উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে চাকরি বাকরি ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ধর্মীয় সংরক্ষণের দাবি জোরালো হয়। বলা যায়, বাংলার নবজাগৃতি, ব্রাহ্ম আন্দোলনের অন্তত ৫০-৬০ বছর পরে শুরু হয়েছিল ইসলামের নবজাগৃতি, আলীগড় আন্দোলন। স্বভাবতই পাশ্চাত্য শিক্ষায় ইসলাম পিছিয়ে পড়ে। আইনসভা থেকে আদালত, সরকারি প্রশাসন, সর্বত্র ইংরেজি শিক্ষিত হিন্দুদের আধিপত্য। এ সময়ে সদ্য ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমানরা সংরক্ষণের দাবি তুলেছিল। এই বিষয়ে কমিশন তৈরি হয়েছিল। সেই কমিশন যখন অযোধ্যায় শুনানি গ্রহণ করছিলেন, তখন অযোধ্যার ব্যবসায়ী আয়ুধিয়া নাথ এবং আইনজীবী হবিবুল্লা বলেছিলেন Neither Hindus nor Muslims, only Bengalees would get all. প্রসঙ্গটি এলো এই কারণে যে, যখন কর্মসংস্থান ও সুযোগ থাকে আংশিক, সকলের জন্য নয়, তখন কর্মপ্রার্থী নানা ধরনের আত্ম পরিচয়ের মাধ্যমে সংরক্ষণের দাবি তোলে। ক্ষেত্র বিশেষে যা হিন্দু মুসলমান সমস্যা, সেটাই ভিন্ন পটভূমিতে বাঙালি বিহারী সমস্যা হতে পারে। এটা এক সাধারণ সর্বজনীন সমস্যা।
বছর কুড়ি আগেও বিহার থেকে মহারাষ্ট্রে চাকরির পরীক্ষা দিতে যাওয়া যুবকদের উপর নির্মম অত্যাচার ও পীড়ন চলে। একজন নালন্দাবাসী ছাত্র মারা গিয়েছিল। প্রতিবাদে বিহারে মহারাষ্ট্র মুখী ট্রেন চলাচলে বাধার সৃষ্টি করা হয়। নীতিশ কুমার তখন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী। এমনকি একটি ট্রেন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। আসামে বাঙালি ও মাড়ওয়ারিদের বিরুদ্ধে একই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়। বিশেষ করে বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে বংগাল খ্যাদা আন্দোলন হয়েছিল আশির দশকে। এগুলোকে এক কথায় বলা হত, অসম বিকাশ জনিত বৈষম্য, ফলতঃ আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠাকামী শক্তি বনাম বহিরাগত ভিন্ন জাতি ধর্মের সংঘাত। অধ্যাপক অমিয় বাগচি তার প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট সংক্রান্ত গ্রন্থে দেখিয়েছেন ইনভেস্টমেন্ট এর স্বাভাবিক প্রবণতা অনুন্নত অঞ্চল থেকে উন্নত অঞ্চলে ধাবিত হওয়া। ফলে উন্নত ও অনুন্নত অঞ্চলের ব্যবধান ক্রমাগত বাড়তে থাকে। তাই পরিকল্পনার লক্ষ্য হবে সমহারে বন্টন নয়। বরং অনুন্নত অঞ্চল কে more than their fare share বরাদ্দ করা। অর্থাৎ সংরক্ষণের বন্দোবস্ত করা যাতে অর্থনীতির নিয়মে সমগ্র টাই উন্নত অঞ্চলে ধাবিত না হয়। এটা ছিল আঞ্চলিক বিকাশের তারতম্য জনিত, রাজ্যে রাজ্যে, জাতিতে, গোষ্ঠীতে, সম্প্রদায়ে, বিরোধের কারণ। এটা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বিপদ সম্পর্কে বামপন্থী বিশ্লেষণ।
