পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

চা’টা আর খাওয়া হলো না

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 206 view(s)
  • লিখেছেন : তন্ময় ইব্রাহিম
২০১৪ সাল থেকেই ‘চা ওয়ালা’ কথাটা একটি রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয় হয়ে গেছে এই দেশে। কিন্তু কোনো বিতর্কিত ‘চা ওয়ালা’ বা কোনো সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া চা বিক্রেতা নয়, আমাদের চাচা অনেক সাধারণ, ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া একজন পরিচয়হীন চা বিক্রেতা। যার খবর কলকাতার বাবু সমাজ রাখে না নানা কারণে, আর কারণগুলোও বেশ সঙ্গত। আজ এক অন্য চা' ওয়ালার গল্প

দক্ষিণ পশ্চিম কলকাতার বেহালা চৌরাস্তা থেকে যে রাস্তাটা ডাকঘরের দিকে যায় সেই রাস্তার নাম হো চি মিন সরণী। সেই রাস্তায় চৌরাস্তার থেকে ঢালু দিক দিয়ে এগিয়ে গেলে এক কিলোমিটারের আগেই পৌঁছে যাওয়া যাবে বকুলতলায়। ওখানেই একদিকে ঝাঁ চকচকে একটি নতুন বিল্ডিং দাঁড়িয়ে যার নিচের তলায় আছে একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের শাখা। তার উল্টো দিকেই, রাস্তার গায়েই চাচার চায়ের দোকান।

এবার চাচা কে, তাঁর নাম কী, এগুলো কিছুই আমি জানি না। অজস্র নামহীন দোকানের সারিতে তাঁর দোকানেরও কোনো নাম নেই। আর কোনো দিন জানতেও পারবো না। কারণ তিনি আর নেই।

রবিবার, ১২ই জানুয়ারি, সন্ধ্যায় সোমবারের খবরের কাগজের বিষয়বস্তু সম্পাদনা করে ডিজাইনার কে নিয়েই সাইকেল চালিয়ে পৌঁছে গেলাম চাচার দোকান। দেখি বন্ধ। রমজানের মাসে তারাবি চলার সময়, ঈদের তিন দিন আর মাঝে মধ্যে বিয়েবাড়ি ছাড়া চাচার দোকান বন্ধ হয় না। একটু এগিয়ে আর একটি চায়ের দোকানে গিয়ে শুনলাম যে চাচা আর নেই। হঠাৎ বুকে ব্যাথা হয় শনিবার আর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই সব শেষ।

সেই ২০২২ সালে কলকাতায় যখন থাকা শুরু করলাম আর শহরে সরকারি নিষেধাজ্ঞা কে অবজ্ঞা করে বাইসাইকেল চালানোর সিদ্ধান্ত নিলাম, সেই সময় থেকেই, বলা যায় ২০২২ সালের শারদোৎসবের সময় থেকেই, চাচার দোকানে যাওয়া আসা শুরু হলো। আর এই চাচাকে নিয়েই আজকের গল্প।

২০১৪ সাল থেকেই ‘চা ওয়ালা’ কথাটা একটি রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয় হয়ে গেছে এই দেশে। কিন্তু কোনো বিতর্কিত ‘চা ওয়ালা’ বা কোনো সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া চা বিক্রেতা নয়, আমাদের চাচা অনেক সাধারণ, ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া একজন পরিচয়হীন চা বিক্রেতা। যার খবর কলকাতার বাবু সমাজ রাখে না নানা কারণে, আর কারণগুলোও বেশ সঙ্গত।

চাচা অশিক্ষিত ‘চা ওয়ালা’, গরিব, ধর্মে মুসলমান, তাও আবার বাঙালি মুসলমান যাকে কলকাতা শহরে অদৃশ্য করে দেওয়া হয়েছে সেই ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার পর থেকেই। তবুও এই চাচার সাথেই নিবিড় ভাবে যুক্ত ছিল পশ্চিমবঙ্গের শহুরে বাঙালি সমাজের কিছু অবিচ্ছিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গ, যেগুলো আজ বহিরাগত বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজির দানবীয় রথের চাকার তলায় তিল তিল করে পিষ্ট হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে চিরকালের জন্যে।

