জানলাটা খুলে দিলেন। বাইরে সব স্থির। পাতা নড়ে না। একটি করে এলইডি মাথায় করে বাতিওলার মত সারসার লাইটপোস্ট দাঁড়িয়ে ঘুমোচ্ছে। সন্ধে হলে তারা চোখ তুলে চাইবে। এই ভাবে ওরা দাঁড়িয়ে আছে ১২ বছর ধরে, নীতা চলে যাবার পর থেকে। কেউ কোন কথা বলে না । একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেও না পাশে আরও কেউ দাঁড়িয়ে রয়েছে।
মুচকি হাসি এলো মনে কেমন উপমা আর কাব্যের ঢল নামছে তাই দেখে। সেই রিটায়ার করার পর থেকে বংশীবদন একটানা লিখে গেছেন। গল্প কবিতা প্রবন্ধ, ফিচার, কল্পবিজ্ঞান কি নয়। খাতার পর খাতা জমে জমে উপচে পড়ে আছে কাঠের র্যাকে র্যাকে, সর্বত্র। রিনরিন, নির্ঝরের বৌ বুঝেছিল এ এক পাগলামি। আড়ালে বলত,
তোমার বাবা এর থেকে পুজো আচ্চা করলে তো পারতেন। যখনই দেখি টেবিলে বসে লিখে যাচ্ছেন খাতার পর খাতা। কি লেখেন এত?
কি আর লিখবেন! বোধহয় ওনার স্ত্রী মানে আমার মাতাকে মনের দুঃখ জানিয়ে চিঠি লিখছেন।
হ্যাঁ আর আমার শ্রাদ্ধ করছেন।
বংশীবদন শুনতে পেতেন সব। কিন্তু লেখা থামতো না। আজ সেই লেখা নিয়ে ভাবনায় পড়েছেন বংশীবদন সরকার।
কি হবে এত লেখা? কেউ পড়বে? কেউ ছাপবে? নিজে গাদা টাকা ঢাললেও ছাপবে না। ফেসবুক হোয়া এখন কত মাধ্যম। কত গ্রুপ, কত ব্লগ। সবাই প্রাণপণ লিখে চলেছে। বংশীবদনের রুচি নেই তাতে। হাতে ষোল বছরের ক্রস গোল্ড। নির্ঝর চাকরি পেয়ে দিয়েছিল। সেই কলম চলেছিল ষোল বছর।
একবছর আগের সেই দিনের কথা মনে পড়ে। ১৩ই জুলাই। সেদিন থেকেই তাঁর সব লেখা বন্ধ।
দুঃখ হয়না। কেউ জানতে চাইলে বলতেন, লেখার আছেটাই বা কি। কিছুই নতুন আর ঘটে না। সব জানা। সব পুরনো। যতই যুক্তি দিয়ে দাঁড় করবার চেষ্টা করুন না, লেখা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আসল কারণটা যে বড় ব্যক্তিগত। খুবই ব্যক্তিগত, কাউকে বলার মত না।
এখন এই যে কথাগুলো লেখার জন্য তাঁর মন আনচান করছে, কিন্তু উনি লিখতে পারবেন না, মরে গেলেও না, তাই বোধহয় লেখা বন্ধ করে দিলেন। লেখা ছাড়ার পরে কি? কিচ্ছু না, ছুটি, অন্তহীন বিশ্রাম, সেটা ভাবা সোজা। কিন্তু মন যা চায় তা লিখলে যে কি হতে পারে সেটা কল্পনাতেও আনতে পারেন না। শরীর সিঁটিয়ে ওঠে, রক্তচাপ হু হু করে বেড়ে ওঠে, চোখের সামনে নানা রঙ্গের ফুল দপদপ করে ফুটতে থাকে, যখন ভাবেন রিনরিন এই লেখা মন দিয়ে পড়ছে, আর পড়তে পড়তে তার ঠোঁট কেমন বেঁকে উঠছে।
