তিলোত্তমার ঘৃণ্য ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে রাজ্যের জনগণের সংগ্রাম শুরুর দিনগুলির তুলনায় বর্তমানে বেশ কিছুটা গভীরতা ও ব্যপ্তি অর্জন করেছে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। শুরুর দিকে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস'-এর মত একটা ফাঁকা স্লোগান দিয়ে আকাশ বাতাস মুখরিত করার তুলনায় বর্তমানে অনেক নির্দিষ্ট ও কাজের কথাবার্তা উঠছে, এটি ভালো লক্ষণ। একথাও আমাদের স্বীকার করতে হবে যে এই ইতিবাচক পরিবর্তনের পেছনে সিনিয়র জুনিয়র মিলিয়ে গোটা ডাক্তারী কমিউনিটির বড় অবদান আছে। ডাক্তারদের প্রথম পর্বের আন্দোলনের মত দ্বিতীয় পর্বের আন্দোলনও গোটা রাজ্যের তথা দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে, সাধারণ মানুষের সমর্থনও আদায় করতে পেরেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই আন্দোলনের কিছু সমস্যার দিকও আছে যা আমাদের, আন্দোলনের সমর্থকদের আলোচনা করতে হবে আন্দোলনকে আরও মজবুত করার লক্ষ্যেই। এই আলোচনা আন্দোলনকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্য নিয়েই করা।
কিন্তু সে প্রশ্নে যাবার আগে অন্য দু-একটি কথা বলে নেওয়া দরকার। অনেকেই এমন একটা মতামত রাখছেন যে, দিন যত যাচ্ছে তিলোত্তমার ন্যায়বিচারের প্রশ্নটি হারিয়ে যাচ্ছে। আনুসঙ্গিক অনেক বিষয় উঠছে কিন্তু তিলোত্তমার বিচারের প্রশ্নটি গৌন হয়ে যাচ্ছে। তাঁদের বোধহয় কোথাও মনে হচ্ছে যে, তিলোত্তমা তিলোত্তমা করে চীৎকার চেঁচামেচি চালিয়ে গেলেই বুঝি তিলোত্তমার ন্যায়বিচারের প্রশ্নটি বেঁচে থাকবে। অন্য কথা এলেই বুঝি যে প্রশ্ন হারিয়ে যাবে। এভাবে দেখার প্রধান বিপদ হল এতে করে তিলোত্তমার ন্যায়বিচার পাওয়ার বিষয়টিকে কিছুটা লঘু করে দেখে ফেলা হয়।
একথা আজ সকলেই মানেন যে তিলোত্তমার ঘৃণ্য ধর্ষণ ও হত্যাকান্ড আর পাঁচটা ধর্ষণ-হত্যার ঘটনা থেকে আলাদা। নিছক লালসার কারণে এই ঘটনা ঘটে নি। এর সঙ্গে ক্ষমতার প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। যুগে যুগে পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যের ভাষা যে রাজনীতির পতাকা হাতে নিয়ে নারীর সাথে কথোপকথন চালায় সেই ভাষার প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। ক্ষমতার এই উপস্থিতি এই ঘটনায় এতটাই প্রত্যক্ষ যে আন্দোলনকেও ক্ষমতার প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে হবে বৈকি। তার দিকে আক্রমণের বর্শামুখ নিবদ্ধ রাখতে হবে বৈকি। এই ঘটনা আরও আলাদা এই কারণে যে, এই ঘটনা ঘটেছে এই অপরাধটির যিনি শিকার তাঁর কর্মক্ষেত্রের চার দেওয়ালের মধ্যে যার সঙ্গে উক্ত কর্মক্ষেত্রের বিশেষ চরিত্র ও গতিপ্রকৃতির প্রশ্ন জড়িত। ঘটনার আরও বৈশিষ্ট্য হল এই কর্মক্ষেত্রটি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। ফলে এই যে প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা এবং আনুষাঙ্গিক ধর্ষন তার সাথে সরকারের প্রশ্ন যুক্ত হয়ে পড়া একান্তই স্বাভাবিক। তিলোত্তমার হত্যা-ধর্ষ্ণের প্রকৃত বিচার চাইলে এই সকল প্রশ্নকে যুক্ত করেই আন্দোলনকে এগোতে হবে। শুধু ‘বিচার চাই বিচার চাই’ বলে চিলচীৎকারকারীদের পথ এবং পদ্ধতিই বরং প্রকৃতপ্রস্তাবে তিলোত্তমার ন্যায়বিচার চাওয়ার পথে প্রতিবন্ধক। এটা সোজাসাপটা বুঝতে হবে।
