পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

“তথাকথিত লাল দল ও নানা মার্কসবাদী লেখক” – রচনাটির সমালোচনা

  • 07 March, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 237 view(s)
  • লিখেছেন : সুশোভন মুখোপাধ্যায়
সহমনের সম্পাদকমন্ডলী ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার একশো বছর : ফিরে দেখা লেখাটি নিয়ে বিতর্ক চেয়েছিল, সেই কারণেই সুশোভন মুখোপাধ্যায়ের লেখাটির একটি সমালোচনা প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই লেখাটির লেখক ছিলেন দেবজিৎ ভট্টাচার্য। আজ আরও একটি লেখা প্রকাশ করা হলো। এটাই এই বিষয়ের শেষ লেখা। এই লেখার শেষে দেবজিৎ ভট্টাচার্যের লেখাটির সূত্রও থাকলো।

সম্প্রীতি মনন পত্রিকার বিগত সংখ্যায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল-ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠার একশো বছর-ফিরে দেখা। লেখক সুশোভন মুখোপাধ্যায়। সম্প্রতি দেখলাম সহমন নামক একটি ওয়েব ম্যাগাজিনে লেখাটির একটি সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে। লেখক দেবজিৎ ভট্টাচার্য। লেখাটির শিরোনাম “সমালোচনায় তথাকথিত লাল দল ও নানা মার্কসবাদী লেখক”। তথাকথিত লাল দল বলতে দেবজিৎ এদেশের কমিউনিস্ট পার্টি নামধারী নানা দলের কথা বলতে চেয়েছেন বলেই মনে হয়েছে, তবে নানা মার্কসবাদী লেখক বললেও তিনি একমাত্র সুশোভনবাবু সম্পর্কেই মূলত সমালোচনা করেছেন, আর কারো নাম উল্লেখ করেন নি।


তাঁর লেখাটি পাঠ করলে বোঝা যায় না তাঁর কলম ধরার উদ্দেশ্যটি কী? শিরোনামে আছে সমালোচনায় তথাকথিত লাল দল অথচ এই  তথাকথিত লাল দল সম্পর্কে কোনো সমালোচনা খুঁজে পাওয়া গেল না। আর “সমালোচনায় মার্কসবাদী লেখক” বললেও সে সমালোচনাও সামান্য একটু অংশেই পাওয়া গেল। বাকী রচনাতেই তিনি তাঁর নিজস্ব জ্ঞান উজাড় করে দিয়েছেন। যা শিরোনামের সঙ্গে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক।
তাঁর লেখাটি শুরু হয়েছে ছাত্র বয়সে ছাত্রদের ভাবনার জগৎ, নতুন ছাত্রকে দলে পেতে লাল পিঁপড়েদের কাড়াকাড়ি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে। এ প্রসঙ্গ অবতারণার কারণ স্পষ্ট হল না।


