পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব: করোনা ষড়যন্ত্র ২

  • 22 August, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1418 view(s)
  • লিখেছেন : ভাস্কর চক্রবর্তী
চোখের সামনে আর যা যা হচ্ছে! সরকারী ক্ষেত্রগুলো জলের দরে সাম্রাজ্যবাদী সংস্থাগুলোর হাতে বিকিয়ে যাবে, সরকারী জনকল্যাণের কাজ বন্ধ হবে, শ্রমজীবি মানুষের অধিকার বলে কিছু থাকবে না, শ্রমজীবি মানুষের অধিকারের পক্ষে যারাই আওয়াজ তোলার চেষ্টা করবে তাদেরই কণ্ঠরোধ করা হবে, না পারলে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে, জনগণের একেকটা অংশকে বেনাগরিকিকরনের মধ্যে দিয়ে সব রকম রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হবে, জাতপাত, এবং ধর্মের ভিত্তিতে জনগণকে বিভাজিত, অবদমিত করে রাখা হবে।

আচ্ছা, সাম্রাজ্যবাদীরা কি এতই বোকা যে তারা এটা বুঝতে পারেনা যে তাদের এই কাল্পনিক গণশত্রু খাড়া করার প্রকল্প সাধারন মানুষেরা কেউ কেউ বুঝে যেতে পারে ? একেবারেই তা নয়। এই কারনেই তাদের হাতে আছে আর একটা অস্ত্র; ষড়যন্ত্রের তত্ত্বের অস্ত্র। তাদের বক্তব্য হল কিছু মানুষ সব সময়েই, প্রাকৃতিক এবং সামাজিক স্বাভাবিক চলনের মধ্যে ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পায়। অর্থাৎ, ষড়যন্ত্র বলে কিছু নেই, হয়ও না করোনা ষড়যন্ত্র বলে কিছু থাকার তো প্রশ্নই নেই। কিছু মানুষ শুধু এই গন্ধ পেয়ে এর পেছনে ছুটে মরে।

এই তত্ত্ব অনুযায়ী মেনে নিতে হয় যে ভারতে বৃটিশ রাজ কায়েম করার সময়ে, বিশেষত সিরাজুদ্দৌলার বিরুদ্ধে কোনও ষড়যন্ত্র হয়নি, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যকে বৃটিশ পদানত করদ রাজ্যে পরিণত করতে গিয়ে কোনও সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র হয়নি, ভারতে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন দমন করতে গিয়ে কোনও ষড়যন্ত্র হয়নি, বাংলা ও পঞ্জাব ভাগের সিদ্ধান্তে কোনও ষড়যন্ত্রের আভাসমাত্র নেই, ১৯৪৩ সালের বাংলার মন্বন্তর কোনও ষড়যন্ত্রের ফলাফল নয়, সুভাষ বসুকে নিয়ে কোনও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র হয়নি, জার্মানীতে Holocaust এর সময়ে কোনও ষড়যন্ত্র হয়নি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বা অন্য কোনও যুদ্ধে কোনও ষড়যন্ত্র হয়নি, ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে কোনও সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব ছিল না, উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়ে (বিশেষত ইরাকের হাতে রাসায়নিক মারনাস্ত্রের মজুতের বিষয়ে) কোনও সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র ছিল না, তালিবান এবং অন্যান্য ধর্ম ভিত্তিক সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর উৎপত্তিতে সাম্রাজ্যবাদের কোনও হাত নেই, ৯/১১ এর ঘটনায় সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের গন্ধ খোঁজার চেষ্টা হল হাস্যকর, ইত্যাদি। সবই হয়েছে স্বাভাবিক সামাজিক চলনে!

