গাছ থেকে পাখির মলত্যাগ হোক বা বিস্ময়ে অবাক হয়ে আকাশ থেকে পড়াই হোক, সবই তো পড়া। এই পড়া আদি অনন্তকাল ধরে চলেছে। কিন্তু সেটা তেমন ভাবে কখনো ভাবায়নি। ভেবেছি এমনি এমনি পড়ে, ওটা তো সততই পড়ে। পড়বে না তো কি উপরে উঠবে! কিন্তু ১৭ শতকে ১৬৮৭ সালে স্যার আইজ্যাক নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র ভৌত জগত সম্পর্কে আমাদের ধারণায় বিপ্লব সংঘটিত করে। মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের সরলতা ও সর্বজনীনতা আজও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের অনুপ্রেরণা। যখনই বিজ্ঞানী মাটিতে পড়ার বৈজ্ঞানিক সূত্র দিলেন, অভিকর্ষ শোনালেন, মাধ্যাকর্ষণ জানলাম, তারপর থেকে বুঝি কত যে পড়ার জন্ম হলো, যেগুলো আগে কখনো হিসেবেই ছিল না। অভিকর্ষের গেরোতেই বৃষ্টি পড়ে, ধস নামে, আকাশ থেকে শিল পড়ে, ইটপাটকেল পরে, আসমান থেকে বাজ পড়ে। এমনকি প্রেমে পড়া, বিপদে পড়া, গায়ে পড়া, কিছু না জানার ভান করে আকাশ থেকে পড়া, সেও হল পড়া। এভাবেই পতনের বহুমুখী সম্ভাবনা, এই বুড়ো বয়সেও নতুন করে জানছি। বেশ মনে আছে প্রেমে পড়ার ইংরেজি fall in love শুনে বিরক্ত হয়েছিলাম। প্রেমেরও ভর আছে! যেন আপেল মাটিতে পড়া। ভর আছে বৈকি, তাইতো মা ঠাকুমারা বলতো "অমুকে মাইয়া মানুষের ভরে পড়সে।"
ঝোঁকে পড়া, সব্বাই করে বলে সব্বাই করি তাই। আমি তো এমনি এমনি খাই, সেও তো পড়া।
অভিকর্ষ নিয়ে এই কচকচানি নিতান্তই উদ্দেশ্যহীন নয়। আমাদের একটি সেবামূলক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠানে ডাক্তারের অভাব দূর করার জন্য, অভিজ্ঞ এবং দক্ষ নার্সদের নিয়ে, সাড়ে চার বছরের একটি ডাক্তারি কোর্স পড়ানোর ব্যবস্থা হয়েছিল। এমবিবিএস সিলেবাস কে একটু সরলীকরণ করা হলো। নামিদামি ডাক্তাররা এদের পড়াতে আসতেন। একদিকে হাতে-কলমে শিক্ষা, অন্যদিকে থিওরি জ্ঞান। অল্পদিনে এরা খুব দক্ষ হয়ে উঠেছিল। এদের নাম দেওয়া হয়েছিল ডক্টরস' অ্যাসিস্ট্যান্ট। এরা চিকিৎসা বিজ্ঞানটাকে খুব সহজ সরল ভাবে ব্যাখ্যা করে বুঝতো ও বোঝাতো। আমি সাধারণভাবে শারীরিক কোন সমস্যা নিয়ে এদের কাছেই যেতাম। ঘটনা হলো আমার লোয়ার abdomen সমস্যা। ডক্টরস' দিদিভাই বললো, চতুষ্পদদের এই সমস্যা অনেক কম। তাদের অ্যাবডোমেনের অর্গানগুলি হরাইজেন্টালি, মানে আনুভূমিক ভাবে বিন্যস্ত। কিন্তু মানুষ দ্বিপদ, সেইখানেই যত বিপদ। যেই সামনের দুটি পা মুক্ত করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখনই