চটাদাও কাউকে কিছু বলেনি। চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল কে কী বলছে। এতে দেখাই যাচ্ছিল, ওনার একটা বড় মাপের লস হয়ে চলেছে। দেশ বিদেশের নানা জটিল সমস্যায় গুরুমাপের মতামতের জন্য উনি নিয়তই প্রশ্নকর্তাদের থেকে অবিরাম প্রবাহে যে বেগুনি সিঙ্গারা এবং চা পেয়ে থাকেন, নীরবতার অনুশীলনে সেগুলো আর ধেয়ে আসছিল না। দেখে আমার মায়া লাগছিল। অনেক ক্ষণ ধরে দেখে দেখে এক সময় আর না বলে পারলাম না, চটাদা, তোমার এই ব্যাপারে কোনো বিশ্লেষণ নেই?
-- না।
-- কেন নেই? এত লোক এত কিছু বলছে, তোমার কিছু মনে হচ্ছে না?
-- না।
-- কেন? পুরো ঘটনাটা এমনি এমনিই হল?
-- হল হয়ত। চটাদা পণ করেছেন, ফাঁদে পা দেবেন না। মুখ বন্ধ রেখে বুঝিয়ে দেবেন, ওনার এতে কোনো বক্তব্য বা আগ্রহ নেই। কিংবা, নানা লোকের কথাবার্তা শুনে উনি আমাদের মতো সাধারণ লোকের অবমগজের উপর এতই বিশ্রদ্ধ যে জ্ঞানালোক ঢেলে তাকে আর পরিষ্কার করতে চান না।
পুরনো অভিজ্ঞতার জোরে ভাবলাম, এরকম গাম্ভীর্যের কালে প্রায়শই দুটো বেগুনি তো ম্যাজিকের মতো কাজ করে। আজও কি করবে? চেষ্টা করে দেখি।
-- আগে চা বলব, না, বেগুনি? চটাদাকে জিগ্যেস করলাম।
ব্যস, দুর্বাসার ধ্যান ভেঙে গেল বুঝি – বেগুনি নিয়ে আসবি, আর চা দিতে বলে রাখবি। অ্যাদ্দিন এখানে আসা যাওয়া করছিস, এটা জানিস না?
একটা ঠোঙায় চারটে বেগুনি নিয়ে এলাম। দুটো নিজের জন্য রেখে কাগজের ঠোঙাটা চটাদার দিকে এগিয়ে দিলাম। তারুকাকা যে তাপমাত্রায় মালটা ছেড়েছে, তাতে হাতের সঙ্গে মুখের সংযোগ স্থাপন করা বেশ কঠিন হচ্ছে। ফুসফুস থেকে প্রচুর বায়ু নিষ্কাশন করে একটু একটু করে তাপমাত্র কমাচ্ছি। এবার হয়ত মুখে কামড় বসানো যাবে। এমন সময় –
– কী হল তোর? বেগুনি ঢুকছে না বলে কথাও বেরচ্ছে না?
– কথা? কী কথা?
– নৈবেদ্য কি ফ্রি দিলি? তোকে তো অমন উদাস মনে হয় না!
– কেন, আমি কি তোমাকে খাওয়াই না? এই কি প্রথম?
– না না, তা নয়। তবে, বরাবরই দেখেছি, “বিনা বাক্যে নাহি দিব সিঙ্গারা বেগুনি!” আজ তোর খুব বৈরাগ্য ভাব জেগেছে বুঝি।
না, সেই ইংরেজ বিবাগী ব্যাচেলর বিজ্ঞানীর প্রতি আমার ভক্তি বেড়ে গেল। সেই যে সাড়ে তিনশ বছর আগে ক্রিয়া আর প্রতিক্রিয়ার মধ্যে একটা সম্পর্ক দেখিয়েছিলেন, আজও দেখলাম তার ব্যত্যয় হল না। বেগুনি প্রদানের ক্রিয়ায় প্রশ্ন সন্ধানের প্রতিক্রিয়ার জন্ম হতে চলেছে। অর্থাৎ, প্রশ্নের ক্রিয়ার জবাবে উত্তরের প্রতিক্রিয়াও পাওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হচ্ছে।
– যদি অভয় দাও, তাহলে দুএকটা কথা জানতে চাইব।
– আমার স্টকে কোনো অভয় টভয় নেই। দিতে পারব না। কিছু জানতে চাইলে নিজেই সাহস করে বলে ফেল, সাধ্যে কুলোলে জবাব জানিয়ে দেব। তার আগে চা-টা দেখ।
আমি বললাম, আচ্ছা চটাদা, এই যে একটা মিনি যুদ্ধ হয়ে গেল ভারত পাকিস্তানের মধ্যে এর সম্বন্ধে তোমার ধারণা কী?