তিলোত্তমার হত্যা-ধর্ষণের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা তথাকথিত নারীবাদী আন্দোলন এবং জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন, এই উভয়েরই প্রধান দুর্বলতা ও ব্যর্থতা হল এই ‘ক্ষমতা’কে চ্যালেঞ্জ করার প্রশ্নে তার দুর্বলতা। এই দুর্বলতা খুব পরিষ্কারভাবে ধরা পড়েছে তার মিষ্টি গোলাপী অরাজনৈতিক নাগরিক আন্দোলন হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে চাওয়ার আকাঙ্খার মধ্যে। পরিষ্কার বুঝতে হবে এই তথাকথিত নাগরিক আন্দোলন আসলে নয়া-উদারবাদের মৌতাতে জারিত হয়ে নরম নরম এক তুলতুলে প্রতিরোধের ভাষ্য ছাড়া আর কিছু নয়। এই ধরণের আন্দোলনে বহু লোক সমাগম হতে পারে, উৎসবের মেজাজ থাকতে পারে কিন্তু শাসকের পক্ষে একে পোষ মানিয়ে নেওয়া কঠিন নয়। কারণ এতে পাল্টা ক্ষমতার প্রশ্ন নেই। তথাকথিত নারীবাদীদের আন্দোলন এবং জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন কোথাও এই পাল্টা ক্ষমতার কোনো বয়ান ছিল না।
রাজ্যের শাসক দলকে খেয়াল করে দেখুন। তারা সর্বদাই কিন্তু এই ভয়ে আছে। ফলে ‘বিচার চাইছেন?’ নাকি ‘রাজনীতি করতে চাইছেন?’ –--- এই দুইয়ের এক বাইনারিতে ফেলতে চাইছেন সবাইকে। একই কাজ করছে কর্পোরেট মিডিয়াগুলোও। যেহেতু এই আন্দোলনে বিভিন্ন ধারার বামপন্থী লোকেদেরই প্রভাব বেশি, তাঁরাই এই আন্দোলনগুলির নেতৃত্বস্থানীয় জায়গায় রয়েছেন তাই কর্পোরেট মিডিয়াও এই ভয়ে কাঁটা হয়ে রয়েছে কে জানে বাবা এর মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক বাম আন্দোলন আবার শক্তিশালী হয়ে উঠবে না তো! তাই তারাও এই বাইনারিকে হাতিয়ার করেই চলেছে। এর সামনে দাঁড়িয়ে কেউ একথা বলার জায়গাতেই নেই যে, ‘হ্যাঁ রাজনীতিই তো করছি, নইলে তিলোত্তমার বিচার কীভাবে পাব?’ তিলোত্তমার হত্যা এবং ধর্ষণের কারণ যদি হয় প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির সাথে রাজনৈতিক ক্ষমতার মেলবন্ধন, তার সঙ্গে পুলিসের যোগসাজশ তার সঙ্গে মেডিসিন কোম্পানীর সাঁট, তদুপরি পুরুষতান্ত্রিক পরিমন্ডল –---- শাসনব্যাবস্থার একট পাল্টা রূপকে প্রতিষ্ঠিত করা ছাড়া এর থেকে মুক্তি আছে?
ঠিকই যে একটা গণ-আন্দোলনের নির্দিষ্ট লক্ষণরেখা আছে। সে সর্বদা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যে পরিচালিত না-ই হতে পারে। কিন্তু একটা গণ-আন্দোলন যদি সত্যিকারের গণ-আন্দোলন হয় তাহলে সে যেমন নিজে সেই লক্ষণরেখার মধ্যেই থাকবে, কিন্তু একই সাথে সে তো চাইবে যে সেখান থেকে এক বিকল্প রাজনৈতিক ভাষ্য উঠে আসুক। সে নিজেই রাজনৈতিক আন্দোলন নাও হয়ে উঠতে পারে কিন্তু তাকে অবশ্যই কোনো না কোনো বিশেষ রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে ওঠার রাস্তা তৈরির কাজকে সচেতনভাবে বেগবান করতে হবে। লুকিয়ে চুরিয়ে নয়, প্রকাশ্যে, খোলাখুলি। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে নয়, রাজনৈতিকভাবে। একেবারে দায়িত্ব নিয়ে। নইলে সে কিসের গণ-আন্দোলন?