চাচার গল্পে ফিরে আসা যাক। ছোট্ট দোকান, সামনে কয়লার উনুন আর তার উপরের অংশে বাসনপত্র, চায়ের কাঁচের গ্লাস, দুধের পাত্র প্রভৃতি রাখা থাকতো। একটি তিনজনের বসার মতন বেঞ্চি দোকানের বাইরে আর দুটি ভিতরে। এক সাথে ১০-১২ জনের মতন বসতে পারে। দোকানে সন্ধ্যায় একটি এলইডি বাল্বের আলো জ্বলতো যার সাথে কালো ধোঁয়ার দাগ লেগে মলিন হওয়া দেওয়াল এক অদ্ভুত সাদা কালো অনুভূতি দিত।

তো এহেন চাচার দোকানে আমি কেন ২০২২ সাল থেকে নিয়মিত—কলকাতায় থাকলে সপ্তাহে তিন থেকে চারবার—যাওয়া শুরু করলাম?

আমাদের হারিয়ে যাওয়া চা

চাচার দোকানের যে জিনিসটা দেখে আমি সেদিন সাইকেল থামিয়েছিলাম সেটা ছিল কাঁচের গ্লাসের চা আর তাও আবার যে সে ধরণের চা না, খাস কলকাতা চা, বা কলকাতার বাঙালি চা।

এবার জানতে চাইবেন কলকাতা বাঙালি চা আবার কী এবং চায়ের আবার বাঙালি-অবাঙালি হয় নাকি।

সত্যি বলতে চায়ের কোনো বাঙালি-অবাঙালি হয়না কারণ চট্টগ্রাম থেকে ধানবাদ পর্যন্ত সান্দাকফু থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বঙ্গবাসী নানা ভাবে চা বানায়। কলকাতা আর ঢাকার বাঙালি সমাজ একই চায়ে চুমুক দেয় না।

কলকাতার বাঙালি চা হলো অনেকটা ব্রিটিশ ‘টি’ জিনিসটার মতন। একটি গ্লাসে অল্প একটু দুধ আগে দেওয়া হবে, তারপরে গরম পানি কে ছাঁকনিতে চা রেখে তার মধ্যে দিয়ে গ্লাসে ঢালতে হবে যাতে চা পাতা ব্রিউ করে ও লিকারটি দুধের উপর পড়ে একটি গাঢ় খয়েরি পানীয় তৈরি করে। কলকাতা চা যে দোকানে বানানো হয় সেখানে আপনি চাইলেই শুধু লিকার বা চিনি ছাড়া চা’ও পাবেন কারণ সব উপাদান আলাদা আলাদা করে গ্লাসে যোগ করা হয়। যেহেতু সব উপাদান—চা পাতা, দুধ, চিনি—একসাথে সসপ্যানে দিয়ে ফুটিয়ে ফুটিয়ে পাকস্থলীর সর্বনাশ করার হিন্দিভাষী বহিরাগতদের পানীয় ‘চায়’ জিনিসটার থেকে কলকাতার বাঙালি চা অনেক আলাদা ভাবে তৈরি হয়, ফলে এটি বেশি খেলেও গ্যাসের সমস্যা হয় না। তবে এই চায়ের ক্ষেত্রে খরচ বেশি হয় কারণ প্রতিবার চা পাতা বদলাতে হয়, যা বহিরাগতদের ‘চায়’ জিনিসটায় এক বার দিয়ে বারবার ফোটানো হয়।