– যুদ্ধ? চটাদা এমন হেসে ফেলল যে বেশ খানিকটা চা হাতের কাগজের পেয়ালা থেকে চলকে পড়ে গেল – শোন যুদ্ধ-যুদ্ধ আর যুদ্ধ এক জিনিস নয় জানিস?
– কী যে হেয়ালি কর! কী তফাত এই দুটো কথায়?
– প্রথমটাকে বলে দ্বন্দ্ব সমাস। ক্রিয়া হীন। গায়ে পড়া পিরিতির ভাব। বাংলা ব্যাকরণে পড়িসনি?
– এর মধ্যে বাংলা ব্যাকরণ এসে গেল? যাচ্চলে!
– ব্যাকরণ ছাড়া সংলাপ হয় না। অন্তত এই ধনঞ্জয় চাটুজ্জের হয় না। চটা এই সুযোগে নিজের নামটা ব্যাস বাক্যে আমাকে কায়দা করে শুনিয়ে দিল।
আমিই বা ছাড়ব কেন? বললাম – কেন? কোনো অ্যাকশন হয়নি? হাল্লাস্তানের কতগুলো শহর একেবারে মিশিয়ে দিয়েছে মাটিতে। খবর পাওনি?
আবার চটাদার হাসি পেল কেন কে জানে! – সেই সব খবর নিয়ে ওই যে ওনারা ওদিকে গ্যাজাগেজি করছে, তুই ওদের সাথে ভিড়ে যা। হাল্লার নগর বন্দর সব ধুলিসাৎ করে দিয়ে আয়!
আমার খুব রাগ হল। সারা দেশে এই নিয়ে তোলপাড় চলছে, আর চটাদা তা নিয়ে তামাসা করে যাচ্ছে। চা-বেগুনির পয়সাটা বেকার গচ্চা গেল মনে হচ্ছে। তবু না বলে পারলাম না – তুমি এটাকে যুদ্ধ বলবে না? যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব বলছ?
– ওরে পাগলা, আমি বলছ না, তোদের বিদেশ মন্ত্রীই বলেছে, তারা হাল্লাস্তানের বাদশাহকে ফোন করে জানিয়েছিল, আমরা আসছি। তোমাদের সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি ভাঙতে।
– তাই নাকি?
– অ, ওটা আবার তুই যে খবর নামক খাবারের চ্যানেলগুলো দেখিস, ওতে বুঝি দেখায়নি! বুঝেছি। তাই তুই বুঝিসনি যে যুদ্ধ বলে আসল জায়গায় কিছু হচ্ছে না। যা হচ্ছে স্টুডিওগুলোতে!
– তুমি বলতে চাইছ, যেসব শহর ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে বলে দেখিয়েছে সেগুলো সব মিথ্যে?
– শুধু মিথ্যে নয় রে বাচ্চু। সে সব অরণ্যদেবের কাহিনির চাইতেও খাজা।
আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম চটাদার দিকে। নির্বিবাদে চা খেতে খেতে চটাদা আবার বলল – দেখলি নে তোর শুন্ডিদেশের তালেবর ওমরাহদের সারা বিশ্বের দেশে দেশে পাঠিয়েছে আমাদের বড়ে উজির। কেন পাঠিয়েছে জানিস?
– কেন?
– শুন্ডির মাথা এমন নিচু করে দিয়েছে তোদের এই খাবারের চ্যানেলগুলো যে এখন বাইরে গিয়ে বিদেশের মিডিয়াকে বোঝাতে হচ্ছে যে আমাদের মিডিয়া যা প্রচার করেছে তার মধ্যে অন্তত ছয় পারসেন্ট খাস মাল আছে।
– ছয় পারসেন্ট? মাত্র?
– মাত্র কী রে? এ তো অনেক। আর আসল প্রশ্ন এরাও তুলছে না, উজির-এ-আলাও বলছে না।
আমি উৎকর্ণ হয়ে উঠলাম। আসল প্রশ্ন? তার মানে চটাদা কাজের জায়গায় এসে গেছে। উদ্গ্রীব হয়ে জিগ্যেস করলাম – কী কী সেই আসল প্রশ্ন?
– শুনতে চাস?
– অবশ্যই।
– তবে শোন। ও, তার আগে দেখে আয় তো সিঙ্গারাগুলি বেগুনির পাশের ঝুড়িতে ঢুকেছে কিনা!
আমি আর দেরি করলাম না। একটা প্লেটে করে তিনটে বয়লার ফেরত সিঙ্গারা এনে ল্যাম্প পোস্টের সেই বেঞ্চিটায় রাখলাম। চটাদা একখানা হাতে নিয়ে বলল – এক নম্বর প্রশ্ন হল, সুরোধামে সেদিন কোনো নিরাপত্তা বাহিনীর লোক ছিল না কেন? আকাশ থেকে ড্রোন দিয়ে নজরদারি হচ্ছিল না কেন?