অথচ, এখানে উল্টো ব্যাপার। আন্দোলনের প্রধান মুখ যাঁরা তাঁরা মাঝেমধ্যেই এই জাতীয় ঘোষণা দিলেন, “আমাদের আন্দোলনকে ব্যবহার করে আমরা কাউকে রাজনীতি করতে দেব না” ইত্যাদি! কোনো দলের পতাকা তাঁদের সমর্থনে এসেছে দেখলেই রে রে করে তেড়ে গেলেন, ধিক্কার জানানো অবধি চলে গেলেন, কোনো গায়ক ‘আজাদী আজাদী’ গান শুরু করামাত্র তাঁর মাইক কেড়ে নিলেন! এইসব কান্ডকারখানা করলেন। এসবের অর্থ কী? কার কাছে তাঁরা 'গুড বয়’ হতে চাইলেন? শাসকের কাছে? মিডিয়ার কাছে? নাকি শহুরে নাগরিক মধ্যবিত্তের কাছে? নাকি সবার কাছেই। যাকে বলে সমাজের কাছে। তা এই “গুড বয়েজ’ আন্দোলন” যে কখনই কার্যকরী কিছু উৎপন্ন করেনি জগতে, শুধু ‘কিছু মায়া রহিয়া গেল’ বলার লোক ছাড়া, একথা তাঁরা এই অবসরে একবার ভেবে দেখতে পারেন।
কৌতুহলোদ্দীপক ব্যাপার হল, যাঁরা আন্দোলনকে তথাকথিত অরাজনৈতিক রেখে এগোনোর প্রাণপণ চেষ্টা চালালেন তাঁরা প্রায় সকলেই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য। কিন্তু তাঁরা কোন সংগঠন করেন সেটা কিন্তু আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে একেবারেই উঠে এল না। রাজ্যের ব্যাপক জনগণ যাঁরা এই আন্দোলনকে সমর্থন দিলেন তাঁরা জানতে পারলেন না আন্দোলনের কুশীলবরা কোন সংগঠন করেন। জনগণের ব্যাপক অংশ জানল, এঁরা সব ‘জয়েন্ট পাস করা মেধাবী ছাত্র’, তদুপরি ‘'অপাপবিদ্ধ”! ‘রাজনীতির কলুষতা, দলীয় রাজনীতির পাঁক’ উহাদের স্পর্শ করে নাই। বেশ গোলাপী চিত্রনাট্য। কিন্তু গোলাপী হলেও তা মিথ্যা। বুর্জোয়া জনপ্রতিনিধিরা বা রাজনীতিকরা সর্বদাই দেখবেন জনগণের কাছে নিজেদের আসল চেহারা লুকিয়ে রাখে, তারা যা নয় তাই দেখানোর চেষ্টা করে। কমিউনিষ্ট বিপ্লবী তথা বামকর্মীদের এই নিজেকে ঢেকে রাখার, নিজে যা তার বিপরীত দেখানোর প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা আসলে এই বুর্জোয়া দর্শনের কাছে আত্মসমর্পণ!