ফলে চাচার দোকানে যখন দেখলাম কলকাতা চা বিক্রি হয় ও জায়গাটা আমার বাড়ির থেকে সাইকেলে পাঁচ মিনিটের রাস্তা, তখন থেকে সেখানেই যাওয়া শুরু করলাম। সত্যি বলতে গোটা কলকাতায় এখন আমার দেখা হাতে গোনা কয়েকজন চা বিক্রেতাই কলকাতার বাঙালি চা বিক্রি করেন। উত্তরে দূর্গা নগর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে, মধ্য কলকাতায় ডেকার্স লেন অঞ্চলে, সূর্য সেন স্ট্রিটে (বন্ধ হয়ে যাওয়া ফেভারিট কেবিনের পাশেই) সিপিআই (এম) অফিসের উল্টো দিকের দোকানে, দক্ষিণে টালিগঞ্জের এনএসসি বোস রোডের চালিয়া মোড়ে মদন’দার দোকানে, একটু এগিয়ে বাঘাযতীন যাওয়ার পথে বারভূতের মাঠের উল্টোদিকে, যাদবপুরের ৮বি মোড়ে লেনিনের মূর্তির পাশের গলিতে, আর বেহালায় চাচার দোকানের থেকে একটু এগিয়েই আরও একটি দোকান আছে (যেখানে তাঁর মৃত্যুর খবর শুনলাম) আর জেমস লং সরণীতে একটি সিপিআই (এম) অফিসের পাশে।

বাকি গোটা কলকাতায় যদিও বা কয়েক হাজার মানুষ চা বিক্রি করে সংসার চালান, তাঁদের কেউই উনুন ব্যবহার করে এই কলকাতা বাঙালি চা আর বানান না বরং আরও বেশি লাভজনক বহিরাগত ‘চায়’ বানান, এবং বিক্রি করেন। যেহেতু পুঁজির বিকাশের নিয়মেই যা বেশি মুনাফা দেবে তাই টিকবে আর যা দেবে না সেটা মুছে যাবে, ফলে কলকাতার বাঙালির নিজস্ব চা আজ ডায়নোসোরে পরিণত হয়েছে যদিও তা স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকারক নয়, বরং বহিরাগত চায়ের থেকে বেশি সুস্বাদু ও গুণগত ভাবে ভালো।

ভাবনার বিষয় হলো তার নিজের চা যে আজ বিলুপ্ত হচ্ছে এবং সে বেশি ভারতীয় সাজতে গিয়ে যে হিন্দি ও গুজরাটি ভাষীদের সমস্ত কিছুর সাথে সাথে তাদের খাদ্যাভাসকেও আপন করে নিয়েছে সেটা এখন পশ্চিমবঙ্গের বা কলকাতার বাঙালিকে বোঝানো অনেক কঠিন। তাই চাচার মতন চা বিক্রেতার সাথেই মুছে যাচ্ছে কলকাতা চা।  চিরকালের জন্যে।

আড্ডা ও মতের মিলন

দীর্ঘদিন ধরেই কলকাতা ও মফস্বলেও অর্থনৈতিক বিকাশের নিয়মেই রকের আড্ডা বিলুপ্ত হয়েছে। মানুষ সামাজিক মেলামেশার থেকে সামাজিক মাধ্যমের মেলামেশায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করা শুরু করেছে। এহেন পরিস্থিতিতে সকলেই বৃহৎ পশ্চিমা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর আলগোরিদমের জালে বাঁধা পড়েছেন। তাঁরা সেই সব বিষয় দেখতে পান বা পড়তে পারেন বা তেমন মানুষদের সাথে আলাপ করতে পারেন যাঁরা তাঁদের সাথে সহমত পোষণ করেন।

ফলে এক বিশাল সংখ্যার মানুষ এক একটি ইকো চেম্বারে বাস করছেন। তাঁরা অন্যমত শুনতে পান না, মতামত বিনিময় করতে পারেন না। তাঁরা শুধু চান নিজেদের মতের ভ্যালিডেশন, অনুমোদন, আজ্ঞাকারী অনুসরণকারীদের। প্রশ্ন-উত্তর তাঁরা পছন্দ করেন না, তর্ক-বিতর্ক না করে তাঁরা গায়ের জোরে নিজের মতামত অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে চান।

