কৃষিতে তিনটি কালা কানুন প্রত্যাহারের দাবীতে গত ২৬শে নভেম্বর থেকে লাখো কৃষক দিল্লির সীমান্তে অবস্থান করছেন। প্রবল হাড়কাঁপানো ঠান্ডা উপেক্ষা করে আবালবৃদ্ধবনিতার এই ধরণের সমাবেশ এক কথায় অভূতপূর্ব। সরকারের সাথে ইতিমধ্যে বারবার বৈঠক হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট আগ বাড়িয়ে একটি পক্ষপাতদুষ্ট কমিটি করে সরকারের হয়ে ওকালতি করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু কৃষকরা তাঁদের দাবীতে অটল---এই কালা কানুন বাতিল করতে হবে। ২৬শে জানুয়ারি ঐতিহাসিক ট্র্যাক্টর মিছিল সরকার ভন্ডুল করার চেষ্টা করেছে, নিজেদের পেটোয়া লোক ঢুকিয়ে লালকেল্লায় ধর্মীয় পতাকা তুলে আন্দোলন কে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু মধ্য রাতে রাকেশ টিকায়েতের আবেগপ্রবণ ভাষণ আন্দোলনে নতুন করে জোয়ার সৃষ্টি করেছে। এ যেন এক ম্যাজিক! বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজারো কিষাণ নতুন উদ্যমে দিল্লির সীমান্তে সমাবেশিত হচ্ছে। সরকার থরহরিকম্প, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পুনরায় বৈঠক চালু করার প্রস্তাব দিয়েছেন। আমরা আজ এমন এক আন্দোলন প্রত্যক্ষ করছি যা দেশের রাজনীতির প্রবাহ ঘুরিয়ে দিতে পারে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এই তিনটি আইন আদপে কী সেটা জানার চেষ্টা করি।
কৃষকদের উৎপাদন, ব্যবসা এবং বাণিজ্য (সম্প্রসারণ এবং সুযোগ বৃদ্ধির) আইন, ২০২০
মূল পয়েন্টগুলি হলঃ----
(ক) এই আইন কৃষক এবং ব্যবসায়ি উভয়কেই কৃষিপণ্য সরকারি বা বেসরকারি সংস্থাকে, নিজের রাজ্যের মধ্যে কিংবা এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে বেচাকেনা করার স্বাধীনতা দিচ্ছে। সরকার বলছে নিজের পছন্দমতো বিকিকিনির এই সুবিধার ফলে, প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবে এবং কৃষক ফসলের আরও ভালো দাম পাবে।
(খ) শুধুমাত্র প্যান কার্ড বা কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দিষ্ট করা কোন ডকুমেন্ট থাকলেই যে কোন ব্যক্তি/সংগঠন কৃষকদের থেকে পণ্য কিনতে পারবে অথবা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ব্যবসা করতে পারবে।
(গ) কৃষক এবং ব্যবসায়ির মধ্যে কোন বিরোধ হলে তাঁদের মহকুমা শাসকের কাছে দরখাস্ত করে সেই বিরোধ মেটানোর চেষ্টা করতে হবে। যদি তাতেও সমস্যার সমাধান না হয় তাহলে জেলাশাসকের কাছে আবেদন করতে হবে। কোন মতেই আদালতে যাওয়া যাবে না বা আইনের সাহায্য নেওয়া যাবে না। কোন সরকার বা সরকারি অফিসারের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না।
বাস্তবে চাষির লাভ হবে না ক্ষতি
প্রথম পয়েন্টটা দেখা যাক।
(১)
