পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

সব ফিরে আসে…

  • 15 January, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1457 view(s)
  • লিখেছেন : সুমন সেনগুপ্ত
১। আজ অনেকদিন আগের সমস্ত কথা মনে পড়ছে। রেহানা, বেশ কিছুদিন হলো, সবুজের জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। ঠিক ঠাক হিসেব করলে প্রায় কুড়ি বছর হলো, আজ রেহানা নেই। অনেক চেষ্টা করেও বাঁচানো যায়নি। ডাক্তারেরা যে চেষ্টা করেননি, তা নয়। কিন্তু তাও পেরে ওঠেননি। তারপর থেকে সবুজ একা।


নিজের লেখাপত্র নিয়ে আর একমাত্র মেয়ে তোয়াকে বড় করাই তখন ওর একমাত্র কাজ। যখন রেহানা চলে যায়, তখন তোয়া সবে ক্লাস টেনে পড়ছে। সবসময়ে মা’কে জড়িয়ে থাকতো মেয়েটা। মা, চলে যাওয়ার পরে বড্ড একা হয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে সবুজ চাকরি থেকে অবসরও নিয়ে নিয়েছে। রেহানার সঙ্গে বিয়ে নিয়ে, দুই পরিবারে প্রচুর সমস্যা ছিল। শুধু তাই নয়, পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয়রা কেউই প্রায় সমর্থন করেনি, তাঁদের এই ভিন ধর্মে বিবাহ। কিছু বন্ধু বান্ধব আর হাতেগোনা কয়েকজন আত্মীয়ের উপস্থিতিতে তাঁদের বিয়ে হয়। আজ সেই সব কথা আবার মনে পড়ছে।

মায়ের ইচ্ছে ছিল, মেয়ে যেন কলেজে পড়ায়। আসলে বোটানিতে পিএইচডি করা সত্ত্বেও একটি সরকারী স্কুলে পড়ানোর খেদটা চিরকাল রেহানাকে কুরে কুরে খেত। তাই বারবার মেয়েকে বলত, ‘ মা, তুই কিন্তু আমার মতো স্কুল শিক্ষক হয়ে থাকিস না, তোকে কিন্তু কলেজে পড়াতে হবে’। তোয়া, যখন ছোট ছিল, তখন কতটা এই কথাগুলো বুঝতো সবুজ জানে না, কিন্তু রেহানা চলে যাওয়ার পর, তোয়া সব কিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে দিনরাত খালি পড়াশুনা করতো। মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে আগেই রেহানা চলে যাওয়াতে অনেকেই তোয়াকে বলেছিল, সেবার পরীক্ষা না দিতে। কিন্তু তোয়া, জেদ ধরেছিল, পরীক্ষা সে দেবেই। ঠিক, দেড়মাস পরে ছিল পরীক্ষা। ফল, যখন বেরলো, তখন দেখা গেল প্রায় বিরানব্বই শতাংশ নম্বর পেয়েছে তোয়া। সবাই যখন তোয়াকে বলছিল বিজ্ঞান নিতে, তোয়া শুধু বলেছিল ও ভবিষ্যতে বোটানি নিয়ে গবেষণা করতে চায়।

সবুজ, কোনোদিনই তাঁর কোনো ইচ্ছে অনিচ্ছে, মেয়ের ওপর চাপিয়ে দেয়নি। রেহানা, চলে যাওয়ার পরে তো আরও নয়, ও শুধু বলেছিল, ‘ তোর যা ভালোলাগে, তুই তাই নিয়েই পড় মা’। তারপর একে একে উচ্চমাধ্যমিক তারপর, গ্র্যাডুয়েশন করে মাস্টার্সে বোটানি নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো, তোয়া। ততদিনে, সবুজও অবসর নিয়েছে। এরপর নেট পরীক্ষা দিয়ে ওখানে গবেষণা করতে ঢুকলো। চার বছর গবেষণা করতে করতে কলেজের চাকরিও পেয়ে গেল।

