একশ বছর আগে ১৯১৯ এর ২৯ মে এক
পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যের ধার ঘেঁষে পৃথিবীতে পৌঁছনো আরেক নক্ষত্রের
আলো পর্যবেক্ষণ করে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে আইনস্টাইন
ঠিক বলছেন। ষাটটি গবেষণাকেন্দ্রের দুশো জন বিজ্ঞানির একটি দল পৃথিবীর সাইজের ‘ঘটনা
দিগন্ত দূরবীন’ কয়েক বছর যাবৎ তাক করে রেখে এক অতিদূর ছায়াপথের কেন্দ্রের অন্ধকার
গহ্বরের ছবি প্রকাশ করেছেন এবছর। এবং আবারও বলেছেন যে আইনস্টাইন ঠিক। সাড়ে পাঁচ
কোটি আলোক বর্ষ দূরের মেসিয়ার-৮৭ গ্যালাক্সির(ছায়াপথ) কেন্দ্রস্থিত এই ব্ল্যাক
হোলের ছবি দেখে দুনিয়া হ্লাদিত হয়েছে, কেবল চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই
কর্পোরেট ‘ভিজুয়াল চায়না’ ও ‘গেটি ইমেজ’-এর যৌথ কোম্পানিটি বিজ্ঞানীদের নির্মিত
সেই ছবিতে নিজেদের ছাপ্পা মেরে বাজারে ছাড়ায় জনরোষ ও চিন সরকারের কোপে পড়ে শেষ
পর্যন্ত শিক্ষা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমা চেয়ে সেই ছাপ্পা-ছবি প্রত্যাহার করে
নিয়েছে।
‘ঘটনা দিগন্ত দূরবীন’ এক বিশেষ
ক্যামেরা এবং সত্যিই তার আকার পৃথিবীর সমান। বিষয়টা আর কিছুই নয়, পৃথিবী ব্যেপে —হাওয়াই
দ্বীপ থেকে দক্ষিণ মেরু— ছড়িয়ে থাকা নির্দিষ্ট ধরণের আটটি টেলিস্কোপ দ্বারা
ধারাবাহিক সংগৃহীত মিলিমিটার রেডিও ওয়েভকে একসূত্রে গেঁথে গেঁথে একটি ছবি গড়ে
তুললে সেই ক্যামেরাকে পৃথিবীর সাইজই বলতে হয়। যে ছবিটি শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে তা
আবছা-উজ্জ্বল-হলদে-কমলা বলয়ের মাঝে এক অন্ধকার গোলক —যে গোলকের আয়তন তিরিশ লক্ষ
পৃথিবীর সমান। কিন্তু ঘটনা দিগন্ত? আইনস্টাইনই বা কী ‘ঠিক’ বলেছিলেন?
আইনস্টাইন ১৯১৫ সালে তাঁর সার্বিক অপেক্ষবাদের তত্ত্বে বলেছিলেন যে আপনি ত্বরান্বিত গতিতে অবাধে পতনশীল অবস্থায় থাকলেও পদার্থবিদ্যার আইন কানুনগুলি আপনার কাছে অপরিবর্তিতই থাকবে। কিন্তু তা সত্যি হতে গেলে দেশকাল —মানে, স্পেসটাইম— সুষম সুস্থির থাকেনা আর। বস্তুজগৎ কীভাবে ছড়িয়ে আছে তা-ই ঠিক করে দেয় দেশকাল কীরম বাঁকাচোরা আকার নেবে। অর্থাৎ, আমি যদি ভেবে থাকি যে এ বিশ্বের সমস্ত বস্তুর বিলোপ ঘটলে পড়ে থাকবে কেবল এক মহাশূন্য দেশ আর নিরবধি কাল, তাহলে তা হবে আমার নিছক কমন সেন্স যা আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব নাকচ করে দিয়ে বলবে যে, বস্তুসকল বিলুপ্ত হওয়ার