বাস্তব হচ্ছে বিজেপি সরকার নতুন কিছু করছে না, এমন কোন আইন নেই যেটার কারণে চাষিরা নিজের রাজ্যে বা অন্য কোন রাজ্যে ফসল বিক্রি করতে পারে না। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে এটা কার্যে পরিণত করতে গিয়ে অনেক বাধা আসে। এই ডিসেম্বর মাসেই মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হুমকি দিয়েছেন অন্য রাজ্য থেকে ফসল এনে তাঁর রাজ্যে বিক্রি করার চেষ্টা করলে ফসল বাজেয়াপ্ত করা হবে। হরিয়ানা সরকার অন্য রাজ্যের চাষিদের তাদের রাজ্যে বজরা বিক্রি করার অনুমতি দিচ্ছে না। বিজেপি পরিচালিত দুটি সরকার নিজেরাই তাদের দলের আনা আইন মানছে না! এটা হচ্ছে বাস্তব সমস্যা। এই ধরণের জমিন স্তরের সমস্যাগুলো নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কোন মাথাব্যাথা নেই।
(২)
সরকারি মান্ডি ছাড়াও যেহেতু সারা দেশে প্রচুর বেসরকারি ক্রয়কেন্দ্র খুলে যাবে তাই প্রধানমন্ত্রী বুক ঠুকে বলছেন এখন ‘এক দেশ, এক মান্ডি’। বাস্তবে এখন ‘এক দেশ এক মান্ডি’র জায়গায় তৈরি হবে ‘এক দেশ, দুই মান্ডি’। দ্বিতীয়টি হবে কর্পোরেট চালিত, যারা তাদের বিশাল টাকার জোর এবং বিপুল রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পুরো কৃষি বাজার দখল নিয়ে নেবে; সরকারি মান্ডিগুলি গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে, ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাবে। ঠিক এই ভাবেই বিভিন্ন সরকারি সংস্থা, ব্যাংক, এয়ার ইন্ডিয়া, বিএসএনএল প্রভৃতিকে রুগ্ন করে দেওয়া হয়েছে। সরকার আম্বানি-আদানিদের আজ্ঞাবহ, এঁদের সাথে মন্ত্রীসান্ত্রীদের নানা স্বার্থ জড়িত। এই ভাবেই বিনা পয়সায় কানেকশন দিয়ে জিও উল্কার মতো উঠে এল। মানুষ দলেদলে বিএসএনএল ছেড়ে দিল। বাজারের বৃহৎ অংশ এখন জিওর হাতের মুঠোয়। এবার জিও যখন খুশি দাম বাড়াচ্ছে কমাচ্ছে, পাবলিক নিরুপায়। এর থেকে শিক্ষা নেওয়া দরকার। কৃষক সরকারি মান্ডিতে ফসল বেচে নূন্যতম সহায়ক মূল্য (MSP) পেতে পারে। বেসরকারি সংস্থা প্রথম দুই তিন বছর এর থেকে আরও বেশি টাকা দেবে, কৃষক সরকারি জায়গা ছেড়ে সেখানে ভিড় করবে। এই ভাবে সরকারি মান্ডি উঠে যাবে, তখন কৃষকদের ভাগ্য এই আম্বানি-আদানিদের সংস্থাগুলোর হাতে; তারা যে দাম দেবে কৃষককে সেই দামেই ফসল বিক্রি করতে হবে। সরকারি ব্যবস্থা কার্যত উঠে যাওয়ার ফলে, বেসরকারি সংস্থাগুলির শোষণ তীব্রতর হবে, কৃষক দেউলিয়া হয়ে যাবে।
(৩) সরকারি মান্ডি গুরুত্বহীন হয়ে পড়লে, সরকারি গুদামে শস্যের পরিমাণ কমে যাবে। খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। রেশনব্যবস্থা, মিড-ডে-মিল, করোনার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়ে অধিক খাদ্যশস্য দেওয়ার ব্যবস্থা, এসবই ব্যাহত হবে। তাই এটা শুধুমাত্র কৃষকের সমস্যা নয়, সমগ্র সমাজের সমস্যা।
(৪) নূন্যতম সহায়ক মূল্য নিয়ে আইনে কোন উচ্চবাচ্য নেই। প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিচ্ছেন এমএসপি থাকবে। কৃষক বিশ্বাস করছেন না কারণ এই রকম অনেক আশ্বাস তিনি দিয়েছেন যা ডাহা ধোঁকাবাজি হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে। কৃষক দাবি করছেন এমএসপি আইনে লিখিত ভাবে থাকতে হবে।