তার এবডোমেনের বেশ কিছু অর্গান অভিকর্ষের নিয়ম মেনে নিচের দিকে নেমে এসেছে। ফলে লোয়ার এবডোমেনের বহু সংখ্যক অর্গান একই জায়গায় কাছাকাছি চলে এসে জটিলতা সৃষ্টি করেছে। আর মহিলাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরও বেশি। তাদের জননাঙ্গ এই জটিলতাকে জটিলতম করেছে। দিদি ভাইয়ের সামনে বসেই অবাক হয়েছি, এখানেও অভিকর্ষের নিয়ম।
প্রশ্ন তো পিছু ছাড়ে না জিজ্ঞাসা করলাম তাহলে অভিকর্ষের নিয়মে শরীরে রক্ত সঞ্চালন তো এমনিই হতে পারত তার জন্য হার্টকে পাম্প করতে হবে কেন? উত্তরে জানালো, এটা তিন-চারটে ভাগ আছে। প্রথমত, হার্ট থেকে মস্তিষ্কে রক্ত পৌঁছানো অভিকর্ষের বিরুদ্ধে। অতএব পাম্প করে গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে দোতালায় জল তুলতে হয়, সেই রকম। দ্বিতীয়ত, নিচের দিকে রক্ত নামানো অভিকর্ষের নিয়মের ওপর ছেড়ে দিলে, প্রধান প্রধান সড়কে রক্ত সহজেই পৌঁছে যাবে। কিন্তু অলিগলি এবং দূরবর্তী হাতের আঙুলের মাথা, পায়ের আঙুল, সেখানে পৌঁছতে গেলে ঠেলে জোর করে পাঠাতে হবে। তা না হলে প্রধান প্রধান অঞ্চলেই বন্টন হবে, অনেকেই বঞ্চিত থেকে যাবে। দেখবে হাতের আঙ্গুল পায়ের আঙুল কত সহজেই কেমন অবশ হয়ে যায়। তৃতীয়ত, হার্ট পাম্প করে বলে রক্তের ডিস্ট্রিবিউশন সমানভাবে হয়। আমি বললাম তার মানে পায়ে রক্ত সঞ্চালন অভিকর্ষের নিয়ম মেনে স্বাভাবিকভাবে হয় না। ওখানে অভিকর্ষের নিয়ম প্রযোজ্য নয়।
তা কেন হবে? প্রযোজ্য তো নিশ্চয়ই। অভিকর্ষের নিয়মের উপর ছেড়ে দিলে, রক্ত নিচে নামতো ঠিকই, কিন্তু সুষম বন্টন হতো না। অভিকর্ষের এই নিয়মটা অনেক বেশি কার্যকর, পায়ের ভেনের ক্ষেত্রে। পায়ের থেকে দূষিত রক্ত ভেন দিয়ে ফের হার্টে ফিরে আসবে কিভাবে? অভিকর্ষের বিপরীতে যাওয়া তো সম্ভব নয়। এই ক্ষেত্রে পায়ের কাফ মাসল পাম্প এর কাজ করে। সে পা থেকে রক্ত উপরে পাঠায় ভেনের মাধ্যমে। এই পাঠানোর কাজটা ব্যাহত হয়, যদি কাফ মাসল কাজ না করে। যারা দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে কাজ করেন, যেমন ট্রাফিক পুলিশ, শিক্ষক, দোকানের কাউন্টারে দাঁড়ানো সেলস বয়, এদের কাফ মাসল ঠিক ভাবে কাজ করে না। সাঁতার, সাইকেল প্যাডেলিং, হাঁটা, এগুলোর মাধ্যমে কাফ মাসল সক্রিয় থাকে।
সেই জন্যই কি কারো কারো পায়ে ভেনগুলো মোটা দড়ির মতো হয়ে ফুলে যায়? যেন গিঁট পাকানো। চামড়ার নিচে স্পষ্ট ভেসে ওঠে। যেটা ভেরিকোজ ভেন বলে?
