সংঘটনের পরে বোধোদয়— ইতিহাস চর্চার আতস কাচ হতে পারে না। বিশেষ করে সেই সব ক্ষেত্রে যেখানে সুযোগ থাকে কোনও ঘটে যাওয়া ঘটনাতে ‘আপন মনের মাধুরী’ মিশিয়ে দেওয়ার। সম্প্রতি দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বলেছেন যে, বীর সাভারকার আন্দামান জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য যে মুচলেকা দিয়েছিলেন, তা তিনি দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধীর যুক্তি-বুদ্ধিতে।
এখন ব্যাপার হচ্ছে এখানে দুটোই সত্যি। প্রথমত, সাভারকার মুচলেকা দিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, গান্ধীজি সাভারকারের সেই সময়ের পরিস্থিতির বিচারে, তাঁকে মুচলেকা দিতে বলেছিলেন। কিন্তু এই দুটি ঘটনার যে সময়কাল সেই সময় মহাত্মা গান্ধী ভারতের রাজনীতিতে নেই, তিনি তখন সবে দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে ভারতে আসার আয়োজন করছেন। আজকের উত্তর সত্যের যুগে এই দুটি আলাদা সত্যিকে যাঁরা অনায়াসে জলে চিনি গোলার মত করে মিশিয়ে দিচ্ছেন, শয়তানিটা তাঁদের মাথায়। প্রথমে, সাভারকারের অবস্থানটা বোঝা দরকার। তিনি যে প্রথম জীবনে বিপ্লবী ছিলেন, তিনি ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ শাসন মুক্ত দেখার স্বপ্ন দেখেছিলেন, এ সবই ঐতিহাসিক সত্য। তাঁর সাহস ও বিশ্বাসের জন্য তাঁকে জীবনে বড় দাম চোকাতে হয়েছে, কালাপানি পার করে আন্দামান জেলে কাটাতে হয়েছে প্রায় ১২ বছর। বিশ শতকের গোড়ায় যখন সাভারকার ইংল্যান্ডে আইন পড়ছেন, তখন তিনি সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসী। বিদেশের মাটিতে বৈপ্লবিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে তাঁকে ভারতবর্ষে ফেরৎ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যখন তিনি জাহাজে করে দেশে ফিরছেন, তখন মার্সেই বন্দরে তিনি জাহাজ থেকে পালাবার চেষ্টা করতে গিয়ে ধরা পড়ে যান। অতঃপর তাঁর ঠাঁই হয় আন্দামান সেলুলার জেলে। এখানে মনে রাখা দরকার যে, সাভারকারকে আন্দামান থেকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে যাঁরা আবেদন করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম শুধু মহাত্মা গান্ধী নয়। গান্ধী ছাড়াও আবেদনকারীদের মধ্যে ছিলেন বাল গঙ্গাধর তিলক ও বল্লভ ভাই প্যাটেল। সাভারকার নিজেও সেই আবেদন করেছিলেন। এই মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পাওয়া কিন্তু কোনও বেআইনি ব্যাপার ছিল না। কোনও বিপ্লবী চাইলে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেতে পারেন, এই আইন সেলুলার জেলে ছিল। বিপ্লবীরা এইভাবে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পাওয়াকে ঘৃণা করতেন, তাই কেউ মুচলেকা দিতেন না। সাভারকার দিয়েছিলেন। সেই সময় সাভারকার কংগ্রেসপন্থী ছিলেন এই অর্থে যে সেই সময়ে কংগ্রেসের মত তিনিও ব্রিটিশকে দেশ থেকে উৎখাত করার চাইতে ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকে কিছুটা বাড়তি স্বাধিকার অর্জন করার পক্ষপাতী ছিলেন। ১৯৭০ সালে কংগ্রেসের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সাভারকারের স্মৃতিতে একটি ডাক টিকিটের উদ্বোধন করেন। স্বাভাবিক ভাবেই বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর বল গড়াতে শুরু করে, এবং সাভারকারের ছবি ঠাঁই পায় সংসদ ভবনে। তারপর আন্দামানের বিমান বন্দরের নাম রাখা হয় সাভারকারের নামে। যাঁরা ভারতের বহুত্ববাদে এবং বৈচিত্রে বিশ্বাসী তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই সাভারকার বিরোধী। ১৯২৩ সালের মে মাসে সাভারকার একটি ছোট পুস্তিকা প্রকাশ করেন, হিন্দুদের কী করণীয় এই বিষয়ে। সেখানে তিনি লেখেন যে ‘হিন্দু’— এই শব্দটির সঙ্গে আসলে সম্পৃক্ত হয়ে আছে একটি সভ্যতা এবং একটি বিশেষ ভৌগোলিক বৈচিত্র্য ও সেখানকার মানুষ। এই অব্দি পড়লে দেখা যাবে যে মহাত্মা গান্ধী ‘হিন্দ স্বরাজ’ গ্রন্থে যা লিখেছেন, সাভারকারের লেখার সঙ্গে তার খুব একটা পার্থক্য নেই। কিন্তু এরপর সাভারকার যা লিখেছেন, তাতে তাঁর সঙ্গে গান্ধীর তৈরি হয়েছে বিস্তর ফারাক। সাভারকার লেখেন যে, প্রাচীন গ্রন্থে উল্লেখিত ‘ভারতবর্ষ’-এ শুধু তাদেরই অধিকার যাদের কাছে এটা পিতৃভূমি বা দিব্যভূমি। সুতরাং যেসব হিন্দুরা অন্য ধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন তাঁরা ভারতবাসী বলে গণ্য হবেন না যেহেতু তাঁদের দিব্যভূমি মক্কা বা ভ্যাটিকান। সাভারকারের এই জাতিবৈশিষ্ট্যবাদী বক্তব্য যেকোন সভ্য সমাজে সেদিনও যেমন গ্রহণযোগ্য ছিল না, তেমনই আজও তা গ্রহণযোগ্য নয়।
