বাঙালি আন্তর্জাতিক হবে । পুঁজি এলে অনেক বেকার ছেলে কাজ পাবে । পাড়ার ক্লাবে মানুষের ঢল নামবে । আমরা চারদিন সব ভুলে সেলিব্রেট করব আধুনিক দুর্গাপুজো। অথচ অনেককিছু করা যে বাকি ছিল । সে হিসেবের খাতাটা সবার মত এই ক্লাবগুলিও হারিয়ে ফেলল । এই ভাবেই বাঙালী দুর্গাপুজো পালন করতে শিখছে ইদানীং
তাই বাঙালির মেগাফেস্টিভলে এখন আর অপেক্ষা বলে কিছু নেই । দশমীর ঘাটফেরত সম্পাদক রেজেলিউশন এ সিদ্ধান্ত নেন আসছে বছর আরও বিগ বাজেট । থিম মায়ার সভ্যতা । তাই সেদিন থেকেই থিমথিসিস আর নেটজার্নালের চক্করে চলল আগামীর হোম ওয়ার্ক । কেননা পুজোতো আরও মস্তি আরও হুল্লোড়কে আ্যকটিভ করতেই এ প্রয়াস । ব্যাস সিনেমা সিমেন্ট গারমেন্ট কিচ্ছু বাদ রইলনা। সবার টার্গেট হয়ে গেল আমার আপনার সেই পুজো। বাঙালির অন্তরঙ্গ প্রাণের পুজোও ডোমিনেশনে চলে গেল। বিপুল পুঁজির স্রোতে বিক্রি হয়ে গেল বারোয়ারি সার্বজনীন কনসেপ্ট। তাই চাঁদা ব্যাপারটাই উঠে গেল। চালু হল ডোনেশন।আর চারদিন মন্ডপ বেচে কিছু বাড়তি রোজগারের ধান্দায় ক্লাবের কোরকমিটি স্পিকটি নট হয়ে রইলেন। কি হবে ? ক্লাবের পশ্চিম দিকে ফাঁকা মাঠে জিমনেশিয়াম হবে। সদস্যদের আরও সুখে রাখতে চারটি এসি কেনা হবে।আর ক্লাবের আসবেস্টাস ছাদ সরিয়ে চারতলা হবে। সিম্পল। আর এটা বুঝতে আপনার যদি অসুবিধে হয়, তবে আপনি বাঙালী নন। ওরা এভাবেই স্টেটমেন্ট দিয়েছিল থিম পুজোর স্বপক্ষে। আর এভাবেই আমাদের পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যকে নদীর জলে তর্পণ সারতে বাধ্য করেছিল থিম। মাও মায়ার সভ্যতার অনুকরণে। আর এ মাকে দুর্গামা আপনার না মনে হলে আপনি ব্যাকডেটেড। পোস্টমর্ডান কালচার নিয়েআপনার কোন পড়াশুনো নেই। আপনার শিক্ষাদীক্ষা কম। বিভিন্ন লজিক দিয়ে ওরাই যে সঠিক আপনাকে বুঝিয়ে দেবে। আপনিও সেইমত নীরব হয়ে অষ্টমীর কাকভোরে ঘুমিয়ে পড়বেন ।
এটাই থিম । আপনার পরিচিত গন্ডি ছাড়িয়ে একটু অন্য মত ভাবা প্র্যাকটিসের অভ্যাস । ভূবনায়নের ইনফ্লুয়েঞ্জায় নিজেদের আপটুডেট রাখার তরিখা।
আর সেকারণেই থিমের সাইড এফেক্টস্বরূপ বিগবাজেটের রেজেলিউশনকে একটু পুণ্যের জলে ধুতে, সচেতন নাগরিকের মনে একটু সেন্টিমেন্ট জাগ্রত করতে সবার মত এই থিমাররাও বৃদ্ধাশ্রম ট্যুর । অরফ্যানদের জামা।ফুটে সংসারপাতা লোকদের কম্বল এবং ফোকাস ঘুরিয়ে দেবার জন্য আরও যা যা করা উচিত সব করবেন । সব । সব ।সব ।
বাঙালি আন্তর্জাতিক হবে । পুঁজি এলে অনেক বেকার ছেলে কাজ পাবে । পাড়ার ক্লাবে মানুষের ঢল নামবে । আমরা চারদিন সব ভুলে সেলিব্রেট করব আধুনিক দুর্গাপুজো। অথচ অনেককিছু করা যে বাকি ছিল । সে হিসেবের খাতাটা সবার মত এই ক্লাবগুলিও হারিয়ে ফেলল । লকআউট হওয়া হারান কাকুর আগামী কেমোর জন্য ছলাখ প্রয়োজন, সম্পাদক জানেন না । বিরাজবাবু পয়সার অভাবে দুবেলার খাবারটাও ঠিকঠাক পাননা, সম্পাদক জানেননা । দরজী আলতাফ চাচার মেয়ে কত স্ট্রাগল করে বোস ইনস্টিটিউটে, সম্পাদক জানেন না । সম্পাদক জানেন না এই ক্লাবের ফাউন্ডার মেম্বার অরনিদা, বিভূ জ্যাঠু,স্বরাজ কাকুরা ভালো আছেন কিনা । পাড়ার একমাত্র নাইটস্কুলে পড়তে আসা লেবারদের কোন সমস্যা আছে কিনা । পুজোমন্ডপের অদূরে বিস্তৃত বস্তীতে সদ্যজন্মানো বাচ্চাগুলো ঠিকঠাক ভ্যাক্সিন পাচ্ছে কিনা ।
