ফাল্গুন মাস পড়ার পর থেকে চারপাশের গাছে ও লতায় অজস্র ফুল। আমগাছে কোকিল সকাল থেকে ডাক দেওয়া শুরু করে আর তা চলতে থাকে সারাদিন। মৌমাছিরও আনাগোনার শেষ নেই। একবার এ ফুল তো খানিক পরে আর এক ফুল। মানুষ যদি এতবার যাতায়াত করত তাহলে পায়ে ব্যথা হয়ে যেত। মৌমাছি ডানায় উড়ে বেড়ায় বলে কোনো ক্লান্তি নেই। আজ দুপুর থেকে মৌমাছির দল আমার বৈঠকখানার তক্তপোশের ছতরিতে একটা চাক গড়ছে । চারপাশে এতো ফল আর ফুলের গাছ আছে যে বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে মাধুকরী করলেই দিনের আহার হয়ে যায়। খানিক বাড়তি সঞ্চয়ও হয় যা চাকের মধ্যে রেখে দেয়। আমি আজ সন্ধ্যেয় বিষ্ণুপুরি লণ্ঠনটি জ্বালাইনি। আলো জ্বেলে ওদের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। ওরা ওদের মতো যাতায়াত করুক। চাক গড়ুক। আমি মৌমাছির ওড়ার গুনগুন ধ্বনিটুকু শুনতে পেলেই খুশি। ওতেই মন ভরে যায়।
রাতটি ধবধবে, যেন আকাশ থেকে কেউ দুধ ঢালছে। বসন্তের ফুরফুরে হাওয়া মন দুলিয়ে বয়ে যাচ্ছে। আমি দরজার পাশের কয়েত গাছের তলায় গিয়ে বসি। বসার জন্যে গাছের চারপাশ উঁচু করে বাঁধানো। উপরে তাকিয়ে দেখি সারা গাছ ছেয়ে আছে ফিকে লাল রঙের ফুলে। বসা মাত্র একটা ছ-পাপড়ির ফুল কোলে এসে পড়ল। ফুলটি হাতে ধরে দেখি ভারি কোমল পাপড়িগুলো। বাইরের দিকে আবার কাঁসার থালার মতো সামান্য কাংড়া কাটা। ভাবি এমন রাতে জোব এলে বড়ো ভালো হতো। ওর প্রিয় একটি পংক্তি হলো দত্ত বাড়ির মধুসূদনের ---মধুহীন করো না গো তব মনঃকোকনদে। জোব এলে দেখাতুম ওই কোকনদ বা লালপদ্মের চেয়ে কোনো দিকে কম যায় না মাথার উপরের ওই কয়েতফুল। সেই কয়েত ফুলের মধু বাইরে থেকে নিয়ে গিয়ে ভিতরের ছতরিতে চাক গড়ছে মৌমাছির দল। জোবের কথা ভাবা মাত্র দেখি জোব ধীর পায়ে হেঁটে আসছে। বুঝলুম ও কোনো ভাব কিংবা ভাবনার ঘোরে আছে। দেখতে দেখতে ও সামনে এসে গেল। কয়েত গাছের ডালে জোব ওর ওক গাছের লাঠিটা ঝুলিয়ে রাখল। তারপর চাতালে বসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, " সাতাশের ঘরের নামতা তোমার মনে আছে, মুখুজ্যে ?"
বসন্তের এমন জ্যোৎস্না রাতে নামতার কথা জোবের মাথায় আসে কেমন করে ? কিন্তু জোবের কথা পরে, উপস্থিত আমার চিন্তা নামতা। সাতাশ চারে একশো আট পর্যন্ত ঠিকই আছে কিন্তু পরের সংখ্যাগুলো মনে আসে না। জোবকে বলি, " দেখো, কবে সেই পাঠশালে নামতা পড়েছি । তখন ঠোঁটস্থ ছিল। এখন আর পুরো মনে পড়ে না। দরকারই বা কী !"