আসলে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির যে বিশাল প্রচার শক্তি, এর ব্যপ্তি এতই বেশী, সমাজের প্রতি রন্ধ্রে এর এত স্বাভাবিক যাতায়াত, যে এর প্রভাব থেকে বেরোনো খুবই কঠিন কাজ। মননে যদি আমরা এর বিরুদ্ধে সজাগ না থাকি, তবে এর নাগপাশে জড়িয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক এবং সাধারন ঘটনা। সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বায়িত জালের মধ্যে বাস করতে করতে, আমরা অনেকেই একে প্রশ্ন করতে, এমনকি সন্দেহ করতেও ভুলে গেছি। এর বিরুদ্ধে কোনও বিরুদ্ধ শিবির নেই, এর বিরুদ্ধে লড়াই যারি নেই, একতরফা এর প্রচারের মধ্যে থাকতে থাকতে, আমরা এর শেখানো ভাবনা গুলোই ভাবছি, ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এ এক জব্বর মগজ ধোলাই। আর এই মগজ ধোলাই যন্ত্রের নাম হল আন্তর্জাতিক গনমাধ্যম, যাকে ছাড়া আমরা আবার চলতে পারিনা এক পাও। কতটা সফল এই সাম্রাজ্যবাদী মগজ ধোলাই তা বোঝা যায় যখন দেখি যে সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে কথা না বলে যারা দিন শুরুই করে না, তারাও অনেকে বলে যে সাম্রাজ্যবাদ এতটা নৃশংস নয়, বা এতটা বোকা নয় যে তারা ভাইরাসের মতো কিছু নিয়ে মানুষ কে আক্রমণ করবে। যে ভাইরাসের সংক্রমণে মানুষ ঝাড়ে বংশে নিপাত যেতে পারে। কেননা, ভাইরাস ছড়াতে শুরু করলে তাকে নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা আর কারুর থাকে না। এটা একটা ফ্র্যাঙ্কেন্সটাইন! আর এই ভাইরাসকে ল্যাবরেটরিতে তৈরী করা সম্ভব নয়! বিজ্ঞানের বিশারদেরাও অনেকে এমন বলছেন।

অনেকেই এই সহজ সত্যটা ভুলে গেছেন যে ভাইরাসটিকে ল্যাবরেটরিতে তৈরী করার প্রয়োজন নেই, এই ভাইরাস প্রকৃতিতেই বিদ্যমান হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু তার যে প্রাকৃতিক বাসস্থান অর্থাৎ অন্য প্রানীর দেহ, অথবা অজৈব পদার্থ, যেমন বহুযুগ সঞ্চিত বরফ, এইসব জায়গা থেকে তাকে মানবদেহে চালান করা আজকের জৈবপ্রযুক্তির কাছে অসম্ভব নয় মোটেই। আর ল্যাবরেটরিতে যেখানে আস্ত একটি স্তন্যপায়ী প্রানীর ক্লোন তৈরী করা সম্ভব হচ্ছে, সেখানে ভাইরাস, যার মধ্যে একটা সম্পূর্ণ কোষই নেই, সেই ভাইরাসের মধ্যে কিছু পরিবর্তন ঘটানো কি আজকের জৈবপ্রযুক্তিবিদ্যার কাছে খুব কঠিন কিছু ? করোনা ভাইরাস তেমন মারন রোগ নয়, বেশী সংক্রমণ ঘটায় কিন্তু বেশী মানুষকে মেরে ফেলে না। তাই আতঙ্ক ছড়াবার জন্য এবং পরিস্থিতি নিজেদের হাতে ধরে রাখার জন্য এই ভাইরাসের সংক্রমণ যে আদর্শ, সেই তথ্যটাও সম্ভবত এই বিশারদেরা ভুলে বসে আছেন।

তাঁরা এটাও তারা ভুলে গেছেন যে আজ আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর দ্বারা উৎপাদন এতটাই যন্ত্র নির্ভর হয়ে গেছে যে এত শ্রমিক আর সাম্রাজ্যবাদের দরকার নেই। সুতরাং এত মানুষেরও তার দরকার নেই। এত মানুষের দ্বায়িত্ব সে আর নিতে চায় না। আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা এতটাই যন্ত্রনির্ভর যে কিছু কিছু দেশ তাদের শ্রমিকদের শ্রম সময় কমিয়ে দেওয়ার কথা ঘোষনা করে দিয়েছে, যেমন সুইডেন। সেখানে জনসংখ্যা কম। আর যেখানে জনসংখ্যা বেশী যেমন ভারত, সেখানে তারা এবং তাদের তাঁবেদার রাষ্ট্র চায় মানুষ কে প্রান্তিক করে দিয়ে, বেনাগরিক করে দিয়ে, তার সব দায় থেকে হাত ধুয়ে ফেলতে। একটা বড় অংশের মানুষকে তাদের পরিচালিত অর্থনীতির বাইরে ফেলে দিতে।