যেদিন, চাকরির খবরটা আসে, সেদিন তোয়ার চোখে অনেকদিন পর জল দেখেছিল সবুজ। সেদিন বুঝেছিল, রেহানাকে কতটা ভালবাসে তোয়া। রেহানার একটা ইচ্ছেকে কতটা গুরুত্ব দিতে চেয়েছে, তোয়া সেটা সেদিন বুঝতে পেরেছিল সবুজ। তারপর চাকরিতে যোগ দেওয়ার পরে আরও বছর দুয়েক যাওয়ার পরে, তোয়া সবুজের সঙ্গে জাহাঙ্গিরের পরিচয় করিয়েছিল। ঝকঝকে যুবক, জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি নিয়ে পিএইচডি করে এখন একটি নামী সংবাদপত্রে কাজ করছে। ভবিষ্যতে ইচ্ছে কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার। কথা বলে যথেষ্ট ভালোই লেগেছিল সেদিন। মনে হয়েছিল, পৃথিবীটা গোল, আর সমস্ত কিছু নিজের মতো করে ফিরেও আসে। সবুজ আর রেহানার ক্ষেত্রে বেশীরভাগ আত্মীয়স্বজন বিরোধিতা করলেও, আজ যে সবুজ বিরোধিতা করবে না, তা, তোয়াও জানতো।

তোয়া আর জাহাঙ্গিরের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে, আরও একা হয়ে গেল সবুজ। তোয়া বারবার বলেছিল,’ বাবা, তুমি আমাদের সাথে গিয়ে থাকবে চলো’। কিন্তু সবুজ চায়নি, রেহানার স্মৃতিগুলোকে ফেলে চলে যেতে। এটা ওর একটা প্রায়শ্চিত্যও বটে। যে খারাপ লাগা একদিন রেহানাকে দিয়েছিল, তার পাপস্খলনও বটে। একজন মহিলা, যিনি তোয়াকে ছোট থেকে বড় করেছেন, তিনিই এখন সবুজদের বাড়িতে থাকেন। সকালের চা, জলখাবার থেকে সমস্ত কিছুর দেখভাল তিনিই করেন।

২।

গতকাল রাতে তোয়া ফোন করে যখন বলেছিল, ‘বাবা, আমি একটু তোমার কাছে আসবো, কিছু কথা আছে’।

সবুজ জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কি হয়েছে, তোর শরীর খারাপ?, জাহাঙ্গিরের কিছু হয়েছে?

তোয়া, শুধু ভারী গলায় বলেছিল, ‘এসে বলছি’।

তারপর কাল সারারাত চিন্তায় ঘুম হয়নি, সবুজের।

আজ সকালে যখন, তোয়া ঘরে ঢুকলো, ওকে দেখে সবুজের মনে হলো, অনেক রাত তোয়া ঘুমোয়নি। ঘরে ঢুকে বললো, ‘মিতালি মাসি কোথায়? এখন এদিকে আসবে না তো?’

সবুজ বললো, ‘ না, মিতালি আজ সকালে আমাকে জলখাবার করে দিয়ে, ওর বোনের সাথে দেখা করতে গেছে, আমার দুপুরের খাবার রাখা আছে, আমি ভাতটা একটু গরম করে নেবো, ও বিকেলে চলে আসবে, ভালোই হয়েছে, তুই চলে এসেছিস, একসঙ্গে দুজনে খেয়ে নেওয়া যাবে’।

তোয়া বললো, ‘আমি খাবো না বাবা, খেয়ে এসেছি, আর তাছাড়া আমার ভালো লাগছে না, কিছু খেতে, তোমার কি সময় হবে, কথাগুলো শোনার?

সবুজ বুঝতে পারছিল, তোয়া ভিতরে ভিতরে হয়তো, অস্থির হয়ে আছে, তাই আবারো প্রশ্ন করলো, ‘ কি হয়েছে মা? সবাই তোরা সুস্থ আছিস তো? জাহাঙ্গির ভালো আছে তো?

তোয়া বলল, ‘ সবাই ঠিক আছে, বাবা, কিন্তু আমি আর পারছি না, জাহাঙ্গিরের সাথে থাকতে। ও প্যারালালি, আরও এক মহিলার সঙ্গে সম্পর্কে যুক্ত। কতদিন এটা চলছে আমি জানি না। কিন্তু ৭ দিন আগে ওঁর হোয়াটসআপ দেখেছি, ও বিষয়টা অস্বীকার করতে পারেনি। এখন আমি কী করবো, বাবা। আমি তো ওঁকে ভরসা করে, বিশ্বাস করেই বিয়ে করেছিলাম। এখন আমি কী করবো? আমার তো সব শেষ হয়ে গেল? আমি কি বেরিয়ে আসবো? আমি আর পারছি না!

