পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

গন্ধ বিচার

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 201 view(s)
  • লিখেছেন : সোমা চ্যাটার্জী
টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের বাইরে মৈনাকের ঘটনা প্রমাণ করে যে শুধু ভাষা দিয়ে নয়, সংস্কৃতি বা চেহারাকেও এই বিভাজনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হবে, অতএব এটি একটি ত্রিমুখী আক্রমণ, যাতে সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাঙালীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় !

‘ভাষা’(পড়ুন বাংলা ভাষা)  বিচারের পর ‘গন্ধ বিচার, এ এক অদ্ভুত সংকটময় পরিস্থিতির সম্মুখীন আমরা, মানে বাঙালীরা। উগ্র জাতীয়তাবাদের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের চারিদিকে আর তার রেশ ধীরে ধীরে  ভিন রাজ্য  ছাড়িয়ে ঢুকে পড়ছে আমাদের রাজ্যে, এমনকি খোদ শহর কলকাতায়। কিছুদিন আগে মৈনাক দত্ত নামে আতর বিক্রয়কারী এক যুবককে টালিগঞ্জ মেট্রোর সামনে হেনস্থা হতে হল, তার অপরাধ সে বাঙালি, তায় আতর বিক্রেতা। অতএব দুয়ে দুয়ে চার করতে সময় লাগল না অভিযোগকারীদের, কারন মৈনাক বাংলায় কথা বলছিল তাই সে বাংলাদেশী এবং আতর বিক্রি করছে, অতএব সে মুসলমান। গত কয়েক দশক ধরে মৈনাক ও তার বন্ধুরা “সোঁদা' নামে এই আতরের ব্যবসা চালিয়ে আসছে, এই একই মেট্রো স্টেশনে, বৈষম্যমূলক আচরণ এর আগে তো কখনও ঘটেনি ! হঠাৎই কি এমন হল ? 

এই অপমানের মূলে কি ? একটু লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে এটি কেবল ধর্মীয় বা জাতিগত নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও সামাজিক একটি সমস্যা।  বিভেদের রাজনীতি 'বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ’এর নাম দিয়ে যেভাবে মগজ ধোলাই করে চলেছে, আজকের বাঙালি সমাজ স্বভাবতই তাতে অনেকটাই প্রভাবিত, ভারতের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিসরে ‘বাংলাদেশি’ শব্দটি কেবল ভৌগোলিক নিশানা বা পার্থক্যয় নয় বরং একটি গালি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মৈনাকের ঘটনা প্রমাণ করে যে শুধু ভাষা দিয়ে নয়, সংস্কৃতি বা চেহারাকেও এই বিভাজনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হবে, অতএব এটি একটি ত্রিমুখী আক্রমণ, যাতে সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাঙালীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় !

প্রশ্ন আসতে পারে আতর বিক্রি করা নিয়ে কেন এই আপত্তি, অভিযোগ? আসলে আতর এখানে এক সাংস্কৃতিক প্রতীক, যেহেতু ভারত এবং অন্য দেশেও এক বৃহৎ জনগোষ্ঠী এই আতর বানানোর শিল্পের সাথে সংযুক্ত, এটিকে  অনায়াসেই মুসলিম সংস্কৃতির সঙ্গে জুড়ে  দেওয়া যায়, এবং পশ্চিমবঙ্গে  আতর বিক্রি মানেই বাংলাদেশি মুসলিমের ব্যবসা।