শম্পার বয়স রিনরিনেরই সমান সমান। সেরকমই লিখেছিল। আর বলেছিল, বয়সে কি আসে যায়? পৃথিবীর বয়স ১৩০০ কোটি বছর। আমাদের দু-দশ বছরে কি যায় আসে।
সোজা সুজি কথা। রাজনৈতিক মঞ্চ নয়, বিচারকের চেয়ার নয়, বা ধর্মস্থানের বেদী নয়, ফেসবুক মেসেঞ্জারে। এখানেই বুঝি বাধাহীন সব। এমন স্ক্রীনে তারে বলা যায়। কি কুক্ষণেই তিনি লোভ করে ফেসবুকে গিয়েছিলেন। জীবনে একবার মাত্র লোভ করেছেন, তা থেকে অজানা কোন পাপ আর পাপে কি মৃত্যু? কাল জানলায় দাঁড়িয়ে দূরের বড় টাওয়ার ঘড়িটা দেখার সময় ঘাড়ের কাছে হঠাৎ কার নিঃশ্বাসের স্পর্শ পেলেন । ঘড়িটা বাজতে থাকল, পিছনে দেখলেন কেউ নেই, শুধু প্লাস্টিকের দড়িতে ঝোলানো পুরনো গেঞ্জিটা দমকা হাওয়ায় উড়ে গিয়ে পড়ল ক্যাক্টাসের টবের ওপর। প্রেম কারো গোলাপ, কারো ক্যাক্টাস। শম্পা কিন্তু গোলাপের মতই ছিল। ছিল ভেবেই একটু খটকা লাগল, সে হয়তো এখনো আছে, নিজের বাগানে। কে জানে কেমন আছে!
সেদিন ছিল প্রথম শীত রবিবার। ২১শে ডিসেম্বর। ছেঁড়া খোঁড়া গলির ওপরে কেউ বিছিয়ে দিয়েছে ফুলপাতা আঁকা রোদের ঢাকনা, ডাইনিং টেবিলের মত সাজানো ছিমছাম লাগছে, তাতে পরিবেশন হচ্ছে হিম হিম কুয়াশার আইস্ক্রীম। বাইরে কাকা ও কাকীকে বিস্কুট আর কুল্লুকে একমুঠো চীনেবাদাম দিয়ে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে ফেসবুক খুলে বসলেন। তিনি বোধহয় একমাত্র দুপেয়ে যার কোন ফ্রেন্ড নেই। মাঝে মাঝে অ্যাপ থেকে সমবেদনা জানায়, “তুমি যে ভারী একা, একটা বন্ধুটন্ধু কর?’ বংশী জানেন এসবই ব্যবসা। যত বন্ধু তত তাদের কথা আড়ি পেতে শুনে জুতসই বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থা করা। আজব জগত । ওপরে আকাশ থেকে নীচে তলহীন গভীরে নেমে গেছে জানা ও অজানা ছবি, রীল, দারুণ, লাইক, হাসিমুখ, রক্ত রাঙা উড়ন্ত হৃদয়। আর সামনে সারি দিয়ে বসে আছে মুখের পর মুখ। বন্ধু করুন, ছোট্ট একটু কথা, ফেসবুক কত সহজে বলে দেয়। কে নেই সেখানে, পাল, চ্যাটারজী, কুটিনহো, ওয়াং চু, উদ্ধত চুলের বিস্ফোরণ মাথায় নিয়ে উন্মুখ যুবক, নানা সাজে সাজা অপরূপা, টুকটুকে লাল লাস্যমাখা ঠোঁটধারী গৃহগিন্নী, এলোমেলো উদাস কুরূপা রমণী সাগরতীরে, হাতে নিয়ে ফুলের সম্ভার, যাকে খুশি আমি বন্ধু চাইতে পারি, ফেসবুক চেয়েও দেখবে না। শুধু টুকে রাখবে চুপচাপ, সবকিছু। আড়ি পেতে থাকবে সারাক্ষণ।
