স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির দিন যখন লালকেল্লা থেকে প্রধানমন্ত্রী গলা ফাটিয়ে নারীর মর্যাদা রক্ষা ও ক্ষমতায়নের কথা বলছেন,নাগরিকদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ' হর ঘর তিরঙ্গার' ডাকে সাড়া দিয়ে বাড়িতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে দেশপ্রেমের হাতে গরম শংসাপত্র নিতে ব্যস্ত তখন গুজরাটে এগারো জন ধর্ষক ও খুনের আসামী তাদের বহুকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা পাওয়ার উৎসব পালন করছিলেন মিষ্টি মুখ করে।এই ' মহান ', ' সংস্কারী ব্রাহ্মণ ',আগাপাশতলা হিন্দু বীরপুঙ্গবদের সাদর অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করার দায়িত্বে ছিলেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর্তা ব্যক্তিরা। আচ্ছে দিনের এই নতুন ভারতবর্ষে মুসলমানরা যেহেতু প্রায় দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে রূপান্তরিত, মুসলমান মহিলাদের কবর থেকে তুলে ধর্ষন করার মত হুমকি যখন পৃথিবীর ' বৃহত্তম ' গণতন্ত্রে প্রায় নিয়মিত শোনা যায় তাই বিলকিস বানো মামলায় দন্ডিত এই নরপশুদের যে সাজা মাঝপথেই মাফ হতে পারে,তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। বিষয়টা শুধু কিছু মানুষের মুক্তির প্রশ্ন নয়,আদতে এক ধর্ম নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ভারত কিভাবে এক ফ্যাসিস্ট হিন্দু রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হচ্ছে তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
গুজরাটের দাহোদ জেলার রাধিকাপুর গ্রামের বাসিন্দা বিলকিস বানো ২০০২ সালের ৩ মার্চ ধর্ষিতা হন।তখন তার বয়স একুশ এবং বিলকিস ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। গুজরাট তখন দাঙ্গার আগুনে জ্বলছে এবং সরকারের সচেতন নিষ্ক্রিয়তার সিদ্ধান্ত গোটা রাজ্যকে এক বধ্যভূমিতে রূপান্তরিত করেছে।সেদিন শুধু বিলকিস নন,তার মা সহ আরো তিনজন ধর্ষিতা হন।পরিবারের সাত জন সদস্যকে পৈশাচিক ভাবে হত্যা করা হয়।বিলকিসের তিন বছরের শিশু কন্যাকে পাথর দিয়ে থেঁতলে মেরে ফেলে ঐ দুর্বৃত্তের দল।ঘটনার বিভৎসতায় আলোড়ন সৃষ্টি হয় দেশে- বিদেশে। কিন্তু গুজরাট পুলিশ তদন্ত শুরুই করে না।এখান থেকেই শুরু হয় বিলকিসের অদম্য লড়াই।শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ২০০৪ সালে সিবিআই তদন্ত শুরু করে। গুজরাটে মামলা চালাবার মত পরিস্থিতি না থাকার কারণে আদালতের নির্দেশে মামলাটি মহারাষ্ট্রে স্থানান্তরিত হয়।২০০৮ সালের ২১ জানুয়ারি স্পেশাল সিবিআই কোর্টে ধর্ষণ ও হত্যার দায়ে এগারো জনের যাবজ্জীবন সাজা হয়।সাত জন প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস হন।একজন মামলা চলাকালীন সময়ে মারা যান।সংক্ষেপে এই হল মামলার ইতিবৃত্ত।
বিলকিস বানো মামলায় দন্ডিত এই ঘৃণ্য মানুষগুলির সাজা মকুবের সিদ্ধান্ত ঘিরে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে তা বহুমাত্রিক। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে দন্ডিত আসামীদের একজন রাধেশ্যাম শাহ গুজরাট হাইকোর্টে এক আপিল করে তাদের সাজা মকুবের আবেদন জানায়।কিন্ত আদালত পত্রপাঠ এই আবেদন নাকচ করে বলে যেহেতু মামলাটি মহারাষ্ট্রে হয়েছিল তাই তাদের আবেদন করতে হবে সেখানে।তখনকার মত বিষয়টি শেষ হলেও কয়েক বছর পর রাধেশ্যাম আবার আবেদন করেন।এবার তার বক্তব্য ছিল যেহেতু ঘটনা স্থল গুজরাট এবং একটি বিশেষ পরিস্থিতির কারণে মামলাটিকে অন্য রাজ্যে স্থানান্তর করা হয়েছিল, এমনকি দন্ডিত আসামীরা সাজা খাটছেন গুজরাটের জেলে তাই তাদের আবেদন গুজরাট হাইকোর্টের বিচার্য হওয়া উচিত। এবারও আপিল খারিজ হলে রাধেশ্যাম ২০২২ সালের ১৩ মে পুনরায় সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন।সুপ্রিম কোর্ট এই বিষয়টি পর্যালোচনা করার দায়িত্ব দেয় গুজরাট সরকারকে।আদালতের নির্দেশ মোতাবেক সরকার একটা কমিটি গঠন করে।এই কমিটিতে প্রশাসনিক প্রতিনিধি ছাড়া আর যারা মনোনীত হন তারা সবাই বিজেপির কর্তাব্যক্তি।উল্লেখযোগ্য হলেন বিজেপি বিধায়ক সি.কে.রালোজি ও সুমন চৌহান এবং প্রাক্তন বিজেপি কাউন্সিলর মুরলি মূলচান্দানি, গোধরা মামলার মূল সাক্ষী হিসাবে যার বয়ান সেই সময়ে বিতর্কের ঝড় তুলেছিল। এই কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে তাদের মুক্তির সুপারিশ করে।
এখন সমস্যা হল যে পদ্ধতিতে এই দন্ডিতদের সাজা মকুব করা হল তার প্রতিটা ধাপে একাধিক অসঙ্গতি রয়েছে যা আলোচনার দাবি রাখে।প্রথমত সুপ্রিম কোর্টের অবস্থান খুবই হতাশাজনক। গণ ধর্ষণ ও একাধিক খুনের ঘটনায় কিভাবে সুপ্রিম কোর্ট পুনঃবিবেচনার নির্দেশ পরিষ্কার নয়।কেউ কেউ একটা আদেশের উল্লেখ করছেন যাতে বলা হয়েছে স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব উপলক্ষে ১৫ আগস্ট (২০২২),২৬ জানুয়ারি (২০২৩),১৫ আগস্ট (২০২৩) দন্ডিত অপরাধীদের মুক্তির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর উপলক্ষে এই ধরনের অপরাধীদের বিষয়টি বিবেচনার মধ্যে আসে তা পরিষ্কার নয়।দ্বিতীয়ত গুজরাট সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ২০১৪ সালের ২৩ জানুয়ারি এক নির্দেশিকায় ( জেকেএল/৮২২০১২/১৮৫৯/জে) বলে কোন অবস্থাতেই ধর্ষণ কান্ডে সাজাপ্রাপ্তদের মুক্তির অনুরোধ বিবেচনা করা হবে না।তাহলে এই সিদ্ধান্ত কি ভাবে সম্ভব?