কিন্তু আতরের ইতিহাস কী বলে? আতর শব্দটির উৎপত্তি ফার্সি শব্দ ‘ইত্তর’ থেকে,  যার অর্থ সুগন্ধ। একটি প্রাকৃতিক সুগন্ধি যা প্রাচীন মিশরীয়, গ্রীক এবং রোমানরা মধ্যপ্রাচ্যে ব্যবহার করত এর চিকিৎসাগত উপকারিতা এবং সুগন্ধের জন্য। ভারতীয় উপমহাদেশে ষোড়শ থেকে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত মুঘলরা সুগন্ধির জন্য  সুগন্ধি শিল্পকে মূল্য দিতেন এবং আতর তৈরির জন্য অভিজ্ঞ কারিগরদের নিয়োগ করতেন। এটি আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানেও ব্যবহার করা হত। ভারতে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ই ৫,০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আতর আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায়  ব্যবহার করে আসছে। পৃথিবীর সব দেশে আজও আতর ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এটি অ্যারোমাথেরাপি, মেকআপ এবং সুগন্ধিতে ব্যবহৃত হয়। ঐতিহ্যগতভাবে, আতর তৈরিতে, ফুল, ভেষজ এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক ব্যবহার করা হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে পশ্চিমি বিশ্বে জৈবপণ্যের প্রতি ভোক্তাদের আগ্রহ বৃদ্ধি হওয়ায় আতর আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে কারণ এটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক এবং  পাতন প্রক্রিয়ায় তৈরি। ভারতে আতর তৈরির ইতিহাস মুঘল আমল থেকেই দেশের রীতিনীতি এবং সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে আতর উৎপাদনের রীতির কারণে ভারত আজ বিশ্বের শীর্ষ আতর উৎপাদনকারী দেশগুলির মধ্যে একটি। ভারতের উত্তরপ্রদেশের কনৌজে  অতি প্রাচীনকাল থেকেই উৎপাদিত উচ্চমানের আতরের  অত্যন্ত চাহিদা ছিল এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চল এবং অন্যান্য দেশে রপ্তানি করা হত।
আজও উত্তরপ্রদেশের কানপুর থেকে কনৌজ হাজার হাজার লোক এই আতর তৈরির শিল্পের ও পেশার সাথে যুক্ত, তাদের মধ্যে মুসলিমদের পাশাপাশি হিন্দুদের সংখ্যা ও নেহাত কম নয়। কিন্ত বিগত এক দশকে ধর্মীয় একপেশেমির জন্য আতর উৎপাদনের সাথে যারাই যুক্ত তাদের মুসলিম বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে,  এবং সমাজে ও সেই বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে, যার ফলে এই পেশার মানুষ নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন মনে করছেন।  
২০১৬ সালের এপ্রিলে, উত্তরপ্রদেশে  তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব  বৃহত্তর আন্তর্জাতিক বাজারে পরিচিতির জন্য আতর শিল্পকে প্রসারিত করার  জন্য একটি 'আতর পার্ক' প্রকল্পের প্রস্তাবনা করেন, কিন্তু ২০১৭ সালের মার্চ মাস থেকে ক্ষমতায় থাকা যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের আগ্রহের অভাবে প্রকল্পটি আজও বাস্তবায়িত করা যায়নি। এমনকি প্রকল্পের বাজেট মূল পরিকল্পনার আনুমানিক ২৫৭ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে বর্তমানে ১০০ কোটি টাকা করা হয়েছে বলে জানা গেছে, পার্কের বরাদ্দকৃত জমিও ১০০ একর থেকে কমিয়ে অর্ধেকেরও কম করা হয়েছে এর ফলে, কনৌজের আতর ব্যবসায়ীমহলে যথেষ্ট হতাশার সৃষ্টি হয়েছে এবং কনৌজের আতর শিল্পও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ।
