পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

এলাটিং মেলাটিং

  • 04 October, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 2005 view(s)
  • লিখেছেন : হামিরউদ্দিন মিদ্যা
ধর্ম ধর্মের জায়গাতেই থাক,একে অপরের আনন্দে আমরা যদি সামিল না হই,তাহলে আমরা আপন হবো কী করে! পুজোর নিমন্ত্রণে বন্ধুর বাড়ি গিয়ে পেটপুরে খেয়ে আসি লুচি-বন্দে,মিস্টি,আবার ঈদের সময় আমি নিমন্ত্রণ করি বন্ধুদের। আমার বাড়িতে খেয়ে যায় লাচ্ছা,সেমাই,পোলাও। আমাদের মেলামেশায় কখনও তো 'আমরা-ওরা' শব্দটা আসে না! আবুল কাকার দোকানে যখন বামুন বাড়ির বউটা চিনি,মুসুরি,তেল,নুন কিনে নিয়ে যায়,তখন তো আমাদের কোনও ভেদাভেদ থাকে না।

আমাদের গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে দহিজুড়ি। দামোদরের পেট থেকে অজগর সাপের মতো এঁকেবেঁকে বেরিয়ে এসেছে যে ক্যানেলটা,তারই একটা ছানা  হল দহিজুড়ি,এখন এই আশ্বিনে দুই পাড় জুড়ে রাশি রাশি কাশফুল ফুটে আছে। কোনও উঁচু টিলার ওপর থেকে যদি তাকাও,দহিজুড়িকে এখন মনে হবে একটা সরু লিকলিকে রূপালী নদী পথ ভুল করে ঢুকে পড়েছে আমাদের জামবনী গাঁয়ে,আসলে সে নদী নয়,একটা নালা। আমাদের গাঁ ছাড়িয়ে  দহিজুড়ি চলে গেছে শিয়ালডাঙা,শিমুলতলী,বাঁকাচাদি,করচবনী হয়ে পাখমারার ডাঙাকে পাশ কাটিয়ে শালী নদীর গাবা পানে। পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশ এখন। মেঘগুলো চরে বেড়াচ্ছে গাই-বাছুরের মতো। প্রকৃতি জানান দিচ্ছে পুজো চলে এসেছে। মাঠে গেলে শুনতে পাওয়া যাবে দূর কোনও গাঁ থেকে  ভেসে আসা ঢাকিদের ঢাকের শব্দ। এখন মহড়া চলছে। আর কয়েকদিন পরেই তো পুজো। সব চলে যাবে দূর-দূরান্তে। দামোদর পেরিয়ে,অজয় পেরিয়ে,গন্ধেশ্বরী, দারকেশ্বর পেরিয়ে, যে যেখানে ডাক পাবে।

যে অঞ্চলটিতে আমার জন্ম,বেড়ে ওঠা,এখানে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের বাস খুব কম। দশটা গাঁ ঘুরলে হাতে গোনা একটি কী দুটি পাড়া পাওয়া যাবে। মূলত কৃষিপ্রধান এলাকা। ছেলেছোকরারা একটু বড় হলে পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে চলে যায় দক্ষিণ মুলুকে। কেরলা,চেন্নাই,পুনে। গাঁয়েঘরে কাজ নেই। চাষবাস করলেও আর পেট চলে না। বাইরে শুকনো টাকা। মেহনতের দাম পাওয়া যায়।

ঈদ, কুরবানি,আর দুর্গাপূজার সময় গাঁয়ের ছেলেরা ঘরে ফেরে। ব্যগ ভর্তি নানান জিনিস নিয়ে বাড়ি ফেরে। পরব পার করে আবার পাড়ি দেয়। এইভাবেই তো চলে আসছে বছরের পর বছর। ফলে এই পুজোর সময়টাই শুনশান শ্মশানপুরীর মতো গাঁ-গঞ্জ সব জেগে ওঠে। ঘরের ছেলেরা ঘরে ফিরলে মা-বাপের যেমন আনন্দ,পাড়াপড়শিরও আনন্দ।

আমাদের জামবনী ছোট গাঁ। দুর্গাপুজো হয় না। সামর্থ্যে কুলায় না। বাগদি,রায়,লোহার,কামারদের বাস। কার্তিক পুজো হয় ধুমধাম করে,কালীপুজোই পাঠাবলী। মনসার পুজো দেওয়া হয় প্রত্যেক পাড়ায় পাড়ায়। ডিজে বক্স আর মাইকে চটুল গানে মুখরিত গাঁ। মুখরিত না বলে কম্পিত বলায় ভালো। ক্লাবের ছেলেছোকরারা আয়োজন করে। নাচাগানা হয়।

