কংগ্রেসের নির্বাচনী ইশতেহারে ন্যূনতম আয় যোজনা (ন্যায়) বা দরিদ্র পরিবারেরর জন্য ন্যূনতম আয় নিশ্চিত করার প্রকল্প ঘোষণা করার পরেই বারতীয় জনতা পার্টির তরফ থেকে গেল গেল রব উঠেছে। প্রায় ডামি অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি হৈহৈ করে উঠেছেন দেশের আর্থিক ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে বলে। সাথে সাথে এও বলছেন যে , এটি কংগ্রেসের মিথ্যে প্রতিশ্রুতি, নির্বাচনী বৈতরণী পার হবার জন্য। গরীবদের ন্যূনতম ব্যয় নিশ্চিত করার এমন পরিকল্পনা ভারতের চলতি আর্থিক অবস্থায় করা সম্ভব নয়। জেটলি সাহেবকে বোধ হয কেউ মনে করিয়ে দেয় নি যে, এমন কথা বলতে নেই। আমাদের প্রধানমন্ত্রী পারেন না এমন কোন কাজ নেই। তেনাদের শ্লোগানতো ৫০০০ কোটি টাকার বিজ্ঞাপনে জনগণের কাছে পৌছে গেছে, “নামুমকিন আব মুমকিন হায়”। সব অসম্ভবই এখন সম্ভব। তাহলে কি ভারতীয় জনতা পার্টির কাছে গেবল গরীবদের গরীবি দূর করাটাই অসম্ভব? এই নিবন্ধে আমরা সীমিত পরিসরে এবং ন্যায় প্রকল্প রূপায়নের জন্য সম্পদ সংগ্রহ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে কংগ্রেস কর্তৃক কোন রূপরেখা ব্যতিরেকে প্রকল্পটি আদতেই কার্যকরী করা যাবে কিনা তা দেখব।
তবে এটি জানিয়ে রাখা দরকার যে, কংগ্রেস এরকম বহু প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। ইন্দিরা গান্ধির বিশ দফা কর্মসূচী গরীবি হটানোর থেকে গণতন্ত্র হটাতে বেশী ব্যবহৃত হয়েছে। তবে এও সত্যি যে, সাম্প্রতিক কালে গ্রামীণ দারিদ্র দূর করার সর্বোত্তম কিন্তু অর্ধ সক্ষম কর্মসূচী ও আইন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন প্রথম সংযুক্ত প্রগতিশীল মোর্চা (ইউপিএ) সরকারের আমলেই প্রচলিত হয়েছে, যার বিরোধিতা করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। তবে সেই ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পকেও পূর্নাঙ্গ ভাবে চালু করতে যথাযথ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেনি কংগ্রেস। একই সঙ্গে, বরং জোরালো ভাবে বলতে হবে বর্তমান বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের গরীব ও কৃষক বিরোধী ভূমিকার কথা। ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পকে লঘু করা, নোট বাতিলের ফলে কোটি কোটি গরীব মানুষের রুটি রুজির উপর আঘাত হানা, গ্রামীণ মজুরির বৃদ্ধিকে শ্লথ করে দেওয়া, জিএসটির মাধ্যমে অসংগঠিত ক্ষুদ্র পুঁজির ব্যবসায়ে নির্ম আঘাত হানা, দেশ জুড়ে কর্মহীনতা সৃষ্টি করা এসবই ঘটেছে বর্তমান সরকারের আমলে, যে সরকার বছরে দু কোটি বেকারের চাকুরি, যে প্রধানমন্ত্রী গরীবের ব্যাঙ্ক খাতায় ১৫ লক্ষ করে টাকা দেওযার কথা বলেছিলেন তিনি এখন গরীব অসংগঠিত ক্ষেত্রের মানুষদের দুর্দশায় নীরব থাকেন, আর হিন্দু-মুসলমান ভাগাভাগি করে ভোট জেতার পরিকল্পনা করেন। ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’ পরিণত হয় ‘আম্বানি-আদানি কা সাথ ভাজপা কা বিকাশ’ মন্ত্রে। তাই ভারতীয় জনতা পার্টির কাছ থেকে যে ‘ন্যায়’ মিলবে না সেটি স্বতসিদ্ধ। দেখা যাক কংগ্রেস নিজেদের পুঞ্জিভূত অন্যায় কমাতে আদৌ বাস্তবিক আগ্রহী কিনা।