না ।এসব প্রশ্নের জবাব একটা রাজ্যের ক্রাউডপুলার কোন দুর্গাপুজো কমিটির সম্পাদকের কাছে জানতে চাওয়া ঠিক নয়।ওনার এসব খোঁজ নিয়ে কি হবে ? তাই কমিশনারের ফোন নম্বর দিয়েই দায়িত্ব সেরেছিলেন মায়ার সভ্যতায় আলো ফেলা মানুষটি। কর্পোরেট সংস্থা বলেছিল ওদের গারমেন্টস পরেই মাকে মন্ডপে ডিসপ্লে করতে হবে । শেষমেশ হিন্দুত্বের ভয় দেখিয়ে কটা ম্যানেকুইন রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল মায়ের পাশে।
আবার নিরুত্তর থেকে গেলাম আমরা । আমাদের সব মুখর মৌন হয়ে গেল বহুজাতিক সংস্থার অফারে।পাড়ার সবার বাড়ির বারান্দা এমনি এমনি রং করে দেবে তারা । বলেছিল পেইন্ট কোম্পানি । প্রত্যেক ঘরের স্টুডেন্টকে তার স্কুল ইউনিফর্ম গিফট দেবে, বলেছিল গারমেন্টস কোম্পানি । শর্ত দিয়েছিল পুজোর কদিন তাদের ব্যানার , ফ্লেক্সে ঢেকে যাবে বাড়ি । শুধু ইন আউটের বন্দোবস্ত থাকবে । কেউ প্রোপোজাল রিফিউজ করেনি ।
এটাই এখন আমাদের শ্রেণী চরিত্র । উপড়ি কিছু পেলেই হল।নীতি আদর্শ ডাস্টবিনে ছুঁড়তে একমিনিট।
আমরা আর পুজোর মধ্যে রইলাম না।পুজোটা নীরবে আ্যমিউসমেন্ট হয়ে গেল । শুধু বিনোদন । দশমীর সিঁদুর মুখের সেরা সেলফি যাবে মিশরট্যুর । অষ্টমীর সেরা র্যাম্পার পাবে ডায়মন্ড রিং। অসুরের মত সেরা কুৎসিত পাবে একবছরের রান্নার মশলা । গণেশের মত দেখতে সেরা হোঁতকা পাবেন হারবাল আইটেম । আর কার্তিকের মত সেরা হ্যান্ডসাম পাবেন ফোরনাইট মন্দারমণি ট্রিপ । এই তো এখন আমাদের শ্রেণী চরিত্র ।
এমনকি আমরা দেবীমাকেও ভাগ করে দিলাম।নামি ভাস্করের বড়মার জন্য এলিট মন্ডপ । আর চারদিন কোনমতে জলবাতাসা অঞ্জলী পাওয়া দুই বাই চারফুটের ছোটমা পড়ে রইলেন ক্লাব ঘরে । হালকা আলোয় বোঝা যেত মা ভাল আছেন।মা তো ! ওনার খারাপ থাকলে চলে ? চারদিন শেষে সবার অলক্ষ্যে বাসি ফুলবেলপাতার অলঙ্কারে মা উঠে পড়েন ট্রাকে । আজ ওনার বিসর্জন । ছোটমা এলেন । ছোটমা চলে গেলেন । কেউ জানতে পারলেন না । একটা নিভৃতদিনমালা উৎসবের পঞ্জিকায় জায়গা করে নিয়েছিল এভাবে । আমরা কিছুই জানিনা।আমরা জানতে পেরেছিলাম শুধু বড়মাকে ছয়গুণ দামে এ এস আই এর কাছে নিলাম করেছিল ক্লাবকমিটি । এটাই প্রফিট।এ ব্যবসায় লস বলে কিছু নেই । পুরোটাই লাভ । শর্ত একটাই লোভকে সংবরণ করা যাবেনা । দীর্ঘজীবী হোক বাঙালির উৎসব বিপ্লব । ততক্ষণ দেখতে থাকুন স্টারপুজোর ভিডিও । যেখানে আমার সেরা উৎসব সাবলম্বী হয়ে উঠছে রাত জ্যোৎস্নায় ।
তবে কি এটাই বাঙালির লাস্ট আপডেট ।এই চরিত্র নিয়েই আমরা ওয়ালে স্ট্যাটাস শেয়ার করব।পুজো বদলে যাচ্ছে--বিষয়ের ডিবেটে শেষ লজিক দিয়ে কাউন্টার করব । শুধু ঘরে ফিরে নিজেদের আয়না গুলোকে আরও অন্ধকারে সাজিয়ে দেব । আর সব শুনে সব বুঝেও চিৎকার করে বলবো, আবার এসো মা।আসছে বছর আবার হবে ।