জোব বলে, " বলো কী ? এক খুরি মিষ্টি দইয়ের দাম সাতাশ টাকা হলে সাত খুরি দই কিনে দাম মেটাবে কেমন করে ? এমন কিছু কিছু জিনিস থাকে যা সারা জীবনের সম্পদ ও সঙ্গী। তেমন একটি বিষয় হলো নামতা।"
আমি বলি, " তা ঠিক তবে কত জিনিস আর মনে রাখব বল দিকি ?"
" জিনিস বেড়েছে নাকি আমাদের স্মৃতিতে শ্যাওলা জমেছে ? পুরোনো লোকজন মহাকাব্যের দু-চারটে সর্গ মনে রাখত। এখন আগের সাত পুরুষ ও নারীর নাম বলতে পারে না। তার ফলে একটু বয়েস বাড়লেই স্মৃতিভ্রম।"
"কিন্তু কেমন করে স্মৃতি বাড়বে ? ঘি খেয়ে ?" আমি উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করি।
জোব ভেবে বলে, "হ্যাঁ তাতে স্মৃতিশক্তি বাড়তে পারে কিন্তু সে সঙ্গে মেদও বাড়বে আর পেট বড়ো হয়ে যাবে। তবে স্মৃতি বাড়াতে প্রথম দরকার বইপত্রের সঙ্গ ত্যাগ।"
আমি আঁতকে উঠে বলি, " এ কী কথা বলছ, জোব ! বই ছাড়া একজন মানুষ যেন আত্মা ছাড়া একটি দেহ।"
জোব বলল, "এসব কথা বিদেশ থেকে আমদানি করেছ। বই এদেশে এসেছে অনেক পরে । যা তোমাদের ছিল তা হলো শ্রুতি আর স্মৃতি।"
" কবি বলেছেন ----শ্রুতি-স্মৃতি ঢালিয়াছি বিস্তৃতির জলে।"
" আহা, কী তাৎপর্যময় কথা ! এই জন্যেই ইংরেজ কবি শেলি বলেছিলেন কবিরা হলেন পৃথিবীর অস্বীকৃত বিধায়ক।"
" এখন বেশ কয়েকটা রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন হচ্ছে। কোনো কোনো রাজ্যে বিধায়ক পদপ্রার্থীদের মধ্যে সাতষট্টি শতাংশের বিরুদ্ধে ফোজদারি মামলা মিলেছে।"
" শেলির কথা থাক। তুমি যেন কী বলছিলে, মুখুজ্যে ?"
" বলেছিলুম এখন স্মৃতি নামের দু-চারজন মেয়ে পাবে কিন্তু পুরোনো কালের শিক্ষার সেই শ্রুতি- স্মৃতি ব্যাপারটা আর ফিরবে না। তার ভাসান হয়ে গেছে। "
জোব বলে, " দুর্গা-কালীর মূর্তি ভাসান দিয়ে পরের বছর তা আবার তোলা হচ্ছে। শ্রুতি আর স্মৃতিকেও তেমন ভাবেই নতুন করে তুলে আনতে হবে।"
আর একটি কয়েত ফুল আমার কোলে পড়ল। আমি সেটি জোবের হাতে দিয়ে বললুম, " শ্রুতি আর স্মৃতির যুগ চলে গেছে । আধুনিক যুগে তাকে আর ফেরানো যাবে না, জোব।"
" না, মুখুজ্যে, ফেরানো যাবে। শুধু একটা নবজাগরণ দরকার। ইতিমধ্যেই সে জাগরণ শুরু হয়েছে। দেখে এলুম।"
অবাক হয়ে বলি,"কোথায় ? দেশে না বিদেশে ?"
" এই পশ্চিমবঙ্গে।"
আমি অবাক হয়ে যাই। আমি ভেবেছিলুম হয়ত জার্মানিতে। ওরা সংস্কৃত ভাষা এবং অন্যান্য ভারতীয় বিষয় নিয়ে কাজ করছে। জোবের মুখে এই ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে ঘটছে জেনে নিজের অজ্ঞানতায় লজ্জা পেলুম। মৌমাছির দল বাইরের কয়েত ফুলের মধু সেই দুপুর থেকে ঘরের ভিতরে নিয়ে গেল আর আমি কিনা ঘরের জিনিসকে বাইরে বার করে দিচ্ছিলুম ! আমি জিজ্ঞেস করি, "জোব, পশ্চিমবঙ্গের কোথায় তুমি শ্রুতি আর স্মৃতির নবজন্ম দেখলে ?"
