সারা বিশ্ব জুড়ে মানুষ আজ সোশ্যাল মিডিয়ার দাস। সোশ্যাল মিডিয়াই ধ্যান, জ্ঞান ও প্রেম। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে একবিংশ শতকের শব্দ ভান্ডারে দুটি শব্দ ক্রমেই গুরুতর হয়ে উঠেছে। তার প্রথমটি "ফোমো"। গোটা করে বললে "ফিয়ার অফ মিসিং আউট"। মনস্তাত্ত্বিকরা বলছেন, নিরন্তর সোশ্যাল মিডিয়া যাপনের এই যুগে "ফোমো" একটি জটিল মানসিক সমস্যার রূপ নিয়েছে। মনস্তাত্ত্বিকরা বলছেন এই "ফিয়ার অফ মিসিং আউট" হল আসলে একটা ভয়, পিছিয়ে পড়ার ভয়। অর্থাৎ, অন্যরা সব সুখ পেয়ে গেল, প্রচারের সমস্ত আলো অন্যদের উপরে পড়ল, সমস্ত উত্তেজনা অন্যরা উপভোগ করে নিল, অন্যরা সব আলোচনার কেন্দ্রে রয়ে গেল - সর্বক্ষণের এই আশঙ্কাই "ফোমো"।
মনস্তাত্ত্বিকরা বলছেন এর চিকিৎসা হল যাবতীয় সোশ্যাল মিডিয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা। যা নেই তার জন্য বিচলিত না হয়ে, যা আছে তাতে মনোনিবেশ করা। কিন্তু হিতোপদেশ আর কে কবে শুনেছে, ফলে "ফোমো"-র অন্তৰ্দাহ চলছে। সেই দহনের এক বিচিত্র প্রকাশ হল, ঘটমান বর্তমানের কার্যত প্রতিটা মুহূর্তের সঙ্গে নিজের অবিচ্ছেদ্য যোগ প্রমাণের চেষ্টা। যেমন, কোনও বিশিষ্ট মানুষ প্রয়াত হলে তাঁর সঙ্গে নিজের সম্পর্ক ফলাও করে লেখা। চলচ্চিত্র অভিনেতা, অভিনেত্রী, পরিচালক,কবি, সাহিত্যিক কারুর মৃত্যু হলে সোশ্যাল মিডিয়া ভরে ওঠে ব্যক্তিগত শোক জ্ঞাপনের প্লাবনে। অনেকেই মৃত ব্যক্তির সঙ্গে নিজের অন্তরঙ্গতা জানাতে পাতা ভরিয়ে(থুড়ি দেওয়াল ভরিয়ে) লেখেন যে তিনি একবার ওই ব্যক্তিকে দূর থেকে দেখেছিলেন, বা গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলেছিলেন, বা তাঁরা একই দোকান থেকে মিষ্টি কিনতেন, বা বইমেলায় দেখেছিলেন ইত্যাদি। "ফোমো" যে কী ভাবে শোককে প্রতিদ্বন্ধিতায় পরিণত করতে পারে তার উদাহরণ যে কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়। যাঁরা বিপর্যয়ের কেন্দ্রে থাকেন তাঁদের সব সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি আপলোড করার সময় থাকে না। কিন্তু বিপর্যয় থেকে নিরাপদ দূরত্বে বসে অনেকেই নিজের টাইমলাইন ভরিয়ে ফেলেন, পূর্বাভাসের উপগ্রহের ছবি, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ধ্বস, ছবি ও ভিডিওর ধারাবিবরণীতে। শুরু হয় একে অপরের সমালোচনা, আবার কখনও চলে কোনও তৃতীয় পক্ষের সমালোচনা। সাম্প্রতিক অতীতে ইয়াস ঝড়, আমফানের মত শহর কলকাতায় আছড়ে না পড়ার ফলে অনেকের ছদ্ম স্বস্তি ভেদ করে প্রকাশ হয়ে পড়েছিল দীর্ঘশ্বাস - ঝড়ের অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ অংশীদার থাকার সোনার সুযোগ ফসকে যাওয়ার বেদনায়। ঝড়ের পর প্রত্যেকেই নেমে পড়েছিলেন অপরের তুলনায় এগিয়ে থাকার দৌড়ে। ত্রাণ পর্যটন যে "ফোমো"-রই একটি সংস্করণ তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। সোশ্যাল মিডিয়ার ভুবন জুড়ে কেবলই দৃশ্যের অবতারণা হয়।যে কোনও ছবির, আক্ষরিক অর্থে ছবি, অর্থাৎ স্থিরচিত্র অথবা চলচ্চিত্র তার মধ্যে সব সময়েই কিছু কথা নিহিত থাকে, অর্থ নিহিত থাকে। যেমন, সাঁজোয়া গাড়ির সামনে দু'হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছেন একজন মানুষ, এই ছবিটি যেমন কোনও কথা না বলেও বলে দেয় বিদ্রোহ ঘোষণার কথা। যেমন, আয়লান কুর্দির সমুদ্রতীরে পরে থাকা নিথর দেহের ছবি চিৎকার করে বলে দেয় যে পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাওয়ার স্বপ্ন আজও অধরা রয়ে গেছে। যেমন, নাপাম বোমার সামনে দৌড়ে আসা কিশোরী, মুমুর্ষ বালকের পাশে অপেক্ষমান শকুনির ছবির অভিঘাত প্রশ্নাতীত। অপরিচিত, আপাত অকিঞ্চিত বহু ছবিও অনেক কথা বলতে পারে। কিন্তু সেই ছবিকে কথা বলার জায়গাটা সবার আগে দিতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া ছবির জ্ঞাপনের তুলনায় জ্ঞাপক হয়ে ওঠেন প্রধান। অর্থাৎ কেউ একজন জানিয়ে দেন