(৫) প্রধানমন্ত্রী এটাও আশ্বাস দিচ্ছেন যে কৃষকের ভয় পাওয়ার কিছু নেই, সরকারি মান্ডি থাকবে। এটাও মিথ্যাচার। বর্তমানে দেশে মান্ডির সংখ্যা মাত্র ৮০০০ যার অধিকাংশই পাঞ্জাব এবং হরিয়ানায়। একটি হিসাব অনুযায়ী অন্তত ৪৪০০০ মান্ডি থাকা প্রয়োজন কিন্তু এই সংখ্যাটাও যথেষ্ট অপ্রতুল মনে হয়। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর মান্ডির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এরকম কোন তথ্য নেই। বিহারে ২০০৬ সালে মান্ডি ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হয়। পাঞ্জাবে এখনো আছে তাই তারা খেয়েপড়ে বাঁচতে পারছে। দুই রাজ্যের চাষিদের অবস্থা তুলনা করে দেখুন। বিহারের চাষিদের পাঞ্জাবে মজুরি করতে ছুটতে হচ্ছে! বেসরকারি সংস্থাগুলি সেখানে চাষের উন্নতির জন্য এক পয়সা ঢালেনি----গুদাম নেই, হিমঘর নেই, ভালো রাস্তা নেই।
(৬) বাংলায় ৯০% কৃষকের জমি দুই একরের কম। এখানে বহু বছর ধরে সরকারি ব্যবস্থা দূর্বল, এমএসপি প্রায় কেউই পায় না। এখানে মান্ডি ব্যবস্থা আরও প্রসারিত করতে হবে, কৃষক যাতে চাষের লাভজনক দাম পায় তা নিশ্চিত করতে হবে, অভাবি বিক্রি বন্ধ করতে হবে। বাংলার মতো রাজ্যে সরকারকে চাষির স্বার্থ রক্ষা করতে হবে।
(৭) শুধুমাত্র প্যান কার্ড দেখিয়ে যদি কেউ ফসল কেনার ছাড়পত্র পেয়ে যান তাহলে তা চাষির পক্ষে বিপদজনক। সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশে একটি চক্র ভুয়ো নথি দেখিয়ে এবং কিছু অগ্রিম টাকা ধরিয়ে দিয়ে প্রচুর ফসল তুলে নিয়েছে। এদের এখনো অবধি কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। কিছু চাষির লক্ষাধিক টাকা লোকসান হয়েছে।
(৮) নতুন আইন বলছে ক্রেতার সাথে কোন বিরোধ হলে চাষি আইনের সাহায্য নিতে পারবে না, কোর্টে কেস করতে পারবে না। এর অর্থ আমলারা বিচার করবে, কোর্ট কাছারির কোন গুরুত্ব রইলো না। কিন্তু সরকার কাউকে কোর্টে আবেদন করতে বাধা দিতে পারে না। এটা মৌলিক অধিকার বিরোধী, সংবিধানের আর্টিকল ৩২ কে লঙ্ঘন করে।
মূল্য এবং কৃষিক্ষেত্রে পরিষেবা নিশ্চিত করতে কৃষকদের (ক্ষমতায়ন এবং সুরক্ষিত রাখার) আইন, ২০২০
এই আইনটি চুক্তি চাষ নামে প্রচলিত। এতে অনেক ভালো ভালো কথা আছে। সেগুলি নিম্নরুপঃ-------------
(ক) কৃষক, স্পনসর অথবা কৃষক, স্পনসর এবং তৃতীয় ব্যক্তির মধ্যে একটি লিখিত কৃষিচুক্তি হবে। এই চুক্তি ফসল উৎপাদনের আগে হবে এবং কী ফসল চাষ হবে, সেটার মান, গুণাগুণ, ওজন নির্দিষ্ট করা থাকবে। চুক্তি অনুযায়ী স্পনসর কৃষিপণ্য কিনতে সম্মত হবেন এবং তার জন্য কৃষি পরিষেবার ব্যবস্থা করবেন। আইনে লিখছে স্পনসর হচ্ছে এমন একজন ব্যক্তি যিনি কোন চাষির সাথে কৃষিপণ্য কেনার জন্য চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছেন।
(খ) এই চুক্তি অনুযায়ী উৎপাদন চলাকালীন পণ্যের মালিকানা কৃষকের। চুক্তিতে এর মূল্য নির্ধারণ করা আছে। পণ্য বা ফসল স্পনসরের কাছে হস্তান্তর করলে কৃষক সেটার দাম পাবেন। মূল্য কীভাবে নির্ধারিত হবে? যদি দেখা যায় মূল্য ওঠানামা করছে তাহলে চুক্তিতে একটা ‘গ্যারান্টেড প্রাইস’, অর্থাৎ যে মূল্য দিতেই হবে সেটা লিখিত থাকবে। মান্ডিতে (মান্ডি থাকবে কিনা তারই ঠিক নেই) যা দাম চলছে সেটা মাপকাঠি ধরে দাম নির্ধারণ করা যেতে পারে। যে ভাবেই হোক চাষি যাতে সেরা দাম পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