লাল রঙের সংগ্রামী তাৎপর্য বোঝাতে গিয়ে দেবজিৎ লাল রং-এর ঐতিহাসিক দিকটিই বাদ দিয়ে গেছেন। এ আলোচনা যদিও অপ্রাসঙ্গিক, তবু বলতেই হচ্ছে দেবজিৎ-এর লেখার সূত্রে, লাল রঙ শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামের রঙ-এর মর্যাদা পেয়েছে আন্তর্জাতিক এক ঘটনার মধ্য দিয়ে। তাই “সংগ্রামী দলগুলো রক্তমাখা লাল রঙের প্রতীক হয়ে উঠেছে.....সমস্ত কিছুই হয়েছে এ  দেশের.... ইত্যাদি কথাগুলি পুরোপুরি সঠিক নয়।
দেবজিৎ যেহেতু কলম ধরেছেন সুশোভনবাবুর লেখাটি নয়, সুশোভনবাবুদের মতো “মার্কসবাদী” লেখকদের সমালোচনা করতে, তাই তার ভূমিকা রচনা করতে অপ্রাসঙ্গিকভাবে তাঁর জ্ঞানের ঝাঁপি খুলে ধরেছেন। আর এখানেই দেবজিৎ গুলিয়ে ফেললেন। একবার লিখলেন “এ দেশে প্রথম লাল দল তৈরী হয়েছে বিদেশে”। কী অদ্ভুত বাক্যগঠন!এ দেশে  তৈরী হয়েছে বিদেশে! বিদেশে দেবজিৎ উল্লিখিত লাল দল অর্থাৎ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি তৈরী হয়েছিল ১৯২০ সালে, সালটা দেবজিৎ উল্লেখ করলেন না। তিনি এবার লিখলেন “ইতিহাস ও মার্কসবাদী পদ্ধতি বলে এ দেশের শ্রমজীবী মানুষের প্রচুর রক্ত ঝরেছে। সেই রক্তের বিনিময়ে প্রথম লাল দল দৈরী হয় ১৯২৫ সালে”। সুশোভনবাবুর লেখার সমালোচনা না করে ব্যক্তি আক্রমণ করার উদ্দেশ্য নিয়ে ফাঁকা মাথায় কলম ধরলে এমনই হয়। একবার লিখলেন প্রথম লাল দল তৈরী হয়েছে বিদেশে, আবার তারপরেই লিখছেন “প্রথম লাল দল তৈরী হয়েছে ১৯২৫ সালে”। ১৯২৫ সালে কোথায় লাল দল তৈরী হয়েছে সে কথা তিনি লিখতে ভুলে গেলে না জানলেও, আমরা জানি, এ ঘটনা ঘটে কানপুরে, আমাদের এই দেশে। সুশোভনবাবুর লেখাতেও সে প্রসঙ্গটি আছে। শুধু তাই নয়, দেবজিৎ এটাও জেনে রাখুন- আপনি যে বলেছেন “ইতিহাস ও মার্কসবাদী পদ্ধতি বলে”, হ্যাঁ, ইতিহাস অনেক কথাই বলতে পারে, কিন্তু “মার্কসবাদী পদ্ধতি” কিছু বলে না।পদ্ধতি হল করার উপায়।মার্কসবাদী পদ্ধতি অর্থ মার্কসবাদ অনুসরণ করে ভাবা বা কিছু অনুশীলন করা। তাই আপনার লেখায় –“ইতিহাস ও মার্কসবাদী পদ্ধতি বলে এদেশের শ্রমজীবী মানুষের প্রচুর রক্ত ঝরেছে”-কথাটি হাস্যকর হয়ে গেছে। তা ছাড়া, মার্কসবাদ আসার বহু আগে থেকেই শ্রমজীবী মানুষের রক্ত ঝরছে সেটা জানার জন্য মার্কসবাদ জানা বা মার্কসবাদী পদ্ধতি অনুসরণের প্রয়োজন হয় না। বহু অমার্কসবাদী ঐতিহাসিকের রচনা থেকেই সেটা জানা যায়।
এরপর তিনি “নদী আপন বেগে পাগল পারা”র মতো আপন বেগে কলম চালিয়ে গেছেন, বোধহয় ভুলেই গেছেন তাঁর কলম ধরার উদ্দেশ্য। তবে এটা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে তিনি মার্কসবাদী তত্ত্ব সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন। আর কলম চালাতে গিয়ে ঢুকিয়ে ফেলেছেন কিছু অবোধগম্য বাক্য। যেমন-“এই লাল দলকে নিশ্চিহ্ন করতে আদতে রাষ্ট্রকে জনগণের পক্ষে রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করতে হবে, যা অসম্ভব এ সময়ে দাঁড়িয়ে”। এই বাক্যটির অর্থ কী? আর কোন লাল দলকেই নিশ্চিহ্ন করার কথা তিনি বলেছেন? আর এ সময়ে দাঁড়িয়ে অসম্ভব হলে, কোন সময়ে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র জনগণের পক্ষে রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করে? দেবজিৎ কী মনে করেন?
অবশেষে তিনি সুশোভনবাবুর মতো “মার্কসবাদী” লেখকদের প্রসঙ্গে এসেছেন। কী সেটা? তিনি বলছেন প্রকৃত মার্কসবাদীদের কর্তব্য হল “মার্কসবাদী তত্ত্বে জোর দিয়ে, সেই মতো সব কিছু বিশ্লষণ করে জনগণের সামনে তুলে ধরা। অনেক “মার্কসবাদী” লেখকেরা এ সমস্ত কিছু করেন না। ফলে তাদের লেখাগুলি সমাজে হতাশাজনক নানা দ্বন্দ্বগুলি বয়ে আনে বা তাকে তীব্রতর করে বা পুনরায় জাগিয়ে তোলে....এই ধরনের হতাশাগ্রস্ততা আসলে সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির বহনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।