ঠিকই বলেছো। তবে মনে রাখতে হবে বয়স্ক মানুষের মাংস পেশী শিথিল হলে ভেন আর্টারি গুলো সারফেসে স্পষ্ট হয়। সঙ্গে আরেকটু জুড়বো যে, এই দূষিত রক্ত উঠে আসাটা কাফ মাসলের কারণে নিশ্চিত ব্যাহত হয়। তাও যদিবা কিছু রক্ত উঠে এলো, কুঁচকির কাছে একটা গ্ল্যান্ড ভাল্বের মত কাজ করে। যাতে রক্তটা নিচে নেমে না যায়। সেটা যদি কাজ না করে, তাহলে দূষিত রক্ত নিচে ফিরে যায়, জমা হয়। এর ফলেই ভেনগুলো ফুলে ওঠে, গিঁট পাকিয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে ভেনের গভীরে রক্ত জমাট বাঁধে, ডিপ ভেন থ্রম্বোসিস (ডিভিটি)। ভেনের মধ্যে ব্লকেজ হয় হার্টের মতোই। এখানেও সেক্ষেত্রে একটি বিকল্প বাইপাস পথ তৈরি করতে হয়, সার্জারি করে। দূষিত রক্ত টা যাতে নিচের দিকে নেমে না আসে তার জন্য গোড়ালি থেকে কুঁচকি পর্যন্ত টাইট মোজা পরতে বলা হয়। বসলে বা শুলে পা দুটো উঁচুতে রাখতে বলা হয়।
তার মানে অভিকর্ষের নিয়ম অনুসারেই পা একটু উঁচুতে রেখে বসতে শুতে বলা হয়। যাতে রক্ত পায়ের দিক থেকে হার্টের দিকে নেমে আসতে পারে। আচ্ছা, তাহলে কি মস্তিষ্কে ঠিক মতো রক্ত সঞ্চালন না হলে, মাথা ঘুরলে বা সাডেন ব্ল্যাক আউট হলে এই জন্যই শুয়ে থাকতে বলা হয়, কারন আনুভূমিক থাকলে রক্ত সঞ্চালন সহজ হবে?
হ্যাঁ, সেটাতো ঠিকই। তবে অভিকর্ষের নিয়মেই বলতে পারি দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থা, মানে বেশি উঁচু থেকে পতন। আর বসে বা শুয়ে থাকা অবস্থায় পতন, অনেক কম বিপদজনক। কম ক্ষতির সম্ভাবনা। এখানেও সেই গাছ থেকে আপেল পড়ার গল্প। গাছের নিচের ডালের পাকা আপেলটা নিচে মাটিতে পড়লে যদিও বা খাবার মতো থাকে, মগডালের পাকা আপেলটা মাটিতে পড়লে খাওয়া তো দূর স্থান, হাতে তুলেও কেউ দেখে না।
ফিজিক্যাল সায়েন্স এভাবে সরাসরি বায়োলজিক্যাল সায়েন্সে প্রয়োগ হয়? দারুন ব্যাপার। দিদিভাই বললো, বাইরে থেকে বল প্রয়োগ না হলে স্থির বস্তু চিরকাল স্থির থাকবে। এটাই নিয়ম। ধরো এরোপ্লেনে উঠে বসে আছো। সবকিছু ঠিকঠাক আছে। যেই প্লেন টেক অফ করলো তোমার শরীর গতিশীল হলো, স্থান পরিবর্তন করলো। কিন্তু তোমার শরীরের রক্ত, সে স্থিতিশীল থাকতে চাইছে। ফলে শরীরের উপরিভাগের রক্ত দ্রুত নিচে পায়ের দিকে নেমে আসে। মুহূর্তের জন্য মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যায়। সেকেন্ডের জন্য অজ্ঞান হতে পারে। এক্ষেত্রে শরীরের নিম্ন ভাগে টাইট পোশাক পরিধান করা হয়। যাতে রক্ত নিচের দিকে নেমে যেতে না পারে। শোনো নি, শোয়া অবস্থা থেকে হঠাৎ কলিং বেল শুনে উঠে দাঁড়ালে অনেকের মাথা ঘুরে যায়, অজ্ঞান হয়ে যায়। এখানেও সেই স্থিতি জাড্য সক্রিয়।