৭০ বছর বয়সে আবার বন্ধু হয়? হবে নাই বা কেন? বংশীর সেদিন কেন কে জানে হাত নিশপিশ করে। পুরুষদের চোখগুলো বড় কঠিন, সবাই যেন যুদ্ধ করতে নেমেছে, অর্থ বা নারী না হলে ভীষণ কিছু করবে, না হলে গালাগালি ছড়িয়ে দেবে ছরছর করে। মেয়েরা বরং অনেকেই শান্ত, দুঃখী, কিছু তাদের বলার আছে, কিছু কথা। আর তাদের চোখগুলো জীবন্ত, যেন সামনে বসে আছে।
ফাঁদে পড়ে গেলেন বংশীবদন। চোখ দেখে। শম্পা লাহিড়ী। বয়স লেখা নেই, মনে হয় ৪০এর ঘরে। হাতে একটা বই, পাবলো নেরুদার। মুখটা সাধারণ, কিন্তু চোখে অনেক কথা। সমুদ্রের ঢেউ থেকে একটু দূরে, সূর্যাস্ত হচ্ছে, তার আলো আর হাওয়া খেলা করছে মুখের ওপর, অবাধ্য কটি চুল। এই ব্যাস। নেরুদা দেখে বংশীর চমক লাগল। নেরুদা বিপ্লবী, কমিউনিস্ট আর পরাক্রমী প্রেমিক। তার লেখা কোন মেয়ের হাতে! এ কি আমার বন্ধু হবে? অসুবিধে কি? আমি তো বয়স লুকোচ্ছি না। বন্ধু হতে চাইলে হবে, নইলে না।
ঝপ করে বংশী পাঠিয়ে দিলেন বন্ধু অনুরোধ। সঙ্গে একটা মেসেজ, ‘আমিও নেরুদার অনুরাগী, আপনার হাতে দেখে আমার ইচ্ছে হল কথা বলার।‘ তারপর খেয়াল করলেন, কোন অজ্ঞাত কারণে হার্ট রেট বেড়ে ৮০ পেরিয়ে যাচ্ছে।
একবার পাঠালে ফিরিয়ে নেওয়ার উপায় তাঁর জানা নেই। একজন ৭০ বছরের বুড়ো ৪০ বছরের মেয়ে বা মহিলাকে কি বন্ধু অনুরোধ পাঠাতে পারেন? পারেন না? ব্যাপারটা খুব বিশ্রী লাগলো নিজেরই। আবার প্রবোধ দিলেন, এটা তো পেশাদারি পরিচয়ও ভাবা যায়। আমি লিখি, কবিতাও লিখি অনেক। উনি, ও যদি লেখে, তাহলে নেরুদাকে নিয়ে আলোচনা চলতেই পারে। উশখুশ করেন, কফিটা পড়ে পড়ে ঠান্ডা হয়। বাইরে দেখেন তাঁর পাশবিক বন্ধুরা খাওয়া শেষ করে পালিয়েছে। রোদটা হেলে গেছে দেবদারুর পাতার ছায়ায়, ঠান্ডা একটু বেশি। একটু শীত করে, মাফলারটা গলায় জড়িয়ে ভাবতে থাকেন, এটা একটা কি কেচ্ছা করে ফেললাম? কেলোর কীত্তি? আমি কি কেলো?
উত্তর আসে পরের দিন। ভোর ভোর। অনুরোধ গৃহীত হয়েছে, ফেসবুক জানায়। সঙ্গে একটুকরো মেসেজ,
‘ধন্যবাদ। আমি নেরুদা নয় আরো অনেক কবির লেখাই পড়ি, লেখার চেষ্টাও করি মাঝে মাঝে। আপনি কি লেখেন টেখেন? আমি দুপুরে ফাঁকা থাকি, কথা হবে।‘
বংশীর মনে পড়ে যায় সেই কবে কিশোর বেলায়, চিঠি এসেছিল একদিন। বন্ধু নয়, চিরসাথী হতে চায় সে। আর এক কিশোরী, নির্ঝরের মা। তারপর কত দিন কেটে গেছে, কত ঝড়, কত বারিধারা, কত ভালবাসা, কত ক্ষোভ, কত প্রাপ্তি, কত আশা। চুকে বুকে গেলে শুধু মনে হয়েছিল, আর কেউ বন্ধু হবে না, এ জীবনে। আর এক মহিলার চিঠি এল এই শীতের উজ্জ্বল প্রভাতে। সে কি বন্ধু হবে আমার শেষ কদিনের?
