মুর্শিদাবাদে কেন্দ্রীয় তদন্ত দল NIA এল, ৯ জন যুবককে সন্ত্রাসবাদী তকমা দিয়ে তুলে নিয়ে গেল। বিচার হয়নি, প্রমাণ হয়নি, সাক্ষ্য প্রমাণ জমা হয়নি। হয়নি বাদানুবাদ। প্রমাণ নেই কোনো অপরাধের। থাকলে, পরে আমরা জানতে পারবো। সীমাহীন অবমাননাকর ও বিধ্বংসী একটি পন্থা অবলম্বন করে সমাজের একটা অংশকে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে। আজ ৯ জনকে নিয়ে গেছে, কালকে আরো কয়েক জনকে নিয়ে যাবে। সাক্ষ্য প্রমাণ হিসেবে যা দেওয়া হয়েছে আর টিভির পর্দায় যা দেখানো হয়েছে তাতে মোটামুটি বাংলার অবহেলিত মুসলিম সমাজের সিংহভাগকে এই একই তকমায় অভিহিত করতে সময় দরকার সামান্য ও অসামান্য কিছু উপায়।
আমার মত একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে নিজের পরিচয়টা জানিয়ে রাখা দরকার বলে মনে হলো। পরিচয়টা মোটামুটি এরকম: আমার নাম সাদিকুল ইসলাম। অনেকের এই নামটা শুনেই কেমন সন্ত্রাসবাদী, মৌলবাদী বলে মনে হতে পারে। নামটা আমার বংশসূত্রে পাওয়া এবং আমি আমার পবিত্র ভিটেমাটি থেকে উঠে আসা একজন সাধারণ মানুষ ও নাগরিক। আমার পরিচয় যত ছোট করেই দেখানো হোক, আমার পরিচয়ে আমি লজ্জিত নই, খাটো নই, ক্ষমাপ্রার্থী নই। যেমনটা আপনারা নন।
তফাৎটা শুধু এটাই, আমি সমাজের উচ্চবর্ণের, উচ্চধর্মের, ভগবানের বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত কোনো মহৎ বংশতালিকার ক্রমানুযায়ী ফ্লো চার্টের কক্ষে আমার স্থান হয়নি। আমার জন্মের পর হসপিটালে যদি বেড স্থানান্তর হয়ে যেত বা ডাক্তার বাবুর একটু ভুল হয়ে যেত, তাহলে আজকে আমার এই আওয়াজ অনেক দূর পৌঁছে যেত। আমি না চাইলেও আমার আওয়াজটা পৌঁছে যেত অনেক উঁচু উঁচু অট্টালিকা ও তারও উঁচু বেদীতে বসে থাকা মানুষরূপী ভগবানগুলোর কাছে। বৃহত্তর উচ্চবর্ণ সমাজে জন্মানো, বড়ো হওয়া ও বংশ পরম্পরায় পাওয়া সম্পত্তি ও সুবিধের উত্তরাধিকারী হতে পারতাম।।
হইনি তো? হওয়ার কথা ছিল না। চাওয়া পাওয়ার হিসেবের মধ্যে এসব কোনোদিন ছিলো না। তবে আমার নাম আমাকে কি কি দিতে পারে (না), সেটার একটা ছোট্ট হিসেব দিই আজ।
আমি একটা বহুজাতিক কর্পোরেট কোম্পানিতে চাকরী করি, একটু অ্যাকসেন্ট নিয়ে ইংরেজিটা বলতে পারি, অ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহার করি, একটা ভাঙাচোরা ল্যাপটপ আছে। বাড়ী যেহেতু বড়ো, অনেকগুলো পুরোনো অব্যবহৃত অ্যানালগ ফোন নিয়ে ছোট্ট ভাইপো ভাইজিরা খেলা করে। আমার মুখে হালকা দাড়ি আছে, বাবারও আছে। অনেক সরকারী অফিসে ঘোরা ঘুরি করি, কলকাতার কলেজ ও ইউনভার্সিটিতে পড়াশোনা। রাজ্য, রাজ্যসমূহ ও কেন্দ্র সরকারের ক্ষমতার অলিন্দে আমার অবাধ বিচরণ, মানুষের অধিকার পাইয়ে দেওয়ার প্রশ্নে।
মা বোন দাদা দিদি ভাবি ও বাড়ির লোকজন সবাই নামাজ পড়েন, স্বাভাবিক ভাবেই কোরান আছে, হাদীস আছে, ইসলামি বই আছে অনেক। সবার ফোনে গজল ও জলসার ভিডিও থাকে।