এহেন জায়গায় চাচার চায়ের দোকান আয়তনে ছোট হয়েও অনেক বড় মাপের একটি মরুদ্যান ছিল। অন্তত আমি তাই দেখেছি। দিনের ও সন্ধ্যার নানা সময় নানা বয়সী মানুষ সেখানে আসতেন, ঘর-সংসার, জীবনের নানা সংগ্রাম, রাজনীতি, খেলা, অর্থনীতি ও মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা করতেন। হিন্দু আসতেন, মুসলিম আসতেন আর হতো সবার এক সাথে বসে চা খাওয়া। একে অপরের সাথে খুনসুটি করা, খিল্লি করা।

এমন একটা সময় যখন দেশে ও পশ্চিমবঙ্গে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্ররোচনায় ইসলাম বিদ্বেষ ছড়িয়ে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের মেরুকরণ তীব্র ভাবে চলছে, সেই সময় এক বাঙালি মুসলিমের দোকানে বাঙালি হিন্দুদের বিলুপ্ত হতে থাকা কলকাতার বাঙালি মুসলিমদের সাথে আড্ডা, গল্প, মত বিনিময় আর তর্ক আমায় অভিভূত করেছিল। এই একটা চায়ের দোকানের সামাজিক গুরুত্ব আমার কাছে অনেক বড় হয়ে গেছিল। কারণ এই দোকান বিদ্বেষের বাজারে সত্যিই মানবিক এক বন্ধন কিছু প্রতিবেশীর মধ্যে অবশ্যই তৈরি করে দিচ্ছিল, আবার সেই বন্ধন অটুট ছিল বলেই অনেক মানুষ চাচা জীবিত থাকা পর্যন্ত সেই দোকানে এসেছেন, দলে দলে এসেছেন। কারণ চা খাওয়ার অনেক দোকান থাকলেও, চায়ের সাথে মানুষে মানুষে কথা বলার সুযোগ সব জায়গায় নেই।

চাচা রেডিও চালিয়ে রাখতেন, এফএম চ্যানেল মূলত। কিন্তু তাতেই দুপুরে বা সন্ধ্যায় রেট্রো বা পুরানো দিনের গান বাজতো, বেশির ভাগ বাংলা। চাচা বোধহয় আমার দেখা প্রথম মুসলিম যার দোকানে আমি রেডিওতে কালী পূজার দিন শ্যামা সংগীত শুনেছি। অনেক মুসলিমের মতন তিনি সেই গান চলতে থাকায় রেডিও স্টেশন বদলে দেননি, চলতে দিয়েছেন। চলতে দিয়েছেন অনেক ভালো গান।  সেই গান নিয়েও নানা লোকে নানা মতামত ব্যক্ত করতেন। কিন্তু চাচা চুপ থাকতেন। সবার কথা শুনতেন আর চুপ করে চোখে শূন্যতা নিয়ে সামনে রাস্তার দিকে তাকাতেন।

সেই শূন্যতার কারণ আসলে দারিদ্র। আর সেই দারিদ্র চাচার জীবনের শেষ দিন অবধি তাঁর সঙ্গী ছিল। তবে সেই দারিদ্র্যের মধ্যেও চাচা দোকান দিতেন। গেলেই বাড়িয়ে দিতেন ₹৫ এর চা আর ₹৫ এর কেক। রোজকার একই হিসাব, কখনো গোলমাল হয়নি। চাচা চলে যাওয়ার পরে সেই আড্ডাগুলো কি আবার হবে? সেই গান কি আর বাজবে? মানুষ কি আবার এক সাথে বসে মত বিনিময় করে সমস্ত ভুল বোঝাবুঝি ও বিভেদ-বিদ্বেষের রাজনীতিকে মুছে দিতে পারবে?

একটি হারিয়ে যাওয়া জাতি

কলকাতায় বাঙালি মুসলিম অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজলেও চোখে পড়বে না। কলকাতায় নতুন এসে বকুলতলার মতন একটি জায়গা, যেখানে কয়েক’শ বাঙালি মুসলিমের বাস, দেখে মনে আনন্দ কেন পেয়েছিলাম? আমি কি তবে সাম্প্রদায়িক? শুধুই নিজের ধর্মের লোক খুঁজি?

