পুকুর-লাগা পাঁচ বিঘার দাগ। গম লাগা ছিল। দু’দিনে কেটে শেষ করতে পারেনি পাঁচজন মুনিষে। তাই আজকেও এসেছে ভোর ভোর।
গম কাটতে ভোর ভোরই আসতে হয়। ফাল্গুনের রোদ গমগাছে অন্যের হাত সহ্য করে না। মচাং মচাং শব্দে ভেঙে যায় শিসগুলি। যতক্ষণ গমগাছে শিশিরের গন্ধ থাকে ততক্ষণই কাটা যায়।
পাঁচজন মুনিষ গম কাটছে খুব দ্রুত। তার মস্মস্ খস্খস্ শব্দে চারদিক ফর্সা হচ্ছে। ওদের বিড়ি খাওয়ার ফুরসৎ নেই। সূর্য ওঠার আগে গম কাটা শেষ করতে হবে ওদের। ওরা গম কাটছে। এমন সময় হঠাৎ ছাই রঙের কী একটা চার পায়ে ছুটে বেরিয়ে গেল ওই গমখেত থেকে। প্রথমে ওরা হকচকিয়ে গেলেও অনুমানে বুঝল, ওটা শেয়াল একটা।
শেয়াল অভাবী মানুষের শত্রু। ওদের ভাঙা প্রাচীর টপকে হাঁস, মুরগি, ছাগল-ভেড়ার বাচ্চা নিয়ে পালায়। কোনোদিন ওরা তাকে সামনে পায় না। আজ পেয়েছে। তাই গম কাটা বন্ধ রেখে ওরা শেয়ালটার পিছু নিল। ওদের কেউ এখজন বলল, কতদূর যাবি রে বেটা- দাঁড়া!
শেয়াল খুব দ্রুত ছুটতে পারে। চারপায়ে ছোটে সে। আর ওদের পা দু’টি করে। যদিও ওরা এখন দশ পায়ে ছুটছে। ওদের প্রত্যেকের হাতে কাস্তে আছে। আকাশে আছে বিবর্ণ চাঁদ। তারা নেই। তবে ওদের অন্তরে তারার মতো অসংখ্য ক্ষত আছে। ওই ক্ষতগুলিই ওদের ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে শেয়ালটার পিছু পিছু। ওদের আত্মবিশ্বাস শেয়ালটা ওদের সামনে পড়েছে যখন, আর তার নিস্তার নেই।
শেয়ালটা খুব দ্রুত ছুটছে। তার চারটি পা। কিন্তু বিপদ এই যে, তার সামনে কোনো গন্তব্য নেই। চারদিকে ধূ-ধূ ফাঁকা মাঠ। কোথাও একটু ঝোঁপঝাড় নেই যে, গিয়ে আত্মগোপন করবে। শেয়ালটার মনে পড়ছে গত রাতের কথা। দু’দিনের না-খাওয়া শরীর নিয়ে সে সুযোগ খুঁজছিল গ্রাম ঘুরে ঘুরে। কারো বাড়িতে ঢুকতে পারছিল না। কিন্তু শেষ রাতে এক রকম মরিয়া হয়েই কঞ্চির বেড়া ফাঁক করে এক বাড়িতে ঢুকে একটা মুরগি পেয়েছিল। সেটা নিয়ে দূরে- কোনো নিরাপদ স্থানে যাওয়ার কথা তার খেয়ালে ছিল না। পেটে দোযখ জ্বলছিল। অগত্যা সে আশ্রয় নিয়েছিল এই গমখেতে। এখন ভরা পেট নিয়ে ছুটতে অসুবিধা হচ্ছে তার। তবু সে ছুটছে তার মুখে লেগে থাকা কাঁচা রক্তের দাগ শুঁকে শুঁকে। আর তার পেছনে ছুটে আসছে দশ-দশটি পা। তাদের ভয়ে সে কখনো আড়াআড়ি, কখনো সোজাসুজি, কখনো আলের ধার ঘেষে একের পর এক চষাখেত অতিক্রম করে ছুটছে। কিছুক্ষণ সোজা ছুটে আচমকা বাঁকও নিচ্ছে ডাইনে-বাঁয়ে। ভাবছে, এভাবে যদি পেছনে তাড়া করে আসা বিপদ দিকভ্রষ্ট হয়!