শম্পা বন্ধু হল । কোন মেয়ে যে গাজা নিয়ে ভাবে, আর কোট করতে পারে নির্ভয়ে,
কাম এন্ড সি দি ব্লাড ইন দি স্ট্রীটস। ভাবা যায় না। একদিন বংশী নিজের কবিতা লিখে পাঠান।
উত্তর আসে কবিতায়।
আপনি কবিতা লেখা ছাড়া আর কি করেন?
শম্পা উত্তর দেয়, কিছু না। সময় পেলে শুধু কবিতাই লিখি। বাকী সময়টা আমার নিজের নয়।
-তখন কি আপনি সময়ের বাইরে চলে যান? অন্য ডাইমেনশানে?
আপনি তুমিতে পালটায় শীগগিরই। শম্পা খুবই সহজে বলে,
-আপনি আমার থেকে অনেক সিনিয়র, আমাকে তুমি বলবেন। আপনি বললে কেমন কানে লাগে।
বংশীর বুকের মধ্যে একটা ছোট ঘণ্টা বাজে। তাড়াতাড়ি সেটা বন্ধ করে দেন। তুমি চালু হয়ে যায়।
-তখন বাড়ী থেকে কল সেন্টারের কাজ করি। আমার স্বামীর শরীর ভালো না, শয্যাশায়ী, তাঁর জন্য অনেক কাজ থাকে, সে সেব জেনে কি হবে। কবিতা কি লিখছেন বলুন। ফেসবুকে যে অনেক কবিতা পোস্ট হয় তার ব্যাপারে আপনার কি মনে হয়?
-ভালোই তো। যত লেখা হবে ততই ভাল। ঝগড়া করার থেকে তো কবিতা লেখা ভাল। সে যেমনই হোক।
-কবিতাগুলো আপনি পড়েছেন? দেখবেন কয়েকজনের কবিতা খালি ঘুরে ঘুরে আসতে থাকে। আর বাকী যারা লেখে, তারা বেশির ভাগ ব্যর্থ প্রেম পুরুষ। অতৃপ্ত। বোঝাই যায় তাদের একটা ঘর আছে, সংসার আছে, ফুটফুটে শিশু আছে, কিন্তু তাদের অতৃপ্ত বাসনা তারা ছড়িয়ে দেয় লাইনে লাইনে। আমার ভালো লাগে না।
-বাহ, ব্যর্থ প্রেম নিয়ে কবিতা লিখবে না? ব্যর্থ নারীরাও লিখতে পারে। লেখে না কেন?
-মেয়েরা কবিতা লিখতে চায়, কিন্তু পড়বে কে?
-আমি তো পড়ি। তোমার লেখা পড়ি, মন্তব্য করি, কাটাকুটি করি, তুমি রেগে যাও নিশ্চয়।
-এই বুঝলেন আমাকে?
খুবই পেশাদার ইন্টেলেকচুয়াল কথা, বংশীবদন তাতে দোষের কিছু দেখেন না। কিন্তু নির্ঝরকে কি তিনি বলতে পারবেন? আমার সঙ্গে রিনরিনের বয়সী এক মেয়ের বন্ধুত্ব, আমরা কবিতা লিখি, তা নিয়ে আলোচনা করি?
