মণীশ সিসোদিয়াকে গ্রেফতার কি অ্যাডভান্টেজ বিজেপি? না কি অ্যাডভান্টেজ আপ? এই সংশয়টা মাথায় খচখচ করছে। সরল ন্যারেটিভ আর পলিটিক্যাল ন্যারেটিভ তো এক নয়। কোথায় যেন একটা মডেল কাজ করছে, সময় সরব হয়ে তা হয়ত সামনে নিয়ে আসবে।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রবিবার সিবিআই দফতরে যাওয়ার আগে দিল্লির উপমুখ্যমন্ত্রী বেশ নাটকীয় মুহূর্ত তৈরি করেন। প্রথমে যান রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীর সমাধিস্থলে। সেখানে গিয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানান তিনি। সেখান থেকে সরাসরি কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার দফতরে। আর সেখানে ঢোকার আগেই সিসোদিয়া আশঙ্কা প্রকাশ করেন, জিজ্ঞাসাবাদান্তে তাঁকে গ্রেফতার করা হতে পারে। হয়ত ৭-৮ মাস তাঁকে আটকে রাখা হবে। সে কারণেই দলের কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশ্যে মণীশ বলেন, 'আমাকে গ্রেফতার করা হতে পারে। কিন্তু তাতে আমি ভয় পাই না। বাড়িতে অসুস্থ স্ত্রী আর ছেলে রয়েছে। ছেলে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। আপনারা তাঁদের দেখভাল করবেন।' আর গ্রেফতারের খবর পাবলিক হতেই বিজেপির মুখপাত্র তথা আইটি এক্সপার্ট সম্বিত পাত্র বলেন, ‘একবার ভাবুন, একজন শিক্ষামন্ত্রী আবগারি নীতির জন্য গ্রেফতার হচ্ছেন। মণীশজি, আপনি আমাদের বাচ্চাদের জীবন নিয়ে খেলা করেছেন।’ আর আপ সুপ্রিমো অরবিন্দ কেজরিওয়াল পালটা টুইট করেন, ‘মণীশ নির্দোষ। ওঁর গ্রেফতারি নোংরা রাজনীতি। সিসোদিয়ার গ্রেফতারিতে মানুষের মনে অনেক রাগ জমা হয়ে আছে। মানুষ বোঝেন সবকিছুই। মানুষই এর জবাব দেবে। আমাদের লড়াই আরও শক্তি পেল।’
এই শেষ বাক্যটি ভারী ইন্টারেস্টিং। আপ আরও শক্তি পেল। আপের জন্মলগ্ন থেকেই কংগ্রেস শিবিরের দাবি, আম আদমি পার্টি বিজেপির বি টিম বা অক্সিলারি ফোর্স। কংগ্রেসের ভোট কাটতেই বিভিন্ন রাজ্যে আপ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। পঞ্জাবে কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। হরিয়ানায় ভোট কেটে বিজেপিকে ক্ষমতায় থাকতে সুবিধা করে দিয়েছে। হিমাচল প্রদেশে প্রার্থী দিয়ে বিজেপির সুবিধা করিয়ে দিতে চেষ্টা চালিয়েছে আর গুজরাতে তো মোদীর রেকর্ড জয়ের আসল কারিগর কেজরিওয়ালের আপ। অন্য জায়গায় বিতর্ক থাকলেও গুজরাত নিয়ে কংগ্রেসের অভিযোগটার কিন্তু যথেষ্ট পোটেনশিয়ালিটি আছে। গুজরাত বিধানসভা ভোটের ফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আপের উপস্থিতি বিজেপিকে ৫০টা আসন বেশি পেতে সাহায্য করেছে, যার মধ্যে বেশিরভাগই ছিল কংগ্রেসের ঘাঁটি। ২০১৭-র বিধানসভা ভোটেও কংগ্রেস ওই রাজ্যে ৪৪ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়েছিল। ২০২২-এ তা নেমে এসেছে ২৬ শতাংশের কাছে। ভোটের ফলে স্পষ্ট, বিজেপি বিরোধী পাটিদার ভোটের পাশাপাশি