ওদের পাঁচজনের একজন-নাম হামিদ মিঞা। টিঙটিঙে শরীর। লম্বা লম্বা হাত-পা। সে দ্রুত ছুটতে পারে। দ্রুত ছুটছেও। কিন্তু চষাখেতের উপর দিয়ে ছুটতে গিয়ে টাল খাচ্ছে তার শরীর। তবু ছুটতে ছুটতে সে ভাবছে তার হাতে ধরা কাস্তেটা ছুঁড়ে মারবে শেয়ালটাকে লক্ষ্য করে। আবার তার ভয়ও করছে, যদি লক্ষ্যভেদ না হয় তবে সে পিছিয়ে পড়বে। যদিও টিপ্পি খেলায় তার নিশানা ছিল তুখোড়। তার সঙ্গে কোনোদিন কেউ পেরে ওঠেনি। কিন্তু সে তো অনেকদিন আগের কথা। তখন তার স্বাস্থ্য ভালো ছিল। আর যাইহোক, তখন দু’বেলা পেটপুরে খেতে পেত। আর এখন বালবাচ্চার সংসার নিয়ে এদিক ঢাকতে ওদিক উদোম হবার জোগাড়। বউ জামিলার একটা মুরগি ছিল। সেটার দৌলতে এই টানাটানির সংসারে গতকাল ভোর পর্যন্ত প্রায় একটা করে ডিম জুটেছে তার কপালে। আজ জোটেনি। এই শালা শেয়াল গেল রাতে মুরগিটাকে সাবাড় করেছে।
মুরগিটার কথা মনে পড়তে হামিদের মরা-জানের রক্ত টগবগ করে ফুটতে লাগল। সে শেয়ালটাকে লক্ষ্য করে ছুটছিল। ছুটতে ছুটতে হাতে ধরা কাস্তেটা ঠিক করে ধরল ছুঁড়ে মারার জন্য। লাগলেই শেয়ালটা ...। কিন্তু না, শেয়ালটা আচমকা বাঁক নিল। আর হামিদের হাতের কাস্তেটা ছুটে গিয়ে শুধু চষাজমির খানিকটা ধুলো উড়িয়ে মিশিয়ে দিল ফাল্গুনের বাতাসে। সেই কাস্তে কুড়োতে গিয়ে হামিদ সবার আগে থেকে সবার পেছনে পড়ে গেল।
একসঙ্গে পাঁচজনের ‘এয্যা’ উচ্চারণে শেয়ালটা ভয় পেয়েছে। ভীষণ ভয়! তার ছোটার গতি বেড়ে গেছে হঠাৎ। যদিও তার পেছনে দশ-পায়ের ধপধপ হারিয়ে যায়নি।
শেয়ালটাকে লক্ষ্য করে সবার আগে এখন যে ছুটছে তার নাম রসুল। সে হামিদের মতো ঢ্যাঙা নয়। গাট্টাগোট্টা। শরীরে বেশ তাকত আছে। হয়ত সে শেয়ালটাকে মারতে পারবে। তার হাতের কাস্তে রেডি আছে। শুধু তাক বুঝে ছুঁড়লেই হয়। কিন্ত কেন জানি, শেয়ালটাকে তার একটু খেলিয়ে বেড়ানোর ইচ্ছে হল। আর অন্যেরা চাইছিল রসুল এখনই তার হাতের কাস্তেটা ছুঁড়ে মারুক। কিন্তু শেয়ালটা এখন আলের ধার ঘেষে ছুঁটছে যে! এখন কাস্তে ছুঁড়লে সেটা আলের ওপর গেঁথে যাবে। আর শেয়ালটা তাদের সঙ্গে ব্যবধান বাড়াবার সুযোগ পেয়ে যাবে। রসুল পাকা শিকারী। এক বছর সাঁওতাল পরগণায় কাজ করতে গিয়ে সাঁওতালদের সঙ্গে শিকার করে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা আছে তার। তবে অন্যদের কথা কেন শুনবে সে? শেয়ালটার প্রতি তার কোনো রাগ নেই। তবু শেয়ালটা তার লক্ষ্যে, শুধু শিকারে সে আনন্দ পায় বলে। এই আনন্দের জন্যই সে জীবনে প্রচুর রাখালডাহিন (গিরগিটি) শিকার করেছে। এত রাখালডাহিন যে, জান্নাতে প্রতিটি রাখালডাহিনের জন্য যদি সোয়াসের করে গম পায় তবে তার সারা জীবনের পরিশ্রমের মূল্যে গেরস্থের কাছে পাওয়া গম তার তুলনায় কিছুই নয়। তাই সে পুরস্কারের লোভে শেয়ালের পেছনে ছুটছে না। সে ছুটছে শিকারের আনন্দে।