সাথে সাথে দেশকালেরও বিলোপ হয়ে যায়। বস্তু বা ভর —ইংরেজিতে যাকে বলে মাস— কীভাবে জমায়েত হলে তা দেশকালকে কী চেহারা দেয় তার সমীকরণ লিখেছিলেন আইনস্টাইন তাঁর সার্বিক অপেক্ষবাদের তত্ত্বে। তাঁর পেপারটি পাব্লিশ হওয়ার মাসখানেকের মধ্যে কার্ল শোয়ারশিল্ড সেই সমীকরণের ভিত্তিতে অঙ্ক কষে দেখলেন যে বিপুল পরিমান বস্তু কাছাকাছি জমায়েত হতে হতে এক পর্বে তার দেশকাল এমনভাবে বাঁকিয়ে নিতে পারে যে সেই অসীম বক্রতায় প্রবেশ করলে কোনও বস্তু, এমনকি আলো সেই ঘুরপাক থেকে আর বেরোতে পারেনা। আলো না আসা মানে কোনও তথ্যই না আসা। এই যে ‘প্রবেশ’ বিন্দু, অর্থাৎ দেশকালের অসীম বক্রতার শুরুয়াৎ যেখানে, তার ভেতরের কোনও তথ্যই সুতরাং আর বাইরের দর্শকের কাছে আসবেনা। ওই সীমারেখার ওপারে কী ঘটছে তা আর জানা যাবে না -ব্ল্যাক হোল। দেশকালের ওই সীমাতল হল ঘটনা দিগন্ত। সেই দিগন্তের ছবি তোলার জন্য রেডিও ওয়েভ টেলিস্কোপমালা সাজানো হয়েছিল বলেই তার নাম ‘ঘটনা দিগন্ত দূরবীন’।
অবাধে পতনশীল বস্তুর ক্ষেত্রেও পদার্থবিদ্যার মূলসূত্রগুলি একই থাকে, বরং দেশকালই যায় পাল্টে —একথা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়েছিল ১৯১৯ সালের সেই পূর্ণগ্রাস সূর্য গ্রহণের দিন। পৃথিবী থেকে দেখলে সূর্যের আড়ালে পড়ে যাওয়ার কথা এমন এক নক্ষত্রকেও যখন দেখতে পাওয়া গেল (সাধারণ দিনে সূর্যের আলোর আতিশয্যে এমনিতেই কোনও নক্ষত্রকে ঠাহর করা যায়না, তাই সেদিন পূর্ণগ্রাস সূর্য গ্রহণের সুযোগ নিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা) তখন স্পষ্টতই তার একমাত্র ব্যাখ্যা দাঁড়াল এই যে, ওই নক্ষত্রের আলো সূর্যের ধার ঘেঁষে আসার সময় বাঁকা পথ নিয়েছে। কিন্তু আলো তো সোজা পথে চলে! তাহলে? সোজা পথই সে নিয়েছে, কেবল সূর্য নামক ‘বস্তু জমায়েত’-এর ফলে ওখানে দেশকাল এমন যে পথটা আমাদের হিসেবে বাঁকা মনে হচ্ছে। আইনস্টাইনের সমীকরণ থেকে পাওয়া হিসেব এবং সেদিনকার পরীক্ষালব্ধ সেই বাঁকাপথ হুবহু মিলে গেল। এরপরই বিজ্ঞানী মহলের গন্ডি পেরিয়ে সারা দুনিয়ার ব্যাপক মানুষের কাছে বিখ্যাত হয়ে যান আইনস্টাইন। আজ যেমন অন্ধকার গহ্বরের ছবি আলোড়ন ফেলেছে তেমনই সেদিন খবরের কাগজের প্রথম পাতায় আলোড়ন জাগিয়ে হাজির হয়েছিল আইনস্টাইন ও তার তত্ত্বের কথা। এবং, ফুটনোটে একথাও লেখা যেতে পারে, এ বিষয়ে ভারতের প্রথম সংবাদ নিবন্ধটি সেদিন দ্যা স্টেটসম্যান পত্রিকায় লিখেছিলেন মেঘনাদ সাহা।