শম্পা রোজ কিছু না কিছু লেখে। তাতে সমাজের কথা, ইতিহাসের কথা, মানুষের বিপন্ন বিস্ময়ের কথা সব থাকে। ও বলে ও যদি দেশে দেশ ঘুরতে পারতো, স্পেন থেকে মেক্সিকো, নরওয়ের সেই শহর যেখান থেকে দেখা যায় অরোরা, আলাস্কার সেই জায়গা যেখানে বরফ খুঁড়ে খুঁড়ে মাছ শিকার করে এস্কিমোর দল। ও পারে না, স্পেস ওকে আটকে রাখে, তাই ও কবিতার গাড়ীতে ওঠে বসে।
বংশীবদন এত কবিতা লিখতে পারেন না। তিনি আরো অনেক কিছু লেখেন, বিজ্ঞানের কথা, রাজনীতির কথা, কবিতা লেখেন মাঝে মাঝে। শম্পার কবিতা রোজ আসে, তার ভাষা দিন দিন আরো তীব্র হয়, ছন্দ ভেঙ্গে নতুন ছন্দ উঠে আসে, উপমা আর অলঙ্কারে সাজিয়ে তোলে অপার দুঃখ।
তিন দিন কোন পোস্ট নেই। বংশীর মন কু ডাক ডাকে। কিছু হল নাকি আবার? খেয়াল করেন, ছন্দ মাত্রা আর মিলের কঠিন আলোচনার মধ্যে কোথায় মনের মধ্যে তৈরী হয়েছে নরম মাটি। কিন্তু বংশী নিজে থেকে কখনো কিছু লেখেন না। শম্পা বলেছে আমি লিখলে আপনি উত্তর দেবেন। হ্যাঁ একটু দাবীর মতই শোনায়। কিন্তু বংশী বোঝেন, ওর জীবন খানিকটা ঝড়ে পর্যুদস্ত নৌকার মত। যখন ঢেউ কমে তখন ও ঠিক লিখবে।
কিন্তু এবারে বংশী আর না পেরে মেসেজ পাঠান,
-ভাল আছ তো? অনেক দিন কোন খবর নেই, লেখা বন্ধ হয়ে গেল নাকি?
দুপুর বেলায় উত্তর আসে, একটা হাসির ইমোজি দিয়ে।
-মাত্র তিন দিন তো হয়েছে, ব্যস্ত হচ্ছেন কেন। লিখব। লিখব। ওর শরীরটা খারাপ হয়েছিল, চেক আপ করতে নিয়ে গিয়েছিলাম।
-এখন ভাল?
-ঐ আর কি। আপনি ভালো তো? চিন্তা করবেন না। কবিতা আমাকে শক্তি দেয়। আমি ঠিক আছি।
-তুমি কোথাও ছাপাও শম্পা, তোমার লেখা খুব ভাল হচ্ছে। অনেক লোকে পড়বে, আমার মত বুড়ো লেখক কি আর তোমার লেখার মূল্য বুঝতে পারবে?
এরপর হঠাত সাতদিন লেখা বন্ধ। শম্পার কি রাগ হল? না কি ও ব্যাপারটা নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবছে? তাহলে তো ভাল।
দুপুরে নয়, রাত বারোটায় মেসেজ এলো, তার সঙ্গে একটা কবিতা।
-আমার স্বামী আর নেই। রাখতে পারলাম না। এই ফিরলাম। কাজ সেরে ফিরে আপনাকে লিখছি। এখন থেকে কাজ কমল। কবিতা লিখব আরো। আপনাকে কি ফোন করতে পারি?
বংশী কিছু সময় স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন, কোন উত্তর দিলেন না মেসেজের। একটা টিকটিকি দেয়ালে বসে একমনে ওনাকে দেখছে। দুটো মেসেজ হোয়াটসাপে নির্ঝরের আর বিদ্যুতের বিল। এই সব বড় পার্থিব। জাগতিক। শম্পার মেসেজ যেন অধিজাগতিক। ফোন করলে কি বলবেন? সান্ত্বনা দেবেন? বংশীকে কেউ কখনো সান্ত্বনা দেয় নি। উনিও দেন নি। কি বলবেন?
