সাম্প্রতিক কালে ইসলামোফোবিয়ার সবচেয়ে বড় এবং ভয়াবহ নজির নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ শহরে নির্বিচার গুলিচালিয়ে নামাজে মগ্ন পঞ্চাশজন মুসল্লিকে হত্যা। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি পশ্চিমা দেশের গণমাধ্যম সিএনএন, রয়টার্স, ডেইলি মেল ওই সন্ত্রাসী দানবকে শুটার এবং মানসিক রোগী বলে বর্ণনা করেছে। বলছে মাস শুটিং। অথচ ওই সন্ত্রাসী মুসলিম নামধারী হলে তাকে টেরোরিস্ট বা সন্ত্রাসী আখ্যা দিতে তারা বিলম্ব করত না। কেবল ইউরোপেই নয়, গোটা বিশ্বে এমনকি মুসলিম প্রধান দেশে শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যেও ইসলামোফোবিয়া রমরমিয়ে বাড়ছে। ইসলামোফোবিয়া হল ইসলামভীতি, ইসলামবিদ্বেষ বা মুসলিম বিরোধী মনোভাব। ইসলামোফোবিয়া হল নিন্দার্থে বা ব্যাঙ্গার্থে ব্যবহূত একটি শব্দ যার অর্থ ইসলামকে ভয় পাওয়া। ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করাকেও বোঝানো হয়। ইসলামোফোবিয়ার কারণ হিসেবে অনেকে চরমপন্থী মুসলিমদের সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডকে দায়ী করেন। আবার মূল ইসলাম ধর্ম এর জন্য দায়ী বলে অনেকে মনে করেন। ইসলামোফোবিয়া প্রায়শই ভিত্তিহীন এবং মিথ্যা প্রচারের ফলাফল। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বিভিন্ন দেশে চরমপন্থী মুসলিমদের সশস্ত্র কর্মকাণ্ড এবং পশ্চিমী ও ইউরোপীয় বিশ্বে মুসলিম অভিবাসী বেড়ে যাওয়ার কারণে সেখানে শব্দটির ব্যবহার বেড়েছে। দুনিয়া জুড়ে সংবাদমাধ্যমে ইসলামি সন্ত্রাসবাদ নিয়ে নানা রকম খবরের জেরেও ইসলামোফোবিয়া ছড়িয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। ইসলামোফোবিয়ার জেরে সবচেয়ে অসুবিধায় পড়েছেন সাধারণ মুসলমান। বিমানবন্দর এবং অন্যান্য যায়গায় নিরাপত্তা তল্লাশির নামে মুসলমান নামধারী যাত্রীদের যেভাবে হেনস্থা করা হয় যেন মুসলমান মানেই সন্ত্রাসী। এছাড়া টুপি দাড়ি ঝুল পাঞ্জাবি বা হিজাব পরা মানুষদের দেখে সন্ত্রস্থ হয়ে ওঠাও ইসলামোফোবিয়ার লক্ষ্মণ। শব্দটির উৎস খুঁজে পাওয়া যায় একটি ফরাসী শব্দ ইসলামোফোবি থেকে, যার আক্ষরিক অর্থ ইসলাম সম্পর্কে মন্দ মানসিকতা বা ইসলাম বিষয়ে শত্রুতার ভাব। ১৯৮৫ সালে প্যালেস্টাইনী বংশোদ্ভূত আমেরিকান লেখক এডওয়ার্ড সাইদ এই শব্দটি ব্যবহার করেন তাঁর লেখায়। সম্ভবত তিনিই প্রথম কোনও একাডেমিক জার্নালে এই শব্দটি ব্যবহার করেন। আবার ইসলামের সমালোচনা মানেই কিন্তু ইসলামোফোবিয়া নয়। বরং ইসলামের চুলচেরা সমালোচনা করাটা যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশে নাগরিকের অধিকার। আধুনিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে ইসলামের (অন্য অনেক ধর্মের মতোই) অনেক দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রথার সরাসরি সংঘর্ষ রয়েছে। উদার গণতান্ত্রিক মানুষ ইসলামের সমালোচনা করেন। ইসলামোফোবিয়া হচ্ছে সেই ইসলাম বিরোধিতা যা সহনাগরিকদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী ঘৃণার জন্ম দেয় এবং সেই ঘৃণা থেকে পদ্ধতিগত ভাবে কোনও বিশেষ গোষ্ঠী মুসলিম সম্প্রদায়কে বৈষম্যমূলক ভাবে অপর করতে শেখায়। মূলধারার রাজনীতি, সংস্কৃতি কিম্বা সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে মুসলমানকে বিচ্ছিন্ন করার এক প্রক্রিয়া ইসলামোফোবিয়া। আমরা আমাদের চারপাশে ইসলাম ও মুসলমান নিয়ে মিথ্যা প্রচার এবং ভীতি ঘরে বাইরে দেখতে পাই। বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষিত হিন্দু ভয়ানক ভাবে ইসলামোফোবিয়ায় অক্রান্ত। তার জন্য শিক্ষাব্যবস্থা এবং সংবাদ মাধ্যমের দায়কেও খাটো করে দেখা যায় না। বাংলাদেশে যুক্তিবাদী এবং বিজ্ঞানমনস্ক নাস্তিকদের জনপ্রিয় ব্লগ ‘মুক্ত মনা’-য় প্রকাশিত একটি নিবন্ধ থেকে সে দেশের ইসলামোফোবিয়া নিয়ে কিছু মন্তব্য এখানে তুলে দেওয়া হল:
‘মনে করেন আপনি বিমানে করে যাচ্ছেন। আপনার পাশে বা পিছনে এক টুপি দাড়ি পাগড়ি পরা মুসলমান সুরমা চোখে তসবি জপছে আর মাঝে মাঝে মৃদু স্বরে আল্লাহো আকবর বলছে… আপনি ভীত হলেন আপনার সহযাত্রীর উদ্দেশ্য নিয়ে। সে কি বোমা মারবে নাকি ছিনতাই করবে বিমান এই আশংকায় আপনি তটস্থ থাকলেন।… মোটা দাগে এটাই ইসলামফোবিয়া। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওই রকম ধার্মীক মুসলমান যাত্রী বিমানে বোমা দিয়ে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করবে না তবে বিগত বিশ বছরের যত ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ তার সবই কোন না কোন ধর্মীয় মুসলমানের হাতেই। ঢাকার রমনাতে যে বছর বোমা ফুটল, এরপর থেকে টুপি দাড়িওয়ালা মাদ্রাসার ছাত্র কিসিমের কেউ মেলায়, এক্সিবিশনে, জনসভায় এসে দাঁড়ালে মানুষ চোরা চোখে চাইত। নিরাপত্তা গেইটে এই লেবাসের লোকজনকে বেশি করে তল্লাসি চালাতো। এখনো খোলা কোন জায়গায় গানের অনুষ্ঠানের আশেপাশে হুজুর লেবাসের লোকজনকে মানুষ আলাদা দৃষ্টিতে দেখে। এটাই হচ্ছে ইসলামফোবিয়া। বাইরের দেশের কথা বাদ দেন, ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশে আপনি কোন রেলস্টেশনে কি বিমানবন্দরে চিৎকার করে নারায়ে তাগবির আল্লাহো আকবর বলেই জোড়ে একটা দৌড় লাগান ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে, দেখবেন আশেপাশের মানুষ ভয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে। এই ইসলামফোবিয়া নেচারাল। এর পিছনে ইসলাম এবং মুসলমানরাই দায়ী।