কিন্তু অতি সম্প্রতি একটা হিড়িক উঠেছে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে, বলা ভালো বিজেপি শাসিত রাজ্য গুলি থেকে, বঙ্গভাষী বাঙালি তাড়াও। বাংলাভাষী মানেই তারা বাংলাদেশী বা বিদেশি। বাংলা একটা বিদেশী ভাষা। এমনকি অতি উৎসাহে বহু ক্ষেত্রে তাদের আটকে রেখে, বিএসএফের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য। মোদি সরকার যেভাবে বাংলাদেশী খুঁজে বেড়াচ্ছেন, তাকে দেশের মানুষের পক্ষে প্রশ্ন করতে চাই, বাংলাদেশী হাসিনা তো আপনার আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে নিরাপদে এদেশ থেকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রচার চালাচ্ছেন। তাহলে সরকার স্পষ্ট বলুক, হাসিনাকে ভারত রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে। এখনো কিন্তু এই কথা সরকারিভাবে ঘোষণা হয়নি।
আজকের সমস্যাটি কিন্তু পূর্ব উল্লেখিত সমস্যা থেকে ভিন্ন ১) এটা ঘটছে শুধুই বাঙ্গালীদের ক্ষেত্রে। ২) এটা বিজেপি শাসিত রাজ্য গুলিতে ঘটেছে ৩) এটার সাথে একটা বিদেশি বাংলাদেশী, অর্থাৎ নাগরিকত্বের প্রশ্ন, অনুপ্রবেশকারীর প্রশ্ন, জড়িয়ে আছে ৪) এর সঙ্গেই জুড়ে আছে এনআরসি, সিএএ, চালু করার প্রশ্ন ৫) সুদীর্ঘকাল কার্যত ১৯৭৭ থেকে এই বাংলা, দিল্লির নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ইতিহাস ঘাঁটলেও দেখা যায়, ব্রিটিশ যুগ ছাড়া মুঘল, সুলতানি, এমনকি প্রাচীন ইতিহাসের সাম্রাজ্যের যুগেও, বাংলা সাধারণভাবে কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের বাইরে ছিল। এই বিষয়গুলো সাম্প্রতিক বিজেপি শাসিত রাজ্যে বাঙালি তাড়াও নীতির পটভূমিতে রাখতে হবে।
পটভূমিতে আরো রাখতে হবে যে, ব্রিটিশ আমলেও বাংলা ছিল শাসকের মাথাব্যথার কারণ। ফলে পূর্ববঙ্গ ও আসামকে যুক্ত করে একটি প্রদেশ এবং অবশিষ্ট বাংলার সাথে বিহারকে যুক্ত করে একটি প্রদেশ গড়ার প্রচেষ্টা চলে। এক্ষেত্রেও লক্ষ্য ছিল দুটি প্রদেশেই বাঙালি হবে সংখ্যালঘু। এই পরিকল্পনার খসড়া পর্যালোচনা করে তৎকালীন ভারত সচিব হারবার্ড রিজলি ব্রিটিশ মন্ত্রী সভা কে সুপারিশ করে নোট দেন, From political point of view alone, I think partition is necessary. স্বাধীনতার পরেও কংগ্রেস শাসনে বাংলা বিহার সংযুক্তি পরিকল্পনা চলে। লক্ষ্য ছিল নিজ বাসভূমে বাঙালিকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করা। মাত্র ২০২৪ সালেও এই রাজ্যের বিজেপি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সহ, বিজেপি নেতারা উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গ কে পৃথক করা এবং উত্তরবঙ্গের সাথে অন্য প্রদেশের কিছু অংশ দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গেও অন্য প্রদেশের অংশ যুক্ত করে বাঙালিকে সংখ্যালঘু একটি জাতিতে পরিণত করার প্রস্তাব পেশ করেন।
অর্থাৎ বাংলা বিভাজন ও বাংলাকে দুর্বল করার একটা প্রয়াস সাধারণভাবে সমস্ত ইতিহাস জুড়েই লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক প্রবণতাটি বিপদজনক। ২০২১ সালে বঙ্গ বিজয় প্রায় সম্পূর্ণ করে ফেলেছিলেন মোদী শাহ জুটি। সেই স্বপ্নের পায়েসের গন্ধ নাকে লাগলেও জিভে লাগেনি। ২০২৪ সালে পরিস্থিতি আরো সুদূর । অতএব এবার সমগ্র বাঙালি জাতিকে আতঙ্কিত করার চেষ্টা। ডবল ইঞ্জিন সরকার না হলে সামনেই বিপদ। এমন একটা হাওয়া তোলা, এই হাওয়ায় সম্ভাব্য চারটি পরিণতি আশা করা যায় :