শেয়ালটা আবার চষাখেতের মধ্য দিয়ে ছুটতে শুরু করেছে। রসুল এরই অপেক্ষায় ছিল। তার হাতের কাস্তেটা সে এবার ছুঁড়ে মারবে। পেছনে যারা ছুটে আসছে তারাও নিঃশ্বাস বন্ধ করে ছুটছে। যাতে তাদের নিঃশ্বাস রসুলের লক্ষ্যভেদে বিঘ্ন না ঘটায়। তার মধ্যেই সালাম নিজের উত্তেজনা চাপতে না পেরে বলে উঠল, রসুল- মার না রে! দেরি করিস কেনে?
রসুল তার হাতের কাস্তেটা ছুঁড়ল বটে কিন্তু এবারেও শেয়ালটা বেঁচে গেল। বেঁচে গেল সালামের জন্য। সালাম কথা না বললে তার মনঃসংযোগে বিঘ্ন ঘটত না। সালাম শালা শিকারের কিছু জানে না। জানবেই বা কী করে? বাপকালে কি কোনোদিন শিকার করেছে! নিজের মনে খেদোক্তি করতে করতে কাস্তেটা কুড়িয়ে আবার ছুটতে শুরু করল রসুল। ততক্ষণে অন্যেরা অনেক এগিয়ে গেছে শেয়ালটার পিছু পিছু। এবার সবার আগে ছুটছে সালাম।
কী জানি কেন, শেয়ালটার পেছনে ছুটতে ছুটতে সালামের মনে হল, তার সামনে ছুটছে তার বউ মাঞ্জুরার নাঙ এক্রাল কানা। গ্রামে এক্রাল কানার ‘চামড়াচোর’ নামে খ্যাতি আছে। মাঞ্জুরার সঙ্গে তার খুব সুখ। সালাম নিজে বাড়িতে থাকলেও এক্রাল মাঞ্জুরার কাছে আসে। অথচ সালাম তাকে কোনোদিনই হাতেনাতে ধরতে পারে না। জানতেই তো পারে না! তাহলে ধরবে কী করে? একদিনই শুধু জানতে পেরেছিল। কিন্তু রাগে এত অন্ধ হয়ে গেছিল যে হাতের কাছে হেস্যা-পাসনি কিছু খুঁজে পায়নি বলে চুপ করে দেখেছিল নিজের বউকে পরপুরুষের সোহাগ করা।
শেয়ালটার পেছনে ছুটতে ছুটতে সেই রাতের দৃশ্যটা ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। এখন তার হাতে কাস্তে আছে। আর তার সামনে ছুটছে ধুর্ত শেয়ালরূপী এক্রাল কানা। কিছুতেই তার আজ নিস্তার নেই। সালাম ভাবছে, এই সময় মাঞ্জুরা যদি তাকে এভাবে ছুটতে দেখত তাহলে সে আর কোনোদিন তাকে মাজাভাঙা, ধ্বজভঙ্গ বলত না। এক্রালকেও ভিড়তে দিত না নিজের কাছে। কিন্তু সে যখন দেখছে না তখন শেয়ালটাকে মেরেই দেখাবে যে তার স্বামী লিমরদা নয়।
শেয়ালটার পায়ে খিল ধরে আসছে। সে আর ছুটতে পারছে না। তার গতি কমে আসছে। মুখে লেগে-থাকা মুরগির কাঁচা রক্ত শুকিয়ে গেছে। চটচট করছে। গন্ধ পাচ্ছে না। তার জীবনে এমন অভিজ্ঞতা হয়নি কখনো। তার খুব ভয় করছে। মৃত্যু ভয়! তবে কি আজ সে সত্যিই মরে যাবে?