সরাসরি কংগ্রেসের অনগ্রসর ও দলিত ভোটে থাবা বসিয়েছে আপ। ভোটের পাটিগণিত বলছে, বহু আসনেই আপ এবং কংগ্রেসের ভোট কাটাকাটিতে জিতে গিয়েছেন বিজেপি প্রার্থী। বিশেষ করে, সৌরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ গুজরাতের পাশাপাশি, আহমেদাবাদ-গান্ধীনগরের একাধিক আসনেও কংগ্রেসকে পিছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে আপ। নর্মদা, গির-সোমনাথ, সুরেন্দ্রনগর, তাপি, অমরেলি, আরাবল্লি, পোরবন্দর, দাহোদ, দ্বারকার মতো জেলায় উল্লেখযোগ্য ভোট পেয়েছে ঝাড়ু শিবির। গুজরাতে ঝাড়ুর প্রথম চমকটা এসেছিল ২০২১ সালের পুরভোটে। দক্ষিণ গুজরাতের সুরাতে কংগ্রেসকে ‘শূন্য' করে দিয়ে ২৭টি ওয়ার্ড জিতে বিরোধী দল হয়েছিল আপ। পদ্মের রাজ্যে ঝাড়ুর প্রথম চমকটা এসেছিল ২০২১ সালের পুরভোটে। দক্ষিণ গুজরাতের সুরাতে কংগ্রেসকে ‘শূন্যে’ ঠেলে দিয়ে ২৭টি ওয়ার্ড জিতে বিরোধী দল হয়েছিল আম আদমি পার্টি (আপ)। পেয়েছিল প্রায় ২৯ শতাংশ ভোট। তার পরেই মোদী-শাহর রাজ্যে বিজেপির ‘সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী’ হিসাবে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নাম নিয়ে আলোচনা শুরু করেন ভোটপণ্ডিতরা। গুজরাতে ‘যাতায়াতও’ বেড়ে যায় দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর। এখনও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছে, বিজেপি কৌশলগত ভাবেই আপকে বাড়তি জনপ্রিয় হতে সাহায্য করছে। কর্নাটক, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড় বিধানসভা ভোটে কেজরিওয়াল অ্যান্ড কোম্পানি যদি গুজরাতের পারফরমেন্স দেখাতে পারে, তবে আখেরে লাভ হবে বিজেপির। এই চারটি রাজ্যেই বিজেপি কিছুটা হলেও ব্যাকফুটে আছে। গত বিধানসভা নির্বাচনে এর কোনোটাতেই বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ভাঙাগড়ার খেলায় মধ্যপ্রদেশ ও কর্নাটকটা হাতাতে পেরেছে। এই পাটিগণিতের ওপর দাঁড়িয়ে মণীশ সিসোদিয়াকে গ্রেফতার আপকে যদি একস্ট্রা মাইলেজ দেয়, তবে লাভ মোদী-শাহদেরই। সে কারণেই একাংশ ভোট বিশেষজ্ঞর ধারণা, লং গেমের দিকে তাকিয়েই এগোচ্ছে বিজেপি। সিবিআই তৎপর হয়ে সিসোদিয়াকে প্রতীকী 'শহিদ' করে ঝাড়ুতে বাতাস লাগাচ্ছে। অপেক্ষাকৃত সফেদ ইমেজের আম আদমি পার্টির ভাবমূর্তি বাড়ানোর জন্য এটা বিজেপির একটি কৌশল হতে পারে এবং এতে সফল হলে এইভাবে বিরোধীদের ভোট ভাগ করতে পারলে, ক্ষমতাসীন মোদী-শাহদের তখত আনটাচ থেকে যাব৷ চব্বিশেও। তারা বলেছে যে বিজেপি এখন আপের ওপর আক্রমণ আরও বাড়াবে এবং এ বছরের চার রাজ্যে নির্বাচন ও ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচনের আগে এই চাপ বাড়িয়ে জাতীয়স্তরে সব মনোযোগ আপের দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারলে বিরোধীদের ঝেঁটিয়ে বিদায় সহজ হয়ে যাবে গেরুয়া শিবিরের। এটাকে বলা যেতে পারে বিজেপির গেম প্ল্যান।