(গ) চাষিকে স্পনসর কৃষি পরিষেবা অর্্থাৎ বীজ, গবাদি পশুর খাদ্য, রাসায়নিক, যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি, অন্যান্য কৃষি উপকরণ এবং পরামর্শ, পুরোটা বা অংশত, দিতে সম্মত হবেন। এর পরিবর্তে, অনুমান করা যাক, চাষিকে ৫০ কুইন্টাল গম উৎপাদন করে দিতে হবে। চুক্তি অনুযায়ী এর মূল্য স্পনসর চাষিকে দিয়ে দেবেন।
(ঘ) কৃষক বর্গাদারের স্বার্থ হানি হয় এমন কোন চুক্তি করতে পারবেন না।
(ঙ) যদি অপ্রত্যাশিত কোন ঘটনার জন্য (FORCE MAJEURE) কৃষক চুক্তি লঙ্ঘন করেন বা পালন করতে ব্যর্থ হোন তাহলে তাঁর থেকে কোন অর্থ পুনরুদ্ধার করা যাবে না। আইন লিখছে ‘অপ্রত্যাশিত ঘটনা’ হচ্ছে বন্যা, খরা, প্রতিকূল আবহাওয়া, ভূমিকম্প, ব্যাধি বা কীট-পোকামাকড়ের মহামারী, যা অবশ্যম্ভাবি এবং উভয় পক্ষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
(চ) চুক্তিতে এমন কিছু থাকবে না যার ফলে চাষির জমি, আবাস লিজ, মর্টগেজ, হস্তান্তর বা বিক্রি হতে পারে। জমিতে কোন পরিবর্তন করা যাবে না বা জমিতে কোন কাঠামো তৈরি করা যাবে না যদি না স্পনসর চুক্তির সময়সীমার মধ্যে নিজের খরচায় কাঠামো সরিয়ে ফেলে বা জমি পূর্বাবস্তায় ফিরিয়ে দেয়।
(ছ) প্রথম আইনের মতো এই ক্ষেত্রেও কৃষক ও স্পনসরের মধ্যে কোন বিরোধ হলে তার মীমাংসা হবে প্রশাসনিক স্তরে-----মহকুমাশাসক, জেলাশাসক বা তাঁদের নির্ধারিত সালিশি বোর্ডে। আইনের সাহায্য নেওয়া যাবে না, কোর্টে যাওয়া যাবে না।
বাস্তবে চাষির লাভ হবে না ক্ষতি
(১) দুজন অসম ব্যক্তির মধ্যে চুক্তি হয়? আমার আছে ১০০ টাকা, স্পনসরের আছে ১০০ কোটি টাকা, দুজনের মধ্যে কোন ন্যায্য চুক্তি হতে পারে যাতে আমার স্বার্থ রক্ষা হয়। সরকার বলছে একটা মডেল চুক্তির বয়ান তৈরি করে দেবে। তা যাঁরা সেটা তৈরি করবেন তাঁরা এই ধনী স্পনসর না দুঃস্থ চাষি কার স্বার্থ দেখবেন? এটা দেশ, কাল, রাষ্ট্র, রাজনীতি সম্পর্কে নামমাত্র ধারণা যাঁদের আছে তাঁদের কাছে এর উত্তর পরিষ্কার। উপরে এই আইনের মূল যে সাতটি পয়েন্ট লেখা আছে তা এই একটি যুক্তিতেই খারিজ হয়ে যায়। (২) যে কোন আইনের মতো চুক্তিতে নানা ফাঁক থাকবে। নানা অছিলায় পণ্যের মূল্য দিতে দেরি করা হতে পারে। ফসলের দাম ওঠানামা করছে কিনা তা কে ঠিক করবে? ‘গ্যারান্টেড প্রাইস’ কে নির্ধারণ করবে? কিছু পণ্য নিয়ে বাকি ফেরত দিয়ে দেওয়া হতে পারে, সেটা নিয়ে চাষি কী করবেন? স্পনসর যদি একতরফা ভাবে চুক্তি বাতিল করে তখন চাষির কী উপায়? তা প্রতিটা ক্ষেত্রে কি চাষি মহকুমাশাসকের কাছে দৌড়াবেন প্রতিকার পাওয়ার জন্য? প্রতিটি পদক্ষেপে চাষিকে স্পনসর বা প্রশাসনের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে? (৩) আদালতে তো তিনি যেতে পারবেন না। সরকার আইনে তাঁর সেই মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে। আদালতেও তিনি আম্বানির প্রতিনিধির সঙ্গে পেরে উঠবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে, তবুও