দিন প্রকাশ হয়ে পড়ছে। চারদিক স্পষ্ট তবু কোথাও একটু ঝোঁপঝাড় চোখে পড়ছে না শেয়ালটার। ধূ-ধূ মাঠ শুধু। এখন কোনদিকে যাবে সে। হঠাৎ তার চোখে পড়ল, দূরে আবছায়া কী একটা। সেটা গ্রাম হতে পারে! ঝোঁপঝাড় হতে পারে! এদিকে পেছনে দশ পায়ে বিপদ এগিয়ে আসছে। তবে কি তার মৃত্যু আসন্ন? মৃত্যুর কথা মনে হতেই শেয়ালটা সবকিছু ভুলে সর্বশক্তি দিয়ে নিজের গতি বাড়ায়।
শেয়ালটা ছুটছে খুব দ্রুত। ছুটছে চার চারটে পা ফেলে। সালাম তার হাতের কাস্তেটা ছুঁড়ে মারতে শেয়ালটার সঙ্গে আর একটু ব্যবধান কমাতে চাইছে। কিন্তু পারছে না। তবু তার জেদ কিছুতেই সে আজ শেয়ালটাকে ছাড়বে না, মারবেই। কিন্তু হঠাৎ-ই শেয়ালটা তার চোখের সামনে থেকে কোথায় উধাও হয়ে গেল। অথচ এই তো এখুনি ছুটছিল তার আগে আগে!
সালামের সবকিছু ম্যাজিকের মতো মনে হয়। চারদিক ফটফট করছে। এখনই সূর্য উঠবে। পূবাকাশ লাল টুকটুক করছে দশমাসের গর্ভবতী মেয়ের মুখের মতো। কিন্ত ওদের পাঁচজনের মুখ ফ্যাকাশে। ওরা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। এবিষয়ে অন্য চারজনের কোনো সংশয় নেই যে সালাম ইচ্ছে করলে অনেক আগেই শেয়ালটাকে কুপোকাত করতে পারত। কিন্তু করেনি। সালাম একটা আস্ত আহাম্মক! যে নিজের বউকে চোখে চোখে দেখে রাখতে পারে না সে সত্যিই আহাম্মক। একথাটা তারা ভুলে গেছিল। হট করে শেয়ালটা হারিয়ে যাওয়ায় একথা তাদের আবার মনে পড়ল। এবং সফি বলেই ফেলল, যে শালা নিজের বউকে দেখে রাখতে পারে না সে বনের পশু শেয়াল দেখে রাখবে কী করে!
সফির কথায় সালামের রাগ হল খুব। হাতের কাস্তে ছুঁড়ে সফিকে মেরেই দিত বোধহয়! এমন সময় কুরবান আচমকা চিৎকার করে উঠল, ওইদ্যারে শালা পালাইছে। শালা খালে ঘাপটি মেরে বসেছিল। ধর! ধর!
সবাই ছুটতে শুরু করল আবার শেয়ালটার পিছু পিছু।
শেয়ালটা খুব মরিয়া হয়ে ছুটছে। ভুল করে সে গ্রামে ঢুকে পড়ত এতক্ষণ। আর গ্রামে ঢুকলে তার আজ নিস্তার ছিল না। ভাগ্যিস বুদ্ধি করে খালটিতে ঘাপটি মেরেছিল। এতে অবশ্য বিপদও হতে পারত। হয়নি তা ভাগ্যের জোর। না তো এই মুক্তির স্বাদ পেত কি? এখন আর তার ছুটতে কোনো অসুবিধা নেই। এ যাত্রা হয়ত সে বেঁচেই যাবে। পেছনে দশপায়ে ছুটে আসা বিপদ অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। কিন্তু এ কোনদিকে ছুটছে সে? এদিকেও যে আরেকটা গ্রাম!
