আবারও অঘটন কাতার বিশ্বকাপে। কাতার বিশ্বকাপ নিঃসন্দেহে অঘটনের বিশ্বকাপ হিসাবে চিহ্নিত হতে চলেছে। কোন দেশ যে কখন কিভাবে অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে তা বুঝে ওঠা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। মাঠের বাইরে বসে তত্ত্ব এবং তথ্য দিয়ে কাতার বিশ্বকাপে প্রেডিকশান করা দুঃসহ হয়ে উঠেছে। আগের দিন তিউনিশিয়ার কাছে পরাজিত হয়েছিল বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স, তাও ফ্রান্সের কোচ দিদিয়ের দেশঁ মূলত তার রিজার্ভ বেঞ্চকে খেলিয়েছিলেন কিন্তু এদিন পূর্ণ শক্তির স্পেনকে হারিয়ে দিল সূর্যোদয়ের দেশ জাপান এবং গ্রুপ-ই থেকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে তারা দ্বিতীয় রাউন্ডে উত্তীর্ণ হল। যে গ্রুপে স্পেন ছাড়াও ছিল জার্মানি এবং কোস্টারিকার মত দেশ। ২০০২-এ দেশের মাটিতে এবং ২০১৮-তে রাশিয়ার মাটিতে যথেষ্ঠ ভাল পারফরম্যান্স ছিল জাপানের কিন্তু তার পরেও এতটা কেউ আশাও করেনি এই এইভাবে জাপান জার্মানি এবং তারপর স্পেনকে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরের রাউন্ডে যাবে। ম্যাচের শুরুতেই ১১ মিনিটে যখন মোরাতার গোলে এগিয়ে যায় স্পেন তখন মনে হচ্ছিল চিরাচরিত পদ্ধতিতে স্পেন জাপানকে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরের রাউন্ডে যাবে। সেই সময় গ্রুপের অন্য খেলায় জার্মানিও এগিয়ে ছিল ১-০ গোলে কোস্টারিকার বিরুদ্ধে। তাই মনে হচ্ছিল স্পেন আর জার্মানি এই দুই মহাশক্তিই এই গ্রুপ থেকে প্রত্যাশা অনুযায়ী কোয়ালিফাই করতে যাচ্ছে। কিন্তু পরবর্তী ঘন্টা দেড়েক সময়ে এই দুই ম্যাচের চড়াই-উতরাই এমনভাবে এগোল যে ঠিক যেন রোমহর্ষক সাসপেন্স থ্রিলার সিনেমা। দ্বিতীয়ার্ধে জাপান যে ফুটবলটা খেলল তা খুব বড় জাপানি সমর্থকও আশা করেছিলেন কি না বলতে পারছি না। দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই আক্রমণে চাপ বাড়িয়ে গোলের জন্য ঝাঁপায় জাপান। খেলার ৪৮ মিনিটে ম্যাচে সমতা ফিরিয়ে আনেন রিতসু দোয়ান আর তারপর ৫১ মিনিটের মাথায় আও তানাকার গোল যা দুই দলের মধ্যে চূড়ান্ত পার্থক্য গড়ে দিল। পরবর্তী সময়েও জাপানই কিন্তু কলার উঁচু করে খেলে গেল। স্পেনকে দেখে কেমন যেন ক্লান্ত গুটিয়ে যাওয়া দল বলে মনে হল। প্রথম ম্যাচে কোস্টারিকার বিরুদ্ধে স্পেন যে ফুটবলটা খেলেছিল ৮১% বলের নিয়ন্ত্রণ রেখে সেটা এদিন বোঝাই গেল না। তবে কোস্টারিকার বিরুদ্ধে ওই ৭ গোলই স্পেনকে নিয়ে গেল পরের রাউন্ডে। কারণ তারা জার্মানিকে পেছনে ফেলল শুধুমাত্র গোল পার্থক্যে। জার্মানি এদিন প্রচন্ড লড়াই করে কোস্টারিকাকে হারালেও তাদের কোনও লাভ হল না। তবে এই খেলা হল প্রচন্ড উত্তেজক। দুই দলই গতি আর শক্তির সম্বন্বয়ে নিজেদের সেরাটা দিয়ে পএর রাউন্ডে যাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু ফুটবল মেধায় দুটি দলই মধ্য মেধার তাই কেউই সফল হতে পারল না। প্রথমার্ধে ১-০ গোলে এগিয়ে থাকার পর দ্বিতীয়ার্ধে অতি-আক্রমণাত্মক হতে গিয়ে হ্যান্সি ফ্লিকের ছেলেরা নিজেদের বিপদ ডেকে আনে। ৫৮ আর ৭০ মিনিটে প্রতি-আক্রমণ থেকে গোল করে ২-১-এ এগিয়ে