জোব বলল, "দাঁড়াও। তার আগে তোমাকে কাজুবাদাম খেতে দিই।"
কথাটা বলে জোব বিলিতি আলখাল্লার ভিতর থেকে একটা থলে বার করল। তার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে এক মুঠো আমার হাতে দিল। সেগুলো কমলালেবুর কোয়ার মতো বড়ো বড়ো। মুখে একটা কাজু ফেলতেই চায়ের কথা মনে পড়ে গেল। চায়ের সঙ্গে কাজুবাদাম জমে ভালো। জোবও বেশ খানিকক্ষণ এসেছে। ওর নিশ্চয় চায়ের নেশা উঠেছে। মুখে কাজুর দানা ছুঁড়তে ছুঁড়তে ঘরে ঢুকি। ছতরিতে তাকিয়ে দেখি মচকে যাওয়া হাতে জড়ানো গজকাপড়ের মতো মৌচাকটা আকার নিয়েছে।
রান্নাচালায় উনোনে জল বসিয়ে চা পাতার সঙ্গে খান কয়েক তালমিছরি দিই। তালের মিছরি খেতে ভালো আর শরীরও ঠান্ডা করে। চা ছেঁকে উঠোন পেরিয়ে বৈঠকখানায় ঢুকি। ভেবেছিলুম জোব হয়ত ভিতরে ঢুকে গড়গড়া সাজাচ্ছে। দেখি জোব কয়েত গাছের চাতালেই বসে আছে। স্মৃতির ক্ষমতা বাড়াতে জোরে জোরে সাতাশের ঘরের নামতা আওড়াচ্ছে । সাতাশ দশকে দুশো সত্তর বলে জোব চায়ে চুমুক দিল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল," হ্যাঁ, এবার স্মৃতির কথা। মাঘে মাসের মাঝামাঝি উত্তরবঙ্গে গিয়েছিলুম। ৩১ জানুয়ারি তিস্তা আর রংগীত নদীর সংগমে লেপচাদের রং-রংগীত-আসুং উৎসব ছিল। সে উৎসবে নদী সংগমে লেপচারা ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে ভগবান যেন শান্তি ও সম্পদ দেন । সে সঙ্গে সবাই মিলে এক সঙ্গে যাতে থাকতে পারে, সে কামনাও জানায়।"
আমি বলি, " অতি উত্তম প্রার্থনা কিন্তু তার সঙ্গে স্মৃতির কী যোগ ?"
জোব হেসে বলে, "সে যোগ আবিষ্কার করলুম দু-চার দিন পরে। ওদের একজনের সঙ্গে ভাব জমিয়ে বাড়িতে হাজির হয়েছি। থাকব বলাতে শুয়োর খোঁয়াড়ের উপর তলায় ব্যবস্থা করে দিল। দুপুরে খাওয়া দেশি মুরগির মাংস দিয়ে গরম ভাত । তারপর সন্ধ্যেয় ওদের একটা পাঠশালে গেছি।"
"তারপর?"
"দেখি ভুট্টার পাতায় ছাওয়া রাতের পাঠশালায় সে প্রায় তিরিশ-পঁয়ত্রিশটি বাচ্চা ছেলেমেয়ে নেচে নেচে বর্ণমালা গাইছে। বাঁশি আর ঢোল বাজছে সেই নাচ ও গানের সঙ্গে। মাটিতে পাতার কম্বল আর হ্যাজাক বাতি ছাড়া পাঠশালায় আর কিছুই চোখে পড়ল না।"
আমি অবাক হয়ে বলি, " বইখাতা নেই ?"