বামকর্মীরা আজকাল এটা করছেন কেন? করছেন কারণ গত তিন দশকে নয়া-উদারবাদী দর্শন যে লাগাতার প্রচারের মাধ্যমে জনচেতনায় (বিশেষ করে শহুরে মধ্যবিত্ত) প্রতিষ্ঠিত যে, রাজনীতি খারাপ জিনিস, দল তো আরও খারাপ, এই চেতনাকে আক্রমণ করার কণ্টকাকীর্ণ রাস্তা তাঁরা পরিত্যাগ করেছেন। তাঁরা একটা সহজ পথ নিয়েছেন। তা হল এই চেতনার কাছে আত্মসমর্পণ করে, উল্টে তাকেই প্রশ্রয় দিয়ে (প্যাম্পার করে) তাতেই ভেসে থেকে বৃহত্তর সামাজিক ঘটনার মুখ হয়ে ওঠার রাস্তা বেছে নেওয়া।
বিষয়টা আরও কৌতুহলোদ্দীপক কারণ এটি বামকর্মীরা নিজেদের সিদ্ধান্তে করছেন এমন নয়, আসলে করছে তাঁরা যে দলগুলির সদস্য তারা। অর্থাৎ, দলগুলি এখানে নিজেই নিজেকে অস্বীকার করছে। নিজেকে জনগণের সামনে আনতে ভয় পাচ্ছে। অর্থাৎ নিজেদের রাজনীতিতে নিজেদেরই বিশ্বাস নেই। পরিভাষা প্রয়োগ করলে বলা যায় যে, এই দলগুলি আসলে নিজেরা বিলোপবাদী রাজনীতির অনুশীলন করছে। নয়া-উদারবাদী দর্শনকে মোকাবিলা না করে তার কাছে আত্মসমর্পন করছে। জনচেতনাকে কলুষিত করছে। জনগণের মধ্যে থাবা গেড়ে বসা ভুল চিন্তাকে আক্রমণ না করে যখন দলগুলি তাকে প্রশ্রয় দেয় তখন তারা জনচেতনাকে কলুষিত করার বুর্জোয়া প্রজেক্টেরই অংশ হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলেই গণ-আন্দোলন হয়ে দাঁড়ায় সুবিধাবাদের আখড়া।
এর বাস্তব ফলাফল কী? এর বাস্তব ফলাফল মারাত্মক। অনেক কিছুই হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। দেখুন, ডাক্তার আন্দোলনে একবারও সামগ্রিক জনস্বাস্থ্যের প্রশ্ন উঠে এল না। কেন এল না? কারণ, বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার রমরমার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে প্রস্তুত নয়। সরকারি স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে কথা বলতে কেউ প্রস্তুত নয়। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলির বিরুদ্ধে কথা বলতে কেউ রাজি নয়। ওষুধ কোম্পানীগুলির বিরুদ্ধে কথা বলতে কেউ রাজি নয়। সরকারি হাসপাতালে থ্রেট কালচারের বিরুদ্ধে অবশ্যই কথা উঠেছে। এটি এই আন্দোলনের একটি সাফল্য। সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় দুর্নীতির প্রশ্ন উঠেছে। এটিও এই আন্দোলনের সাফল্য। কিন্তু এতে করে সামগ্রিক জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি সামনে আসে না। আন্দোলনকারীরা চাইছেন যে, তাঁদের আন্দোলনের পাশে সমাজের সকল অংশের মানুষ সমবেত হোন। খুবই স্বাভাবিক ও ন্যায্য চাওয়া। কিন্তু তাঁরা সমাজের সকল মানুষের, বিশেষ করে দুর্বলতম অংশের মানুষের স্বাস্থ্যের অধিকার নিয়ে কথা বলতে রাজি নন। ঠিক যেমন আন্দোলনকারীরা চান না রাজনৈতিক দলগুলি দল হিসাবে পাশে দাঁড়াক। কিন্তু তারাই মিছিলে লোক জোগাবে। তারাই আন্দোলনের পাশে মানুষকে টেনে আনবে। অর্থাৎ তারা (পাশে) থাকবে কিন্তু (দল হিসাবে) থাকবে না। অর্থাৎ মুখ লুকিয়ে থাকবে। জনগণও পাশে থাকবে কিন্তু জনস্বার্থে লড়াই হবে না।
আন্দোলনের রূপের ক্ষেত্রেও দেখুন। জুনিয়র ডাক্তাররা অনশনে গেলেন। আমরণ অনশন। ব্যাপারটা কিন্তু প্রচুর আলোচনার দাবি রাখে। আমি আপাতত শুধু একটা ব্যাপারই উল্লেখ করতে চাইব। আমরণ মানে কিন্তু আমরণ। অসুস্থ হলে উঠে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যাওয়া নয়। আমরণ অনশনের এই অদ্ভুত রূপ কিন্তু আসলে জালিয়াতি করার সামিল। তা আন্দোলনের ধার নষ্ট করে দেয়।
তিলোত্তমার ঘৃণ্য হত্যা ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত যা আন্দোলন হয়েছে তার অনেক সদর্থক দিক আছে। কিন্তু এই আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা ও সুবিধাবাদের প্রতিও আমাদের নির্মোহ সমালোচনা থাকতে হবে। নইলে তিলোত্তমারা বিচার পাবে না।