আকাশ বাতাসে নাই নাই ভাব। যেন প্রকৃতি কতদিন চুলে তেল দেয়নি, গায়ে স্নো পাউডার লাগায়নি। আদাড়া বাদাড়ে শুকনো পাতার ফড়ফড়। ধুলো উড়ছে। গাছপালায় সবুজ রঙের অভাব। কেবল সজনে ডাটার গাছ গুলো ফুলে ফুলে ভরিয়ে তুলেছে প্রকৃতির প্রতি বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
কুলোয় করে একগাদা সজনা ফুল নিয়ে বসেছিলো জামিলা। একটা একটা করে বেছে রাখছিলো ডালিতে।
'সজনে ফুলের শালুন এই সুমা খাওয়া ভালো। হামবসন্তের যম'— এই কথা সে জন্ম অব্দি শুনে এসেছে। বাড়ির পেছনে আজদাহা দুখান সজনে ডাটার গাছ। ফুলে ফুলে সাদা। কোন ভোরে তার পোতা বজলকে বলেছিলো, দু তিন খান ছিমটি ডাল ভেঙ্গে আনতে, সে কিনা ডাল আনতে আনতে করলো দোফর বেলা। আকাশের মতিগতি বোঝা দায়। শীত যখন যায় যায় তখন একবার মেঘ হবেই। মেঘ হলে, ঝড়বৃষ্টি হলে সব সজনে ফুল ঝরে যাবে। হাতেগোনা যে কটা ডাল থাকবে তা আর ফুল খাওয়ার জন্য ভাঙ্গা যাবে না। ডাটা হবার জন্য রাখতে হবে। তাই যতই দোফরবেলা হোক বজল কে দিয়ে ডাল কখান ভাঙ্গিয়েছে সে। দাওয়ায় বসে সে ফুল বাছছিলো মন দিয়ে।
তার ফুল বাছা দেখছিলো আসাদের দাদী কশিরন। কশিরন এর গায়ে একখান ময়লা শাড়ি। ছাপা। শায়া নাই। কেবল ব্লাউজ। ব্লাউজের বগলের কাছে ছেঁড়া। ছেঁড়া ঠিক না, ঘষা লেগে লেগে ক্ষয় হয়ে যাওয়া।
- বুবু আর কতক্ষুন ব্যইসবো? বৌ ঝিরে এডুধান বুলো পানি খান এড্ডু দিয়ে দ্যেক। সাত আট দিন হতে মানুষডার জান আসে যায়। কাতল মাছের মতন হাঁপপাঁক করত্যছে। মুলবি বইল্যো এডটু জন্মজমের পানি মুখে দাও, সুর ইয়াসিন পড়হো। কালেমা পড়হো যদি জান কবজ সহজ হয়, হতি পারে। তুমাদের বাড়ি ছাড়া আর কুথায় পাবু বলো জমজমএর পানি।
- তাকি তুমারে দিবুনা বুল্যেছি বুবু। এড্ডুধান সবুর করো। বিনি অজুতে জমজমের পানি ছুঁই ক্যামনে। দেখছনি কডগুলান ফুল বাছা বাকি। জোহরের আজান হবো হবো। এখুন না বাছলে পাতে দিবু কখন। জামিলা মুখ না তুলেই বলে।
- আহা কি কষ্ট। মুলিবি বুল্যছে কবরের আযাব কম হবে, যা পাপ হেয়খানের শুধ হয়্যে যাছে। কি বা পাপ আছে মানুষডার কে জানে।
- পাপ তো কত ধরনের আছে। জ্ঞানের অজ্ঞানের। তা হেয় খানে কষ্ট পালি কবরের আযাব যদি কম হয় তাহিলি ভালো।
- হেয় ল্যগে তো মুলবি বুল্যলো জমজমের পানি মুখে দিতি। এড্ডু আসান হয় যদি।
কসিরন বসেছিলো বারান্দায় উঠার সিঁড়িতে। পায়ে চপ্পল নাই। পা ফেটে চৌচির। ফাটা পাএর ফাঁকে ফাঁকে কয়েক পুর ধুলোর আস্তরণ। সিঁড়ির মধ্যেই কয়েকবার পা ঘষে ধুলো ঝাড়ার চেষ্টা করে। বিড়বিড় করে বলে— চটিখানের ফিতাখান ছিঁড়ে গেলছে, লাগাবু লাগাবু করে হয়ি উঠেনা। বলতে বলতেই কিসিরণ সিঁড়ি থেকে বারান্দায় উঠে জামিলার পাশে বসে, বলে— এড্ডু হাত লাগাবু বুবু? তুমার তাড়াতাড়ি হব্যে। যতক্ষন না পানি খান মুখে দিতে পারছি বুবু জান কবজ হবে না মুনে হয়। কি তড়পানি। মুখখান কালো ভুষট্যা হয়ে গেলছে। সেই কবে হুনে পড়ে আছে। জান খান মুখে আটকে আছে জানে, পানি খান দিলিই...
জামিলা বলে, হয়েই গেলছে। তাও বাছো। ফির অজু করি লিও কিন্তু। জমজমের পানি পবিত্রর পানি। ওজু না করি ছুঁয়ো না।
- হাঁ বুবু তুমি তো গিয়াছিলা,জমজমের ম্যালা পানি? সাগরের পারা?