জোব বলল, " এককালে ছিল। সরকারই সে সব অক্ষর পরিচয় ও অংকের বই ছেপেছিল। পরে সে সব বই ফুরিয়ে যাবার পর আর ছাপেনি। মহাকরণে পাঁচ-সাত বছর ধরে যাতায়াতের পরেও কোনো সুবিধে করতে পারেনি। তারপর বইয়ের আশা ছেড়ে দিয়ে শ্রুতি আর স্মৃতির উপর বত্রিশটি রাত-পাঠশাল চলছে।"
"কিন্তু অক্ষরগুলো লিখছে কোথায়? যোগবিয়োগ করছে কেমন করে ?" আমি উদ্বেগের সঙ্গে জিজ্ঞেস করি।
" বাতাসে লিখছে হাত ও অন্যান্য অঙ্গের মুদ্রায় । সেটিকে আবার গানের সুর ও কথায় বাঁধছে।" জোব বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে।
আমার সংশয় তবু কাটে না। তাই বলি, "তবু কাগজ -কলম বা স্লেট-চকে কিছু লিখবে না ?"
জোব বলে, "কাগজে লিখলে সে কাগজ একদিন ছিঁড়ে যাবে। খুব যত্ন করে রাখলে তা একদিন ঠোঙা হবে। স্লেটও ক্ষয়ে যাবে। ভেঙেও যেতে পারে । একমাত্র শরীরই যত্নে ধরে রাখবে। আর যদি হৃদয়ে লিখে রাখতে পারো, তাহলে চিরকাল থেকে যাবে।"
আমি বলি, "ভিতরে বৈঠকখানায় গিয়ে বসবে তো ! চা খেয়ে তোমার গড়গড়া টানার অভ্যেস।"
জোব বলল, " না, থাক। গড়গড়ার ধোঁয়ায় মৌমাছিদের কষ্ট হবে। ছতরি থেকে উড়েও যেতে পারে। তখন ঘরের মধু আবার বাইরে চলে যাবে।"
আমি বলি, " তাহলে গড়গড়াটা এখানে এনে দিই। ধূমপান না করলে তুমি তো আবার কথার খেই হারিয়ে ফেলো।"
জোব বুকের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে বাঁশের তৈরি একটা ছোটো চোঙা বার করে। বুঝতে পারি এটা লেপচাদের তামাক খাওয়ার নিজস্ব বাঁশের জিনিস । তাতে তামাক দিয়ে চমমকির আগুন দেয় জোব। একটু পরেই মুখ থেকে বাতাসে ধোঁয়া মেশে।
জোবকে বলি, "কোথাও লিখে না রাখলে সব কথা মনে টিকে থাকবে তো ?"
জোব বলে, " শ্রুতি হলো শ্রবণ। গুরুর মুখ থেকে শোনা জীবনের সার সত্যকথা । সে কথা শোনার পরে আবার পড়ার কথা উঠছে কেন? শোনার পরে মানুষ ভাবে। স্মৃতি হচ্ছে এই ভাবা, চিন্তা করা । মুখুজ্যে, ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখো ।"
জোবের তত্ত্বকথায় আমি নিজেই তলিয়ে গেছি । তাই তলিয়ে ভাবার মতো বল পাই না।
জোবের তামাক খাওয়া শেষ। বাঁশের নলটি ঝেড়েমুছে বুকের কাছে ঢোকায়। তারপর বলে, "এই পড়ার ব্যাপারটা যেদিন থেকে চালু হলো সেদিন থেকে সাক্ষর ও নিরক্ষর বলে দুটি পক্ষ তৈরি হলো। ওই পড়া আর লেখা...।"
আমি কিন্তু-কিন্তু করে জোবকে বলি,"আমিও তো একটু লিখি ।"
"লেখা ছেড়ে দাও। আজই ছেড়ে দাও।"
"মানে ?"
" মানের কোনো ব্যাপার নেই। লেখা ছেড়ে এবার মুখে বলো। যেমন পুরোনো যুগের মানুষেরা রামায়ণ-মহাভারত ইলিয়াড-ওডেসি বলেছে, তেমন ভাবেই মানুষজনকে শোনাও। আর তোমার গল্প-উপন্যাস ওই মহাকাব্যের তুলনায় আকারে ছোটো। গল্পের জন্যে এক সন্ধ্যে, উপন্যাসের জন্যে এক মাস। দরকার হলে মোটা উপন্যাসের ক্ষেত্রে যাত্রাপালার মতো সারারাত্রিব্যাপীও হতে পারে।"
"মানুষজন যদি ঘুমিয়ে পড়ে ?" আমি ভয়ের কথা শোনাই।
" ঘুম আসে না বলে কত মানুষ রাতের বেলা জেগে থাকে জানো ? কত মানুষের ওষুধ না খেলে ঘুম আসে না জানো ! তোমার গল্প- উপন্যাস শুনে মানুষ যদি ঘুমিয়ে পড়ে তবে বুঝবে ওটি তোমার কাহিনির গুণ।"
"আর জেগে থাকলে..."
