিচ্ছে। আর কেন্দ্র সরকার সেটাকে দেশ ও দশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেওয়া, মানুষের অধিকারকে দমিত করার সুযোগ হিসাবে কাজে লাগাতে উঠেপড়ে লেগেছে। এটা অগণতান্ত্রিক। এটা রাজনৈতিক পাকচক্র।
ঘটনা-পরম্পরা থেকে এই প্রত্যয়ই জাগে যে, আসলে লকডাউনকে কেন্দ্র সরকার রাষ্ট্রীয় অপকর্মগুলো করার ঢাল বানাতেই চেয়েছিল। সেজন্যই বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞদের সতর্ক-বার্তায় কান না দেওয়া। তাই পূর্বাপর যত ছল-চাতুরি। করোনার বিপদ সামলানো সেখানে লোক দেখানো ব্যাপার।