সহমন পত্রিকায় প্রকাশিত শ্রীমান সুশোভন মুখোপাধ্যায়ের “ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার একশো বছর-ফিরে দেখা প্রবন্ধটিও মোটা দাগে সেই ধারার ইঙ্গিত বহন করে। আসলে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠার একশো বছরের শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস সঠিক ভাবে বুঝতে ও বোঝাতে গেলে কম করে তার আগের একশো বছরের শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাসের সঠিক পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে দেখানোর প্রয়োজন পড়ে। যার ধার পাশ দিয়েও ঘেষেন না অনেকে”। দীর্ঘ উদ্ধৃতির জন্য দুঃখিত। এটা দিতেই হল কারণ সমগ্র নিবন্ধে শুথু এই অংশটুকুতেই সুশোভনবাবুর সম্পর্কে সমালোচনার আঁচড় কাটার চেষ্টা করেছেন। আর সেটা করতে গিয়ে আরও কিছু এলোমেলো কথা বলে ফেলেছেন। প্রথমত সহমন পত্রিকায় সুশোভন মুখোপাধ্যায়ের এই নিবন্ধটি প্রকাশিত হয় নি। প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রীতি মনন পত্রিকায়। এখানে সহমন কোথা থেকে এল বোঝা গেল না। দ্বিতীয়ত, “হতাশাজনক দ্বন্দ্ব” বলে কোনো কিছু হয় বলে মার্কসবাদ শেখায় না। আর সুশোভনবাবুর লেখাটি কেন সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির হতাশার ধারা বহন করছে, সে সম্পর্কে নির্দিষ্টভাবে কিছুই বলতে পারেন নি, অথচ এটাই চিহ্নিত করা দরকার ছিল। আর কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠার একশো বছরের শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস সঠিকভাবে বুঝতে ও বোঝাতে কম করে তার আগের একশো বছরের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ করতে হবে, এটাই বা দেবজিৎ কোন মার্কসবাদী তত্ত্বের ভিত্তিতে স্থির করলেন? সে প্রসঙ্গেও কোনো আলোচনা না করে শুধু মন্তব্য করেই ছেড়ে দিয়েছেন, আর ভুলে গেছেন সুশোভনবাবু লিখেছেন “সম্প্রীতি মনন” নামক একটি ছোট পত্রিকার পাতায়, এবং সেখানে বলেছেন একথাও যে স্বল্প পরিসরে এই বিস্তৃত আলোচনা সম্ভব নয়, একটা রূপরেখা দেওয়া হচ্ছে মাত্র। ১৮২৫ থেকে ২০২৫, এই দুশো বছরের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা শুরু হলে তার যা পৃষ্ঠাসংখ্যা হত, তা কি সম্প্রীতি মননের পাতায় প্রকাশ করা সম্ভবপর হত? দেবজিৎ কিন্তু নির্দিষ্ট করে বলতেই পারেন নি, সুশোভনবাবুর লেখার ত্রুটিটা কোথায়? কেন তা সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির ধারা বহন করছে? দেবজিৎ-এর সমালোচনার মার্কসবাদী পদ্ধতির এ কেমন ধারা?
আসলে দেবজিৎ যেটা বোধহয় বলতে চেয়েছেন কিন্তু বলতে পারেন নি, তা হল সুশোভনবাবুর লেখায় বর্তমান সময় নিয়ে কিছুটা হতাশা প্রকাশ পেয়েছে। তার কারণ হয়তো সুশোভনবাবুর একটি বক্তব্য। তিনি বলেছেন কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার একশো বছর পরেও আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, বস্তুগত ভাবে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি। আমার মনে হয় এটা বর্তমান বহু বামপন্থী কর্মীরই মনের কথা। অভিজ্ঞতায়,তত্ত্বে আমরা সমৃদ্ধ হয়েছি ঠিকই, কিন্তু শ্রমিকশ্রেণীর রাজ কায়েমের লক্ষ্যে আমরা কতটা এগোতে পেরেছি? দেবজিৎ অবশ্য এ সম্পর্কে কোনো আলোচনা না করেই সুশোভনবাবুকে হতাশাগ্রস্ত সাম্রাজ্যবাদী ধারণার বাহকরূপে চিহ্নিত করে দিয়েছেন।। সুশোভনবাবু কিন্তু তাঁর লেখাটি হতাশা দিয়ে শেষ করেন নি, তিনি এগোতে না পারার কারণগুলিও তুলে ধরে লেখাটি শেষ করেছেন।
দেবজিৎ তাঁর লেখার একেবারে শেষে আবারও একটি বিভ্রান্তিকর অংশ যোগ করেছেন। ছাত্র বয়সে সমাজবদলের রাজনীতি করতে গেলে কী করা উচিত সে সম্পর্কে তিনি তাঁর জ্ঞানের ঝাঁপি খুলে ধরেছেন, যা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। দেবজিৎকে অনুরোধ, ব্যক্তি সমালোচনা না করে রচনাটির সমালোচনা করুন। শুধু মন্তব্য না করে সমালোচনার জায়গাটি চিহ্নিত করুন। যে লেখাটি সমালোচনার যোগ্য তার ভুলগুলি, সীমাবদ্ধতাগুলি তুলে না ধরে, ব্যক্তি সমালোচনা ও নিজের জ্ঞানের বিশালতা দেখানোর জন্য সমালোচনার কলম নাই বা ধরলেন। সে জন্য তো পৃথক নিবন্ধ লেখার উন্মুক্ত আকাশ অপেক্ষা করে আছে। লিখুন না আপনি কত কিছু জানেন সেটা সবাইকে জানানোর জন্য!

 

সমালোচনায়: তথাকথিত লাল দল ও নানা 'মার্কসবাদী' লেখক

  • দেবজিৎ ভট্টাচার্য


                                    

0 Comments

Post Comment