পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষের - মহাভারত আলোচনা

  • 11 December, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 3119 view(s)
  • লিখেছেন : সুতপা সেন
ক্ষমতাবান কেউ দেশাচার-বহির্ভূত কোনও ঘটনা যদি ঘটিয়েই ফেলে বৃহত্তর স্বার্থের উদ্দেশ্যে, কল্পিত কাহিনী পুরাকাহিনী বলে মুখে মুখে প্রচলিত করে দেওয়া এবং এই দেশাচার-বিরুদ্ধ ঘটনা কেবলমাত্র ঐ পূর্ব- কাহিনীর বিলম্বিত অধ্যায় বলে মানুষকে বিশ্বাসে স্থিত করা, সাধারণের চোখে যা অস্বাভাবিক তাকে স্বাভাবিক প্রতিপন্ন করে তোলার যে সুচিন্তিত প্রচেষ্টা এ মহাভারতের কালে বারংবার দেখা গেছে।

"জগতে এই ইতিহাসকে কোনো কোনো কবি আংশিকভাবে বলেছেন পূর্বে, অপর কবিরা বর্তমানে বলছেন এবং ভবিষ্যৎ-এও অন্য কবিরা সেই ভাবেই বলবেন।"

এবং সমকালীন করে নেওয়ার প্রবণতা, এমনকি স্থানভেদে, জনগোষ্ঠী-ভেদে সংযোজন বিয়োজন করে জীবনের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক করে নেওয়ার যে বিপুল সম্ভাবনা ও ধারণক্ষমতা আছে এই কাহিনীর---- সেই প্রেক্ষাপটে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করে, বেদ-পুরাণ-ইতিহাস-বিজ্ঞান-দর্শনাদি মোক্ষণ করে এ গ্রন্থ নির্মাণ করে আমাদের চেতনাকে জাগ্রত করার প্রয়াস পেয়েছেন লেখক।

ক্ষমতাবান কেউ দেশাচার-বহির্ভূত কোনও ঘটনা যদি ঘটিয়েই ফেলে বৃহত্তর স্বার্থের উদ্দেশ্যে, কল্পিত কাহিনী পুরাকাহিনী বলে মুখে মুখে প্রচলিত করে দেওয়া এবং এই দেশাচার-বিরুদ্ধ ঘটনা কেবলমাত্র ঐ পূর্ব- কাহিনীর বিলম্বিত অধ্যায় বলে মানুষকে বিশ্বাসে স্থিত করা, সাধারণের চোখে যা অস্বাভাবিক তাকে স্বাভাবিক প্রতিপন্ন করে তোলার যে সুচিন্তিত প্রচেষ্টা এ মহাভারতের কালে বারংবার দেখা গেছে।

দ্রৌপদী-পঞ্চপাণ্ডব বিবাহে যে সংকট দেখা দিয়েছিল, পিতামহ ব্যাসদেব স্বয়ং পঞ্চ-ইন্দ্রের পুরাকাহিনী বর্ণন করে সে বিবাহের মান্যরূপ প্রতিষ্ঠা করেছেন।

দুর্যোধন একই কাজ করলে কি পিতামহের এই অনুমোদন পেতেন?

"এই যে আজ পাণ্ডবদের নিয়ে আমরা ভাবতে অন্তত পারছি, যে তাঁরা বেদধর্ম ও দেবধর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন, এ সম্ভব হত না যদি তারা নিতান্তই ক্ষত্রিয় ঔরসে জন্মাত।"

"বিবাহ নিছক বিবাহ নয়, সে বিশিষ্ট রাজনীতিও। সে রাজনীতি অতিক্রম করা তাঁদের পরিস্থিতিতে দুঃসাধ্য।"

