সোশাল মিডিয়ায় মাঝেমাঝেই একটা ছবি চোখে পড়ে। তিনরকমের উচ্চতার তিনটি শিশুর পায়ের নিচে সমান উচ্চতার একইরকম তিনটি টুল। সেই টুলের ওপরে দাঁড়িয়ে তারা উঁচু বেড়া দেওয়া খেলার মাঠের বাইরে থেকে ভেতরের খেলা দেখছে। যে শিশুটি লম্বায় বাকিদের চেয়ে বড়, সে ভালোভাবেই খেলা দেখতে পাচ্ছে। তার থেকে উচ্চতায় একটু কম শিশুটিও মোটামুটি দেখতে পাচ্ছে। সমস্যায় পড়েছে সবচেয়ে কম উচ্চতার শিশুটি। টুলের উচ্চতা বাকি দু'জনের সমান হওয়া সত্ত্বেও তার সামনে শুধুই দেওয়াল! অর্থাৎ সাম্যবাদের কেতাবি সংজ্ঞা মেনেও আসলে প্রকৃত সাম্যবাদে পৌঁছনো সম্ভব হচ্ছে না। ইকুয়ালিটি অ্যান্ড জাস্টিস শিরোনামের ছবিটিতে সবচেয়ে ছোট শিশুটির পায়ের নিচে যখন সবচেয়ে উঁচু টুলটি দেওয়া হয়, তখন সাম্যবাদ রক্ষিত হয় না বটে কিন্তু সেটাই হয় জাস্টিস অর্থাৎ ন্যায়।
১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্যদিবস উপলক্ষে নিয়ে ভাবতে গিয়ে ছবিটার কথা মনে পড়ে গেল। ইকুয়ালিটি, জাস্টিস, ফ্রেটারনিটির যে বার্তা আমরা ছোটবেলা থেকে শিখেছি বা শিখিয়ে এসেছি, আজ যেন তাতে একটা বড়সড় ধাক্কা লাগছে! সাম্যবাদ আর ন্যায়ের ধারণা চলে হাত ধরাধরি করে। অথচ আজ যেদিকে তাকাই শুধু বিভাজন! সাম্যবাদ একটা কষ্টকল্পনার জায়গা আর সেই প্যাঁচে পড়ে ন্যায়ের ধারণাও অলীকে পর্যবসিত! নতুন এই সমাজে গরিবেরা ক্রমশ আরও গরিব হচ্ছেন, ধনীরা উত্তরোত্তর আরও ফুলেফেঁপে উঠছেন। অর্থাৎ পায়ের নিচের টুলের উচ্চতাটুকু সমান তো নেইই, কোথাও কোথাও টুলটাই নেই! আজকের দিনে রান্নার গ্যাসের দাম হাজার টাকার বেশি! সরষের তেলের দাম দুশো পঁচিশ টাকা! নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসের দামই আকাশছোঁয়া। রাইট টু ফুড ক্যাম্পেনের এক সমীক্ষা বলছে আমাদের দেশের ১৮.৭ শতাংশ মানুষের দৈনন্দিন খাবার জোটে না। অপুষ্টির কারণে প্রতি তিনটি শিশুর একজনের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। তার ওপরে অতিমারী পরবর্তী সময়ে বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন, তাঁদের হাতের জমানো টাকার পরিমাণ ক্রমশ কমছে, গত বছর অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে দেশে কর্মহীন মানুষের সংখ্যাটা ৭.৯ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১০.৩ শতাংশ, পশ্চিমবঙ্গে তার হার ২০২০-র এপ্রিল মাসেই ছিল ১৭.৪% (সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমির সমীক্ষা অনুযায়ী)। অন্যদিকে এক প্রবল বৈপরীত্যের খেলায় দেশের সমস্ত সম্পদের সিংহভাগ জমা হচ্ছে হাতে গোনা দু' তিনজন শ্রেষ্ঠীর হাতে। আমার দেশের বাস্তবচিত্র এটাই!