ভারতের সমাজ-রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদের প্রভাব নতুন নয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর আক্রমণাত্মক প্রকাশ আরও বেড়েছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) বা জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (NRC)— এসআইআর (SIR) প্রভৃতি ইস্যুতে মুসলমানরা সবচেয়ে বেশি কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। তাঁদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে, দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ করা হয়েছে। যেসব মানুষকে  হিন্দুত্ববাদী বিভেদকামীরা তাদের প্রতিপক্ষ মনে করে, তাদের ওপরই এই লেবেল চাপিয়ে দেওয়া হয়।  তাঁদের দেশবিরোধী, পাকিস্তানপন্থী বা বাংলাদেশি বলে অপমান করা হচ্ছে, একসময় এর নিশানায় শুধু মুসলমানরাই ছিল  কিন্তু এখন তাদের লক্ষ্য হিন্দু বাংলাভাষী মানুষও।
মৈনাকের  ঘটনা আমাদের  এক  ভয়ঙ্কর প্রশ্নের  সামনে দাঁড় করায়, আজকের ভারতে কি কেবল ধর্ম নয়, ভাষার পরিচয়ও হয়ে উঠছে আক্রমণের কারণ? বাঙালি মানেই কি বাংলাদেশি বলে গালি খাওয়া?  মাত্র মাসখানেক আগেই নয়ডাতে জাতীয়স্তরের স্কেটিং খেলোয়াড়কে বাঙালী হবার জন্য  চূড়ান্ত অপমান করা হয়েছে,  তাদের থাকতে দেওয়ার অনুমতি দেয়নি হোটেল কর্তৃপক্ষ, গুরুগ্রামে নিত্যদিন বাঙালী হেনস্থা হচ্ছে,  পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশাপাশি বাংলাভাষীদের উপর প্রতিদিন নজরদারি চলছে,  হচ্ছে অবাধ ধরপাকড়,  কোনরকম আইনি অভিযোগ ছাড়াই। বলাই বাহুল্য যে এর বীজ নিহিত আছে,  হিন্দু,  হিন্দি ও হিন্দুস্থান এই লক্ষ্যে... এক ভাষা,  এক ধর্ম, ও একরাষ্ট্র।
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে ইতিমধ্যেই শোনা যাচ্ছে এমন বহু কাহিনি, যেখানে সাধারণ মানুষকে সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে কেবল তাদের ভাষা বা সংস্কৃতির কারণে। গত সপ্তাহেই বাঁকুড়ায় শুধুমাত্র  জয় শ্রীরাম বলতে না চাওয়ার  অপরাধে রক্তাক্ত করে দেওয়া হয়েছে একজন মুসলিম যুবককে। খবরের কাগজের পাতায় চোখ রাখলে এরকম উদাহরণ রোজই দেখা যাছে, বোঝাই যাছে শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে অসহিষ্ণুতার কালো মেঘ।
প্রাক ও উত্তর স্বাধীনতা যুগেও ভারতবর্ষের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল বিবিধের মধ্যেই ঐক্য, আমাদের জাতীয় সংগীতের মূল প্রতিপাদ্যই তাই, এবং এই বৈচিত্র্যের মধ্যে একতা বহন করার পথে দিশারী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,  ছিলেন নজরুল।  বঙ্কিম থেকে শরৎচন্দ্র, সবাই মিলে নির্মাণ করেছেন এক বহুত্ববাদী ঐতিহ্য। বাংলার ইতিহাসই হলো সহাবস্থানের ইতিহাস। কিন্তু আজ উগ্র জাতীয়তাবাদের নামে মানুষকে ভাঙা হচ্ছে ‘আমরা’ আর ‘ওরা’তে। যেখানে “ওরা’ বলতে বোঝানো হচ্ছে বাংলাদেশি, অনুপ্রবেশকারী, বহিরাগত।  মৈনাকের অপমান শুধুই তার নয়, সম্পূর্ণ একটি জাতিকে ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করার নিরিখে বিপর্যস্ত, অবমাননা এবং ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টা এবং দুঃখজনক বর্ষীয়ান মানুষ , আবেগপ্রবন বাঙালী ও তাতে গা ভাসাচ্ছে, স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হছে বিভেদের রেখা ,কোনও যুক্তি, বুদ্ধি বা বিবেচনা ছাড়াই। 
আজ অণূপূর্ণা রায়ের মত বাঙালি ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা চিত্রপরিচালকের পুরস্কার জিতে বাঙালি তথা সমস্ত দেশের সম্মানকে বিশ্বের মানচিত্রে প্রতিষ্ঠা করেছে, মফস্বলের মেয়ে হয়েও সম্পুর্ণ নিজের কৃতিত্বে ও মানসিক জোরেই ছিনিয়ে এনেছেন  বিশ্বজয়ের খেতাব। সেখানেই নিজেদের দেশে, বা রাজ্যে বাঙালি বাঙ্গালীর কাছে এ হেন অপমানের আর লাঞ্ছনার শিকার হছে তাও শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্ররোচনায়, এটা ভাবতেই আত্মগ্লানি হয়, তাই  এই প্রতিহিংসা, ঘৃণার যোগ্য জবাব আমাদেরই দিতে হবে, মানবতার বার্তার মাধ্যমে, ভালবাসার সুগন্ধ ছড়িয়ে !

0 Comments

Post Comment