সমকালেও মহা-ভারতের এই প্রবণতা, বুঝিবা কাহিনী পরম্পরায় লোকবিরুদ্ধ কাজের মান্যরূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা। আলোচ্য মহাভারত পাঠকালে সমকালীন ভারত সবসময়ই সচেতন পাঠকের পাঠ- সত্ত্বায় মিশে থাকবে। উঁকি দিয়ে যাবে সমকালীন রাজনীতির অস্থির ঘটনাসমূহ। আপাত স্থির ঘটনাগুলোর পেছনে লুকিয়ে থাকা বিপদ, জানান দেয় সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের অবস্থান।

ব্রাহ্মণ্যধর্মের পৃষ্ঠপোষক অর্থাৎ ব্রাহ্মণ সমর্থনে ক্ষমতাবাণ---- ক্ষমতায়ণের এই উভয়তঃ চলাচল যে সমাজব্যবস্থাকে গঠন করে দেয়, ইচ্ছেমতো তাকে গড়া এবং ভাঙার যে রাজনৈতিক খেলা চলে সাধারণ মানুষের সেখানে অংশগ্রহণ কতটুকু থাকতে পারে?

তখনও সমাজের সুস্থিতি আসেনি, সামাজিক অনুশাসন অস্থির, মূল দুই ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর ক্ষমতা দখলের লড়াই এবং দ্বন্দ্ব, বশিষ্ঠের ব্রাহ্মণ্যবাদ আর ভার্গব বিশ্বামিত্রের দ্বন্দ্ব, কিরাত, শবর‌ ইত্যাদি বিচ্ছিন্ন প্রাচীন জনগোষ্ঠী, তারা তাদের অরণ্যের অধিকার সহজে ছাড়বে না কাউকেই।

বৈদিক ব্রাহ্মণ, শৈব, বৈষ্ণব---- এই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক সমীকরণ, ক্ষমতাদখলের দলবদল ও জোটবদ্ধতা এবং দুর্যোধনের চার্বাকাদি লোকায়তিক প্রিয়তা, যা আদতে ব্রাহ্মণ্যবাদবিরোধী---- এই সমস্ত সম্পর্ক ভারতবর্ষের ইতিহাস এবং যুদ্ধবিগ্রহ, বন্ধুতা এবং শত্রুতা নিয়ন্ত্রণ করছে।

প্রাথমিকভাবে যুদ্ধের মাধ্যমে সংযোগ বৈদিক-অবৈদিক গোষ্ঠীর। দিনযাপনে পারস্পরিক সহযোগিতার প্রয়োজন হলে বিজেতা গোষ্ঠী বিচিত্র অপর বিজিত গোষ্ঠীগুলির সামাজিকতাকে আত্মীকরণ প্রচেষ্টায় রত হয়।

কিছু কৌশল কিছু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে সমাজে সমতা আনার চেষ্টা।

আবার কখনও কখনও রাজাকে প্রজার সঙ্গেও সন্ধি করতে হয় প্রজার উৎপাদন এবং সম্পত্তি আত্মসাৎ করতে। সন্ধির নানান রকমফের। সেসব আলোচনা করেছেন লেখক।

রাষ্ট্রানুগ পরিবর্তনে প্রাথমিকভাবে রাজশক্তির নিগ্রহ, অতঃপর ক্ষতে স্নেহ-সিঞ্চন এবং রাজশাসন---- এই সমস্তই প্রচলিত পদ্ধতি অধিবাসী অধিকৃত প্রাকৃতিক সম্পদ এবং সম্পত্তি অধিগ্রহণ উদ্দেশ্যে।

"দেবব্রত দেখছেন, আগের রাজাদের সহজ জীবন পরিহার করে এখনকার রাজারা বিলাসের জীবন বেছে নিচ্ছেন। এমনকি গণের শাসনের ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। অর্থাৎ, নতুন নীতি হল শাসক যে শাসিতের থেকে আলাদা তা আচার-আচরণ-বাসস্থান-সংস্কৃতি সবেতেই প্রমাণ করতেই হবে।" কাজেই আরও ধন চাই রাজকোষে, সেই হেতু বণিকের বাণিজ্যেও রাজার অংশগ্রহণ।