আরও পড়ুন করোনা ষড়যন্ত্র ১

https://www.sahomon.com/welcome/singlepost/corona-conspiracy-1

পুঁজিবাদী সমাজের নিয়মই এই যে পুঁজির পুঞ্জীভবন বাড়বে, সাধারণ মানুষের হাত থেকে আর্থসামাজিক ক্ষমতা কমতে থাকবে, এবং তা পুঞ্জীভূত হবে অল্প কিছু মানুষের হাতে, শাসক শ্রেনী এবং তাদের তাবেদারদের হাতে। সমাজের ওপরের তলার কিছু মানুষ তাঁর নীচের তলায় নামবে, নীচের তলার কিছু মানুষ অর্থনীতির প্রান্তে বা তার বাইরে চলে যাবে; এই প্রক্রিয়া গোটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রক্রিয়া। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থায় সম্পদ পুঞ্জীভবনের চাপে, এই ব্যবস্থার স্বাভাবিক চলন পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সঙ্কট ঘনীভূত করে এবং সেই সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পেতে পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ যে পথ নেয়, তাতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ভবিষ্যতের সঙ্কটের পথ প্রশস্ত করে। বিগত কয়েক দশক ধরেই সাম্রাজ্যবাদীরা যে সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে চলেছে, যার জেরে, দেশে দেশে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে এক দীর্ঘস্থায়ী ছায়াযুদ্ধের অবতারনা করা হয়েছে, তার ধারাবাহিকতাতেই এই করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। যুদ্ধের বাতাবরণে সামনে শীখন্ডী খাড়া করে গোটা অর্থনীতিকে আবার অন্য একরকম ভাবে সাজিয়ে নেওয়ার চেষ্টা। যে অর্থনীতিতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ আরো সঙ্কুচিত, আরো অপাংক্তেয় হয়ে উঠবে। ক্ষমতা আরো কেন্দ্রীভূত হবে, কোথাও কোথাও হয়ত তা হস্তান্তরিতও হবে। দেশে দেশে ফ্যাসীবাদের উল্লাস উঠবে, হয়ত বিশ্বজোড়া ফ্যাসীবাদের সূচনা হবে।

আর কি হবে? কেন চোখের সামনে আর যা যা হচ্ছে! সরকারী ক্ষেত্রগুলো জলের দরে সাম্রাজ্যবাদী সংস্থাগুলোর হাতে বিকিয়ে যাবে, সরকারী জনকল্যাণের কাজ বন্ধ হবে, শ্রমজীবি মানুষের অধিকার বলে কিছু থাকবে না, শ্রমজীবি মানুষের অধিকারের পক্ষে যারাই আওয়াজ তোলার চেষ্টা করবে তাদেরই কণ্ঠরোধ করা হবে, না পারলে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে, জনগণের একেকটা অংশকে বেনাগরিকিকরনের মধ্যে দিয়ে সব রকম রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হবে, জাতপাত, এবং ধর্মের ভিত্তিতে জনগণকে বিভাজিত, অবদমিত করে রাখা হবে। এবং এই সব কিছুই হবে, যেমন হচ্ছে, প্রতিবাদ প্রতিরোধের রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে। মানুষের আর্ত চিৎকার বড় বেশী যদি কানে বাজে তাহলে মাঝে মাঝে ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’ এর মতো ডোল দেওয়ার নাটকগুলো একটু জোরে চালানো হবে। কিন্তু চিন্তা নেই, ডোলও দেওয়া হবে না, বড় জোর, মাঝে সাঝে কোথাও কোথাও কিছু ত্রান।

এই দাওয়াই দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্কট ঘুচবে না কারন সঙ্কট পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত। আলোচনা এই নিয়ে হওয়া জরুরি যে মানুষ এই সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের হাত থেকে, ষড়যন্ত্রের হাত থেকে বাঁচতে কি করবে? এই লেখার উদ্দেশ্য পণ্ডিতি ফলানো নয়, এই লেখার কোনো অংশ আমার মস্তিষ্কে প্রথম দানা বেধেছে এমন দাবী করার কোনো অবকাশ নেই, সেই ধৃষ্টতা তো নেইই। এই লেখার বেশিরভাগ উপকরণ আন্তর্জাতিক গনমাধ্যমে ইতিমধ্যেই আলোচিত। এই লেখার উদ্দেশ্য হল একটা প্রশ্ন সকলের কাছে রাখা – অতঃ কিম?

0 Comments

Post Comment