কংগ্রেস দেশের ২০% নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য মাসিক ১২০০০ টাকা বা বার্ষিক ১৪৪০০০ টাকা আয় নিশ্চিত করার কথা বলেছে। তাদের অনুমান অনুযায়ী এর জন্য ৫ কোটি পরিবারকে মাসিক ৬ হাজার বা বার্ষিক ৭২ হাজার টাকা করে দিতে লাগবে। অর্থাৎ বছরে সর্ব মোট ৩ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা লাগবে। যদি কোনো অতিরিক্ত সম্পদ সংগ্রহ না করা যায় তাহলে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্ব ঘাটতি, ৬ লক্ষ ২৪ হাজার কোটি টাকার সঙ্গে যুক্ত হয়ে মোট রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়াবে ৯ লক্ষ ৮৪ হাজার কোটি টাকা। ফলে রাজস্ব ঘাটতি বনাম মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) অনুপাত, বর্তমানের ৩.৩৩% গিয়ে দাঁড়াবে ৫.২৫%-এ। ফলে রাজস্ব শৃঙ্খলা নষ্ট হবে, দেশের অমোঘ অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে। এমনটাই ভারতীয় জনতা পার্টির যুক্তি। অর্থাৎ রাজস্ব ঘাটতি (এফডি) বনাম জিডিপি অনুপাতের ১.৯% বৃদ্ধি আমাদের অর্থনীতি সহ্য করতে পারবে না। অন্যদিক দিয়ে বর্তমান অনুরূপ অনুপাতের প্রায় ৫৮% বৃদ্ধি অর্থনীতির উপরে প্রবল চাপ ফেলবে। এদিকটা একটু খতিয়ে দেখা যাক।
প্রথমত, দেশের এফডি/জিডিপি অনুপাত সামগ্রিকে (কেন্দ্র ও রাজ্য মিলিয়ে) ২০১৮-১৯ সালের বিত্ত বর্ষে ৫.৮৭%। ফলে ‘ন্যায়’ এর ফলে উদ্ভুত অতিরিক্ত রাজস্ব ঘাটতি এফডি/জিডিপি অনুপাতকে ৫.৮৭% থেকে বাড়িয়ে ৭.৮% (প্রায় করবে)। ফলে এফডি/জিডিপি অনুপাতের বৃদ্ধি ঘটবে ৩৩% (৫৮% নয়)। এই বৃদ্ধি তেমন কোন ভয়ঙ্কর নয়। বিগত সময়ে সামগ্রিক এফডি/জিডিপি অনুপাত অনেক ক্ষেত্রেই ৮% কে ছাড়িয়ে গিয়েছে। যেমন বাজপেয়ী সরকারের আমলে, ১৯৯৮-৯৯ থেকে ২০০৩-০৪, এই ছটি বছরেই তা ৮%-এর উপরে দাঁড়িয়েছিল, ২০০১-০২ সালে তা ছিল গত ২ দশকে সর্বোচ্চ, ৯.৬১%। এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারের এফডি/জিডিপি অনুপাতও ওই ছটি বছরের ৫টি বছরেই ৫%-এর উপরে ছিল, ২০০১-০২ সালে ছিল ৫.৯৮%। সুতরাং রাজস্ব বিশৃঙ্খলার যুক্তি বিজেপির মুখে মানায় না।
দ্বিতীয়ত, যেহেতু ওই ৩ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা চলতি মূল্যে দেওয়া হচ্ছে এবং চলতি মূল্যে ভারতীয় অর্থনীতি বার্ষিক অন্তত ১০% হারে বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়, তাই ‘ন্যায়’ এর জন্য অতিরিক্ত রাজস্ব ঘাটতি/ জিডিপি অনুপাত ধারাবাহিক ভাবে কমতে থাকবে। যেমন, ২০১৯-২০ তে তা কমে দাঁড়াবে ১.