শেষ আটের লড়াইয়ের প্রথম দুটি ম্যাচই বুঝিয়ে দিল বিশ্বকাপের প্রতিদ্বন্দ্বিতা কোন পর্যায়ে পৌছাতে চলেছে। দুটি ম্যাচই গড়ালো টাইব্রেকার পর্যন্ত এবং রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ের পর কাতার বিশ্বকাপে লাতিন আমেরিকার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখল লায়োনেল মেসি ও তার আর্জেন্টিনা দল।
লাতিন আমেরিকীয় ফুটবল শিল্প বনাম বনাম ইউরোপীয় ঘরানার হিসাবভিত্তিক যান্ত্রিক ফুটবলের প্রতিযোগিতা ছিল দুটি ম্যাচেই। ফলাফল হিসাবে কোপা চ্যাম্পিয়নরা যেখানে আরও একধাপ এগোলো বিশ্বকাপ জয়ের দিকে সেখানে কোপা রানার্সরা এবারের মত বিদায় নিয়ে ফিরে চলল স্বদেশের উদ্দেশ্যে। বিগত রাশিয়া বিশ্বকাপ রানার্স ক্রোয়েশিয়া যে কতটা লড়াকু হতে পারে তার পরিচয় পাওয়া গেল প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালে এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামে। প্রথমার্ধে সমানে সমানে লড়াই হলো কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধ থেকে সেলেকাওরা ম্যাচের রাশ নিয়ে নেয় নিজেদের পায়ে। ক্রোয়েশিয়া ছোট ছোট পাসে স্কোয়ার এবং ব্যাকে খেলে ব্রাজিলের চিরাচরিত আক্রমণের রীতিকে ভাঙার চেষ্টা করছিল প্রথমার্ধ থেকেই। দ্বিতীয়ার্ধে তিতের ছেলেরা তার জবাব হিসাবে নিজেদের মধ্যে আরও বেশি পাস খেলে হঠাত গতি বাড়িয়ে কাঁপুনি ধরানোর চেষ্টা করল ক্রোয়েশিয়ার রক্ষণভাগে। দারুণ খেললেন এই সময় ক্রোট গোলরক্ষক ডমিনিক লিভাকোভিচ। আত্মবিশ্বাস অটুট রেখে বহুবার দলের পতন রক্ষা করলেন। তবে এই ম্যাচে আবার জ্বলে উঠলেন ক্রোয়েশিয়ার অধিনায়ক লুকা মডরিচ। কাতার বিশ্বকাপে আগের ম্যাচগুলোয় সেভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি মডরিচ, কিন্তু সময়মতো ফর্মে ফিরে এলেন। পাশাপাশি বর্ষীয়ান পেরিসিচ এদিনও ছিলেন অসাধারণ। নেইমার যথেষ্ঠ চেষ্টা করলেন, নিজের ফুটবল প্রতিভা চেনালেন কিন্তু শেষরক্ষা হল না। অথচ ব্রাজিলকে ১০৫ মিনিট আটকে রাখার পর ক্রোয়েশিয়া ডিফেন্স প্রথমবারের জন্য হার মানল সেই নেইমারের ফুটবল প্রতিভার কাছেই। দুই ডিফেন্ডারের মধ্যে থেকে ধনুকের ছিলা থেকে বেরনো তীরের মতই ছিটকে বেরিয়ে গোল করলেন নেইমার। দশ নম্বর জার্সির যোগ্য উত্তরসূরি হিসাবে এই গোলের সাথেই ফুটবল সম্রাট পেলের করা ৭৭ আন্তর্জাতিক গোলের রেকর্ড ছুঁয়ে ফেললেন নেইমার। তখন মনে হচ্ছে জোগো বোনিতোর ছটা বিচ্ছুরিত হতে শুরু করেছে আর ব্রাজিলের শেষ চারে শুধু সময়ের অপেক্ষা তখনই একেবারে অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস পতন ঘটালো ব্রাজিলের। দুর্দান্ত একটা প্রতি-আক্রমণ থেকে ১১৭ মিনিটে ব্রুনো পেটকোভিচ গোল করে সমতা ফেরালেন। কার্যত গোলের মধ্যে বেশি শট রাখতে পারেনি ক্রোয়েশিয়া, ব্রাজিলের পেনাল্টি বক্সে তারা খুব একটা স্বচ্ছন্দ ছিল না কিন্তু যে সুযোগটা তারা পেল সেটাকেই ষোলো আনা কাজে লাগিয়ে ম্যাচে ফিরে এল। দীর্ঘ এই ম্যাচে ব্রাজিল খেলোয়াড় পরিবর্ত করতে করতে এমন জায়গায় চলে গেল যে টাইব্রেকারের সময় তাদের বেশিরভাগ মাঠে থাকা খেলোয়াড়ই অনভিজ্ঞ আর অন্যদিক থেকে এটা পরিষ্কার যে টাইব্রেকারকে নক-আউটে আলাদাভাবে গুরুত্ব দেয় ক্রোয়েশিয়া। এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামে জলাটকো ডালিচের ছেলেরা যেখানে একশো শতাংশ টাইব্রেকার পেনাল্টি শট গোলে পরিণত করল সেখানে ব্রাজিল গোল করতে পারল মাত্র দুটি। বিশ্বকাপ রানার্সরা অগ্রবর্তী হয়ে গেল সেমিফাইনালের দিকে।