সত্যি বলতে কী যদি আপনি পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলের বাঙালি মুসলিম হন তাহলে আপনি নানা প্রান্তেই শাসকদল-আশ্রিত বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়ের মুরুব্বিদের দেখে ও তাদের আপনার জীবনে পদে পদে নাক গলানো দেখে অতিষ্ঠ হয়ে উঠবেন। কিন্তু কলকাতার, আসানসোলের মতন শহরে যদি বাঙালি মুসলিম খুঁজে পান, তাহলে একজন বাঙালি মুসলিম হিসাবে আনন্দিত হবেন কারণ এটা ক্ষুদ্র একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানসিকতার অভিন্ন অংশ। কারণ আপনি কলকাতা, আসানসোলের মতন শহরে আপনার চারদিকে যে সব মুসলিম অঞ্চল খুঁজে পাবেন সেখানকার মানুষ আপনার ভাষায় কথা বলে না, আপনার মতন খাবার খায় না, আপনার জীবনের নানা অংশের সাথে তাঁরা পরিচিত নন। আর শুধু ধর্ম কোনো জাতি তৈরি করে না, মানুষের ঐক্যের কারণ হতে পারে না সেটা পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে, বাঙালি মুসলিমেরা প্রমাণ করেছে।

যখন একজন সংখ্যালঘুর মধ্যেও সংখ্যালঘু হয় তখন সে নিজের মতন কাউকে খোঁজে এবং এই খোঁজার ও খুঁজে পাওয়ার অনুভূতি যে কী সেটা লিখে বা বলে বোঝানো যায় না।

কলকাতা শহর থেকে বহু আগেই বাঙালি মুসলিমদের বিতাড়িত করে শহরতলী বা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই  কলকাতার বুকেই, সংখ্যাগরিষ্ঠ-অধ্যুষিত অঞ্চলে বাস করেও, যখন আমি বাসার কাছেই এক বাঙালি মুসলিমের কলকাতা চা’র দোকান পাই, তখন আনন্দ হয়, একটা আলাদা একত্মতা অনুভব হয়। এই কারণেই চাচার দোকান ছিল প্রিয়। কারণ সেখানে ওই ছোট্ট গ্লাসে কয়েক চুমুক চা বাদেও জানা যেত ওই অঞ্চলের শ্রমজীবী বাঙালি মুসলিমদের হালহকিকৎ, বেঁচে থাকার সংগ্রামের কাহিনী, শূন্য হয়েও ঘুরে দাঁড়ানোর অক্লান্ত পরিশ্রমের কাহিনী। কারণ শহরের স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা আড্ডা থেকে সরে গেলেও গরিব সেই জিনিসটা টিকিয়ে রাখে এমনি টিম টিম করে চলা চায়ের দোকানগুলোয়। আর এখানেই আমি একটি হারিয়ে যাওয়া জাতির সাথে আবার একাত্ম হতে পেরেছিলাম।

ফিরে দেখা

চাচার মৃত্যু যত না বয়সের কারণে তার চেয়ে বেশি দারিদ্র্যের কারণে হয়েছে। এই রকম মানুষেরা কোনোদিন জানতেও পারেন না তাঁদের স্বাস্থ্যের হালহকিকৎ কারণ তাঁদের সেই সামর্থ্য নেই ডাক্তার দেখানোর আর সরকারি হাসপাতালে হাজার মানুষের ভিড়ে বসে থাকলে একবেলার ব্যবসা মার খাবে। কিন্তু চাচার মতন মানুষেরা একা একা চলে যাচ্ছেন না, এই শহরের থেকে নিয়ে চলে যাচ্ছেন তার অবিচ্ছেদ্য কিছু অংশ আর সেই হারিয়ে যাওয়া অংশগুলো আর কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে না, কারণ আর কেউই তা মনে করে খুঁজবে না। কেউই চাচার কথা মনে রাখবে না। আর আমারও তাঁর হাতে চা খাওয়া আর হবে না।

 

 

 

0 Comments

Post Comment