- ওতকি দ্যাকতে পাইছি? আমি তো বজলের দাদোর পিছনে পিছনে ঘুরছি ক্যাবল। মুখ বুরখ্যায় ঢাকা। তবে শুনেছি কলের পারা বেশি বড় লয় কিন্তুক পানি ফুরায় না।
- পানি কতো লুকে লিছে বলো, তাও ফুরায় না। আল্লার কি রহমত।
- হ্যাঁ। কতো দ্যাশের লুক লিছে কালো ধলো সব লুক।
- হাঁ বুবু তা এই পানি খায়লে সব রুগ জ্বালা।ভালো হয়ি যায়? সত্যি?
- সত্যি মিথ্যা বুল্যতে পারবু না। লুকে বলে, শুনেছি। তবে সে একখান দ্যাশ দেখি আসিছি। সোনার মদিনা বলে তো সত্যিই সোনার মদিনা। সব জাগা এচি লাগানো। গুটা মহজিদ খান এচি। কি দ্যাশেই জমন নিয়েছিলো আমার নবী।
কশিরন ভাবে সব জায়গা এসি হলে কতটা টাকা লাগতে পারে। হিসেব করতে পারে না।।এসির দাম তার জানা নেই। পাখা একটা লাগানো আছে তার বড়বেটার ঘরে কিন্তু তার দামও জানা নেই তার। কখনো সখনো পাখার হাওয়া খাবার সৌভাগ্য হয়েছে তার কিন্তু সব সময় না। আর পাখা লাগাবেই বা কোথাও। পাখা লাগানোর জন্য ছাদ চাই।
মাটির দুখান ঘর তাদের। চাল ডাল থেকে শুরু করে কাঁথা কাপড় সব ওই ঘরের মধ্যে ঠাসা। একখান চৌকি আছে। তার উপরে প্রয়োজনের সবকিছু। গরীবের সংসারে ফেলনা কিছুই না, তাই সব জমিয়ে রাখতে হয়। চৌকিতে কেউ শোয় না, শোয় মাটিতে খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে। শীতকাল হলে পাটির উপরে একটা কাঁথা, গায়ে একটা। কেবল নতুন মেয়ে জামাই এলে চৌকিটা পরিস্কার করে শুতে দেওয়া হয়। তখন তারা বাইরের বারান্দায়। এ ব্যবস্থা মেয়ে বৌ বাচ্চাদের জন্য। ছেলেরা চিরকালই বাইরের বারান্দায় শোয়, বর্ষা বাদল আর খুব শীত হলে বারান্দায় একটা পুরানো পাটির আড়াল। এখানে ইলেক্ট্রিক ফ্যানের জায়গা কোথায় ছিলো।
আসাদের বাপ হানিফ কসিরণের একমাত্র ছেলে। আটটা মেয়ে বিয়োয়ে হানিফের জন্ম দিয়েছিলো সে। গোঁফ দাড়ি গজাতে গজাতে হানিফ যখন বলল, রাজমিস্ত্রীর কাজে বাইরে যাবে বুক চাপড়ে কেঁদেছিল কসিরণ। একমাত্র ছেলে। তারা যা খায় তাই খাবে সামনে তো থাকবে। কসিরণের মানা হানিফ শোনেনি বলেই ঘরে ইলেকট্রিক ফ্যান দেখেছে সে। এককুঠরি পাকা ঘরে ঘটাং ঘটাং করে ফ্যান চলে । কেবল গরমকালে পাশের ইলেক্ট্রিক খুঁটি থেকে তার টানা হয় ফ্যানের জন্য। কসিরণের অবশ্য ঘরে শুতে দম আটকে আসে। সে মাটির মেঝের উপরেই শোয়।
- ল্যাও হ্যয়ে গেলছে। সজনে ফুল রাখা ডালি খান নাড়িয়ে বলে কসিরণ।
- উ মাগো, মাযা পিঠ খান ধ্যরে গেলো। লাও তো ফুল গুলান রান্নাঘরে দিয়া আসো, আমি গুসল খান করে ওজু করে আসি। বাটি আনছো পানি লিবা যে?
রান্নাঘরে কসিরণ ফুল গুলো দিতে গিয়ে দেখে কড়াই ভর্তি মাছের ঝোল রান্না করছে বড় বৌ। মাছের ঝোলের রঙ দেখে পেটের মধ্যে খিদে মোচড় দিয়ে উঠে।
- কি মাছ রাঁধছ বৌ? এই লাও তুমার শাউরি দিলো। ডালি এগিয়ে দিয়ে বলে কসিরণ।
বড়বৌ সজনের ফুলগুলো হাতে নেয়, কিন্তু কথার উত্তর দেয় না। রান্নাঘরে সকাল থেকে থেকে তার মাথা গরম, তার উপর আবার সজনার ফুল।
- ডিম দিয়ে সজনার ফুলের ভাজি করবা বৌ না বড়া করবা? কসিরণ বলে আবার।
বড় বৌ উত্তর দেয়না, পাশে বসা কোলের বাচ্চার উপর ধাঁয় ধাঁয় করে দুটো কিল বসিয়ে দেয়— কখন থেকে মুড়ি নিয়ে বসে আছিস। একবাটি মুড়ি থেকে তোর এতক্ষণ লাগে হারামির পোলা।
- ওমা গাল দাও কেন বৌ? ছুটু ছেলা।
বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে আসে কসিরণ। আদর করে। খেলা দেয়। কান্না থামানোর চেষ্টা করে। বাচ্চার হাতে ধরা বাটি থেকে মুড়ি নিয়ে চিবোতে থাকে। পেটের মধ্যে উথাল-পাথালে যেন ঠান্ডা হয় একটু খানি।
তখনই সদর দরজা দিয়ে আসাদ দৌড়ে আসে— দাদীগো তাড়াতাড়ি বাড়ি চলো। দাদা আর নাই।