অন্যদিকে লুসেইল স্টেডিয়ামে চিত্রনাট্য শুরু থেকেই ছিল মেসির তৈরি। এলবিসেলেস্তে জার্সি শুরু থেকেই ছিল উজ্জ্বল। আর্জেন্টিনার সমর্থকদের বর্ণময় উপস্থিতি ও দলের জন্য সমানে গলা ফাটানো আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের উদ্বুদ্ধ করে চলেছিল দারুণভাবে। আর সর্বোপরি মেসি, তার বিদায়ী বিশ্বকাপে এই ট্রফিকে বুয়েনস এয়ার্সে নিয়ে যেতে মরিয়া তিনি। প্রথমার্ধের ৩৫ মিনিটে নাহুয়েল মোলিনা তার জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক গোল যেটা পেলেন সেটা আসলে মেসি ম্যাজিকেরই চূড়ান্ত ফল। বিপক্ষের পেনাল্টি বক্সের ডানদিকে থেকে ঢুকে এসে বাঁপায়ের শট নেওয়া বা থ্রু বাড়ানোয় মেসি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সেইভাবেই বাড়ানো মেসির থ্রু-পাস থেকে গোল করলেন মোলিনা। নেদারল্যান্ডসের মেমফিস আর গাকপো সেভাবে কিছু করতে পারলেন না। কিন্তু দারুণ খেললেন আর্জেন্টিনার আকুইনা। রক্ষণ থেকে আক্রমণে সমানে গতি বাড়িয়ে ওঠানামা করে গেলেন। তবে কার্ড সমস্যায় তাকে সেমিফাইনালে পাচ্ছেন না কোচ লায়োনেল স্কালোনি। দ্বিতীয়ার্ধে আর্জেন্টিনাকে পেনাল্টি আদায়ও করে দিলেন তিনি আর আর্জেন্টিনীয় অধিনায়ক পেনাল্টি থেকে গোল করতে এযাত্রা ভুল করেননি। ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে থাকা অবস্থায় যখন মনে হচ্ছে আর্জেন্টিনা হেসেখেলে শেষ চারে যেতে চলেছে তখনই ছন্দপতন। ডাচেরা দুর্দান্তভাবে ফিরে এল ম্যাচে। যিনি ফেরালেন তিনি পরিবর্তিত খেলোয়াড় দীর্ঘকায় ওউট ওয়েঘর্স্ট। খেলার আশি মিনিটের পর থেকে যেন জ্বলে উঠল লুই ফ্যান গালের ছেলেরা। ওয়েঘর্স্টের প্রথম গোল ম্যাচের ৮৩ মিনিটে দুর্দান্ত হেড থেকে। তারপরেও আর্জেন্টিনা তাদের এক গোলের অগ্রগমনকে বজায় রেখেছিল ইনজুরি টাইমের শেষ মিনিট পর্যন্ত। শেষ বাঁশি বাজার ঠিক আগের মুহুর্তেই গোল করে ম্যাচে সমতা ফিরিয়ে ম্যাচকে অতিরিক্ত সময়ে নিয়ে যান ওয়ঘর্স্ট। অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্ধে কিছুটা এলোমেলো খেলা হলেও দ্বিতীয়ার্ধে আর্জেন্টিনার আক্রমণে নাভিশ্বাস উঠে যায় ডাচ ডিফেন্সের। এমনকি অতিরিক্ত সময়ের শেষ মিনিটেও এনজো ফার্নান্ডেজের শট পোস্টে লেগে প্রতিহত হয়। তবে এই সময় ডাচ গোলরক্ষম আন্দ্রিয়েস নপ্পার্ট কয়েকটি দুর্দান্ত সেভ না করলে খেলা পেনাল্টি শুট-আউট পর্যন্ত গড়ায় না। তবে টাইব্রেকারে পেনাল্টি শুট-আউটে নায়ক হলেন আর্জেন্টিনার গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। ডাচ অধিনায়ক উইরজিল সহ নেদারল্যান্ডসের প্রথম দুটি পেনাল্টি শটই পরপর বাঁচিয়ে দেন মার্টিনেজ। প্রসঙ্গত দুই দলের গোলকিপারই খেললেন ২৩ নম্বর জার্সি পরে। মেসি টাইব্রেকারেও পেনাল্টি থেকে গোল করলেন। একমাত্র এনজো ফার্নান্ডেজই এলবিসেলেস্তে জার্সিতে পেনাল্টি মিস করলেন আর তখন নেদারল্যান্ডস আবার কিছুটা ম্যাচে ফিরে এসেছিল কিন্তু আর্জেন্টিনার আরেক মার্টিনেজ ২২ নম্বর জার্সিধারী এল মার্টিনেজ গোল করার সাথে সাথেই ডাচ দলের বিদায় নিশ্চিত হয়ে যায়। অবশেষে ফ্যান গালের দলের অশ্বমেধের ঘোড়াকে থামিয়ে বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে যাওয়ার ছাড়পত্র পেল আর্জেন্টিনা। মেসি আরও একধাপ এগোলেন ফিফা বিশ্বকাপের দিকে। তবে এবারে তাদের প্রতিপক্ষ অদমনীয় লড়াকু ক্রোয়েশিয়া, যারা পরিকল্পিত ফুটবল খেলে ছিটকে দিয়েছে পেলের দেশকে এবারের মত বিশ্বকাপের লড়াই থেকে। এবারে মারাদোনার দেশের সঙ্গে তাদের লড়াই কোন মাত্রায় পৌছায় তা দেখা যাবে ১৩ ডিসেম্বর প্রথম সেমিফাইনালে। তবে শেষ চারের লড়াই যে হবে আরও তীব্র তা বলাই বাহুল্য।