                   দুর্গাপূজা হয় পাশের গাঁ মোলডাঙাতে। ও বাবারে বাবা,সে কী ধুমধাম করে পুজো! মোলডাঙার মাঠে মেলা বসে। খেলনা,মনোহারি,খাবার-দাবার থেকে নাগরদোলা,ম্যাজিক শো কী নেই! কী নেই! আমাদের ছোট থেকে আকর্ষণ ওই মেলাটির জন্যেই। পৌষ পরবে পীর পুকুরের পাড়ে পীরের মেলায় যেমন হিন্দু-মুসলিম  দুই সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়,দুর্গাপূজার সময় মোলডাঙার মেলাতেও সেই একই ভিড়। মেলায় তো মানুষকে মিলায়।

ঠোকাঠুকি যে হয় না,তা নয়। যেবারে রশিদ সেখের মেজো ব্যাটা ইউনুস ডুঁয়াশাহির ফকির পালের মেয়ে টুম্পাকে নিয়ে ভোরের ফিনকি  আলোয় বেরিয়ে পালিয়ে গেল ,আর ফেইসবুকে ডুয়েট ছবি ছেড়ে পোস্ট দিল — Living with Tumpa,  তখন আশেপাশের দুই সম্প্রদায়ের মানুষ বেশ উত্তাল হয়ে উঠেছিল। গাঁয়ে ফিরে দেখ তোরা,দুটোকে কেটে গাঙের জলে ভাসিয়ে দেব। হিন্দু-মুসলিমে প্রেম!

তখন দুর্গাপূজারই সময়। মোলডাঙার মেলাটাই দোকান বসাল না হাসিবুল,আবুল,সাবেদরা। গাঁয়ের ইমানদার মোড়লরা ফতোয়া দিয়েছিল,কুনু মুসলমান উয়াদের পরবে যাবি নাই। কেউ গেলে ঠ্যাং ভেঙে দিবো। কয়েকদিন পেরতে না পেরতেই পরিস্থিতি হালকা হল,মিয়া-বিবি রাজী তো কী করবে কাজী! পুজোর আনন্দটাকে তো মাটি করে দেওয়া যায় না। গ্রাম ষোল-আনার ডাক হল। সেখানে মীমাংসা হল,ফকির পালের মেয়েকে তো কেউ জোর করে নিয়ে যায়নি,নিজের ইচ্ছেতে গেছে,আর রশিদের ব্যাটাকেও কেউ শিখিয়ে দেয়নি। উয়ারা কপত-কপতি ঘর বেঁধেছে সুখে থাকবেক বলে,তো থাকুক। আমরা কেনে নিজেদের মধ্যে ফুটোফুটি,মারামারি করব! কথাটাই সবাই সায়  দিল। মেলাকমিটির হেড ধীরেন মন্ডল বলল,কোনও উৎসবে একা কখনও আনন্দ হয় না। তুমরা যদি তুমাদের ছেলেদের মেলায় দোকান না বসাতে দাও,না যাও,তাহলে মেলা জমবেক কী করে! এইভাবে কী বাস করা যায়!

মোলডাঙার মেলার কথা বলতে গেলে কথা ফুরাবে না। মহালয়া থেকেই বসে যায় দোকানপাট। দুর্গাপূজার অনেক খরচ বলে সব গাঁয়ে পুজা হয় না। আশেপাশের দশ বারোটা গাঁয়ের মধ্যবর্তী হল মোলডাঙা। মোলডাঙার পুজো প্যান্ডেলের থিমও হয় নানান ভ্যারাইটির। একবারের থিম হয়েছিল 'জঙ্গল রানী'। গেট থেকে শুরু করে পুজো মন্ডপ পর্যন্ত কৃত্তিম শাল গাছের বন তৈরি করা হয়েছিল। শালবনের নিচে ময়নাকাঁটা,লতা পলাশ,বেঁচঝোপ।ঝোপে জোনাক জ্বলা দিপিক দিপিক লাইট। দু'পাশে জঙ্গল,মাঝে সিঁথির মতো সরু পায়ে চলার পথ। সেই বন পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে পৌঁছাতে হবে পাহাড়ে। পাহাড়ের চুঁড়ায় পাথরের চটানের ওপর মা দূর্গা দাঁড়িয়ে। লোক ভেঙে পড়েছিল সেবার। ব্লকের সেকেন্ড হয়েছিল মোলডাঙার মন্ডপ।

ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। মহালয়ার আগেই যখন মন্ডপের খুঁটি পোতা হত। প্যান্ডেল বানানোর কাজ শুরু হত,তখন পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে টায়ার চালিয়ে চালিয়ে চলে যেতাম মোলডাঙার মাঠে। মোলডাঙার মাঠের দক্ষিণ ধারে একটা ছাতিমগাছ। আটচালার ভেতর স্বপন পাল ঠাকুর গড়ত। আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্বপনকাকার ঠাকুর গড়া দেখতাম। সেই যখন থেকে খড়ের ম্যাড়ের ওপর এক মেটের কাজ শুরু হত,তখন থেকেই আমাদের আনাগোনা লেগে থাকত। স্বপন পালের মতো নিপুণ কারিগর এই এলাকায় দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। হাতে জাদু আছে লোকটার।

হয়তো খাঁ খাঁ রোদেলা দুপুর। বাড়ির সবাই ভাতঘুম দিচ্ছে,চুপিচুপি উঠে চলে গেছি মোলডাঙার মাঠ। কোনও ক্লান্তি ছিল না। হাঁ করে চেয়ে  বসে থাকতাম স্বপনকাকার দিকে। একটা খড়ের ম্যাড় কীভাবে মাটি আর জলের সংস্পর্শে শিল্পীর হাতের মুনশিয়ানায় একটা ঠাকুর হয়ে যায়,তা লক্ষ্য রাখতাম। প্যান্ডেলপার্টির লোকরা খুব ব্যস্ত। কত উঁচুতে চেপে কাজ করছে! কেউ হয়তো কাজের ফাঁকে নেমে নিচে বিড়ি ফুঁকছে ফকফক করে। কাছে গিয়ে বকাতাম লোকটাকে,এবার কী থিম হবে কাকা? বিরক্ত হত আমাদের কথা শুনে,আর কয়েকদিন পরেই তো পুজো, তখনই তো দেখতে পাবি। এই রোদে গরমে খামোকা বকাস কেনে! খেয়েদেয়ে কাজপাট নাই তুদের!

আমরা ধমকানি খেয়ে সরে যেতাম। কিন্তু চলে যেতাম না। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই দেখতাম। আর দিন গুনতাম ক'দিন দেরি আছে পুজোর। মেলায় কী কী খেলনা কেনা হবে,এবারে বিশেষ নতুন চমক কী থাকবে—সেসব নিয়ে নানান কথা। আর আমরা নিজেরাই তর্কাতর্কি লেগে যেতাম। আমার বড়কাকা আবদুর জমির আলি ছিল নামাজি। রোজ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত। সবসময় বাড়ির ছোটদের ধর্মীয় অনুশাসনে বেঁধে রাখতে চাইত। আর আল্লা-খোদার কথা বলে,নানান হাদিস ঝেড়ে আমাদের ভয় খাওয়াতো। পুজোর সময় বলত,ঠাকুর দেখতে যাস না খোকা,আল্লাহ গোনাহ দিবেক,জাহান্নামে চলে যাবি। সেরেকি গোনাহ ওগুলো। জমির কাকাকে খুব ভয় করতাম। কাকার হাত থেকে বাঁচাত দাদো। গন্ডী ছাড়িয়ে আমাদের উদ্ধার করত। দাদো নামাজ পড়ে,তবে গোড়া মুসলিম নয়। দাদো ধমকে উঠত বড় কাকাকে,তুই বাপ যে পথে চলছিস চল,ওই ছোট ছেলেগুলোর মাথায় ওসব ঢুকাস না। এখন ওদের কচি বয়েস। আনন্দ ফূর্তি করবেকনি! আজ ক'বছর নামাজ পড়ে হাজিগিরি ফলাতে আইচিস,তুর ছেলেবেলার কথা ভুলে গেলি! বড়কাকা 'তওবা তওবা তওবা! আস্তাগফিরুল্লাহ! আস্তাগফিরুল্লাহ! বলে রেগে বেরিয়ে যেত। দাদোর মুখের ওপর আর কোনও কথা বলার সাহস ছিল না। আমরা হাসতাম। আমরা বলতে চাচাতো ভাই,শরিফুল,বড় ফুপুর ছেলে খাইরুল,আর আমি। সবসময় আমরাই তো ছিলাম একে অপরের ছায়া সঙ্গী!