ফিজিক্যাল সায়েন্সের অনেক সূত্র বায়োলজিক্যাল সায়েন্সে প্রয়োগ করা যায়। পাখি আকাশে ওড়ে। উড়তে হবে অভিকর্ষের নিয়মের বিপরীতে। অতএব ভর কমাতে হবে। দেখবে পাখির হাড়গুলো কতো সরু সরু। পালকের কাঠি গুলো কতো হালকা, কিন্তু মজবুত ও ফাঁপা। আমি বললাম, হ্যাঁ ঘুড়ির কাগজ, কাঠি সবই যেমন হালকা হয়। দিদিভাই বললো, পাখি সারাক্ষণ খাচ্ছে, কিন্তু বেশি পরিমাণে নয়, অল্প অল্প খুঁটে খুঁটে। পাকস্থলী ভারি হলে চলবে না। সারাক্ষণ মলত্যাগ ও একইসাথে মূত্র ত্যাগ করে। এগুলো শরীরে জমা হলেই ভর বৃদ্ধি পাবে। কখনো প্রশ্ন আসেনি মনে? জিরাফের হার্ট থেকে মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন হয় কিভাবে? অতো উঁচুতে। জিরাফ তাদের লম্বা ঘাড় এবং পায়ে রক্ত সঞ্চালন পরিচালনা করার জন্য অসাধারণ অভিযোজন উদ্ভাবন করেছে। তাদের রক্তনালীগুলি পুরু প্রাচীরযুক্ত এবং পেশীবহুল, এবং তাদের পায়ের ত্বক এতটাই টানটান যে এটি বিশাল কম্প্রেশন মোজার মতো কাজ করে, মাধ্যাকর্ষণের বিপরীতে লড়াই করতে এবং হৃৎপিণ্ডে রক্ত ফেরাতে সহায়তা করে।
সত্যিই সব শুনে আমি বিস্মিত। আরও আশ্চর্যের কথা জিরাফ নাকি প্রতি কয়েক দিনে মাত্র একবার জল পান করে, এমনকি জল সহজলভ্য হলেও।এমনকি অনেক জিরাফ নিয়মিত জলপান করে না।
পান করার সময় মাথা অনেক নিচু করা খুবই অসুবিধা জনক। সামনের পা দুটো হাঁটু ভেঙে বসে এতে রক্তচাপের আকস্মিক পরিবর্তন থেকে জিরাফের মস্তিষ্ককে রক্ষা করার জন্য, এর গলার কাছে শিরাগুলিতে স্থিতিস্থাপক দেয়াল এবং বড় একমুখী ভালভ রয়েছে। এটা শিরাগুলিকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রসারিত করতে দেয় এবং জিরাফের মাথা নিচু করার সময় মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহিত হতে বাধা দেয়। জিরাফের হৃৎপিণ্ড, প্রায় ১১ কিলোগ্রাম ওজনের, অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর তুলনায় এটির বাম দিকে অনেক বেশি ঘন পেশী রয়েছে। এর ফলে জিরাফের দীর্ঘ শরীর জুড়ে মাধ্যাকর্ষণ বিরুদ্ধে রক্ত পাম্প করার জন্য হৃদপিণ্ডকে অতিরিক্ত বল তৈরি করতে দেয়।
তার মানে মেকানিক্যাল সাইন্স, ফিজিক্যাল সাইন্স, এর সাথে বায়োলজিক্যাল সাইন্সের ঘনিষ্ঠ নিবিড় সম্পর্ক আছে। লোভ সংবরণ করতে পারছি না, এখন মনে হচ্ছে সোশ্যাল সাইন্সেরও সম্পর্ক আছে। ওই যে বললে না, মগডালের পাকা আপেলটা মাটিতে পড়লে খাওয়া তো দূর স্থান, হাতে তুলেও কেউ দেখে না। ধরো ৭০ বছরের বেশি সময় সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের অস্তিত্ব বা পশ্চিমবাংলায় সুদীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম শাসন এত বেশি পরিপক্ক হয়ে এতটাই শীর্ষ দেশ থেকে মাটিতে পতিত হয়েছে যে, নিকট ভবিষ্যতে কেউ এদের হাতে তুলে নেবে না বলেই মনে হয়। অন্তত নির্বাচনী গতিপ্রকৃতি সে কথাই বলে।
এই সেরেছে, এর মধ্যে আবার রাজনীতির কথা ঢোকাচ্ছ কেন। সরলীকরণ থেকে তরলীকরণের সম্ভাবনা থেকেই যায়। সহজ করে বুঝতে গিয়েই যত সমস্যা।