যায় কোস্টারিকা। তখন অন্য ম্যাচে জাপানও ২-১ গোলে এগিয়ে গেছে আপেনের বিরুদ্ধে। ৭০ মিনিটে কোস্টারিকার গোলটি আবার জার্মানির গোলরক্ষক এবং অধিনায়ক ম্যানুয়ের ন্যুয়রের আত্মঘাতী গোল। তবে এর পরেই জেগে ওঠে ঘুমন্ত দৈত্য জার্মানি ৭৩, ৮৫ মিনিটে হাভের্টজ এবং ৮৯ মিনিটে ফুলকুর্গ গোল করে নিশ্চিত করেন জার্মানির ৪-২ গোলে জয়। কিন্তু সেই জয়ও তাদের পক্ষে যথেষ্ঠ ছিল না পরের রাউন্ডে যাওয়ার জন্য। রাশিয়া বিশ্বকাপে গ্রুপে নিজেদের শেষ ম্যাচ হারতে হয়েছিল জার্মানিকে বিদায় নেওয়ার আগে এবারে গ্রুপে নিজেদের শেষ ম্যাচ জিতেও শেষরক্ষা হল না। চারবারের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন, আটবারের ফাইনালিস্ট এবং একসময় সেমি-ফাইনাল পর্যন্ত যাওয়া রুটিন করে ফেলা বেকেনবাওয়ার, গার্ড মুলার, লোথার মাথাউস, জুর্গেন ক্লিন্সম্যান, ক্লোজের দেশ জার্মানি ২০১৪ সালে ব্রাজিলের মাটিতে বিশ্বকাপ জেতার পর থেকে বিশ্বকাপে তারা কিছুতেই ভালো কিছু করে দেখাতে পারছে না। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে ধারাবাহিক দল বলে পরিচিত জার্মানি রাশিয়া বিশ্বকাপের পর চারবছরের ব্যবধানে কাতার বিশ্বকাপ থেকেও বিদায় নিল প্রথম রাউন্ড থেকেই। যদিও এই ম্যাচটি ফিফা বিশ্বকাপের ইতিহাসে থেকে গেল কারণ ম্যাচটি পরিচালনা করলেন স্টেফানি ফ্র্যাপার্টের নেতৃত্বে মহিলা রেফারিরা এবং অফিশিয়ালরা এবং দারুণভাবে ম্যাচ পরিচালনার নিয়ন্ত্রণ রাখলেন তারা। এই মুহুর্তে ফিফা রেফারিদের মধ্যে স্টেফানি ফ্র্যাপার্ট যে অন্যতম সেরা তা আরও একবার প্রমাণিত হল।
অন্যদিকে গ্রুপ-এফ-এর শেষ পর্বে মরক্কো হারিয়ে দিল কানাডাকে এবং গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই তারা পরের রাউন্ডে গেল। মরক্কো এই প্রথম বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ডের বাধা টপকালো এবং তাও আবার অপরাজিত থেকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে। ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে প্রথম ম্যাচ অমীমাংসিত রাখার পর বেলজিয়াম আর কানাডাকে হারিয়ে সাত পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হল আফ্রিকার দেশ মরক্কো। অন্যদিকে ড্র হল ক্রোয়েশিয়া-বেলজিয়াম ম্যাচ। বিশ্বকাপ রানার্সরা এই গ্রুপে হারাতে পারল শুধুমাত্র প্রথমবাব্র বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলতে আসা কানাডাকে। রবার্তো মার্টিনেজের বেলজিয়াম বেশ কয়েকবার গোলের কাছে এসেও গোল করতে পারল না। লুকাকু, হ্যাজার্ডরা যেন গোলের রাস্তাই ভুলে গেছেন। তিন ম্যাচে বেলজিয়ামের গোল মাত্র একটি, কানাডার বিরুদ্ধে। বিগত বিশ্বকাপের তৃতীয় স্থানাধিকারীরা তাই এবার বিদায় নিলেন প্রথম রাউন্ড থেকেই। গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় দ্বিতীয় রাউন্ডে মরক্কোর সামনে স্পেন এবং ক্রোয়েশিয়া খেলবে জাপানের বিরুদ্ধে। না, আর কোনও প্রেডিকশানে যাবো না, কাতার বিশ্বকাপে এখনু পর্যন্ত বিভিন্ন খেলার ফলাফল এটা বুঝিয়ে দিয়েছে যে খেলার ফল নির্ধারিত হয় ম্যাচের পারফরম্যান্সের ওপর নির্ভর করেই, ঘরে বসে তথ্য ঘেঁটে প্রেডিকশান করলে তা সবসময় মেলে না।