২৫০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে মৌর্য সম্রাট অশোক স্থাপন করেন স্তম্ভটি। স্তম্ভের মাথায় চারটি এশিয়াটিক সিংহ পরস্পরের সঙ্গে পিঠোপিঠি করে দাঁড়িয়ে। অশোক স্তম্ভের এই অংশটিকে বলে লায়ন ক্যাপিটাল। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারত রাষ্ট্র এই লায়ন ক্যাপিটাল অংশটিকে জাতীয় প্রতীকের মর্যাদা দেয়। অশোকস্তম্ভের শীর্ষ থেকে জাতীয় প্রতীকে আনয়নের শিল্পীত কাজটি করেন আচার্য নন্দলাল বসু, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুর অনুরোধে। তারপর থেকে যথাবিহিত মর্যাদার সঙ্গে এই প্রতীক ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমানে সারনাথের মিউজিয়ামে আসল লায়ন ক্যাপিটালটি শোভা পাচ্ছে।
স্বাধীনতার ৭৫ বছরে এসে ভারতের জাতীয় প্রতীকের মর্যাদা ভূলুন্ঠিত হল, দেশের সরকারের বদান্যতায়। প্রায় আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন একটি ভাষ্কর্যের চেহারা বেমালুম পালটে গেল কয়েকটি বিকৃত মস্তিষ্ক মিথ্যাচারীর খেয়ালে। বিশ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রস্তুত সেন্ট্রাল ভিস্তার অন্তর্গত নতুন পার্লামেন্ট ভবনের মাথায় প্রতিষ্ঠিত হল একটি বিকৃত মুর্তি যার সঙ্গে জাতীয় প্রতীকের বিস্তর ফারাক। প্রকৃত প্রতীকটিতে সৌম্য সিংহদের শৌর্য ফুটে আছে, কিন্তু কোনো হিংস্রতার চিহ্ন নেই। বিকৃত মূর্তির সিংহরা ক্রুদ্ধ, যেন গর্জনরত এবং খানিক ছাতি ফোলানোও।
বিকৃত জাতীয়তাবাদী মননে হয়তো এই হিংস্র মূর্তি ফুর্তির জোয়ার আনবে, মনে মনে চিন আর পাকিস্তানকে লাল লাল আঁখ দেখানো হয়ে যাবে। কিন্তু দেশের সুস্থবুদ্ধির জনতা এতে ক্রুদ্ধ না হয়ে পারবেন না।
বিজেপির আরো একটি সূক্ষ্ম চক্রান্তও কারো কারো নজর এড়ায়নি। অশোকস্তম্ভের লায়ন ক্যাপিটালটি বসানো আছে একটি উলটনো পদ্মফুলের উপর, যা জাতীয় প্রতীক হিসেবে গৃহীত হয়নি। কিন্তু সেন্ট্রাল ভিস্তার অশোকচক্রে সেই উলটোনো পদ্মটি সোজা হয়ে একেবারে বিজেপি দলটির প্রতীকচিহ্ন হয়ে জুড়ে বসেছে হিংস্র ক্রুদ্ধ বুকফোলানো সিংহগুলোর নীচে। তাছাড়া, প্রকৃত জাতীয় প্রতীকের সিংহের নীচে দেবনাগরী হরফে লেখা আছে " সত্যমেব জয়তে", যার অর্থ "সত্যের জয়"। এই বাক্যটি গৃহীত হয়েছে ঊপনিষদ থেকে। আমাদের দেশের ক্ষমতাসীন মিথ্যাচারীর দল এমনিতেই সত্যকে ভয় পায় , ফলে সত্যের জয়ের মতো তাদের পক্ষে আত্মঘাতী লাইনটি তারা জেনেবুঝেই উড়িয়ে দিয়েছে। স্বাধীন ভারতের জাতীয় প্রতীক, যা প্রায় আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন এক ভাস্কর্য থেকে গৃহীত, তাতে তো সব নাগরিকের উত্তরাধিকার। আশ্চর্য প্রাচীন আর সর্বসমন্বয়ী এই দেশের তা অহংকারও বটে, তাকে বিকৃত করে একেবারে পার্লামেন্টের মাথায় বসানোর অধিকার কারোরই থাকতে পারে না।
https://twitter.com/MahuaMoitra/status/1547059040467193856?s=20&t=KOKZ6cmRnwtTcj-iGiteNA
আপত্তিকর আরো দুটি কাণ্ড আজকের ক্ষমতাসীন সরকারটি একইসঙ্গে ঘটিয়েছে। প্রথমত, ধর্মনিরপেক্ষ ভারত রাষ্ট্রে সব ধর্মের সমান অধিকার। এবং রাষ্ট্রেরও সব ধর্মের প্রতি সমান নির্লিপ্ততা থাকা জরুরি। গণতন্ত্রের প্রধান চর্চাকেন্দ্র পার্লামেন্টে হিন্দুমতে পুজো আচ্চা করে সংবিধানের অমর্যাদা করেছে মোদী সরকার।
দ্বিতীয়ত, দেশের প্রধান রাষ্ট্রপতি। নতুন পার্লামেন্ট ভবনে জাতীয় প্রতীক প্রতিষ্ঠার অনুষ্ঠান হওয়া উচিত ছিল রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নয়।
যাই হোক, এরকম একের পর এক ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেও বিজেপির বিন্দুমাত্র অপরাধ বোধ নেই, বরং তারা এই সুযোগে ৫৬ ইঞ্চি ছাতি ফোলাবে, কারণ দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ সব কিছুর ঠেকা একা বিজেপির। তাঁরাই একমাত্র বলার অধিকারী দেশকে ঠিক কোন পদ্ধতিতে ভালবাসতে হবে। মুমূর্ষুকে মেরে খুঁচিয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ানোতেই সম্ভবত বিজেপির আসল “দ্বেষপ্রেম” লুকিয়ে আছে । তবে, এই ঘটনার যা প্রতিক্রিয়াই হোক তাতে বিজেপির লাভ। এতে যদি দেশ প্রতিবাদে উত্তাল হয়, তাহলে বিজেপির লাভ, কারণ অন্তত কিছুক্ষণের জন্য হলেও মানুষ গ্যাস সিলিন্ডারের দাম, পেট্রলের দাম, টাকার দাম, বেকারি ইত্যাদি বিপুল সব ব্যর্থতা থেকে দৃষ্টি ঘোরাতে বাধ্য হবে। আর যদি ওইসব থেকে দৃষ্টি না ঘুরিয়ে জাতীয় প্রতীকের বিকৃতি নিয়ে জনতা উদাসীন থাকে, তাহলে ওদের বহুদিনের অভীষ্ট হিন্দুরাষ্ট্র ক্রমশ বাস্তব হয়ে উঠবে।
একটা কথা পরিশেষে বলা উচিত। আজ দেশে এই সরকারের তত্ত্বাবধানে যা যা হচ্ছে তা এক দীর্ঘ শতবর্ষব্যাপী
এবং সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের ফল। ফলে এর মোকাবিলা করা যেমন কঠিন, তেমন জটিল। জাতীয় সম্মানের অবমাননা রোধী আইন ১৯৭১-এর আওতায় জাতীয় প্রতীকের অসম্মান অপমান করা অপরাধ। দেখা যাক দেশের কোনো আদালত, কোনো বিচারক দেশের জাতীয় প্রতীকের এই ভয়াবহ অবমাননায় টুঁ শব্দটি উচ্চারণ করার স্পর্ধা দেখাতে পারেন কিনা।