তৃতীয়ত এই মামলার তদন্ত কারী সংস্থা ছিল সিবিআই যা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন।তাই সাধারণ নিয়ম হল এই ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের সন্মতি নেওয়া।এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার তার অবস্থান স্পষ্ট করছে না।চতুর্থত একথা আদালত ও গুজরাট সরকারের অজানা নয় যে এই মামলায় দুজন দন্ডিত যখন প্যারোলে মুক্তি পান তখন তারা মামলার দুজন সাক্ষীকে ভয় দেখায় ও শারীরিক নির্যাতন করে।তাই মুক্তির খবর শুনে আতঙ্কিত বিলকিস বানো ও তার স্বামী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে জানিয়েছেন। এই বিবেচনার গোটা প্রক্রিয়ায় কমিটির কেউ বিলকিস বানোর সঙ্গে যোগাযোগ পর্যন্ত করেন নি।এই মুক্তির সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে সর্বোচ্চ আদালতে একাধিক মামলা দায়ের হয়েছে যা অবশ্যই সুখবর।
বিলকিস বানো মামলায় দন্ডিতদের সাজা মকুব শুধু কয়েকজন ধর্ষনকারী ও আততায়ীর মুক্তি নয়,এ আসলে এক নতুন ভারতের বিপদজনক সংকেত। যারা বলছেন আগামী বছর গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনকে মাথায় রেখে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের সন্তুষ্ট করতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তারা বিপদের গভীরতাকে উপলব্ধি করতে পারছেন না।প্রথমত নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক জীবনে গোধরা কান্ড ও মুসলিম নিধন যজ্ঞ এক মাইলস্টোন। একদিকে এই ঘটনা যেমন তাকে উগ্র হিন্দু মৌলবাদীদের কাছে ' হিন্দু হৃদয় সম্রাট ' করে তুলেছে তেমনি ' রাজধর্ম' পালন না করার কারনে দেশের বহু মানুষের কাছে এবং অবশ্যই আন্তর্জাতিক মহলে এক নিন্দিত ব্যক্তিত্ব হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছে।তাই গুজরাট দাঙ্গাকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে মোদি- শাহরা আজ এত তৎপর।সেই জন্য যাতে এহসান জাফরির হত্যা যাতে আর সংবাদের শিরোনামে না থাকে তাই চক্রান্তকারী হিসাবে তিস্তা শীতলাবাদকে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে আমলারা সেইসময় মুখ্যমন্ত্রীর হুকুম অমান্য করে রাজধর্ম পালনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন তারা আজ জেলে।একই ভাবে এগারো জনের মুক্তির পর বিলকিস বানো মামলাও আজ অতীত।দ্বিতীয়ত এই সময়ের তাৎপর্যকেও আমাদের ভুললে চলবে না।স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরে আজ হিন্দি- হিন্দু- হিন্দুস্তানের জয়ধ্বনি নিয়ে এক নতুন ভারত জন্ম নিচ্ছে যা তার ধর্মনিরপেক্ষ পরিচিতিকে বিসর্জন দিয়ে হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত হতে চায়।যেখানে প্রকাশ্যে স্বাধীনতা দিবসে মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসের ছবিতে মালা দেওয়া হয়।এই ভারতে রীতিমতো সাংবাদিক সম্মেলন করে প্রস্তাবিত হিন্দু রাষ্ট্রের সংবিধানের খসড়া বিলি করা হয়।সেই খসড়ায় উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা থাকে প্রস্তাবিত হিন্দু রাষ্ট্রে মুসলমান ও ক্রিশ্চানদের ভোটাধিকার থাকবে না।এই ভারত আজ মুসলমানদের তাদের রাষ্ট্র ভাবনা থেকে বিযুক্ত করতে চায়।শুধু একটি রাজনৈতিক দল বা তার শাখা সংগঠনগুলো নয়,প্রায় সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান আজ এই ভাবনার শরিক।এই ঘৃণা বমনকারী রাষ্ট্রে মুসলমান নারীকে ধর্ষণ করা খুব একটা গহির্ত কাজ নয়। আজ তাই ঘাতকরা নায়ক,মুক্তির পরে চলে বিজয় উল্লাস।এই সর্বগ্রাসী, উন্মত্ত, হিংস্র রাজনীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভাবে প্রতিরোধে নামতে না পারলে আরো অনেক বিলকিস বানো হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না।