সফি আর কুরবান পাশাপাশি ছুটছে। শেয়ালটা যাতে আর ডান-বাঁয়ে বাঁক নিয়ে তাদেরকে বোকা বানাতে না পারে। একজনকে ফাঁকি দিলে অন্যজন যেন তাঁর নাগাল পায়। দু’জনের উদ্দেশ্য এক- শেয়ালটাকে মারা। যদিও এই উদ্দেশ্যের পেছনে রাগ ভিন্ন ভিন্ন। সফি মনে করছে, শেয়ালটা ঠিক তাদের গ্রামের সাজ্জাদ সেখের মতোই ধুর্ত। সাজ্জাদ গেল সনে তার পনেরো কাঠা জমি হাতিয়ে নিয়েছে। কে জানত যে, সাজ্জাদ নিজের বেটার সঙ্গে তার বিটির বিয়ের সম্বন্ধ রচনা করে এমন ষড়যন্ত্র রচনা করবে! না হলে কি বিটির বিয়ে দিয়ে জমিটুকু হারিয়ে বিটিকে আবার নিজের ঘরে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হত? হত না। সেই অপমান এখনো কুরে কুরে খায় তাকে। মজলিস ভর্তি লোকের সামনে তার বিটিকে কলঙ্কিনী সাজিয়েছিল সাজ্জাদ। যে-কারণে সাজ্জাদকে সে কিছুতেই ভুলতে পারে না। ভুলতে পারে না জমিটুকুর কথাও। তাই তো শেয়ালটাকে মারবার জন্য সে ছুটছে। শেয়ালটা একইসঙ্গে তার কাছে অপমান এবং সাজ্জাদ। শেয়ালটাকে মারতে পারলে হয়ত সে তার অপমানকেই মেরে ফেলবে। তখন আর সাজ্জাদের কথা মনে পড়বে না।
আর কুরবান ছুটছে তার কুরবানীর খাসিটার দুঃখে। যে-খাসিটা সে-বছর শেয়ালের হাতে মারা পড়েছিল মাঠে চরতে গিয়ে। তার নয়, খোদার নামে ছিল খাসিটা। আর এই শালা শেয়াল খোদার ওপর খোদকারি করেছিল। শালার পেটে দোযখ জ্বলে উঠেছিল। সেই দোযখের আগুন নেভাতে কুরবান দাঁতে দাঁত চিপে ছুটছে শেয়ালটার পিছু পিছু।
গ্রাম নয়, যেন নিজের মৃত্যু দেখছে শেয়ালটা। ঘাপটি মেরে দিক পরিবর্তন করতে ভুলে গেল সে। আসলে গ্রামের এত কাছাকাছি চলে এসেছে যে সেখান থেকে ফিরবার পথ নেই। অথচ রাতের অন্ধকারে এই গ্রামগুলি তাকে বেঁচে থাকার আনন্দ জুগিয়েছে এতদিন। তবে কি দিনের আলোই ভয়ঙ্কর? না হলে পেছনে ছুটে-আসা দশপায়ের বিপদের শ্বাস-প্রশ্বাস শুনে তার এত ভয় করছে কেন? শ্বাস-প্রশ্বাস নয়, যেন মৃত্যুর হলকা। অথচ ঘুমিয়ে থাকা মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস রাতের অন্ধকারে যখন সে মুরগি-ভেড়া চুরি করে ধরতে যায় তখন অন্যরকম লেগেছে। সেই শ্বাস-প্রশ্বাস তাকে সাহস জুগিয়েছে।
এর মধ্যে শেয়াল ঢুকে পড়েছে গ্রামের রাস্তায়। তার পেছনে এখন দশ নয়, একশো পায়ের বিপদ। একশো নয়- যেন একহাজার পায়ের। শেয়ালটা আর পারল না, রাস্তার ধারে একটা পুকুর, লোকে বলে সামেদ সেখের পুস্কুরণী, সেখানেই নেমে পড়ল। তার গলা শুকিয়ে গেছিল। একটু জলের জন্য নেমেছিল সে। কিংবা প্রানভয়ে। কিন্তু পুকুরে তো জলই নেই। সবই কাদা। আর কাদা মানেই ভয়। কাদায় নেমে তার মনে হল, এই কাদাকে