এক) সাধারণভাবে এখানে, এই রাজ্যেও বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে একটি আগ্রাসী মনোভাব গড়ে তোলা। স্মরণ করুন মেট্রো স্টেশনে বাংলা বলার কারনে এক মহিলাকে হেনস্তা করা অথবা সম্প্রতি এই রাজ্যের এক ট্যাক্সিচালক নাকি যাত্রীকে বাংলা বলতে নিষেধ করেন, হিন্দি বলতে বলেন। বাংলাদেশী আখ্যা দেন। এই ধরনের ঘটনাগুলি সমাজ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। যা এরাজ্যের বাঙালিকেও উত্তেজিত করবে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিকল্প হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বিপন্ন করার কাজ করবে।
দুই) রাজ্যে রাজ্যে বাঙালি আক্রান্ত – এই হাওয়ায় একটা ভীতিসঞ্চার করা যাবে। যার ফলে বঙ্গ বিজয় কিছুটা মসৃণ হবে।
তিন) বাঙালি জাত্যাভিমান আরো তীব্র ও সংযত রূপ গ্রহণ করে ২০২৬ সালে এ রাজ্যে বিজেপিকে পুনঃমুষিক ভব অবস্থায় পৌঁছে দেবে ২০১৯ পূর্ববর্তী তৃতীয় চতুর্থ স্থানে।
চার) গাজাকে প্যালেস্টিনিয়ান মুক্ত করার লক্ষ্যে ইসরাইল যেভাবে প্যালেস্টিনিয়দের ঠেলে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে পাঠাতে চায়, ঠিক তেমন পুশ ব্যাকের একটি পরিকল্পনা।
ক্ষমতাসীন তৃণমূল দল ছাড়াও সিপিআই এমএল (লিবারেশন) দল এবং বামফ্রন্ট এক্ষেত্রে প্রতিবাদে পৃথকভাবে পথে নেমেছে। ইতিপূর্বে বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনাগুলিকে যেভাবে বাঙালি জাতি নিজ নিজ পথ ও পদ্ধতি অনুসরণ করে চক্রান্ত প্রতিহত করেছে, এবারেও সেভাবে বাঙালির আত্মমর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করা ও সমস্ত বাংলা বিরোধী ষড়যন্ত্রকে নির্মূল করতে হবে। এই লড়াই বিভিন্ন দল তার নিজ নিজ মঞ্চ থেকেই পরিচালনা করুক। কিন্তু প্রতিটি মঞ্চেরই প্রচারের বর্ষা মুখ হবে বিজেপি বিরোধী। এই বিরোধিতা থেকেই বিজেপি পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে তৃতীয় চতুর্থ স্থানে পৌঁছে যাবে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে অন্যতম শর্ত হলো, লড়াইয়ের মঞ্চ থেকে শত্রুকে চিহ্নিত করতে গিয়ে দ্বিধা প্রদর্শন করলে চলবেনা। সিপিআইএম দলের সাবেক অবস্থান “বিজেমূল” তত্ত্ব, “এ রাজ্যেও জনবিরোধী সরকার”, এমন ইস্যু সামনে আনা চলবে না। তাহলেই লক্ষ্যভ্রষ্ট হবার সম্ভাবনা।
এই বাঙালি বিদ্বেষের একটি তীব্র প্রকাশ দেখা যাচ্ছে উড়িষ্যায়। অথচ উল্লেখ করা যেতে পারে, এই উড়িষ্যা একই সাথে “বাংলা বিহার উড়িষ্যা” নামে একদা উচ্চারিত হতো। ওড়িয়া সাহিত্যের অগ্রপথিক ফকির মোহন সেনাপতির রচনায় বিভিন্ন ছত্রে ও বিভিন্ন প্রসঙ্গে বাংলা মেদিনীপুর হুগলি বর্ধমানের কথা উল্লেখ আছে। কারণ উড়িষ্যার উপকূলের একটি পশ্চাৎভূমি ছিল এতদঞ্চল। ১৯৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে মেদিনীপুরের জাতীয় সরকার গুলি আর তালচের বালাশোর অঞ্চলের জাতীয় সরকার তো একাকার ছিল। বাঘা যতীনের বিপ্লবী কার্যকলাপের ঐতিহাসিক রণক্ষেত্র তো বুড়িবালামের তীর। উড়িষ্যার পুরীধাম তো বাঙালির সবচেয়ে নিরাপদ ও আরামদায়ক তীর্থস্থান ও পর্যটনকেন্দ্র বলেই জানতাম। কথায় বলতো, বাঙালির পুরী। তাহলে আজ হঠাৎ কি কারনে এত বাঙালি বিদ্বেষ? উড়িষ্যা উপকূলের মালঙ্গীদের প্রধান জীবিকারই ছিল লবণ তৈরি। ইংরেজ কোম্পানি লবণ তৈরির উপর একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার পর লক্ষ লক্ষ মালঙ্গী জীবিকা চ্যুত হয়। তারা বাংলার বিভিন্ন স্থানে বাগানের মালি, বনেদি বাড়ির পাচক, পূজারী, ইত্যাদি জীবিকায় নিযুক্ত হয়। কোথাও তো এদের সাথে বাঙালির বিরোধ ঘটেনি। এতদিন এবং এখনো নামি দামি ক্যাটারিং এর বহু রাঁধুনী উড়িষ্যা থেকে আগত।