দু লাইন লিখে মেসেজ সেন্ড করে দিলেন।
-ফোন করে আরো কষ্ট বাড়বে। কিছু তো সান্ত্বনা দিতে পারব না। নিজের যত্ন নাও, শরীরের অবহেলা করো না। কবিতা পরে লিখো।
অনেক সময় চুপচাপ। টিকটিকিটা অন্য কোথাও শিকারের খোঁজে চলে গেছে। দেওয়াল ঘড়িটা টিক টিক করে না, শুধু নিঃশব্দে সময় হত্যা করতে করে আর ঘুরে যায়।
উত্তর এলো মিনিট দশেক পরে।
-আমি ঠিক আছি। আপনার পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ। ভেবেছিলাম আপনি কথা বলবেন। বুঝলাম।
বংশী লজ্জা পান, কিন্তু কথা বলার সাহস হয় না। সত্যি কথাটাই লেখেন,
-তোমার শোকের সামনে দাঁড়াবার সাহস আমার নেই। সহ্য করতে পারবো না।
-বুঝেছি। আপনাকে ভাবতে হবে না। এটা আমার আর আমার স্বামীরও নিষ্কৃতি। অনেক কষ্ট পেয়েছিল, তিন বছর ধরে ক্যন্সারের রোগী। ওও চাইত শেষ হয়ে যেতে। আর বলে গেছে কবিতা লিখো, আমি না থাকলেও।
-তোমার আত্মীয় বন্ধুদের সঙ্গে কষ্ট ভাগ করে নিও, শান্তি পাবে।
-আমার বন্ধু কেউ নেই, আপনি ছাড়া।
-আমি কে? ইথারের অন্ধকার দূরে দাঁড়ানো এক শেষ হওয়া মানুষ।
-আমার শেষ ছুঁয়ে থাকা মানুষ তো চলে গেল। এখন অন্ধকারে কবিতা আপনার হাত ধরে আছে, কবিতা আমার হাত ধরে আছে। আমার হাতের তরঙ্গ পৌঁছচ্ছে না আপনার হাতে?
-পাচ্ছি। কিন্তু আমার হাতে তো কিছু নেই। একটা দূর্বা ঘাসও নেই, শুধু ক্যাক্টাস।
-তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে চাও? এখন? আমার যে কিছুই থাকবে না আর।
হঠাত শম্পা নেমে আসে আপনি থেকে তুমিতে। বংশীর শরীর কাঁপতে থাকে, বুঝতে পারেন না, এই বিদ্যুৎ তরঙ্গ আলো জ্বালাবে না পুড়িয়ে ছাই করে দেবে তাকে। বয়সের বাধা কি সত্যি ভাঙ্গে? সত্যিই কি দুটি মানুষ হাতে হাত ধরতে পারে সমাজ সময় সব তুচ্ছ করে?
শম্পা টাইপ করে,
--তোমাকে আমি ভালোবাসি। তুমিও কথা না বললে আমি এই অন্ধকারে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো? কি করে আবার আমি লিখব?
-এটা ঠিক না শম্পা। তুমি আমার থেকে অনেক ছোট, ভালোবাসা কথাটা খুব কঠিন আইনি কথা, যে কেউ যাকে খুশি বলতে পারে না তুমি তো জানো।
-ওসব আমি জানি না। আমি তো তোমাকে ভালোবাসি, ব্যস এটাই কথা। এর পরে আর আমার কিছু বলার নেই। তুমিও কি ভালোবাসো না আমাকে?
-সে কথা বলা এমনকি ভাবাও আমার মনে হয় পাপ।
-পাপ করো নি মনে মনে?