আমার রাগ হল – কেন, এক আধদিন ল্যাপ্স হতে পারে না?
– সিদ্ধান্ত না নিলে হয় না। ওরকম সেনজিটিভ জায়গায় হয় না।
– দু নম্বর প্রশ্ন?
– ওরা বর্ডার পেরিয়ে এল কীভাবে? খুন জখম সেরে চলে গেল কীভাবে?
আমি এবার খানিক থমকে গেলাম। এটা একটা ভাবার মতো প্রশ্ন বটে। আমাদের গৌড় দেশের বর্ডার এলাকায় দেখেছি, নিজেদের সীমানাতেই বাজার দোকান করতে গেলেও প্রতি পঞ্চাশ মিটার অন্তর সীমানা সুরক্ষণ ফৌজের লোকেরা কেউ না কেউ বার বার এসে রাস্তা আটকায়, জিজ্ঞাসাবাদ করে, দারুণ ঝামেলা করে। ওখানে তাহলে — ভাবার মতোই প্রশ্নটা। এবার জানতে চাইলাম – তোমার তিন নম্বর প্রশ্নটা কী?
– ওই এলাকায় সাধারণ পর্যটকদের নিরাপত্তা দেবার দায়িত্ব কার ছিল? তারা কি দায়িত্ব পালন করেছে না ব্যর্থ হয়েছে? ব্যর্থতার দায় স্বীকার করেছে কেউ?
এতক্ষণে চটাদার কথার অর্থ খানিক বোধগম্য হল। হ্যাঁ, প্রশ্নগুলো ভাবার মতো। বললাম – এই প্রশ্নগুলি কি তুমিই প্রথম ভেবেছ, না, আরও কেউ কেউ তুলেছে?
চটাদা বলল – কী যে বলিস। এই সব প্রশ্ন আজ থেকে বিশ বছর আগে একজন তুলে রেখেছিল।
– সে কী? কে সে? কবে তুলেছিল? তুলেছিল কেন?
– যে তুলেছিল সে ছিল তখন গুজ্জর রাজ্যের সুবাদার। শুন্ডিতে তখন এক বৃদ্ধ ছিল উজির-এ-আলা। তার আমলে এরকমই একটা হাল্লা সন্ত্রাসীদের হামলার ঘটনা ঘটে। তখন তুলেছিল।
– সেই সুবাদারই তো এখন —
– শুন্ডির বর্তমান উজির প্রধান। তারই বিশ বছর আগে উত্থাপিত প্রশ্নগুলো এখন তাকেই দেওয়া হয়েছে। জানা প্রশ্ন হলেও বেচারা উত্তর দিতে পারছে না। ছৌ নাচের নানা রকম পোশাক পরে ইদিক সিদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, পালাগান করছে, আর খুব হাসাহাসি করছে।
– হাসাহাসি করছে? কেন?
– ওই যে ওদের কাণ্ডকারখানা দেখে।
আমি এবার শেষ প্রশ্ন করে ফেললাম – তাহলে যুদ্ধের ব্যাপারটা পুরোটাই ফেক?
চটাদা বলল – না না, পুরো ফেক হবে কেন? একটা ট্রায়াল যুদ্ধ তো হয়েছেই।
– ট্রায়াল? কারা করল?
– কেন, পীতাঙ্গরাজ আর ফরসাপতি!
– কীরকম ব্যাপার? একটু বুঝিয়ে দেবে?
– নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। ফরসাপতি শুন্ডিরাজকে কিছু যুদ্ধপক্ষী দিয়েছিল জানিস তো?
– সেই মলিন বানির ঘোটালা কেস বলছ তো?
– হ্যাঁ, চটাদা হাসল – যাক, তোর খুপড়িতে কিছুটা নরঘিলু আছে দেখছি। আবার পীতাঙ্গরাজও হাল্লারাজকে একই জাতীয় সমরবিহগ বেচেছিল। সেই দুই তরফই চাইছিল তাদের যার যার রণপক্ষীর আকাশে ক্রিয়ারত অবস্থায় টেকনিক্যাল সামর্থ্য এবং ত্রুটিবিচ্যুতিগুলি একটু দেখে নিতে। সেটা দেখে নেওয়া শেষ হতেই ওরা কলম্বিয়ায় খবর দিয়ে দেয়, কাজ খতম। কলম্বিয়ার খলিফা সঙ্গে সঙ্গে হাল্লা আর শুন্ডিকে বলে দেয়, হল্ট, ঘর ওয়াপস যাও!!
আমি হা করে আছি দেখে চটাদা মুখে একটা তেরছা হাসি ফুটিয়ে বলল – এই জন্যই তোকে বলছিলাম, ব্যাকরণ থেকে দ্বন্দ্ব সমাস শিখে আয়।