৭৫%, ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ এ যথাক্রমে ১.৫৯% ও ১.৪৪%। এই মুহুর্তে, ভারতীয় অর্থনীতির মত এমন একটি বর্ধমান অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ করের অনুপাত খুবই কম। সারা দেশে প্রত্যক্ষ করের সঙ্গে জিডিপির অনুপাত বর্তমানে ৬.৯%, ২০০৭-০৮ সালে সেটি গত দু দশকে সর্বোচ্চ ছিল,৭.১%। ফলে দেশে ধনীদের কাছ থেকে কর আদায়ের সুযোগ যথেষ্টই রয়েছে। তবে রাজনৈতিক “উৎকোচ”এর বন্ডের বদলে কর আদায়ের কথা ভাবা রাজনীতির ব্যবসায়ীদের কাছে অত্যন্ত কঠিন। কেবল তাই নয়, দেশের প্রত্যক্ষ কর বনাম পরোক্ষ করের অনুপাতকে খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, বর্তমান সরকারের আমলে সামগ্রিক কর রাজস্বে প্রত্যক্ষ করের আনুপাতিক অবদান কমেছে। ২০০৯-১০ সালে কর রাজস্বে প্রত্যক্ষ করের অনুপাত ছিল ৪৩%, ২০১৪-১৫ সালে ৪০%, সেটি ২০১৮-১৯-এ কমে দাঁড়িয়েছে ৩৭%। প্রত্যক্ষ করের অনুপাতকে যদি বাড়িয়ে অন্তত ৪০%-এ নিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে ২০১৮-১৯ সালেই অতিরিক্ত প্রত্যক্ষ কর আদায় হতে পারত ১ লক্ষ ৬৭ হাজার কোটি টাকা। গড়ে পরোক্ষ করের বার্ষিক বৃদ্ধি ১৫% ধরে, প্রত্যক্ষ করের অনুপাত মোট কর রাজস্বে আগামী দিন গুলিতে ৪০% হিসেবে ধরে হিসেব করলে, বর্তমান ৩৭% প্রত্যক্ষ কর ও মোট কর রাজস্বের অনুপাতে প্রত্যক্ষ কর আদায়ের তুলনায়, ওইরূপ কর আদায় ২০১৯-২০, ২০২০-২১, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ বিত্ত বর্ষে যথাক্রমে ২ লক্ষ কোটি টাকা, ২ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকা, ২ লক্ষ ৬৫ হাজার কোটি টাকা ও ৩ লক্ষ ৫ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত রাজস্ব প্রদান করতে পারে। সুতরাং রাজস্ব ঘাটতির দোহাই দিয়ে গরীবদের ন্যূনতম আয় প্রদান না করার কোন যুক্তিই খাটে না।
তৃতীয়ত, গরীবদের জন্য রাজস্ব ঘাটতি না বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে মুদ্রাস্ফীতির অজুহাত খাড়া করা হচ্ছে। ঘাটতি বাড়লে মুদ্রাস্ফীতির হার বাড়বে বলে সহজ প্রচার করা চলছে। এফডি/জিডিপি অনুপাতের সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতির হারের এমন সহজ সরল সম্পর্ক তৈরী করা যায় না, অন্তত বিগত ২১ বছরের হিসেব তা বলছে না। যেমন এই সরকারের আমলে ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের এফডি/জিডিপি অনুপাত ছিল যথাক্রমে ৪.১% ও ৩.৯% (রাজ্য=কেন্দ্র সংযুক্ত যথাক্রমে ৬.৭% ও ৭%) তাদের হিসেবেই মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল যথাক্রমে ১.৩% ও -৩.৭%। অর্থনীতির ভাষায় ল্যাগড বা দেরীতে প্রভাবের কথাও টিকছে না, কারণ সেক্ষেত্রে ২০১৪-১৫ সালে চড়া এফডি/জিডিপি অনুপাতের প্রভাব ২০১৫-১৬ সালে পড়ত, কিন্তু সেই বছরের মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ঋণাত্মক ৩.