চিন্তার বিষয় এখানেই যে বিজেপি-আরএসএস আজও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সাভারকারের বক্তব্যকেই তাঁদের পার্টির মূল বক্তব্য বলে মনে করে। সাভারকারের হিন্দুত্ববাদী বিষবৃক্ষ আজ ফুলে ফলে টইটম্বুর। ১৯২৫ সালে আরএসএস প্রতিষ্ঠার পর গোলওয়ালকর, সাভারকারের বক্তব্যকে আরও টেনে হিঁচড়ে এগিয়ে নিয়ে দাবি করেন যে ‘হিন্দুস্থান’-এ থাকতে গেলে অ-হিন্দুদের অবশ্যই হিন্দু সংস্কৃতি ও ভাষা মেনে চলতে হবে এবং হিন্দু দেব-দেবীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সোজা কথায় হিন্দুস্থানে বিদেশিদের জায়গা নেই। বিদেশিদের প্রতি রাষ্ট্রের কোনও দায়বদ্ধতা নেই, তাঁরা রাষ্ট্রের কাছে কোনও সুবিধা দাবি করতে পারবেন না। এমনকি নাগরিক সুবিধাটুকুও তাঁরা ভোগ করতে পারবেন না। বলাই বাহুল্য এই ধরণের ভয়ঙ্কর বিদেশি বিদ্বেষ এমন একটি দেশে যেখানে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও প্রচুর সংখ্যায় অন্য ধর্মের মানুষ সেখানে বাস করেন, তাঁদের পক্ষে বিপদজনক। অথচ বিজেপি-আরএসএস আজও গোলওয়ালকরের বক্তব্যকে শিরোধার্য করেই হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখে চলেছে। এটা খুব আশ্চর্য্যের ব্যাপার যে স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরে, সংবিধান মেনে দেশ চালাতে যাঁরা শপথবাক্য পাঠ করেছেন, তাঁদের মনে হয় না যে আজকের এই একুশ শতকের পৃথিবীতে হিন্দু রাষ্ট্র মার্কা কোনও ধারণা কতটা অবান্তর, কতটা অবাস্তব। যে সংবিধান আমাদের এই প্রজাতন্ত্রের বহুত্ববাদকে সম্মান করতে বলে, সকল ধর্মের মানুষকে সমান অধিকার দেওয়ার কথা বলে,সেই সংবিধানের রীতিনীতি মেনে এতগুলো বছর পার করে এসে আজ ভারতবর্ষের বুকে একটি রাজনৈতিক দল হিন্দু রাষ্ট্র নামের একটি আজগুবি দাবি করছেন। তাঁরা কী বোঝেন না যে হিন্দু রাষ্ট্র তৈরি করতে গেলে এক বিপুলসংখ্যক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে দেশ ছাড়া করতে হবে, যা আজকের দিনে অসম্ভব। অথবা সেই সম্প্রদায়ের মানুষদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের তকমা দিতে হবে যা এক স্থায়ী দুর্বিপাক ও বিপর্যয়ের সৃষ্টি করবে। সংবিধানের সম্পুর্ণ বিপরীতে যদি এমনটা ঘটে, তবে তা এক স্থায়ী সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে, ধর্মের ভিত্তিতে তৈরি হবে এক স্থায়ী বিভাজন— যা দেশের প্রগতি ও উন্নয়নের পথে তৈরি করবে বাধার পাহাড়। সাভারকারকে বিচার করতে হবে এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে— তাঁর জাতি বিদ্বেষী তত্ত্বের ভিত্তিতে তৈরি হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণা যে আদতে একটি কাল্পনিক, অবাস্তব রাষ্ট্র সে সম্পর্কে যত তাড়াতাড়ি বোধোদয় ঘটে ততই মঙ্গল। তার জন্য সাভারকার যে জীবনের একটা সময় ব্রিটিশ বিরোধিতা করেছিলেন, সেটা কেউ অস্বীকার করেছেন না, কিন্তু তাঁর হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণা যে আদ্যন্ত সাম্প্রদায়িক এটাও জোর গলায় বলা দরকার। মহাত্মা গান্ধীরও সাভারকার সম্পর্কে এটাই ছিল মত। আর সেটাই ইতিহাসে সাভারকারের অবস্থান। আসলে হিন্দ রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্য আজ আর বিজেপি-আরএসএস-এর কোনও হাতের আস্তিনের তলায় লুকোনো তাস নয়। সবটাই আজ প্রকাশ্যে এসে পড়েছে। ইতিহাসের বিনির্মাণ করতে না পারলে, সেই কাজ এগোবে না। তাই হিন্দু স্বরাজের গান্ধীর সঙ্গে হিন্দু রাষ্ট্রের সাভারকারকে যুক্ত করার এই অপচেষ্টা। যে গান্ধীকে হত্যা করল আরএসএস, সেই আরএসএস মতবাদের অন্যতম কারিগরকে গান্ধীর সঙ্গে জুড়ে দিলেই ইতিহাস বদলে দেওয়া যাবে, মাননীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী যদি এই খোয়াব দেখে থাকেন, তবে তিনি মস্ত ভুল করছেন। ইতিহাস সাক্ষী আছে— কে বীর সাভারকার, আর কে মহাত্মা গান্ধী সেটা সবাই জানেন।