বণিকের নজর থাকে সবসময় ক্ষমতার কেন্দ্র বদলের দিকে। সেইমতো পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে তাঁর ভূমিকা তিনি ঠিক করেন। এই কাহিনীতে সুধন্য বণিক কাজে লাগান নট সুবাহুকে।

সাম, দান, দণ্ড, ভেদ---- এই চার নীতি হল রাজনীতি। রাজনীতির মূল হল পরিস্থিতির সম্যক মূল্যায়ন।

রাজনৈতিক কারণে ধর্ম এবং তীর্থগুলিকেও একসূত্রে বাঁধা হয় কীভাবে অর্জুনের বনবাসকালীন সেই চেষ্টাও পরবর্তীকালের শক্তির কথা বিবেচনা করে।

"বণিকের মানদণ্ড পরিণত হলো রাজদণ্ডে"---- এই বাক্যবন্ধ আমরা ছেলেবেলা থেকে পাঠ্যপুস্তকে পড়ে আসছি বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীদের সম্পর্কে। যদিও এ কথা সর্বকালেই সত্যি। বণিক ঠিক করে দিয়েছে রাজদণ্ডের মান। কখনও অতি প্রকাশ্যেও।

রাজ্যের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণেও বণিকের বিপুল ভূমিকা। যুদ্ধের সময় বণিকের লাভ বাড়ে, কারণ যুদ্ধের প্রয়োজনীয় যাবতীয় কাঁচামাল বণিক দুতরফেই সরবরাহ করে। তাহলে কি নিজের লাভের জন্য যুদ্ধও বণিকের অভিপ্রেত? সামান্য সুযোগেই অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণে বণিক রাজার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে? বণিককে প্রশ্রয় দিলে বণিক গোষ্ঠীগত ধর্মাচরণের অভিমুখও বদলে দিতে পারে। এতটাই ক্ষমতাধর বণিকের মানদণ্ড।

বাণিজ্যে সুবিধে না হলে হিংসা, বর্ণভেদ এবং ধর্মব্যবস্থায় জড়িত থাকতে বণিক আগ্রহী হয় না। ধর্ম, সামাজিক রীতিনীতি সমূহ থেকে রাজনৈতিক দণ্ডনীতিও নির্ধারণ করে যেহেতু, এতে সংশ্লিষ্ট হতে তৎপর হয় বণিক।

কৃষি আর বাণিজ্যর যুদ্ধ আর রাজনীতির সঙ্গে সংযোজন ঘটে যায়।

বাণিজ্যপথ নিয়ন্ত্রণের ফলে নগরের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় বণিকসভার হাতে। বণিক, শ্রেষ্ঠী, কারিগর, সার্থবাহর প্রয়োজনে পথ তৈরি হয়, মুদ্রার প্রচলন ও তার ব্যবহারবিধি--- সকলই বণিক- নির্ধারিত পরিকল্পনার অন্তর্গত।

এ সবই অবধারিতভাবে হতে থাকে।

শ্রমমূল্য নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণও বণিক নিজের হাতে রাখতে চায়, সেই কারণেও শাসকের ওপর প্রভাব জরুরি তার। রাজ্যের রাজা যদি শক্তিশালী হয়ে থাকেন তাহলে এঁদের তিনি জনহিতকর কর্মে বাধ্য করতে পারেন। অন্যথায় রাজাকেই এঁরা নিয়ন্ত্রণ করেন, বাধ্য করেন তাঁদের নিজস্ব নীতির শাসন মানতে। এমনকি রাজশাসন ইচ্ছে মতন বদলেও দিতে পারেন লাভের চক্রের জন্য।

'কুরুগণের শাসন' থেকে 'কুরুবংশের শাসন'-- এ আখ্যায়িত হতে যে সব ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে আসতে হয়েছে, সেখানে গণের ব্যবস্থায় অন্তহীন দুর্নীতি ঢুকে গেল, সে ব্যবস্থাচালিয়ে নিয়ে যাওয়ার উপযুক্ত কেউ আছে আজ?

