দেবানুর মহাদেবা রচিত পুস্তিকা ‘আরএসএস: তার গভীরতা ও ব্যাপ্তি’ কর্নাটকে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। কর্নাটকে হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলোর আগ্ৰাসন এখন তার শিখরে পৌঁছেছে। হিজাব, আজান, পাঠ্যপুস্তকে পাঠ্যক্রমের পরিবর্তন, ইত্যাদি ইস্যুগুলোকে ধরে তারা আক্রমণাত্মক মুসলিম-বিরোধী প্রচার লাগাতার চালিয়ে আসছে।
রাজ্যের বিজেপি সরকার একটা অর্ডিন্যান্স জারি করেছে — ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা সুরক্ষা আইন ২০২২’। অধ্যাদেশের নামটা যে অর্থ ব্যক্ত করে, এর নিহিত উদ্দেশ্য ঠিক তার বিপরীত — অধ্যাদেশে ধর্মান্তরণকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে, এবং বিশেষভাবে নিশানা বানানো হয়েছে হিন্দু নারীর ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম পুরুষকে বিবাহ করার ঘটনাকে।
১৯৭০’র দশকে জনপ্রিয় দলিত লেখকদের যে প্রজন্ম আত্মপ্রকাশ করে, দেবানুর মহাদেবা তার অন্যতম। তিনি দলিত সংঘর্ষ সমিতিরও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। সাহিত্য ক্ষেত্রে এবং রাজনৈতিক সক্রিয়তায় তিনি বিপুল অবদান রেখেছেন। তিনি পদ্মশ্রী পুরস্কারের মত মার্যাদাও পেয়েছেন। তিনি কর্নাটকের বিবেক স্বরূপ। এই পরিপ্রেক্ষিত এবং দৃষ্টিকোণ থেকেই আলোচ্য পুস্তিকাটির বিচার করতে হবে।
পুস্তিকাটি মাত্র ৬৪ পৃষ্ঠার যেটিকে হাতে নিয়ে গড়গড় করে পড়ে ফেলা যায়। দেবানুর মহাদেবা জানিয়েছেন, এই পুস্তিকাটি রচনার উদ্দেশ্য হল আরএসএস’এর প্রকৃত চরিত্রকে উন্মোচিত করা এবং সাধারণ জনগণকে আলোকিত করা। আরএসএস’এর চরিত্রের কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্যকে ধরেই তিনি এটা করতে চেয়েছেন। আলোচনার জন্য তিনি মূলত ভিডিসাভারকার, গুরুজি গোলওয়ালকার ও হেডগেওয়ার’এর লেখাগুলিকেই বেছে নিয়েছেন। গোলওয়ালকারের মতে ‘মনুস্মৃতিকে’ই ভারতের সংবিধান হতে হবে, যদিও এই অভিমতটির প্রথম প্রস্তাবনা সাভারকারেরই। গোলওয়ালকার বলেছেন, ‘মনুস্মৃতি’র বিপরীতে আম্বেদকার রচিত সংবিধান বিশ্বের সংবিধানগুলো থেকে চয়ন করা, আর ‘মনুস্মৃতি’ হল ব্রাহ্মণ্যবাদী ধারণায় জাতি ও লিঙ্গের স্তরতন্ত্রের আইনি শাস্ত্র। এক পতাকা, এক নেতা, এক মতাদর্শের ধারণাই হল আরএসএস’এর অনুপ্রেরণার উৎস। গুরুজি গোলওয়ালকারের ধারণায় নাজি জার্মানি হল ‘জাতিগত অস্মিতার’ সর্বোচ্চ রূপ। আর তাই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিলীন হয়ে যেতে হবে সংখ্যাগুরুদের সঙ্গে, আর তাদের দয়াতেই বাঁচতে হবে।
দেবানুর মহাদেবা জানাচ্ছেন, গোলওলাকারের লেখা ‘দ্য বাঞ্চ অব থটস’ গ্ৰন্থে তিনটে ভয়ানক ধারণা আছে।
(ক) ঋগবেদের পুরষাসুক্তা, ঈশ্বরের দেহধারণ এবং ভগবৎ গীতার প্রচার।
(খ) ‘চতুরবর্ণ’কে (জাতি প্রথার স্তরবিন্যাস) মেনে চলা এবং আম্বেদকার রচিত সংবিধানের প্রত্যাখ্যান।
(গ) আর্য শ্রেষ্ঠত্বের মহিমা প্রতিষ্ঠা।