এর পর আর কিছু বলার থাকে না বংশীর। এই পৃথিবীতে আর কটা দিন আছে, তাঁর সুনামে কি কালি ফেলবেন? স্বীকার করবেন? তারপর সংসারের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারবেন, এই আমার চেয়ে ৩০ বছরের ছোট মেয়েটাকে আমি ভালোবাসি। কানের কাছে শুনতে পান হা হা করে হেসে ওঠে সারা ঘর, সারা পাড়া, সারা শহর।
আর লিখবেন না বংশীবদন। কোন উত্তর না দিয়ে আন ফ্রেন্ড করে দিয়েছেন শম্পাকে। এটা ঠিক না। লোকে বলবে শোকের সুযোগ নিয়ে আমি ছোট মেয়েকে ফুসলেছি। কি বীভৎস আমাদের সব শব্দবন্ধ। চিরকাল তিনি একটু শব্দ নিয়ে সংবেদনশীল। খারাপ ভাষা শুনলে অশ্লীল ভাষা শুনলে শরীর কেমন করে। ফুসলেছি? মনে মনে শুনতে পান রিনরিনের তীব্র বিদ্রূপ, এই বয়সেও কি রস, ছোট মেয়েদের ফুসলাচ্ছেন।
একবছর আগে ঠিক এমনি ছিল সে দিন। কিছু লেখেন নি এক বছর। আজ আবার সেরকম সিক্ত হাওয়া হেঁটে যাচ্ছে মেঘের ছায়ায় ছায়ায়। বংশীকে কি যেন টানছে কদিন ধরে। ঠিক করেছেন আজ শম্পার বাড়ী যাবেন। শম্পার এক কবিতায় ছিল এক বাড়ীর গল্প। নিরালাহাটের ভিতরে শেষ যে গলিটা ঢুকে একবার পাক খেয়ে আবার বেরিয়ে গেছে, সেই পাকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটা নীল একতলা বাড়ী। সেই বাড়ী ঘেরা বাঁখারির বেড়া দিয়ে আর সেই বেড়ার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে এক চম্পাবতী।
কবিতায় লিখেছিল এরকম কিছু। জানতে চেয়েছিলেন বংশী এটা কি তোমার বাড়ী? উত্তর দিয়েছিল, হতেও পারে। কোনদিন এসে দেখবেন।
বংশী একটা উবের ভাড়া করে নিরালাহাটে পৌঁছলেন তখন বিকেল চারটে। দোকানপাট দু একটা খুলেছে, রাস্তায় ভাপ উঠছে কিছু আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, চার দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কিছু গুলমোহরের পার্থিব শরীর। এর শেষ গলি। সেই গলি অনেকখানি ঢুকে পাক খেয়ে আবার বেরিয়ে গেছে নদীর মত, তার ঠিক মাঝে-
না কোন নীল বাড়ি নেই। একটা চার তলা ফ্ল্যাট, নতুন লোক এসেছে, এসি লাগানো হয়েছে, চক চক করছে, ঝক ঝক করছে বাড়ীটা। কোন বেড়া নেই, সোজা রাস্তা থেকে উঠে গেছে সিমেন্টের শক্ত শিরদাঁড়া।
কোন চম্পাবতী নেই। চাঁপা ফুলের গাছ নেই ত্রিসীমানায়।
মুচকি হাসেন, বংশীবদন। বেশ ঘুরিয়েছে মেয়েটা। কবিতার সঙ্গে কী জীবন মেলে? আর অনলাইনের ওয়াই ফাই দিয়ে বিনোদন ঝরে ঝরে পড়ে, তাকে ভালোবাসা ভেবে ভুল করা শুধু মুর্খামি।
আর এক কোণে একটি চায়ের দোকান। মনে হয় হাটের লোকজন এখানে চায়ের অর্ডার পাঠায়, ছোট্ট ১০ সিসির কাগজের কাপ, লেবুর গন্ধ, চায়ের শট বলা যেতে পারে। সারা দিন চলে। সামনে গিয়ে দাঁড়ান, একটা চায়ের অরডার দেন, বড় ভাঁড়ের চা, ১০ টাকা। লিকার। আসতে আসতে দোকানীকে জিজ্ঞেস করেন,
“এই ফ্ল্যাট বুঝি নতুন? ফাঁকা আছে নাকি একটা? অনেক দাম হবে মনে হয়। নতুন ঝক ঝক করছে।
চা-ওলা একবার পুরোটা জরীপ করে বলে, দালাল আছে দরকার হলে মোবাইল দিতে পারি। তবে অনেক দামী। এই পাড়ায় দাম অনেক, ব্যবসার পয়সা না হলে… আপনি তো মনে হচ্ছে রিটায়ারড লোক, পারবেন না।
-তবু খোঁজ করি, এদিক ওদিক, রেডিমেড যদি পাই তো সুবিধে। এখানে কি কোন বাড়ী ছিল?