"সেটি লেখার দোষ কিনা জিজ্ঞেস করছ ? না, দোষ নয়। সেটিও লেখার গুণ। একই গাছের কিছু আম বোঁটায় ঝোলে, কিছু নীচে পড়ে যায়। আমার কথা হলো যে আমগুলি তলা জুড়ে শুয়ে আছে, সেগুলিকেও গাছের দান বলে ধরতে হবে।"
আমি বলি, "তাহলে অবশ্য চিন্তা নেই। উপর-নীচ মিলে সংখ্যাটা ভালোই হবে। বলার ঠিকঠাক মেজাজটা তাহলে তৈরি হবে।"
" ঠিকই তবে পুরুষদের বলার ব্যাপারটা একটু পরে আসবে। আগে মহিলারা। এতকাল মা-ঠাকুমারা বাচ্চাদের গল্প শুনিয়েছে। মৌখিক সাহিত্য মেয়েরা ভালো বোঝে। তাই দিদি, বোন, বউ , বউদি, বান্ধবী, সাধনসঙ্গিনীরা আগে আমাদের গল্প শোনাক ।"
" আরে এ তো আর এক রকমের লিঙ্গ বিভাজন !"
"যেদিন থেকে কথা ছেড়ে লেখা শুরু হলো সেদিন থেকে এই বিভাজনের শুরু। তোমরা লেখার অক্ষর তৈরি করে একটা আলাদা শ্রেণি তৈরি করলে । মেয়েদের নিরক্ষর রেখে বইয়ের পর বই লিখলে। বইয়ের সাহিত্য পুরুষের সাহিত্য।"
" আমরা মঞ্চে না উঠলে চারপাশের নানা পরিষদ, সমিতি, সোসাইটি, এ্যাকাডেমিগুলোর কী হবে ?"
"তুলে দাও।" জোব রাজনৈতিক নেতাদের মতো হাত ছুঁড়ে বলল।
আমি আঁতকে উঠে বলি, " তাহলে বসব কোথায় ?"
"যেখানে বসে আছ, এই কয়েত গাছের তলায়। যাদের কয়েত গাছ নেই তারা বসুক আম, জাম, তেঁতুল, শ্যাওড়া গাছের নীচে। এখানেই সাহিত্যসভা হবে। তবে পড়ার ব্যামো ছেড়ে বলা অভ্যেস করতে হবে। দরকার হলে গল্প-উপন্যাস বলার মাঝে দু-চার কলি গেয়ে দিতে পারো। পায়ে ঝুমুর বা ঘুঙুর বাঁধা থাকলে নাড়ানোও যাবে। তেমন জমাতে পারলে কঙ্কণ বা অন্য কোনো উপাধিও মিলে যাবে।"
জোব অনেকক্ষণ খালি মুখে বসে আছে দেখে আমি ভিতরে গেলুম। ক্ষান্তপিসির দিদি শাশুড়ি পরশু সন্ধ্যেয় এসেছিল। বহুকালের সম্পর্ক । দেখতে মন গেছে বলে এক ধামা মুড়কি নিয়ে চলে এসেছে। তারপর কত পুরোনো গল্প হলো। জোবকে ধামা থেকে এক কাঁসি মুড়কি আর এক ঘটি জল দিলুম। জোব এক মুঠো মুড়কি মুখে ফেলেই "আহা আহা" করে ওঠে। বলে, "নতুন আখের গুড়ের মুড়কির স্বাদই আলাদা। তার সঙ্গে আবার নলেন গুড়ের নকুলদানা দিয়েছে।"
আমি জোবের পরিকল্পনাটা ঠান্ডা মাথায় ভাবি। দেখি ওর ভাবনার মধ্যে অনেকগুলো ভালো দিক আছে। যে দিকটা জোব
এখনও বলেনি তা হলো পরিবেশ সংরক্ষণ। কাগজ তৈরি করতে অসংখ্য গাছ কাটতে হয়। সে সব বেঁচে গাছ থাকলে এত গরম পড়ত না। পাখিদের বাসা থেকে উৎখাত হতে হত না। রোদ-বৃষ্টিতে মানুষজনের ছাতার দরকার পড়ত না। ফল কিনতে বাজারে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ত না। বাঁশের বন নির্বংশ হত না। এখনকার কলকাতায় পয়সা দিয়ে চিড়িয়াখানায় বাঘ আর বাঁশ দেখা। জোবকে পরিবেশের কথাটা বলতে ও মুড়কি শেষ করে এক ঘটি জল খেলো। তারপর দু-হাত ঝেড়ে বলল,"এখন প্রদীপের সলতে কিনতে হয়। তুলো দিয়ে লেখা আর ছাপার তুলোট কাগজ তৈরি করা হচ্ছে। আগে কলকাতার আকাশে কত তুলো উড়ত ! মনে আছে মুখুজ্যে ?"