সেই অধিকারটা তো তাঁর থাকা দরকার। (৪) প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং হুঙ্কার দিয়েছেন কোই মায় কা লাল কৃষকের জমি নিতে পারবে না। জমি তো নেবে না, নিজের জমিতে চাষি দাস হয়ে যাবে। চাষের উপকরণ তিনি নেবেন স্পনসরের থেকে কিন্তু স্পনসর নানা অছিলায় দেরিতে দাম দেবেন, কিছু ফসল নেবেন বাকি ফেরত দিয়ে দেবেন, গুণমান ভালো নয় বলে কম দাম দেবেন। স্পনসরের নানা বায়নাক্কায় চাষি জেরবার হয়ে যাবেন। ধীরে ধীরে তিনি দেনাগ্রস্ত হবেন। চাষি নিজেই যদি দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়েন, তাহলে তাঁর বর্গাদারের স্বার্থ আর কীভাবে রক্ষা হবে? তখন স্পনসর তাঁকে নিজের ইচ্ছা মতো চালনা করবেন। আর চাষির জীবন জীবিকা যদি স্পনসরের হাতের মুঠোয় চলে আসে তাহলে বন্যা, খরা ইত্যাদির আর কোন গুরুত্ব থাকে কি? চাষিকে বেঁচে থাকার যৎসামান্য টুকু দিয়ে পুরো মুনাফা স্পনসরের পকেটে যাবে। (৫) এই চুক্তি চাষ শুধু চাষির নয় সমগ্র সমাজের সবচেয়ে বড় বিপদ। স্পনসর চাষিকে বাধ্য করবে যে ফসলে বেশি লাভ সেটা চাষ করতে। চাল গমের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যর উৎপাদন কমে গিয়ে অর্থকরি ফসলের রমরমা হবে। চাহিদা অনুযায়ী চাষ করতে বাধ্য করা হবে। ধরা যাক গুজরাটে চিনির খুব চাহিদা; বাংলার চাষিকে ধান চাষ বন্ধ করে আখ চাষ করতে বাধ্য করা হবে। খাদ্যের আকাল দেখা দিতে পারে, দূর্ভিক্ষও হতে পারে। খাদ্য সুরক্ষা ভেঙে পড়বে। (৬) সমস্ত প্রাকৃতিক নিয়ম লঙ্ঘন করে, জমির চরিত্র উপেক্ষা করে শুধুমাত্র চাহিদার কারণে তা যদি খামখেয়ালি ভাবে ব্যবহার করা হয় তাহলে অতি দ্রুত সেই জমি অনুর্বর হয়ে পড়বে। ভূজলের স্তর নেমে যাবে, দূষন বাড়বে, পরিবেশের ক্ষতি হবে। তখন উৎপাদন বাড়াতে আবার গাদা গাদা সার, কীটনাশক ইত্যাদি বিষ ঢালা হবে। তাতে হয়তো জমি আবার কয়েক বছর ভালো ফসল দেবে তারপর বন্ধ্যা হয়ে যাবে; এই চক্র চলতেই থাকবে। চুক্তি চাষ সমাজের পক্ষে একটি অভিশাপ হিসাবে প্রতিপন্ন হবে।
অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন, ২০২০
(ক) মূল্যবৃদ্ধির ওপর নির্ভর করবে কৃষিপণ্য কতটা মজুত করা যাবে। মজুতদারি নিয়ন্ত্রণ করা হবে শুধুমাত্র তখনই যখন বাগিচা সংক্রান্ত পণ্যের দাম ১০০% বৃদ্ধি পাবে এবং অপচনশীল কৃষিপণ্যের দাম ৫০% বৃদ্ধি পাবে। এই দাম নির্ধারণ করতে গত বারো মাস পণ্যের দাম কি ছিল বা পাঁচ বছরের গড়পড়তা দাম, দুটির মধ্যে যেটি কম সেটা গণ্য করা হবে।
(খ) উপরোক্ত ধারায় যা আছে তা কোন ভাবেই পিডিএস বা রেশন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
(গ) খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ব্যবসায় যাঁরা যুক্ত আছেন, উৎপাদক থেকে উপভোক্তা, তাঁদের ক্ষেত্রে মজুতদারি নিয়ন্ত্রণ করার কোন ধারা প্রযোজ্য হবে না।
বাস্তবে চাষির লাভ হবে না ক্ষতি
(১) অত্যাবশ্যকীয় পণ্য কী সেটার কোন সংজ্ঞা নেই।