অন্যান্য জেলার কথা জানিনা, হুগলিতে বিশেষত শিল্পাঞ্চলে, মেইন লাইনে, বড় বড় এলাকা ওড়িয়া পাড়া হিসেবে গড়ে উঠেছে। কোথাও তো কখনো অসুবিধা চোখে পড়েনি এখন পর্যন্ত। এই সম্প্রীতির পরিবেশটা নষ্ট করা একান্ত প্রয়োজন। শুনে অবাক হচ্ছি বাংলা ভাষা বলাটাই প্রথম সন্দেহের কারণ। তারপর তাকে প্রমাণ করতে হবে সে ভারতীয়, বাংলাদেশী নয়। এই প্রমাণের ক্ষেত্রে আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, সরকারি জব কার্ড, প্যান কার্ড, এমনকি বিজেপির মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরের মতুয়া কার্ড, কিছুই গ্রাহ্য করা হচ্ছে না। তুমি বাংলা ভাষা বলছো, অতএব তুমি বাংলাদেশি। অভিযোগকারী প্রমাণ করবে না, আমি বাংলাদেশী নয় এটা আমাকে প্রমাণ করতে হবে, কিম আশ্চর্যম! এমনকি শুনেছি পুরীর মাছের বাজারে গিয়ে বাঙালির যে বাড়তি উৎসাহ, সেটাকেও আঁড় চোখে দেখা হচ্ছে। হোটেলে মাছ মাংস চাইলে বাঁকা চোখে দেখা হচ্ছে। সমুদ্র উপকূলের শহরে মাছ, কাঁকড়া এগুলো প্রধান খাদ্য বলেই জানা ছিল। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে মহারাষ্ট্র গুজরাট থেকে আসাম উড়িষ্যা সমগ্রটাকে গো বলয়ে পরিণত করতে চায় বিজেপি। বাধা হয়ে আছে বাংলা বিহার ও ঝাড়খন্ড। এই তিন রাজ্যেই বিজেপি দ্বিতীয় শক্তি। ফলে আসন্ন বিহার ও বাংলা নির্বাচনে জয়লাভ বিজেপির কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সোজা পথে এই কাজে সে সক্ষম নয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা, প্রাদেশিক জিগির, ভোটার তালিকা থেকে বৈধ ভোটারকে বাদ দেওয়া, সব রকম চেষ্টা চলেছে এবং চলবে। লক্ষ্য করুন, এমনকি কাশ্মীরে পহলগাঁও হত্যাকান্ড ও তৎপরবর্তী সংবাদ মাধ্যমে মিথ্যা প্রচারের প্লাবন, ভারতীয় সেনার পাকিস্তান হানা, বিদেশে ভারতের সংসদীয় প্রতিনিধিদল প্রেরণ, এর সবকিছু কেন্দ্রীয় শাসক কে বিশেষ রাজনৈতিক সুবিধা এনে দিতে পারেনি। পরবর্তী উপনির্বাচন গুলি তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। কেন্দ্রীয় শাসক এখন বাংলা বিহার জয়ের জন্য মরিয়া। তার কাছে শেষ অস্ত্র বাংলায় আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতির মাধ্যমে এ রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে নির্বাচন করা।