বর্ণাশ্রম প্রতিষ্ঠিত সমাজে রাজতন্ত্র না গণতন্ত্র বেশি মঙ্গলজনক তাই নিয়েও প্রশ্ন থাকতে পারে। যেখানে প্রথম থেকেই বিপুল পার্থক্য সেখানে কোনটা ভালো কোনটা মন্দ এ মীমাংসা করবে কে? সম্পদের বেশিটাই যখন একটি বা দুটি বর্ণের হাতে চলে যায়, সমাজের ভারসাম্য বিঘ্নিত হতে বাধ্য।

গণরাজ্যে এমন কোনো শাসকের হাতে সরাসরি শাসনের ভার থাকবে না যে জনগণকে ছাপিয়ে ব্যক্তি হিসেবেই অনেক বড় হয়ে যাবে। যাদবদের রাজ্যেও তাই কংসকে সরে যেতে হয়েছে তার সর্বগ্রাসী ক্ষমতার জন্য। সেই কারণেই কৃষ্ণ বা বলরাম সিংহাসনে বসতে পারেন না, কারণ তাঁরা স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল, গণের সভা তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।

রাজনৈতিক বিভেদ আর ধর্মীয় বিভেদ কখনো কখনো এক হয়ে যাচ্ছে, হয়তো বেশিরভাগ সময়ই। ধর্ম বলতে ঐশ্বরিকতার চাইতে সামাজিক-রাজনৈতিক অনুশাসনই যে প্রবল তা উঠে আসছে আখ্যানে। ধর্ম, ধন এবং কর্ম সম্পৃক্ত। অতএব রাজনৈতিক শক্তিই।

অবৈদিকদের কখনো শক্তিপ্রয়োগে দমন করে, কখনও বিবাহসূত্রে মৈত্রী বন্ধনে অনুগত করা হয়েছে। এ কাজে যে যত পারদর্শী, যত বেশি পরিশ্রম এবং সময় ব্যয় করেছে পরবর্তী সংঘর্ষে জয়ের সম্ভাবনা তার তত'ই বেড়েছে।

পাণ্ডবরা যে ক্রমশ বৈদিক ধর্মাচারী ঋষিদের সমর্থন পেয়েছেন, যুধিষ্ঠিরের ধর্মানুগত্য, যজ্ঞানুষ্ঠানে আগ্রহ এইসমস্তই সেই দিকনির্দেশ করেছে। শাসন, বৈধতা পায় কোনো না কোনো উৎস থেকে। নিতান্তই সামরিক শক্তিতে বৈধতা পাবার যুগ তখনো ছিল না। অতএব তাকে বৈধতা পেতে ধর্মের আনুকূল্য লাভ করতে হচ্ছে। সেই একই সূত্রে আবার ধর্মও বৈধতা লাভ করছে শাসকের কাছে। পারস্পরিক পরিপূরক এক ব্যবস্থা যা বাকী সমগ্রকে গ্রাস করে নিতে উদ্যত। যুধিষ্ঠির সেই ব্যবস্থার প্রতিনিধি স্থানীয় হয়ে উঠছেন কালে কালে। একাধারে তিনিই ধর্ম, তিনিই শাসন। এ যাত্রার সূত্রপাতে যে দরিদ্র বালকটি মা আর ভায়েদের হাত ধরে হেঁটে আসছে হস্তিনাপুর, সেই বালকটির প্রতিচ্ছবি রাজসূয় যজ্ঞকারী মহারাজ যুধিষ্ঠিরের মধ্যে আর থাকে না। থাকতে পারে না। দ্রৌপদীকে বিবাহের কালে সমগ্র সম্পদ পঞ্চ ভ্রাতায় ভাগাভাগি হবার যে সূত্রটি যুধিষ্ঠিরেরই হাত ধরে এসেছিল সেই সূত্রই বিলীন হয়ে যায় রাজসূয় যজ্ঞে সমগ্র সম্পদকে যুধিষ্ঠিরের নিজস্ব সম্পদ ঘোষণার মধ্যে। পঞ্চ ভ্রাতার মধ্যে যুধিষ্ঠির প্রভুত্বে প্রতিষ্ঠিত হ'ন, ভ্রাতাদের সেবক করে তুলে। সেখানেও চালিকা শক্তি তৎকালীন ধর্মধ্বজী সমাজের বুদ্ধিজীবি অংশ যাঁরা শাসনকে নিতান্তই নিজস্ব গোবৎস বলে বিবেচনা করেন। মহাভারতের চেনা কাহিনীর মধ্যেকার অচেনা অংশ উঠে আসে এই পাঠের উপরিতলে।