৭%। জাতীয় গণতান্ত্রিক মোর্চা-১ সরকারের আমলেও ২০০১-০২ ও ২০০২-০৩ সালে অনুরূপ ঘটেছিল। এফডি/জিডিপি অনুপাত সর্বোচ্চ ৫.৯৮% (২০০১-০২) ও ৫.৭২% (২০০২-০৩) হলেও মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল যথাক্রমে ৩.৬৫ ও ৩.৪%। একই উদাহরণ ২০০৮-০৯ ও ২০০৯-১০ সালে মনমোহন সিং সরকারের আমলে পাওয়া যায়। ওই বছরে এফডি/জিডিপি অনুপাত ৬.৫ % হলেও মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৩.৮%। সুতরাং গরীবকে ন্যূনতম আয় পাইযে দেওয়ার বিরোধিতা হিসেবে মুদ্রাস্ফীতির যুক্তিও ধোপে টিকছে না।
তবে ‘ন্যায়’ বা ন্যূনতম আয় যোজনার সপক্ষে উপরের যুক্তি গুলি ভারতীয় অর্থনীতির তথ্য ভিত্তিক অর্থনৈতিক যুক্তি। হবে। অবশ্যই যোজনাটিকে প্রয়োগে নিয়ে যাওযার ক্ষেত্রে যেসব জটিলতা রয়েছে তাকে খুঁটিয়ে দেখতে হবে। এর পাশাপাশি ন্যূনতম আয়ের নিশ্চয়তাকে কাজে লাগিয়ে দরিদ্র মানুস যাতে ক্রমাগত দক্ষতা বাড়িয়ে দারিদ্র সীমাকে অতিক্রম করে সমাজিক ন্যায় ও গনতন্ত্রের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠতে পারে তা দেখতে হবে। সে বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। অবশ্যই যোজনাটিকে প্রয়োগে নিয়ে যাওযার ক্ষেত্রে যেসব জটিলতা রয়েছে তাকে খুঁটিয়ে দেখতে হবে।
তথ্য সূত্র: রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া: ডাটাবেস অফ ইন্ডিয়ান ইকনমি
টীকা:
১. ২০১৮-১৯ সালের পর থেকে চলতি মূল্যে জিডিপির বার্ষিক বৃদ্ধির হারকে ১০% অনুমান করা হয়েছে।
২. পরোক্ষ করের বার্ষিক বৃদ্ধির হার ১৫% ধরে ২০১৮-১৯ সালের পর থেকে পরোক্ষ কর আদায় অনুমান করা হয়েছে।
৩. বর্তমান ব্যবস্থায় ৩৭% কর রাজস্ব প্রত্যক্ষ কর থেকে ও ৬৩% পরোক্ষ কর থেকে আসে। বর্তমান ব্যবস্থায়, ২০১৮-১৯ সালের পর থেকে উল্লেখিত (টীকা- ২) পরোক্ষ করকে (৩৭/৬৩) দিয়ে গুণ করে প্রত্যক্ষ করকে অনুমান করা হয়েছে।
৪. উপরোক্ত পরোক্ষ করের (টীকা- ২) সঙ্গে উল্লেখিত প্রত্যক্ষ কর (টীকা-৩) যোগ করে বর্তমান ব্যবস্থায় মোট কর অনুমান করা হয়েছে।
৫. নুতন ব্যবস্থায়, ২০১৮-১৯ সালের পর থেকে অতিরিক্ত প্রত্যক্ষ কর আদায়ের ক্ষেত্রে অনুমান করা হয়েছে যে মোট করের ৪০% প্রত্যক্ষ কর থেকে আসবে। ফলে প্রত্যক্ষ কর মোট করের ৪০% ও পরোক্ষ কর ৬০% হবে। ফলে প্রত্যক্ষ কর ও পরোক্ষ করের অনুপাত ৪০/৬০ হবে। ফলে উল্লেখিত (টীকা- ২) পরোক্ষ করকে (৪০/৬০) দিয়ে গুণ করে প্রত্যক্ষ করকে অনুমান করা হয়েছে।
৬. নূতন ব্যবস্থায় টীকা-৫ এ উল্লেখিত প্রত্যক্ষ করের সঙ্গে টীকা ২ এ উল্লেখিত পরোক্ষ করের পরিমাণ কে যোগ করে ২০১৮-১৯ এর পর থেকে মোট কর আদায় অনুমান করা হয়েছে।
৭. টীকা ৬ থেকে প্রাপ্ত মোট কর থেকে টীকা-৩ এ প্রাপ্ত মোট করকে বাদ দিয়ে ২০১৯-২০ তেকে অতিরিক্ত কর আদায় হিসেব করা হয়েছে।
৮. রাউন্ডিং আপের জন্য হিসেবে সামান্য গরমিল থাকতে পারে।