(২) আইনের ধারা 2(ক) বলছে তালিকাভুক্ত পণ্যগুলি অত্যাবশ্যকীয়। এই তালিকায় আছে ওষুধ, সার (জৈব, অজৈব বা মিশ্রিত), ভোজ্যতেল সহ কিছু খাদ্যপণ্য, তুলার লাছি, পেট্রোল ও পেট্রোলজাত দ্রব্য, কাঁচা পাট ও পাটের কাপড়, ফল, আনাজ, খাদ্যশস্যের বীজ ও গবাদি পশুর খাদ্য এবং মাস্ক ও স্যানিটাইজার। সরকার প্রয়োজন মতো এই তালিকা সংশোধন করতে পারবে। যেমন ৩০শে জুনের পর মাস্ক, স্যানিটাইজার আর অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নয়।
(৩) আলু, পেঁয়াজ, খাদ্যশস্য, ডাল, তৈলবীজ আর অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নয়। শুধুমাত্র যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, বিরাট প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে সরকার এই পণ্যগুলির দাম নিয়ন্ত্রণ করবে। এর অর্থ সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন খাদ্য আর অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নয়। এর ফলে আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি হবে। মজুতদারদের পোয়াবারো। তারা এইসব পণ্য যত খুশি মজুত করবে; আকাল দেখা দিলে অগ্নিমূল্যে তা বিক্রি করবে। এই আইন অত্যন্ত নগ্ন ভাবে কালোবাজারি এবং মজুতদারদের পক্ষে এবং সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে।
উপসংহার
গণ্যমান্য ভুবনজয়ী বিশেষজ্ঞরা বলছেন আমাদের দেশ খাদ্যে স্বনির্ভর, প্রয়োজনের তুলনায় তিন গুণ বেশি খাদ্যশস্য এফসিআইয়ের গুদামে পচে যাচ্ছে। অথচ গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স অনুযায়ী ১০৭টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ৯৪, নেপাল, পাকিস্থান, বাংলাদেশেরও নীচে! এটা একটা প্রহেলিকা! মাননীয়রা কি জানেন না যে গুদামে খাদ্য ইঁদুরে খাচ্ছে এই কারণে যে বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে খাদ্য পৌঁছাছেই না। রেশন ব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত, প্রবল ভাবে অপ্রতুল, বহু মানুষ এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এঁরা এটাও বলছেন এতো চাল গম করে কী হবে, পাঞ্জাবের চাষিরা কেন ভুট্টা, আখ, বিভিন্ন ফল ইত্যাদি উৎপাদন করছে না? চাষিরাও বলছেন এতো চাল গম উৎপাদন করেও দেশের অর্ধেক মানুষ অর্ধাহারে অনাহারে রয়েছেন। আর ভুট্টা, আখ ইত্যাদি ফসল সরকার কেনার ব্যবস্থা করুক, এমএসপি, বিমা দিক, ঐ সব ফসল চাষ করতে আমাদের কোন আপত্তি নেই। আরেকজন বলছেন এতো কৃষিজীবী কেন? তারা কেন অন্য কাজ করছে না! ভাবুন, শুধুমাত্র লকডাউনে ১২ কোটি লোকের চাকরি চলে গেছে, যার মধ্যে ২ কোটি স্থায়ী চাকরি? এর আগে বিমুদ্রাকরণ করে লক্ষ লক্ষ মানুষের রুটিরুজি কেড়ে নেয়া হয়েছে। এই চরম সংকটের মধ্যে সামান্য কিছু জমিজমা ছিল বলেই জনসংখ্যার বিপুলাংশ বেঁচেবর্ত্তে থাকতে পেরেছেন। এই রকম এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে সরকার মানুষের প্রতি নিজের দায়বদ্ধতা থেকে খালাশ হয়ে পুরো কৃষিক্ষেত্র সরাসরি আম্বানি-আদানিদের হাতে তুলে দিতে চাইছে। এই তিন আইন প্রত্যাহার না হলে শুধুমাত্র কৃষক নয় ভারতীয় সমাজ নিঃস্ব হয়ে যাবে।