বেদবাদী সূর্য ও ইন্দ্র-পূজক গোষ্ঠীর পাশাপাশি বৈষ্ণবগোষ্ঠীর উত্থান ও বিস্তার। সেখানে নারদীয় ভক্তিমার্গ গুরুত্বপূর্ণ। এই গোষ্ঠীর বর্ণাশ্রম একদা কঠোর ছিল না। ব্রহ্মবাদীর ব্রাহ্মণত্ব, ইন্দ্রপূজকের ক্ষত্রিয়গরিমা কিছুই প্রয়োজন হয় না, বিষ্ণুর পূজা যিনি করেন তিনিই বৈষ্ণব। অন্যদিকে বৈষ্ণব পরম্পরায় অষ্টবসুর কাহিনী গুরুত্বপূর্ণ। কালে কালে 'বাসুদেব' পূজাই বৈষ্ণবের একমাত্র পূজা বলে প্রতিষ্ঠার প্রবল যুদ্ধ চলে। নানান পরিকল্পনার পরম্পরায় এই 'বাসুদেব' হয়ে উঠবেন কৃষ্ণ। ওদিকে ভীষ্মর জীবনও অষ্টবসুর কাহিনীতে জুড়ে যায়। জুড়ে যায় ব্রাহ্মণ্যগোষ্ঠীগুলির মধ্যে শেষের দিকে প্রতিষ্ঠা পাওয়া ভার্গাবাঙ্গিরসদের বৈষ্ণব পরিচিতি আত্মসাৎ-এর পদ্ধতি। বিশেষ করে ভার্গবেরা নানা প্রক্রিয়ায় কাহিনীর কেন্দ্র ও কন্দরকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে।

এইভাবে বাসুদেব এবং বাসুদেব গোষ্ঠী, পাঞ্চাল, বাসুদেব গোষ্ঠীর সহায়ক ভার্গবরা---- পাণ্ডবদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন। যে রাজা যাগযজ্ঞের অনুরাগী, স্বভাবতই বৈদিক ব্রাহ্মণরা সেই রাজার ক্ষমতাবিস্তারে সহায়ক হবেন। কারণ যজ্ঞানুষ্ঠানই তাঁদের সম্পদের মূল উৎস। যুধিষ্ঠির বেদনিষ্ঠ পুরাণনিষ্ঠ, ভ্রাতারা তাঁর অনুসারী। অপরপক্ষে চার্বাকাদি শ্রামণিকেরা দুর্যোধনের মিত্রস্থানীয়। ব্রাহ্মণ্য ধর্মীয় শিক্ষার প্রাধান্য খর্ব করছেন শ্রামণিকেরা। দুর্যোধন ব্রাহ্মণ আধিপত্য মেনে নিচ্ছেন না। ঐ আধিপত্য ঐ শাস্ত্রসমূহই তাঁর পিতা ধৃতরাষ্ট্র কিম্বা তাঁকে হস্তিনাপুরের সিংহাসনে বসতে দিতে ইচ্ছুক ছিল না। তাই হস্তিনাপুরে বহুকাল কোনো বড় যাগযজ্ঞ হয়নি, দুর্যোধন এই বিষয়ে অনাগ্রহী। কাজেই ক্ষমতাদখলের নানান মেরুকরণ এবং গোষ্ঠীগত দলগঠনের কাজ ঘটে চলেছে।