যে, ছবির বার্তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই তথ্য যে, ছবিটি তিনি শেয়ার করছেন। এই ঢাক পেটানোর মুহূর্তেই ছবিটি তার অর্থ থেকে বিচ্যুত হয়। ছবিগুলি ক্রমে কোলাহলে পরিণত হয়। সমাজ মাধ্যম অনেকটা সেই শুঁড়িখানার মত যেখানে অনেকের কথা একসঙ্গে শোনা যায় উচ্চগ্রামে, কিন্তু সেখান থেকে কোনও অর্থ খুঁজে পাওয়া ভার। এই কোলাহলই "ফোমো"-র সবচেয়ে বড় অভিশাপ। যখন সবাই কথা বলছেন কোনও কথা না শুনেই, শুনছেনও না শুনেই, তখন আর কোনও কথারই দাম থাকে না। তখন যে কোনও শোক, ক্রোধ, হতাশা শেষ অবধি এক প্রতিযোগিতামূলক উৎসব হয়ে রয়ে যায়। অর্থহীনতার উৎসব। কিন্তু কেন এমনটা হয়? মনস্তাত্ত্বিকরা বলছেন এর জন্য দায়ী বিভ্রান্তি। না সত্য না মিথ্যার বিভ্রান্তি। আর এইখানে প্রবেশ করবে সমাজ মাধ্যমের দৌলতে আমাদের শব্দভান্ডারের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শব্দ জোহনারিজম। যার অর্থ হল একটা সহজ সরল সত্যকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে মানুষের সামনে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে উপস্থাপন করা। এই তত্ত্বের যিনি উদ্ভাবক সেই ন্যাথান জোহনর -এর মতে এর ফলে মানুষ বিভ্রান্ত হন এবং ভুল বার্তা গ্রহণ করেন। ন্যাথান কিছু মানুষের উপর একটি পরীক্ষা চালান, যেখানে তিনি বলেন যে আমরা একটি বিশেষ বিষাক্ত রাসায়নিক, যার নাম ডাই-হাইড্রোজেন -মোনো -অক্সাইড, সেটিকে বর্জন করতে চাই। এই রাসায়নিক আমাদের চামড়া পুড়িয়ে দেয়। তাছাড়া এর কারণে প্রতি বছর প্রচুর মানুষ মারা যান, গৃহহারা হন। এসিড বৃষ্টিতেও এটি প্রধান উপাদান। পরীক্ষায় দেখা গেল এই রাসায়নিকটি যে আসলে জল, সেটা ৭০% মানুষ বুঝতে পারলেন না । তাঁরা অঙ্গীকার করলেন এই ক্ষতিকারক রাসায়নিক বর্জনকে সমর্থন করবেন ! সমাজ মাধ্যমে এই জোহনারিজমের প্রভাব খুব বেশি। প্রায়ই দেখবেন সমাজ মাধ্যমের শিরোনাম, "ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পের আশঙ্কা, প্রলয় কি তবে আসন্ন?" কিংবা, "আগামী দশকেই ধ্বংস হবে পৃথিবী, শুনুন কি বলছেন বিজ্ঞানীরা"। এগুলির কোনোটাই ভুল নয় আবার নৈতিকভাবে দেখতে গেলে এগুলি সঠিক নয়, এগুলি সবই মানুষ ঠকানো, মানুষের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছে দেওয়া। ভারতের সমাজ মাধ্যমে এই জোহনারিজমের প্রয়োগ চলছে অর্থের বিনিময়ে। একটি বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠী ক্ষমতায় থাকার জন্য পূর্ন অসত্য বা অর্ধ সত্যকে এমন মোড়কে পরিবেশন করছেন যে ঐতিহ্যগত ভাবে স্বভাবে সরল ভারতীয়দের একটা বড় অংশ সেগুলিকে সত্য বলে ধরে নিচ্ছেন এবং তাঁদের মতামত তৈরি করে ফেলছেন। এব্যাপারে একটি বড় ভূমিকা নিয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে এমন ভিডিও বানানো সম্ভব যেখানে আপনার মুখে আপনার গলায় এমন কথা বসান সম্ভব যা আপনি কস্মিনকালেও বলেননি। ধরুন একটি ভিডিও এলো যেখানে দেখা যাচ্ছে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী আইনস্টাইনের পাশে বসে স্বকণ্ঠে কথা বলছেন, বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বকণ্ঠে গাইছেন, শা-, চাঁদ উঠেছিল গগনে।ভুলে যাবেন না সেইদিন থেকে এগুলিকেই সত্য বলে মেনে নেওয়ার লোকের সংখ্যা প্রচুর, অগুনতি। আজ স্রেফ পরিবেশনার গুনে সমাজ মাধ্যমে 'দেশপ্রেমিক' হয়ে ওঠা কয়েকজন অন্যদের কান মূলে দিতে সদা প্রস্তুত। এই দেশপ্রেমিকদের কাছে পাড়ার সবজান্তা নেলোদার সঙ্গে অমর্ত্য সেন বা অভিজিৎ বিনায়কদের কোনও পার্থক্য নেই। সমাজ মাধ্যমে অন্যকে গালমন্দ করাটাই বর্তমানে রেওয়াজ। এটা একটা শৃঙ্খল বিক্রিয়ার মত ছড়িয়ে পড়ছে সমাজের প্রত্যেক স্তরে। সচেতন মানুষ এগিয়ে না এলে এই শৃঙ্খল ভাঙা সম্ভব নয়। আর এই শৃঙ্খল ভাঙতে না পারলে আমরা যাদের মানুষ বলি, যাদের অমৃতের সন্তান বলি তারা সবাই মিলে ডুবে যাব সমাজ মাধ্যমের এই গরলের পাঁকে।