গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সুপ্রিম কোর্টে অরুণ মিশ্রের নেতৃত্বে তিন বিচারপতির বেঞ্চ বনবাসীদের উচ্ছেদের মারাত্মক রায়টি দেয়। যারা ‘অরণ্যের অধিকার আইন, ২০০৬’ অনুযায়ী জমির জন্য আবেদন করেছিলেন কিন্তু সেই আবেদন খারিজ হয়ে গেছে এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে ২৭ জুলাই ২০১৯-এর মধ্যে বন থেকে উচ্ছেদ করার নির্দেশ দেওয়া হয় রাজ্য সরকারগুলিকে। একটি বেসরকারী সংস্থার রুজু করা জনস্বার্থ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে এই রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট। ষোলোটি রাজ্যের প্রতি এই নির্দেশ। এই রায় কার্যকর হলে ষোলোটি রাজ্যের বনাঞ্চল থেকে মোট ১১ লক্ষ মানুষ উচ্ছেদ হবেন। পশ্চিমবঙ্গ এই ষোলোটি রাজ্যের মধ্যে একটি এবং এখানে উচ্ছেদ হবে নব্বই হাজার আবেদনকারী। এই রায়ের সূত্র ধরে বাকী রাজ্যগুলিতেও যদি অনুরূপ নির্দেশ কার্যকর করতে হয় তাহলে দেশে সর্বমোট ২৩ লক্ষের অধিক মানুষকে উচ্ছেদ করতে হবে বনাঞ্চল থেকে। বাস্তবে তা সম্পূর্ণ সম্ভব হোক বা না হোক, আশঙ্কার বিষয় হল এই রায় কার্যত ‘অরণ্যের অধিকার আইন, ২০০৬’-কেই অকেজো করে দেবে। আবেদন খারিজ হলে যদি উচ্ছেদ হতে হয় তাহলে আবেদন করতেই ভয় পাবেন বনবাসী আদিবাসীরা। তাছাড়া সম্প্রতি কেন্দ্র সরকার যে ‘নতুন ফরেস্ট অ্যাক্ট’-এর প্রস্তাবনা এনেছে তা অরণ্যের অধিকার আইনকে পুরোপুরিই নস্যাত করে দেবে!
২০ ফেব্রুয়ারী লিখিত রূপে সুপ্রিম কোর্টের রায়টি সামনে আসার পর দেশের গণতান্ত্রিক মহল থেকে তীব্র ধিক্কার ওঠে। একথা পরিস্কার হয়ে যায় যে কেন্দ্র সরকারই মামলাটিকে এই পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। মামলার শেষ তিনটি শুনানিতে কেন্দ্র সরকার আদালতে হাজিরই হয়নি। রায় ঘোষণার পরও সম্পূর্ণ নীরব ছিল সরকার। দেশ জুড়ে যখন প্রতিবাদের ঢেউ ওঠে, যখন আদিবাসী সংগঠনগুলি এই রায়ের বিরুদ্ধে ভারত বন্ধের ডাক দেয়, আর দলিত সংগঠনগুলি এবং বিভিন্ন ছাত্র-যুব সংগঠন যখন ১৩ পয়েন্ট রোস্টার বাতিল করার দাবিকে যুক্ত করে ৫ মার্চের সেই ভারত বন্ধের সমর্থনে দাঁড়ায় তখন প্রবল চাপের মুখে কেন্দ্র সরকার আদালতে হাজির হয়। সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে “ঘুমিয়ে থাকা” বিশেষণে ভর্ৎসনা করে বলে, “এখন ঘুম ভেঙেছে আপনাদের?... গত কয়েক বছর ধরে ঘুমাচ্ছিলেন কেন? বছরের পর বছর ধরে কিছুই করলেননা, আর এখন এসেছেন রায় বদলাতে!” সুপ্রিম কোর্ট তার পূর্বের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ জারি করে বলে যে আগামী চার মাস এই রায় অকার্যকর থাকবে। এই চার মাসের মধ্যে (১০ জুলাই পর্যন্ত) রাজ্য সরকারগুলিকে আদালতে হলফনামা দিয়ে জানাতে হবে যে ঠিক কোন কোন কারণে তারা আদিবাসী ও অন্যান্য বনবাসীদের করা আবেদনগুলি খারিজ করেছিল।
অরণ্যের অধিকার আইনকে বাস্তবে কার্যকর করার বিষয়টি রাজ্য সরকারগুলির ওপর নির্ভর করে। কিন্তু এই অধিকারকে কার্যত এড়িয়ে যায় সব সরকার। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন ও বন সংরক্ষণ আইন কাজে লাগিয়ে বন দপ্তরের আধিকারিকেরা এখনও ঔপনিবেশিক যুগের মতই নিজেদেরকে বনের প্রভু বানিয়ে রেখেছে। বনসম্পদের কারবারি, সরকারি দলনেতা ও পুলিশ—এই চক্রের বিপুল ক্ষমতাঅরণ্যবাসীদের সন্ত্রস্ত রাখে। আইন অনুযায়ী অরণ্য অঞ্চলের পঞ্চায়েতগুলিতে আদিবাসী ও বনবাসীদের নেতৃত্বে বনাধিকার কমিটি গঠন করে তাঁদের হাতেই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়ার কথা। পশ্চিমবঙ্গে আগের সরকার বা এই সরকার কোনও সরকারই একাজ করেনি। এমনকি যে সমস্ত মানুষেরা এই অধিকার দাবি করেছেন তাঁদের ওপর সরকারী নিপীড়নও নেমেছে।
‘সিডিউল্ড ট্রাইব’ হিসেবে তালিকাভুক্ত নন এমন বহু মানুষ আছেন যাঁরা বনজ গৌণ সম্পদের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করেন। ভারতে এমন বহু কারিগর গোষ্ঠি বহু যুগ থেকে আছেন যাঁরা মূলত বনের কাঁচামাল থেকে তাঁদের শিল্পদ্রব্য উৎপন্ন করেন। এঁদের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। এই ধরণের বহু কারিগর গোষ্ঠি বনজ সম্পদের অধিকার হারিয়ে জীবনজীবিকা থেকে উচ্ছিন্ন হয়েছে, হারিয়ে গেছে। বনাধিকার আইনে “পারম্পরিক বনবাসী” বলতে অ-আদিবাসী এই অরণ্য-নির্ভর মানুষদেরই বোঝানো হচ্ছে। কিন্তু সুন্দরবন, জঙ্গলমহল বা উত্তরবঙ্গের জঙ্গলের ঘাস-বাঁশ-পাতা-বেতের ওপর কারিগরদের প্রাপ্য অধিকার এইসব মানুষেরা পাননি। পশ্চিমবাংলায় টিএমসি সরকারের প্রচারকদের মুখে বাংলার কারিগরি অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনের গল্প খুব শোনা যায় বটে কিন্তু এবিষয়ে কোনও উচ্চবাচ্য শোনা যায়না। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে উচ্ছেদের মুখে থাকা এই রাজ্যের লাখ-খানেক আদিবাসী ও বনবাসীদের জন্য ১০ জুলায়ের আগে রাজ্য সরকার কি কোনও সদর্থক পদক্ষেপ নেবে? লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে বিভিন্ন দলের আদিবাসী নেতারা কি এই প্রশ্নকে জোরালো ভাবে তুলে ধরবেন?