দেবানুর মহাদেবা টিপু সুলতান শাসন সম্বন্ধে মিথ্যাচার ছড়ানো এবং হিন্দু-বিরোধী রাজা রূপে তাঁর বিরুদ্ধে প্রচারের প্রসঙ্গেরও অবতারণা করেছেন। লেখক বলছেন, বিজেপি-আরএসএস গৃহযুদ্ধ সৃষ্টি করতে চায়। আরএসএস তার শত-শত প্রকাশ্য সংগঠনের মধ্যে দিয়ে সারা দেশেই বিস্তার লাভ করেছে। আরএসএস তার ক্যাডারদের মানুষ হিসেবে নয়, বরং আজ্ঞাবহ রোবোট রূপে প্রশিক্ষিত করে।
বিজেপি-আরএসএস কেন্দ্রে এবং অনেক রাজ্যেই রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করছে। তারা ১৯৭৭ সালে চুপিসারে জনতা পার্টির মধ্যে ঢুকে পড়ে আরএসএস’এর সদস্যপদ পরিত্যাগের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। এরপর তারা দেশের সর্বপ্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। তারা পাকিস্তানকে স্থায়ী শত্রু হিসাবে তুলে ধরে এবং দেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতে থাকে। এই কাজের মধ্যে দিয়ে তারা দেশের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে, যে দেশ অর্থাৎ, ভারত ছিল বহুত্ববাদী সংস্কৃতির মিলন ক্ষেত্র।
বিজেপি-আরএসএস সরকার ‘মনুস্মৃতি’র বাস্তবায়নের জন্য কূটকৌশল চালিয়ে যাচ্ছে। ওরা দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সম্পূর্ণ বিরোধী। জিএসটি এই যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এক বড় আঘাত। হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের বিস্তারের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাতেও পরিবর্তন সাধন করা হচ্ছে। এক ভাষা, এক মহিমময় ধর্ম এবং এক নেতা — এই অভিপ্রায়ের বাস্তবায়নের পরিকল্পনা হল আরএসএস’এর গোপন এজেন্ডা। যে সাভারকার ব্রিটিশ সরকারের কাছে মার্জনা ভিক্ষার চিঠি লিখেছিলেন, তাঁর মহিমা কীর্তন করা হচ্ছে, গডসেকেও গৌরবময় করে তোলা হচ্ছে।
আগামী নির্বাচনে বিজেপিকে পরাস্ত করার কৌশলও দেবানুর মহাদেবা সামনে এনেছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোর অধিক দায়িত্বকে স্মরণ করানো হয়েছে। ‘চতুরবর্ণ’ রূপায়ণের প্রচেষ্টায় আরএসএস’এর মিথ্যামোহ সৃষ্টির উন্মোচনের উপরও তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। বিজেপি-বিরোধী শক্তিগুলোকে বিনত হওয়ার এবং আত্মগরিমা ত্যাগের পরামর্শও তিনি দিয়েছেন। এই লক্ষ্যে পৌঁছনোর বহু পথই রয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় বিজেপি-বিরোধী সমস্ত শক্তিকে নিয়ে একটা জোট বা যুক্তমোর্চা গড়ে তুলতে হবে। সকলকেই এটা মনে রাখতে হবে যে, “ঘৃণা তার স্রষ্টাকেই ধ্বংস করে”।
তাঁর এই লেখায় দেবানুর মহাদেবা উপদেশ দেওয়ার পথে যাননি; বিপরীতে, তিনি সরল ভাষায় তাঁর ভাবনাকে বিধৃত করেছেন যাতে সবাই বুঝতে পারে তিনি কি বলতে চাইছেন। তিনি নিজেই একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হওয়ায় জনগণের কাছে তাঁর চিন্তাভাবনার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। আর এটাই আলোড়ন ওঠার কারণ।