দাদো বলত,উয়ার কথায় কান দিস না বাপ। ঠাকুর দেখলে কখনও পাপ হয় রে! তুরা তো পুজো দিতে যাচ্ছিস নাই। ঠাকুর দেখবি,মেলা দেখবি,নাগরদোলায় চড়বি। ধর্ম ধর্মের জায়গায় থাকবেক—আনন্দ,ফূর্তি,শখ,আহাল্লাদ কিছুই থাকবেক নাই তা বলে! আমাদের মহরমে,পীর পুকুরের মেলাতেও তো ওরা আসে। পীরের সিন্নি খাই  লাইন দিয়ে বসে। তাতে কি পাপ হয়! দাদোর ওসব কথার মূল্য তখন বুঝতাম না। তবে মনে সাহস পেতাম,দাদোর মতো এত অভিজ্ঞ একটা মানুষ যখন বলছে,ঠাকুর দেখতে গেলে,মেলা দেখতে গেলে নিশ্চয়ই পাপ হবে না। বিকাল হলেই আমরা যে যার নতুন ড্রেস আছে,পরে রেডি থাকতাম। ফাইরুল ছিল বড়,ওর নিজের সাইকেল ছিল। ব'কাটা লেডিস্ সাইকেল। আমাকে আর শরিফুলকে নিয়ে যেত দাদো,কখনও আব্বা,ছোটকাকা। কত আনন্দই না হত!

এখনও মোলডাঙাতে দুর্গাপুজো হয়,তবে আর আগের মতো এত ধুমধাম করে নয়। ইদানীং গ্রামগুলোর ভেতরে ভেতরে একটা ভাঙন ধরে  গেছে। একই গ্রামে নানান পার্টি,নানান দল,নানান মত। রামপুরেই দু'দুটো বড় বড় মণ্ডপে পুজো হয়। পাশাপাশি ধুলাই,কামারগড়িয়া,রাঙামাটি —ওদিকে হামিরহাটি,রপটগঞ্জ কেউ আর বাদ দিচ্ছে না। ক্লাবে পুজোর অনুদান ঢুকছে,সাহসী হচ্ছে ছেলেপুলেরা।

ধর্ম ধর্মের জায়গাতেই থাক,একে অপরের আনন্দে আমরা যদি সামিল না হই,তাহলে আমরা আপন হবো কী করে! পুজোর নিমন্ত্রণে বন্ধুর বাড়ি গিয়ে পেটপুরে খেয়ে আসি লুচি-বন্দে,মিস্টি,আবার ঈদের সময় আমি নিমন্ত্রণ করি বন্ধুদের। আমার বাড়িতে খেয়ে যায় লাচ্ছা,সেমাই,পোলাও। আমাদের মেলামেশায় কখনও তো 'আমরা-ওরা' শব্দটা আসে না! আবুল কাকার দোকানে যখন বামুন বাড়ির বউটা চিনি,মুসুরি,তেল,নুন কিনে নিয়ে যায়,তখন তো আমাদের কোনও ভেদাভেদ থাকে না। হারু মুচির চা-চপের দোকানে সকাল বিকাল মাচায় ঠ্যাং দুলিয়ে দুলিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি বদরুল মোল্লা,ছবির মোল্লারা যখন চা খায়,হারু মুচির বউয়ের হাতে গড়া চপ-ফুলুরিতে কামড় বসায়,তখন তো আমাদের ভেদাভেদ থাকে না। নিতাই বোষ্টম যখন জরিনাদের আঙিনায় দাঁড়িয়ে গান ধরে- ও আমার কালাপাখি....জরিনা বাটি করে চাল দিয়ে যায় ঝুলিতে,তখন তো মুসলমান বাড়ির চালের ভাত খেতে জাতের কথা আসে না,মাঠে ধান কাটার সময়,ধান রোয়ানোর সময় যখন দল বেঁধে কাজ করি আমরা,আলে বসে,গাছতলায় বসে জল খাই,ভাত খাই,তখন তো আমাদের কোনও ভেদাভেদ থাকে না। তাহলে বিভেদের বিষ কারা ঢোকাচ্ছে আমাদের মনে! আমরা কি তাহলে কোনও চোরা শিকারীর পাতা ফাঁদে বোকা ডাউকের মতো পা দিয়ে ফেলছি!

 

এই লেখাটি এই সময় পত্রিকায় প্রকাশিত।

ছবি পার্থ দাশগুপ্ত

0 Comments

Post Comment