পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

একটি সাক্ষাৎকার - কিছু বিতর্ক- একটি সম্ভাবনা

  • 23 September, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 3007 view(s)
  • লিখেছেন : অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
ধরুন, PM Cares Fund ঠিক কিভাবে প্রধানমন্ত্রীর নাম ছবি ঠিকানা ব্যবহার করেও সরকারী ট্রাস্ট নয় তার ব্যাখা খোদ ঐ মামলার বিচারপতি নিজে এসে আমাদের সবাইকে জানাচ্ছেন! ভাবুন তো কেমন হবে!

সাক্ষাতকার। রাজনীতি থেকে ক্রীড়া, ছায়াছবি থেকে সাহিত্য, প্রতিটি জগতেই বিভিন্ন সময়ে তোলপাড় ফেলে দেওয়া বহু সাক্ষাত্কারের সাক্ষী ভারতবর্ষের মানুষ। সে,করণ থাপারকে দেওয়া নরেন্দ্র মোদীর সাক্ষাৎকার হোক বা ক্যামেরার সামনে লাইভ অনুষ্ঠানে কপিল দেবের কেঁদে ফেলা। সাড়া জাগানো বহু বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এই সব সাক্ষাত্কার। কিন্তু এই তালিকায় ইতিপূর্বে কোন কর্মরত বিচারপতির নাম নিশ্চিতভাবেই ছিলনা। বিচারপতিরা যে কখনো সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হননি তা কিন্তু নয়। কর্মরত অবস্থাতেই হয়েছেন। কিন্তু তা ছিল নেহাতই ‘নিরামিষ’ শিক্ষা জগতের আলোচনায় ভারাক্রান্ত সাক্ষাত্কার। কয়েক বছর আগে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির সাংবাদিক সম্মেলনটিকে ইচ্ছে করেই বাদ রাখা হচ্ছে এই আলোচনায় কারণ তা ঠিক সাক্ষাত্কার ছিল না। যদিও বিতর্ক হয়েছিল পুরোদমে। তবে সে আলাদা আলোচনা। আপাতত থাক।

সাম্প্রতিক সময়ে আসা যাক। ইতিমধ্যেই বিতর্কিত সাক্ষাৎকারের তালিকায় শেষ অবধি জুড়ে গেল এক বিচারপতির নাম। কার কথা বলা হচ্ছে সেটা বোধ করি আলাদা করে বলার আর প্রয়োজন নেই। অনেকে অনেক কথা বলছেন। কেউ তাঁর মধ্যে দুর্নীতি বিরোধী এক ‘মসীহা’কে খুঁজে পাচ্ছেন, কেউ বলছেন তিনি রাজনীতিতে যোগ দেবেন, তারই ভূমিকা এই সাক্ষাৎকার। কিন্তু অনেকে বলছেন তিনি আইন বিরুদ্ধ কাজ করেছেন, সত্যিই কি তিনি কোন বেআইনি কাজ করেছেন?

দুইয়ের উত্তর লুকিয়ে আছে Bangalore Principles of Judicial Conduct 2002এ। আন্তর্জালে খু্ঁজলেই পাওয়া যাবে কি এই ব্যাঙ্গালোর কন্ডাক্ট। কি উদ্দ্যেশ্য নিয়ে তৈরী তাও স্পষ্ট করে শুরুতেই বলা আছে। কর্মরত বিচারপতিরা কী করতে পারবেন বা কী পারবেন না, তাও স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে। ঠিক এই সনদটির কথা বিচারপতি তার সাক্ষাত্কার চলাকালীন উল্লেখ করে তার ঐ সাক্ষাত্কার দেওয়ার সিদ্ধান্তটিকে সমর্থন করেছেন। এই কথাটা সত্যি যে একজন বিচারপতির যে কথা বলার অধিকার আছে এবং তা প্রয়োগের অধিকারে কোন বাধা নেই তা উক্ত সনদে স্পষ্ট করেই বলা আছে। কিন্তু....

এখানে একটি কিন্তু আছে। উক্ত সনদটির তিনটি ধারার দিকে মাননীয় পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। ধারাগুলি হল ২.৪, ৭৬ এবং ১৫২। এই তিনটি ধারা পড়লে বোঝা যায় যে একজন কর্মরত বিচারপতির কথা বলার অধিকারের ক্ষেত্রে আসলে কিছু শর্ত আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্তটি হল যে একজন সক্রিয় বিচারপতি তার এজলাসে থাকা নিষ্পত্তি হয়নি এমন মামলা নিয়ে কোন মন্তব্য জনমানসে করবেন না। আর কি আছে? কোন সংবাদমাধ্যমে, বিশেষত মুনাফাভিত্তিক কোন সংবাদমাধ্যমে, আইন সংক্রান্ত জ্ঞানচর্চার বাইরে অন্য কিছু নিয়ে আলোচনা করবেন না। নজর দিন ৭৬(এ)র দিকে। নিজের ভাবমূর্তি তৈরী বা জনমত গঠনের জন্য নিজের দেওয়া কোন রায় নিয়ে সংবাদমাধ্যমে আলোচনা তো এক্কেবারে নৈব নৈব চ। একদম করা যাবে না। ৭৬ নং ধারার একদম শেষের লাইনটির দিকে দেখা যাক। কি বলা আছে? বিচারপতিদের অযথা বিতর্ক তৈরী হতে পারে এমন বিষয়, তাদের নিজেদের দেওয়া রায় নিয়ে প্রকাশ্য আলোচনায় যেতেই মানা করা হচ্ছে।

তাহলে কি দাঁড়াল?

