ঔরঙ্গজেব মারা গেলেন সতেরোশো সাত সালে। তাঁর শেষ ইচ্ছের কিছু পূরণ হয় তার মধ্যে একটা ছিল তাঁর সুফি মুরশিদ জইনুদ্দিন চিস্তির দরগাহতেই এক কোণে আটপৌরে ভাবে সমাধিস্থ করা। জায়গাটা খুলতাবাদ, এখনকার ছত্রপতি শম্ভা জি মহারাজ নগরে। তাঁর অন্য ইচ্ছে ছিল মোঘল সাম্রাজ্যকে তিন ছেলের মধ্যে ভাগ করা। ঔরঙ্গজেবের মতোই তাঁর ছেলেরাও বাবার কথা শোনে না।বিরাট এলাকা জুড়ে নিজেদের অনুগত সব সেনানায়ক আর মনসবদারদের জড় করে মারামারি করতে থাকে। সেসব দলে মারাঠা, শিখ, রাজপুত, বুন্দেলা সব সামরিক বর্গের লোকেরা ছিল ইরানি–তুরানি–আফগানদের সঙ্গে ইউরোপিওরাও ভারতের এই বিশাল মিলিটারি লেবার মার্কেটে তাদের কামান বন্দুকের যোগান দিয়ে বা নিজেরা ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে খেটে টাকা কামাতো। এই যুদ্ধে কুড়ি হাজার সেরা সেরা মোঘল যোদ্ধা আর সেনানায়ক মারা গেল। এ সবে ঔরঙ্গজেবের নয়নের মণি সেরা সেনানায়ক আজমপুত্র বিদার বখত মারা যেতে মোঘল সাম্রাজ্যের অশেষ ক্ষতি হয়। জয়ী হলেন মোয়াজ্জম তিনি বাহাদুর শাহ এক উপাধি নিলেন। গুরু গোবিন্দ সিংহ ছিলেন তাঁর সহযোগী, ফলে শিখরা ওনার হয়ে লড়েছিল ।
ঠিক এই সময় ষোলশো ঊনআশির এগারোই মার্চ নৃশংস ভাবে মারা হয়েছিল যাকে, সেই ছত্রপতি শম্ভাজি মহারাজের পরিবার মোঘল প্রশাসনের হাতে বন্দী। যে আলমগীর হানাফি বিচারবিধির কূটতর্কে শম্ভাজিকে ও তাঁর আমাত্য কবি কলসকে শিরচ্ছেদের রায়ে সায় দেন তিনিই ওই মৃত রাজার বউ ছেলেকে সযত্নে দেখভাল করে এসেছেন। একই সঙ্গে শম্ভাজিকে কচুকাটা করা আর তাঁর ছেলেকে ফার্সি আদবকায়দায় মানুষ করার উদ্দেশ্য কি হতে পারে ? আলমগীরের নিজস্ব কায়দায় সেটা ছিল ধর্মীয় নয় ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা মাথায় রেখে নেওয়া নিখাদ এক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, যার বৈশিষ্ট্যই হলো এক দিকে চরমতম নৃশংসতা আর অন্যদিকে আঁতাতের সম্ভাবনা জিইয়ে রাখার অত্যন্ত সুচিন্তিত পদক্ষেপ গ্রহণ। আঠেরো বছর মোঘল হেফাজতে থেকে চোস্ত এক ফার্সি শিক্ষিত যুবক শম্ভাজি মহারাজের ছেলে শাহুজি মহারাজকে নিয়ে আলমগীর পরবর্তী মোঘল প্রশাসন কী করে ? এই নিয়ে একটা ধোঁয়াশা আছে। তিনি কি মালওয়া থেকে পালিয়েছিলেন না আলমগীর পরবর্তী বাদশাহ মোয়াজ্জম তথা বাহাদুর শাহ'র ফরমানের অপেক্ষা না করে পাদশা বেগম জিনাত উন্নিসার মদতে আর মারাঠা ভূমির মোঘল সেনানায়ক ঔরঙ্গজেব ঘনিষ্ঠ জুলফিকার খানের প্রত্যক্ষ পরামর্শে তাঁকে চলে যেতেই দেওয়া হয়, সেই নিয়ে ইতিহাসকাররা সন্দিহান। দ্বিতীয় মতটাই ঠিক মনে হয়। যেভাবে আলমগীর পরবর্তী মোঘল বাদশাহরা শক্তিমান সেনানায়কদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসেছিলেন তাতে সেসময় মারাঠাদের মধ্যে ঝামেলা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে দাক্ষিণাত্যের মোঘল প্রশাসনের প্রধান জুলফিকার খানের এই সিদ্ধান্ত। তিনি হয়ত অতি আত্মবিশ্বাসে ভেবেছিলেন সেসময়ের মারাঠা নেত্রী তারাবাইয়ের বিরুদ্ধে শাহুজি তাঁর হয়ে কাজ করবেন। তবে শাহুজি ছাড়া পেয়ে কী কী করলেন, কী ভাবে মারাঠারা শাহুজি বনাম তারাবাই দু'দলে ভাগ হয়ে নিজেদের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়লেন বা কীভাবে ফার্সি জানা সফিস্টিকেটেড দাখানি ( মোঘল দরবারের বা সেসময়ের হিন্দুস্থানি ভাষায় দাক্ষিণাত্যের লোক) শাহুজি মোঘলদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজেই স্বাধীন মারাঠা সাম্রাজ্যের পতাকাবাহী হলেন সে নিয়ে ইতিহাসকাররা নিঃসন্দেহ। তবে এখানে একটা গল্প আছে যা এই হিন্দু- মুসলিম মেরুকৃত সময়ে শম্ভাজির নৃশংস মৃত্যুর পাশাপাশি রাখলে একটু হোঁচট খেতে হবে। স্টুয়ার্ট গর্ডন বলছেন ছাড়া পেয়েই মালওয়া থেকে সোজা খুলতাবাদে ঔরঙ্গজেব আলমগীরের সমাধিতে উপযুক্তভাবে সম্মান জানাতে এলেন শাহুজি আর তারপর চললেন আরো দক্ষিণ মহারাষ্ট্রের দিকে (Stewart Gordon The Marathas পাতা ১০৩, ২০০৩ সংস্করণ)। ব্যাপারটা কেমন হলো ? চূড়ান্ত হিন্দু বিরোধী বলে পরিচিত, ক্রুর শাসক ঔরঙ্গজেব আলমগীরের হাতে মৃত শম্ভাজির ছেলে শাহুজি তাঁর পিতৃহত্যাকারীর সমাধিতে যাবেন কোন যুক্তিতে ?