জ্ঞান যখন সমাজ নিয়ন্ত্রণের উপকরণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন জ্ঞানের মাধ্যমে জ্ঞানের বিস্তার রোধ করার প্রচেষ্টাও চলে। সকলেই যেন জ্ঞানের অধিকারী না হতে পারে তাই জ্ঞান কুক্ষিগত করে রাখা হয়েছে কিছু মানুষের মধ্যে।

কথক বলছেন, "পারবেন কোনো নিষাদরাজ পাঞ্চালের সঙ্গে যুদ্ধ করতে? আশেপাশের সব রাজা, সব রাজ্য তাকে একতালে আক্রমণ করবে না? একবার যদি শূদ্র নিষাদ ----- ক্ষত্রিয়কে হারিয়ে রাজ্য নেয়, কাল কার রাজ্য সুরক্ষিত থাকবে? সেই জন্য বলছি, একলব্য, যতই গুণী হোন, এ খেলায় পারতেন না। ওরাই পারতে দিত না। তাই একলব্যকে কেন শিষ্য নেবে কেউ বলুন? নিষাদ-শবর সব, সবাই, অন্যের হয়ে যুদ্ধ করে, অন্যের হয়ে জেতে-হারে, নিজের হয়ে লড়ে না। লড়তে পারে না। লড়াই-ঝামেলা হয় ওদের নিজেদের মধ্যে--কুরু-পাঞ্চাল, মথুরা-মগধ, তাতে লড়ে মরেন একলব্য। তাও নিজের বংশের ক্ষমতায় অতদূর গিয়েছেন বলে। একলব্যের মতো শিষ্য দ্রোণেরা নেয় না। আজ অবধি শুনেছ বড়ো ক্ষত্রিয় বংশ বা রাজকুমারদের ছাড়া দ্রোণ কাউকে শেখাচ্ছেন? আজ অবধি শুনেছ ব্রাহ্মণ বলছে বেদ সবার? হয় না! যত বেশি গোপন রাখা যায় ওদের বিদ্যা তত তার দাম আদায় করা চলে। এবং সর্বোচ্চ দামে সে বিদ্যা বিক্রয় করেছেন আচার্য দ্রোণ।''

লেখক বলছেন, 'প্রাচীনেতিহাসের মধ্যে থাকে পরবর্তী সম্ভাবনার ইঙ্গিত।'

রাজনীতি অর্থনীতি সমাজনীতির বিবর্তন সবই লেখক মহাভারতের কাহিনী বলতে বলতেই ব্যখ্যা করছেন, আবার অনেককিছু বলছেনও না--- পাঠকের চিন্তার সীমানাকে শুধুমাত্র বিস্তৃত করে দিচ্ছেন। বহুস্তরীয় চিন্তা-ভাবনার পথ খুলে দিচ্ছেন। বারে বারে উঁকি দিয়ে যায় বর্তমান স্বদেশ। এই বইটির মূল লক্ষ্যও সম্ভবতঃ তাই, একবারও নিজের দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভুলতে দেবে না।

কাহিনী নির্মাণ-বিনির্মাণের মধ্যে দিয়ে চলা এই উপন্যাসমালা ভারে এবং ধারে 'মহাভারত'-ই হয়ে উঠতে ব্যাগ্র।

আলোচক – সুতপা সেন

0 Comments

Post Comment