সেদিনের সাক্ষাত্কার উপরিউক্ত ধারাগুলিকে লঙ্ঘন করেছে না করেনি? ঐ চ্যানেল কি ঐ সাক্ষাত্কার সম্প্রচার করে মুনাফা করেছে? ঐ অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপনদাতারা কি আর্থিক ভাবে লাভবান হয়েছেন না হননি? তারই এজলাসে বিচারাধীন মামলা নিয়ে কি কথাবার্তা হয়েছে? বিচারপতি কি নিজের দেওয়া রায়ের স্বপক্ষে জনমত গঠনের প্রচেষ্টা করেছেন? তার দেওয়া রায় নিয়ে কি অযথা বিতর্ক তৈরীর সুযোগ করে দিয়েছেন? তিনি কি সচেতন ভাবে নিজের কোন বিশেষ ভাবমূর্তি গঠন করার লক্ষ্যে সাক্ষাত্কারটিকে ব্যবহার করেছেন?

আসুন, আমরা নজর দিই একটু অন্য দিকে।

ভারতের সংবিধান অনুযায়ী আইনসভা, প্রশাসন এবং বিচারব্যবস্থার স্বতন্ত্র ভূমিকা রয়েছে যা একে অন্যের থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন। রয়েছে আইন। যে আইন অনুযায়ী বিচার করবে আদালত। সেখানে কোনও ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ নন। কারণ কোন পরিস্থিতিতে কী করতে হবে তার দিকনির্দেশ দেওয়া রয়েছে আইনে। একজন বিচারপতি সেই অনুযায়ী মামলার বিচার করবেন মাত্র। সেখানে ব্যক্তি মানুষটি দুর্নীতির ব্যাপারে কতটা অসহিষ্ণু তা ধর্তব্যের মধ্যেই পড়েনা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যা আইন আছে তার সর্বোচ্চ প্রয়োগ তাকে যথাযথ ভাবে করতে হবে। সে তিনি দুর্নীতিকে ভাল মনে করুন বা খারাপ।

ধরুন কোন বিচারপতির ব্যক্তিগতভাবে মনে হতেই পারে যে ধর্ষণে অভিযুক্তরা সমাজের ব্যাধি অতএব তাদের অত আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনই নেই। ফাঁসি দিলেই হয়। কিন্তু সেটা তিনি করতে পারেন না। আইনি প্রক্রিয়া তাকে অনুসরণ করতেই হবে। আইন অনুযায়ী তাদের সাজা ঠিক করতেই হবে। এবং সেটা করার পর তিনি প্রকাশ্যে এসে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে “দেখলি কেমন দিলাম” করলে তা হয় দেশের আইনব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ করা। একটা ব্যবস্থা তৈরিই হয় বিভিন্ন পরিস্থিতির মধ্যে একটা সামঞ্জস্য আনার জন্য যাতে কোনও ব্যক্তিমানুষের গুণ বা দোষের কারণে বিচারের রায় প্রভাবিত না হয়। এবং ঠিক সেখানেই বিচারব্যবস্থায় ব্যক্তিপুজো বা আত্মপ্রচারের কোনও স্থান নেই। মামলার রায় হবে তার মেরিটে। বিচারপতির ব্যক্তি পছন্দ বা অপছন্দের ওপর নয়।

পরিশেষে একটা কথা না বললেই নয়। উক্ত সাক্ষাৎকার কিন্তু একটি দারুণ সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। কেমন হয় যদি প্রতিটি জনমানসে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করছে এমন মামলা নিয়ে তার স্বীয় স্বীয় বিচারপতিরা নিয়মিত সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে তিনি কোন রায়টি কেন দিলেন তা নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেন? ধরুন, PM Cares Fund ঠিক কীভাবে প্রধানমন্ত্রীর নাম ছবি ঠিকানা ব্যবহার করেও সরকারি ট্রাস্ট নয় তার ব্যাখা খোদ ঐ মামলার বিচারপতি নিজে এসে আমাদের সবাইকে জানাচ্ছেন! ভাবুন তো কেমন হবে!

ভাবুন ভাবুন, ভাবা প্র্যাক্টিস করুন....

উত্তরগুলি খোঁজার ভার আপনার।

0 Comments

Post Comment