প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতায় ও সমাজ মাধ্যমে বিজেপি শাসিত প্রদেশে বাঙালিদের ওপর নির্মম ও অমানবিক অত্যাচারের কাহিনী প্রকাশ পাচ্ছে। সেই কাহিনী নতুন করে উত্থাপন করব না। শুধু বলতে চাই, যেভাবে মিথ্যা অভিযোগে, বঙ্গভাষী হওয়ার কারণে, পিছমোড়া করে বেঁধে, দুদিন তিনদিন ধরে শারীরিক নির্যাতন চলেছে, সেটা বিজেপি ও মোদি সরকারের কাছে খুবই স্বাভাবিক। সেই কারণেই আমেরিকা থেকে ভারতীয় অভিবাসীদের হাতে-পায়ে শেকল বেঁধে ক্রীতদাসের মতো দেশে পাঠানোর ঘটনা সরকারের চোখে স্বাভাবিক ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের চোখে এগুলি অত্যন্ত স্বাভাবিক ও মানবিক। প্রতিদিন যা ঘটছে সেই সংবাদের খুঁটিনাটি বিবরণ এ রাজ্যে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করুক, একটা পাল্টা নিপীড়ন, নির্যাতনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করুক, এটাই বিজেপির ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা। তবেই তো আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতির প্রশ্ন তোলা যাবে।
ইতিপূর্বে যে সমস্ত প্রাদেশিক বিরোধের ঘটনা তার সাথে আজকের এই বিরোধ মাত্রাগত ভাবে ভিন্ন। সমগ্র বাংলাভাষী বাঙালিকে অত্যন্ত সংযতভাবে, দৃঢ়তার সাথে প্রত্যুত্তর দিতে হবে। কিন্তু সেই দৃঢ়তার পথে আমার চোখে দুটি বাধা :
প্রথমতঃ নতুন প্রজন্মের বাঙালি ছেলেমেয়েদের মধ্যে ইংরেজি ও হিন্দি মিশ্রিত কথোপকথন বা কালচার। বাঙালি ছেলে মেয়েদের কথায় “সায়েদ”, “মুঝসে পাঙ্গা লেনা”, “আবে ইয়ার খুলকে বাতা” এসব শব্দবন্ধ অনায়াসে ব্যবহৃত হয়। দেখেছি কোন বাঙালি ছেলে মেয়ে, কোথাও ফোন করে রিং হবার সময় “আবে ইয়ার, উঠানা, জলদি উঠা” অবশেষে “ওহ্ শীট” বলতে শুনেছি। হোলি, দিওয়ালি, ধনতেরাস, বিয়ের অনুষ্ঠানে মেহেন্দি, রঙ্গোলি, জাঁকিয়ে বসেছে। ভাবুন “কেননা” শব্দটি এখন ব্রাত্য, “কিঁউ কি” সমাদৃত। “মোকাবিলা” শব্দটি এখন “মুকাবলা” হয়ে গেছে। ফলে এদের কাছে ঘটমান বাঙালি খেদা সমস্যাটা স্পর্শ করছেনা। কারণ মূলত নিম্নবর্গের পরিযায়ী শ্রমিক, রাজমিস্ত্রি, ছোট খাটো হস্তশিল্পী, দিনমজুর, এরাই ভুক্তভোগী। কর্পোরেট সেক্টরে এটা প্রভাব ফেলে নি।
দ্বিতীয়তঃ যারা প্রতিবাদ করছেন সেই রাজনৈতিক প্রতিবাদের মধ্যেও লক্ষ্য করলাম, ভিন রাজ্যে বাঙালির ওপর পীড়ন ঘটলেও, কোন অঞ্চলে, কোন দলের, প্রতিবাদী পথসভা চোখে পড়েনি। লিবারেশন এবং কিছু মানবাধিকার সংগঠন কাজটা শুরু করেছে। কোনও কোনও দল হাতে লেখা পোস্টার দেয়ালে সাঁটিয়েছে কিন্তু তা অপ্রতুল। যখন সমস্যাটা বেশ ছড়িয়ে পড়েছে, চারদিক থেকে প্রতিবাদের মনোভাব একটু একটু প্রকাশ পাচ্ছে, তখন তৃণমূল, লিবারেশন, সিপিএম, সকলে কেন্দ্রীয় কর্মসূচি নিচ্ছেন। সাধারণভাবে আমি যে রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মে থেকেছি, সেখানে দেখেছি, ঘটনা ঘটার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া এলাকায় এলাকায় শুরু হয়। তারপর সেটা সংঘটিত আকারে কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতে রূপ নেয়। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি কেন্দ্রীয় কর্মসূচি হয় সংগঠিত ভাবে। কিন্তু আঞ্চলিক কর্মসূচি গুলি হয় স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে। এক্ষেত্রে বাঙালি পীড়নের ঘটনায় বাঙালির মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া কতখানি এই সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।