-তা তো ছিল, বাড়ী ভেঙ্গেই তো ফ্ল্যাট হয়, এখানে আর ফাঁকা জমি কোথায়।
-বাড়ীর লোকজন? তারা ফ্ল্যাট পেয়েছে নিশ্চয়। এটা একটা সুবিধে।
-দূর, বাড়ীর লোক কেউ নেই। এখানে একটা গোলমাল হয়েছিল, তারপর বাড়ী ফাঁকা পড়েছিল, আত্মীয়েরা ব্যবস্থা করে, প্রোমোটার আছে নেপালদা, সেই বানিয়েছি।
-গোলমাল মানে?
-সে একটা, আপনাকে ঠিক বলা যাবে না।
-আচ্ছা এখানে কি একটা চাঁপা গাছ ছিল?
-তা ছিল, আপনি কি করে জানলেন? দোকানদার হাঁ হয়ে যায়, প্রশ্ন শুনে।
-মানে, আমি অনেকদিন আগে এখানে এসেছিলাম, আমার এক বন্ধুর সঙ্গে। আর বাড়ীটার রঙ ছিল নীল। আমার আবার একটু মনে থাকার অসুখ আছে।
-নীল, একটু ভাবে দোকানদার, তারপর তার মনে পড়ে, আকাশী নীল। আপনার তো খুব মনে আছে। কিন্তু এটা কি রকম অসুখ সেটা ঠিক সে ভেবে পায় না।
-বাড়ীর লোকজন?
-ঐ তো ক্যান্সার পেসেন্ট ছিল, নীলুদা। খুব সুন্দর গান গাইত। আর…
-আর? আগ্রহ ভরে বংশী জানতে চান
- না আর কিছু না। আপনি সি আই ডি নয় তো?
-ধুর, সি আইডি এখন আছে নাকি? এখন ইডি, সি বি আই এইসব। আমাকে দেখে তোমার ভাই সি আই ডি মনে হল। একটা বিস্কুট দেবে? এস বিস্কুট? এখনো পাওয়া যায়?
দোকানদার বিস্কুট ধরিয়ে কথায় ছেদ দেয়। সে বোধহয় অনেকটাই বলে ফেলেছে, আর বলা বারণ। বিস্কুট ৫ টাকা, হাত বাড়িয়ে দেয় দামের জন্য।
বংশী ধীরে ধীরে বিস্কুট ভাঙ্গেন, চা খান, আর ভাবার চেষ্টা করেন, চম্পাবতীর কথা, নিশি রাতে যার চিঠি ভেসে যায় সিক্ত হাওয়ায়। অনেক অনেক দূরে।
বংশী সেই বাতাস বুকে ভরে নিয়ে ফিরে আসেন। সব কিছু হয়ত না জানাই ভালো। সে কি আমায় সত্যিই ভালবাসত? আজ দেখতে পেলে জিজ্ঞেস করবেন বলে এসেছিলেন। একই সঙ্গে বলতে তাঁর মনের কথা, লজ্জা দ্বিধা সব ছেড়ে।
হলো না। এখন রাত নটা, বংশী জানলা দিয়ে হাত বাড়ান। অন্ধকার হাতে লাগে, ভিজে ভিজে। হাত মুছে ফেলেন বংশী। ক্রস কলমটা খুলে দেখেন, সরু তীক্ষ্ণ টিপ, তা থেকে ঝরে পড়ে অশ্রু। বংশী লেখা শুরু করেন। লিখবেন। যতদিন পারেন। যতদিন বাঁচেন।