আজ সেই বেসিক মাস্টারকে খুব মনে পড়ছে, ১৯৯২ সাল ফেব্রুয়ারি মাস,শুরু হয়েছে দেশ জুড়ে দাঙ্গার প্রস্তুতি , দিকে দিকে ইট পুজো করে আনা হচ্ছে, গড়া হবে রাম মন্দির, ভাঙা হবে বাবরি মসজিদ, স্কুল কলেজ ছুটি হয়েছে বাড়ি ফিরে গেছি । দেশের পরিস্থিতি খুব খারাপ । আমার অন্যান্য ভাই বোনেরাও হস্টেল থেকে বাড়ি ফিরেছে । আমরা প্রত্যেকেই গ্রামের মধ্যেই আছি । কেউই যাচ্ছে না গ্রাম ছেড়ে কারণ অন্য গ্রাম হিন্দুদের। তার পাশ দিয়ে চলে গেছে শহরে যাবার রাস্তা । হিন্দুরাও এই গ্রামের পাশ দিয়ে যাচ্ছে না। খুব ই সাম্প্রদায়িক আগুনের ঝলকানি দেখছি। আমরা বাড়িতে বসেই নিজেদের বাদ দিয়ে অন্য জাত কত খারাপ সেই কথায় আলোচনা করছি। মাঝে মাঝে বড়োভাই বলছিলো নিজেদের গায়ের দুর্গন্ধের কথা। এই সব বিষ বাতাসের মাঝে নিজেদেরকে আর একটু একটু করে বিষাক্ত করে নিচ্ছিলাম আর মাঝে মাঝে রেডিওর খবর বিবিসির নিউজ দেখছিলাম । হঠাৎ দেখি কর সেবকদের উল্লাস। বিবিসি দেখালো বাবরি মসজিদের প্রধান গম্বুজ কি ভাবে মাটিতে গুড়িয়ে দিলো আর শুরু হলো সেই মহান উৎসব দাঙ্গা । এক জন আর এক জনের রক্তে স্নান সারে। আমরা কেবল ঘামতে থাকলাম কেবল ঘামতে থাকলাম কেবল ঘামতে থাকলাম । তখন আর দরদ নেই আছে কেবল গরল আর হাজার মাথার ফণা। আমরা স্থির করছি ছোবল দেবার নিশানা । আমরা কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছি না নিজেকে স্থির রাখতে পারছি না। এমন সময় আমাদের মনে হলো বেসিক মাস্টার কি বলেন এই বিষয়টা নিয়ে । তাঁর কাছে গিয়ে দেখলাম তিনি এক মনে তার কোরান নিয়ে বসে আছেন আর কোরান পাঠ করছেন । গিয়ে ডাক দিতেই তিনি তাকালেন আমাদের দিকে। প্রশ্ন করলেন ,কি হলো তোমরা উঠোনে দাঁড়িয়ে আছো কেন ? বললাম ,আপনি নিশ্চিন্তে নিভৃতে কোরান পাঠ করছেন ও দিকে কি দেখেছেন দেশের পরিস্থিতি কি ?
তিনি বললেন, না তা দেখিনি, কেন কি হলো ? বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে দিলো কর সেবকরা । বেসিক মাস্টার আমাদের সকলের মুখের দিকে তাকালেন । সবাভাবিক মুখের লেপন। তিনি আমাদের ডাকলেন। তার পর বললেন শোনো তোমরা এদিকে এসো, আমার কাছে বসো। এমন খবর শোনার পরেও বেসিক মাস্টারের এমন নির্বিকার মুখ দেখে আমরা খুব অবাক হলাম, ধীর পায়ে তার কাছে গিয়ে বসলাম । তিনি আমাদের আবার জিঙ্গাসা করলেন ,কি হয়েছে দেশে ? তোমরা কোথায় দেখলে ? স্যার বি বি সি টি ভি চ্যানেলে দেখলাম , বাবরি মসজিদকে ভেঙে গুড়িয়ে দিলো এই মাত্র । বেসিক মাস্টার কিছুক্ষণ চুপ রইলেন , তারপর বললেন ওটাতো খোদার মসজিদ ! আমরা এমন কথা শুনে খুব রাগ করলাম । মনের ভিতরে বলে উঠলাম , “বেসিক মাস্টার আপাদমস্তক ধর্মের পোশাক পরে আছেন আর এমন ধর্মের জায়গাটাকে গুঁড়িয়ে ফেলে দিলো আর উনি বলছেন ওটা খোদার মসজিদ ! কেমন ধর্মের মানুষ উনি ?
বেসিক মাস্টার আবার বললেন, ওই জায়গাটা রাজনীতিবিদদের করে খাবার জায়গা । ওটা ভেঙে দিলে দেশের কাবাডি খেলা শেষ হয়ে যাবে বুঝেছো ? মনের মধ্যে সাম্প্রদায়িক গাছের বাড়ন্ত পাতাটাকে বেসিক মাস্টার কেমন কচলে দিচ্ছেন । মসজিদ আর বারবি মসজিদ এটার ফারাক এতো ? রাজনীতিবিদদের করে খাবার জায়গা ! বেসিক মাস্টার প্রশ্ন করলেন, মসজিদ কাকে বলে জানো ?