বাড়িতে পুরোনো অনেক টালি আছে যেগুলো মাটির বাড়ী ভাঙার সময় পাকা বাড়ির পেছনে রেখে দিয়েছিলাম। দাদা আগে সাইকেল মিস্ত্রি ছিলো, তাই কিছু টায়ার, রিং আছে। আমরা অনেক বড়ো পরিবার, তিন ভাই পরিযায়ী শ্রমিক, তাদের অনেকগুলো হাতুড়ি, ছেনি, সিমেন্টিং ও সেন্টারিংএর যন্ত্রপাতিও আছে। আমার পুরোনো বাড়ির ফাউন্ডেশনের তলায় জায়গা করে রাখা হয়েছিল গোডাউন করার জন্য, যেহেতু মার্কেটের চৌমাথায় আমাদের দোকান ও বাড়ী একসঙ্গে। বাড়িতে শাক তোলার জন্য বর্শা টাইপের কিছু একটা আছে, দু তিনটে কোদাল আছে। বাথরুমের চেম্বারটা একটু বড়ো করে করা হয়েছে, বাড়ির সদস্য সংখ্যা একটু বেশি বলে। আমার মা একটু পুরোনো যুগের মানুষ। পুরোনো জিনিষ কোনো মতেই ফেলে দিতে চান না। এক কৌটো করে চাল হাঁড়ি থেকে সরিয়ে আমার স্কুলের ফিজ দিতেন। পুরোনো জিনিষের প্রতি মায়া অনেক বেশি।
তর্কের খাতিরে ধরে নিন, কালকে যদি আমাকে এনআইএ তুলে/ধরে নিয়ে যায়, আর আমার বাড়ির এই সব জিনিসপত্র তুলে নিয়ে যায় সেই হলিউডি সিনেমার গ্লসি প্লাস্টিকের প্যাকেটে। তারপর আমার বাড়ি প্রত্নতাত্ত্বিক খনন করা হয়, তাহলে দেখবেন নিচে কেমন ব্যাঁকা মতো একটা পুরনো স্ট্রাকচার দাঁড় করানো আছে। তারপরের চিত্রটা আপনারা নিজেই বানিয়ে নেবেন। চ্যানেলগুলো নিজের কাজ করে বেরিয়ে যাবে।
আপনারা সবাই ভাববেন সত্যিই তো! বাড়ির নিচে গোডাউন? এত্তোগুলো কোদাল? এত্তোগুলো টালি? এত্তোগুলো অ্যানালগ ফোন? মোল্লাদের বাড়ী, আবার ওয়াইফাই সমেত ইন্টারনেট, রং করা বাড়ী আবার বর্শা ও হাতুড়ি? গাঁয়ের মোল্লা আবার ইংরেজি? নিশ্চয়ই বিদেশ যোগ আছে?
তাহলে শুধু আমাকে না আমার পুরো পরিবার। মানে আমাকে কলকাতা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে, বীরভূম থেকে বাড়ির লোকজনকে, কেরালা থেকে ছোট ভাইকে, ব্যাঙ্গালোর থেকে আরো এক ভাইকে ও বাকি একজনকে চেন্নাই থেকে।
তারপর শুরু হবে মিডিয়া ট্রায়াল। তকমা জুটবে হাজার। সারাজীবনের আইনী জটিলতা নিরসনের দায়িত্ব, বয়স্ক বাবা-মায়ের শেষ দেখাটুকু পাওয়া যাবে না। শেষ হবে একটা বিশাল পরিবার ও সঙ্গে জুড়ে থাকা আরো বিশাল একটা বাস্তুতন্ত্রের।
আমার নামটা যেহেতু এরকম জঙ্গি টাইপের তাই একটা অংশের মানুষ খুব সহজেই বিশ্বাস করবেন যে আমার দ্বারাই তো এই সব সম্ভব। আমার ফাঁসি হওয়া উচিত। বাড়ির লোককে সুলিতে চড়ানো উচিত। নির্জন হয়ে থাকবে বাংলার তাহরির স্কোয়ার ও রামলীলা ময়দান। থাকবে না কোনো সম্মেলন বা পক্ষ। থাকবে না কোনো ঘাসমূল বা পুকুরের ফুল।
"এই ভাবেই পুড়তে থাকবে বাড়ী, পড়তে থাকবে লাশ।
দেখিবে সবাই গ্লাডিয়েটরের লড়াই, ফেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস"
ছবি শিল্পী : আনখ সমুদ্দুর ( লাবনী জঙ্গী)