এ আলোচনার পরিধি অনেক বিশাল। এ বুঝতে গেলে মোঘল রাষ্ট্রে আঁতাতকামী চরিত্র বুঝতে হবে। বুঝতে হয় সে রাষ্ট্রর এখনকার মতো জাতি রাষ্ট্র (Nation State) ছিল না, ছিল স্থানীয় রাজার সঙ্গে বৃহদাকার মোঘল রাষ্ট্রের এক সহযোগের ফলাফল (shared basis of sovreignty), স্থানীয় রাজারা কেন্দ্রীয় করের পাশাপাশি নিজের ইচ্ছে মতো কর তুলতেন, মোঘল ফৌজে ছিল বিরাট সংখ্যক মারাঠা সর্দার যা আলমগীরের আমলে অনেক বাড়ে, সর্বোপরি বুঝতে হয় শিবাজির রাষ্ট্র ভাবনা নিয়ে বিভিন্ন মতের কথা আর শাহুজির রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কথা। সে সময়কে এখনকার সময়ের নিরিখে দেখলে চলে না। কিন্তু হিন্দুত্ববাদীরা এসব কোন কিছুই শোনে না। তারা এই দেশকে আবার ভাগ করার দিকে নিয়ে যায় ধর্মের ভিত্তিতে, তারা দেশের জটিল ইতিহাসকে হোয়াটস এ্যাপ ইউনিভার্সিটির গাঁজাখুরি হিন্দু -মুসলিম মেরুকরণের ফলাফল মনে করে আর সবচেয়ে বড় কথা সে করতে গিয়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক প্রভুর মদত পায়। কে বোঝাবে আলমগীর আর শিবাজির–শম্ভাজি–তারাবাই– শাহুজির সময়ে মারাঠা বা মোঘলরা বা শিখরা এই ভাবে মেরুকৃত ছিল না - সে কথা। তবে সমসময়ে জিন্দা পীর বলে বন্দিত ঔরঙ্গজেব আলমগীরের বা তার সমাধির তাতে কিছু এসে যায় না কারণ তাতে তার স্থান মাহাত্ম্যই বাড়ে। লোকে আরো বেশি দেখে ফেলে সেই সমাধির ছবি। করসেবকরা যদি বাবরি মসজিদ ভাঙতে পারে তবে ছত্রপতি শম্ভাজি নগরের খুলতাবাদে ঔরঙ্গজেব আলমগীরের আটপৌরে সমাধিও বাঁচবে কী করে ? কিন্তু বাবরি ভেঙেও কি বাবরির নাম মুছেছে? সে তো শুধু ইতিহাসের পাতায় নয় বারবারই নানা প্রসঙ্গে উল্লেখিত হয় ভারতীয় ব্যবস্থার ব্যর্থতা হিসেবে। ওই মসজিদ ভাঙার ঘটনাটা যেন চীনের তিয়েন আন মেন স্কোয়ারের ঘটনার মতোই এক ব্যবস্থার কলঙ্ক।
প্রত্নতত্ত্ব সমীক্ষণের মতে ইতিহাসের এই বিখ্যাত প্রতীক ঔরঙ্গজেব আলমগীরের খুলতাবাদের সমাধি রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা পেয়ে এসেছে। তাই শেষমেশ একে রক্ষা করা বা উপড়ে ফেলা দুটো দায়ই এখন রাষ্ট্রের। এ এক যুগসন্ধি ক্ষণ আর তার কেন্দ্রবিন্দু তিনশোর বেশি বছর আগে মৃত এক বাদশাহ । আমরা কি অতীতেই বাস করছি ?
আগ্রহীরা সাম্প্রতিক ইতিহাসকার Stewart Gordon The Marathas , Richard Maxwell Eaton এর A Social History of Deccan, 1300 -1761, Indian in the Persianate Age 1000-1765 আর Munis D Faruqui The Princes of the Mughal Empire, 1504-1719 , The Mughal State 1526-1750 by ALAM MUZAFFAR & SUBRAHMANYAM SANJAY (EDITORS)
Jos Gommons, Mughal Warfare মিলিয়ে পড়ে নেবেন।