"হ্যাঁ, খুব মনে আছে। ওই উড়ো তুলো মানুষজন লাঠির ডগায় ছোটো জাল বেঁধে ধরত । তাতেই আকাশবাতির সলতে, চতুর্দশীর চোদ্দো প্রদীপ, শীতের লেপকাঁথা।"
জোব বলে," আজকাল পরিবেশ রক্ষার একটা চেষ্টা চলছে কিন্তু সর্ষের মধ্যেই ভূত।"
"সেটা কী বল দিকি?"
"পরিবেশ রক্ষার জন্যে আবেদন জানিয়ে খবরের কাগজে পাতা জুড়ে বিজ্ঞাপন আর পরিবেশবিদদের বড়ো বড়ো লেখা ছাপা হচ্ছে। তাতে কত গাছ কাটা পড়ে তা একবার ভেবে দেখেছ ? পরিবেশ নিয়ে ভাবলে প্রথমেই লেখা ছাড়তে হবে। মিছিল হবে, সভা হবে, পাড়ায় পাড়ায় বৈঠক হবে কিন্তু বাদ। এমনকি কাগজে লেখা প্ল্যাকার্ডও চলবে না।"
আমি সমর্থন জানিয়ে বলি," গল্প-উপন্যাস লেখা না হলে প্রবন্ধ লেখারও দরকার নেই। নাচ আর গান না লিখেই যখন চলে তখন এক্ষেত্রেও চলবে।"
জোব বলল," এবার উঠব কিন্তু ভাবছি একটা মৌখিক সাহিত্য উৎসব করলে কেমন হয় ?"
"খুব ভালো হয়, জোব। প্রথম দিকে মৌখিক কথাটা থাকবে কিন্তু পরে আর দরকার হবে না। সবাই বুঝে যাবে সাহিত্য মানেই যা লেখা হয় না। আর 'লোকসাহিত্য' ব্যাপারটাও উঠে যাবে কারণ লেখালিখি শুরু হওয়ায় আগে সাহিত্যে লোক-ফোক বলে কিছু ছিল না।"
জোব বলল, "ঠিক বলেছ। তাহলে আমাদের উৎসবের নাম কী দেওয়া হবে ?"
আমি বলি, "আন্তর্জাতিক মৌখিক বাংলা সাহিত্য উৎসব।"
"আন্তর্জাতিক হবে কেমন করে ?" জোব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
" তুমি বিলেতের চার্নক আর আমি বাংলার মুখুজ্যে । আমরা দুজনে মিলে দু-দুটো মহাদেশ। আন্তর্জাতিক উৎসব নাম দিতে এর বেশি কিছু লাগে না।"
জোব বলল," বেশ। তাহলে সিদ্ধান্ত পাকা হয়ে গেল। এবার উঠি।"
কয়েত গাছের ডাল থেকে জোব ওকের লাঠিটা নিয়ে রওনা দিল। সকাল হতে এখনও খানিক বাকি।