সবুজের মনে হলো, যেন পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। ঠিক, এই রকম একটা অভিযোগ একদিন রেহানা করেছিল, সবুজের বিরুদ্ধে, সেদিন সবুজও অভিযোগ অস্বীকার করতে পারেনি। সব দোষ স্বীকার করে নিয়েছিল। বলেছিল, রেহানাকে, যেন আর একটা সুযোগ দেয়। অনেক কথার পরে, রেহানা বলেছিল, সে তো গড়তেই এসেছে, ভাঙতে আসেনি, তাই শেষদিন অবধি চেষ্টা করবে, তারপর যা করার সবুজকেই করতে হবে। সবুজও তারপর থেকে চেষ্টা করেছিল, নিজেদের সম্পর্কটাকে জোড়ার। জুড়তে পেরেছিল কিনা জানতে পারেনি, তবে তোয়ার কথা ভেবে, ওঁরা তখন নিজেদের পথটাকে আলাদা করে নেয়নি। আজ হঠাৎ, সেই ছোট্ট তোয়ার মুখটা মনে পড়ে গেল সবুজের। দশ বছর বয়সী, তোয়া, তখন বুঝতে পারছিল, বাবা- মায়ের মধ্যে কোনো একটা সমস্যা চলছে। তাই ওঁদের দুজনকে কথা বলার সুযোগ করে দিতে, তোয়া সবুজের মায়ের কাছে গিয়ে শুচ্ছিল। যাতে রেহানা আর সবুজ কিছু কথা বলার সুযোগ পায়। তারপরে বেড়াতে গিয়েছিল ওঁরা। দার্জিলিং, বিজনবাড়ি, রংটং। সেখানে গিয়েও তোয়া মাঝে মাঝেই মায়ের কাছে এসে, আদর করে যাচ্ছিল। বুঝিয়ে দিচ্ছিল, আর কেউ না থাকলেও তোয়া, মায়ের সাথেই আছে।

ক্ষমা করে দিয়েছিল রেহানা, আরও একবার সুযোগ দিয়েছিল সবুজকে। তারপর থেকে সবুজ কোনোদিন ভালো করে চোখ তুলে তাকাতে পারেনি রেহানার দিকে। মুখে বললেও, ক্ষমা রেহানা করেনি, তাই একটুও সুযোগ না দিয়ে একেবারে চলে গিয়েছিল রেহানা। আজ যখন তোয়া এসে সবুজকে জাহাঙ্গির সম্পর্কে কথাগুলো বললো, তখন আরও একবার হেরে গেল সবুজ, এবার মেয়ের কাছে। কি উত্তর দেবে সে? কি বলবে সে? কি বলা উচিৎ?

রেহানার তো সেদিনই চলে যাওয়ার কথা ছিল, রেহানা তো সবুজ এবং তাঁর পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে আর তোয়ার কথা ভেবে যায়নি। রেহানা সেদিন এই প্রশ্নটা রেখেছিল সবুজের কাছে, ‘তোমার মেয়ে যদি আজ থেকে কুড়ি বছর পরে, একই রকম একটা সমস্যা নিয়ে হাজির হয়, কি উত্তর দেবে তুমি?’ কোনো উত্তর দিতে পারেনি সেদিন। সে শুধু বলেছিল, ‘জানি না’।

কিন্তু তা যে এভাবে সত্যি হবে, তা স্বপ্নেও ভাবেনি সবুজ।

কি উত্তর দেবে সবুজ আজ তোয়াকে?

আজ সমস্ত কথা আবার মনে পড়ছে সবুজের। সমস্ত কিছু ফিরে ফিরে আসছে। জানলা দিয়ে বাইরে চোখ রাখলো, পাশের গাছ থেকে পাতা ঝরে পড়ছে, নীচে পাতা পড়ে আছে। সবুজ নয় হলদে বিবর্ণ পাতা।

মাথা নামিয়ে নিল, সবুজ। চোখ বন্ধ করে বললো ‘আরও একবার চেষ্টা করে দেখ,কথা বল, না পারলে বেরিয়ে আয়, তোর মা, আবার আমায় শাস্তি দিল’।

তারপর তোয়ার দিকে চোখ তুলে বললো, ‘ আচ্ছা, মা, একই দোষে একটা মানুষের কতবার শাস্তি হতে পারে?’ আর সমস্ত কিছু কি এভাবে ফিরে আসে?


0 Comments

Post Comment