এই উত্তেজনার সময়ে ,এতো উত্তাপে হৃদয় শুকিয়ে যাচ্ছে ! এমন সময় সাম্প্রদায়িকতার রসে ঘুলা এক গ্লাস সরবত পেলে কি সুন্দর দেহে মনে বল পাই এমন সালাইনের আশা করেছিলাম । কিন্তু তা বেসিক মাস্টার সেই শরবৎ দিলেন তো না পরন্ত সাম্প্রদায়িকতার গাছটাকেই শিকড় সমেত উপড়ে পুড়িয়ে দিলেন আর সেই মাটিতে আর একটা শান্তির গাছ রোপণ করলেন । আমি উত্তর দিলাম – হ্যা জানি ওইতো আমাদের গ্রামের মাঝে সে স্থাপত্য আছে। যার মাথায় কতক গুলো মিনার আর গম্বুজ আছে । যে মিনারের পাশে দাঁড়িয়ে নামাজের আজান দেওয়া হয় । যেখানে একটা অজু করার জন্য ব্যবস্থা আছে, যেখানে গ্রামের পুরুষেরা গিয়ে নামাজ পড়ে সেইটাই মসজিদ।
বেসিক মাস্টার হাসলেন,এর বেশি উত্তর তোমাদের কাছে থাকার কথা নয় । তোমরা হজরত মহম্মদ সাল্লোলাহ আলাইহেসাল্লামের তৈরি মসজিদ সম্পর্কে কিছু জানো নাকি ? না জানি না । আমরা তাঁর জীবনি জানি তবে তার জীবন চর্চা নিয়ে তেমন করে কিছু জানি না । বললাম , স্যার জানি না বা পড়ি নি স্যার তাঁর মসজিদ নিয়ে ।
তিনি বর্ণনা করলেন একটা জায়গাকে চারটি খেজুরের গদি পুতে দিয়ে একটা চৌকো মাচান করা তাতে বেশ কিছু খেজুরের ডাল দিয়ে ছায়া করা ছিলো ওইটা ছিলো তাঁর নামাজ পড়ার জায়গা । প্রশ্ন করলাম , তার মসজিদে কোনো মিনার গম্বুজ ছিলো না স্যার ?
বেসিক মাস্টার হাসলেন, যেখানে ধর্ম মানুষের জন্য, যেখানে মানবাধিকার স্থাপনের জন্য ধর্ম । তিনি সেই মানুষকেই ধর্মের মিনার বলেছেন ।
প্রশ্ন করলাম, তাহলে তাঁর মসজিদ কি ছিলো এক একটা মানুষ ?
স্যার হাসলেন , বললেন অনেকটা কাছাকাছি গেছো , তবে মানুষ একা একা মসজিদ হতে পারে না , লাগে আরো দুটো বিষয় ,একটা মাটি আর একটা নিরাকারের মহা ক্ষমতার বিশ্বাস । বড়ো তাজ্জোব কথা ! জানাতে এলাম ধর্মের দুঃসংবাদ , আর বেসিক মাস্টার ধর্মের বেসিক টিকা করণ করতে থাকলেন আমাদের।
বেসিক মাস্টার বলতে থাকলেন, মসজিদ তাকেই বলে যেখানে মানুষ তার জীবনের লেখন লেখা কপাল , মাটির যে অংশটাতে ঠেকিয়ে নিজের কথা ভুলেগিয়ে বলে, “তুমি মহান তুমি মহান তুমি মহান” তখন ওই মানুষের কপাল ঠেকানো মাটি খানি মসজিদ হয়ে ওঠে । সুতরাং পৃথিবীতে এখন এমন ক্ষমতাধর তৈরি হয়নি যে ওই মানুষের কপাল ঠেকানো মাটিকে ওই মুহূর্তে মসজিদ হয়ে ওঠা মাটিকে ভেঙে গুঁড়িয়ে নিজের পতাকা ওড়াতে পারে । ওই মাটিকে ভাঙতে পারে । ওই মসজিদকে ভাঙতে পারে ,ওতো সমানতার কথা বলে । ওই মাটিকে যত শাবল দিয়ে কোপাবে তত মাটি উঠবে । অনন্ত কোপেও ওই মাটি শেষ করা যাবে না । মাটি কোপাতে কোপাতে মাটি চষে ফেললেও মানব মসজিদ, জলে ঘুলে দিলেও সে মসজিদ , চারি দিকে ছড়িয়ে দিলেও ও মসজিদ । আর ওই মাটি পৃথিবীময় ছড়িয়ে আছে। কোপানো মাটিতে বীজ ছড়িয়ে দিলেই সে শস্য ক্ষেত হয়ে ওঠে । মসজিদ সবুজ সোনালি ফসলে মানুষের জীবন হয়ে ওঠে ।
মা এতো দুঃখ করো না, এতো হিংসা খেয়ো না । মনের ভিতরে গড়ে তোলো মানুষের মসজিদ যা কেউ ভাঙতে পারবে না। ওটা রাজনীতি করে রক্ত ছড়ানোর এক ট্রফি । যে রক্ত খেলায় মাতলে মানুষ মারার এক তোফা পাওয়া যায়, আল্লাকে পাওয়া যায় না । আর আল্লাকে পাওয়া মানেই তো মানুষকে পাওয়া ।
আমাদের মনের সাম্প্রদায়িক আগুনের জলন্ত শিখায় তিনি যে জল ছিটিয়ে দিলেন সেই জল চোখের কোণায় ভরে নিয়ে মনের ময়লা ধুতে শিখেছি । এখন আমাদের দেশে এমন বেসিক মাস্টার দরকার।