সে জল মনে করল কী ভাবে? তবে কি সত্যিই তার মৃত্যু আসন্ন? শেষবারের মতো চারদিক তাকিয়ে দেখল শেয়ালটা। তার মতোই সব ভয়ার্ত মানুষজন দাঁড়িয়ে আছে চারদিকের পুকুরপাড়ে। তাদের কারো হাত খালি নেই। লাঠি-সড়কি, হেস্যা-পাসনি, কাস্তে, তীর-ধনুক, ইট-পাটকেল ..., যে যা পেয়েছে তাই নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে শেয়ালটা খুব ভয় পেল। এমনই ভয় যে, সে ছুটে পালাতে গেল ওইসব মানুষের মধ্য দিয়ে। কিন্তু মানুষ তো একটা নয়, প্রচুর মানুষ। একজনের হাতে তার লেজ আটকে গেল। একজনের হাতে পেছনের পা, আরেকজনের কাছে মাথা- এভাবেই সম্পূর্ণরূপে সে যখন ধরা পড়ে গেল, আর বাঁচবার কোনো চেষ্টাই করল না, সে মরে গেল। এবং তাকে ফেলে দেওয়া হল সামেদ সেখের পুস্কুরণীর কাদার মধ্যে। আর তার ওপর পড়তে লাগল ইট-পাটকেল। দু-একটা তীরও ছুটে এসে বিঁধে গেল তার শরীরে। নিমেষেই সে ঢুকে গেল কাদার মধ্যে। তারপর আর তার অস্তিত্ব কাদা থেকে আলাদা করা গেল না। শুধু শরীরে বিঁধে-থাকা দু-চারটে তীর একটু আধটু জেগে রইল কাদার ওপরে।
তারও অনেক পরে দু’জন হাড়-হাভাতে মানুষ যখন শেয়ালটাকে কাদাসমেত তুলে আনল ডাঙায় তখন আর তাকে শেয়াল বলে চেনা গেল না। তখন সবার মনে দুঃখ হল। দুঃখ হল অনর্থক একটা প্রাণের অপচয় দেখে। এমন নয় যে এই শেয়ালটাই একমাত্র পৃথিবীর সব অনিষ্ট করে বেড়াচ্ছিল। এর মৃত্যুর পর আর কোনো অনিষ্ট হবে না কারো। সবই তো যেমনকার তেমনই চলবে।
এদের মধ্যে একজন, যে এদের সবার চাইতে একটু বেশি ভাবতে পারে বলে গ্রামের মোড়ল, এই পুকুরটির বর্তমান মালিক সে। পুকুরটি আগে ছিল সামেদ সেখের। সামেদ সেখ কবেই মরে গেছে কিন্তু পুকুরটির সঙ্গে সে যেন আজও বেঁচে আছে। গ্রামের মোড়ল হয়ে লোকটা তা সহ্য করতে পারে না। তার মনে হল, এটাই সুযোগ- পুকুরটি থেকে সামেদ সেখের নামটা মুছে দেওয়ার। তাই সে বলল, ভাই সকল- শেয়ালটা যখন এখানেই মরল, এর কবরটাও এখানে হোক। আর আজ থেকে এই পুকুরটার নাম হোক ‘শেয়ালমারা পুস্কুরণী’। কী বলিস তোরা?
কে কী বলবে? পুকুরের মালিক যখন এই কথা বলছে তখন কার কী আপত্তি থাকতে পারে! তাই সবাই হৈ হৈ করে সম্মতি জানাল। মোড়লের বুদ্ধির প্রশংসাও করল কেউ কেউ। আর মোড়ল লোকটাও সন্তুষ্ট হয়ে বাতাসা বিতরণ করল সবার মধ্যে। মজুরির বদলে সেই বাতাসা নিয়ে বাড়ি ফিরল হামিদ, রসুল, সালাম, সফি, কুরবানরা। তারা আজ গম কাটেনি বলে মজুরি পায়নি।
[প্রথম প্রকাশ : ‘চতুরঙ্গ’, কার্তিক ১৪০১ ; অক্টোবর ১৯৯৪। পরে ১৯৯৬-এর কলকাতা বইমেলায় এই গল্পের নামে লেখকের প্রথম গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়]