সাধারণ মানুষের যখন এমন টালমাটাল অবস্থা, সেখানে কেমন থাকবেন মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষেরা! বৈষম্যে ভরা এই পৃথিবীতে মানসিক স্বাস্থ্যের জায়গাটাই বা কেমন, কোথায়? গবেষণা আমাদের দেখিয়েছে দারিদ্রের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শুধু তাই নয়, সমাজের অন্যান্য মাপকাঠি, যেমন শিক্ষার অভাব, সামাজিক বৈষম্য, বেকারত্বের মতো নানা সমস্যার সঙ্গে মানসিক রোগের যোগ রয়েছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য, আয়ের অভাব শুধু শরীরের ওপরেই নয়, মনের ওপরেও গভীর প্রভাব ফেলে। স্কিৎজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, শৈশব ও কৈশোরের নানা মানসিক সমস্যা, নেশাক্রান্ত হয়ে পড়া, এ সব কিছুর সঙ্গেই যোগসূত্র রয়েছে দারিদ্রের।
প্রশ্ন হল দারিদ্রের সঙ্গে মানসিক অসুস্থতা কীভাবে সম্পৃক্ত?একটু বিস্তারিত বললেই বিষয়টা পরিষ্কার হবে! অস্বীকার করার জায়গা নেই, এ সমাজে ধনবানের সঙ্গে ক্ষমতার একটা সংযোগ রয়েছে। যাঁর যত আর্থিক সম্পদ, তিনি তত ক্ষমতাবান। সম্পদ আর ক্ষমতার সেই রক্তচক্ষুর সামনে ম্রিয়মাণ হতে থাকে আর্থিকভাবে দুর্বলের কণ্ঠস্বর। বৈষম্য যত প্রকট হতে থাকে, বাড়তে থাকে অস্তিত্বের সংকট, বাড়তে থাকে মানসিক চাপ। আর যাঁদের আগে থেকেই কোনও কারণে মানসিক অসুস্থতার সমস্যা আছে বা ছিল, তাঁদের সংকট কতটা প্রগাঢ় হয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না! যে মানসিক রোগী হয়তো সুস্থ হয়েছেন, বাড়ি ফিরেছেন, সামান্য একটা কাজ করে নিজের জীবন চালিয়ে নিচ্ছেন, তাঁর কেমন অবস্থা হবে অগ্নিমূল্যের এই বাজারে? মানসিক রোগের কথা ছেড়ে দিন, সাধারণ কোনও সমস্যা থাকলেও কি সম্ভব এই অসাম্যের জগতে সুস্থভাবে বেঁচে থাকা? সবচেয়ে সমস্যায় পড়ছেন বয়স্ক মানুষেরা। ব্যাঙ্কে জমা টাকার ওপর সুদ কমছে, লাফিয়ে বাড়ছে জীবনদায়ী ওষুধের দাম, ক্রমশ টান পড়ছে সম্বলে। বাড়ছে আত্মহত্যার সংখ্যাও। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৯ সালে ভারতে পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যায় মৃত্যু ঘটেছে। কিছুবছর আগেও পরিস্থিতি তো এতটা শোচনীয় ছিল না! তা হলে আজকের দিনে দাঁড়য়ে কোন সাম্যবাদের কথা বলব আমরা?
সাম্প্রতিক কোভিড মহামারীর প্রেক্ষিতে আরও প্রকট হয়ে উঠেছে বৈষম্যের ছবিটা। যাঁদের হাতে অর্থ রয়েছে তাঁরা সহজেই বেসরকারি টিকাকেন্দ্রে গিয়ে টিকা নিতে পেরেছেন। যাঁদের নেই, তাঁদের শুকনোমুখে বসে থাকতে হচ্ছে সরকারি আনুকূল্য কবে জুটবে সেই আশায়। তার মধ্যেই খবর আসছে টিকা নষ্ট হওয়ার। একশো কোটির বেশি জনসংখ্যা যে দেশে, এবং যে জনসংখ্যার অন্তত ৭০ ভাগের দিনে কুড়ি টাকা করে খরচ করারও ক্ষমতা নেই, সেই দেশে টিকা নষ্ট হওয়ার বিলাসিতা করা হচ্ছে কারণ টিকাকর্মী আসেননি! একদিকে চোখ ধাঁধানো বুলেট ট্রেন, ঝাঁচকচকে শহুরে রাস্তাঘাট, অন্যদিকে বিশাল পাঁচিলের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে অন্ধকার বৈষম্যের স্থিরচিত্র! একদিকে আর্সেনিকমুক্ত সামান্য একটু পানীয় জলের আশায় মাইলের পর মাইল হেঁটে যাচ্ছেন গ্রামের মেয়েরা, অন্যদিকে কোনও এক শ্রেষ্ঠীপত্নী ৬০ হাজার ডলারে এক বোতল জল কিনে খাচ্ছেন। সাম্যবাদ নিয়ে আর কীই বা বলার থাকতে পারে এর পর?
আর এ সবের মধ্যে চোখে ভেসে উঠছে হাঁটুর ওপরে কাপড় পরা এক সন্তের ছবি, ক'দিন আগেই যাঁর জন্মদিন গেল! কোথাও পড়েছিলাম তাঁর একটি উদ্ধৃতি। উন্নয়ন প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলছিলেন, যখনই কোনও উন্নয়নমূলক প্রকল্পের কথা ভাববে, তোমার দেখা তোমার দেশের দরিদ্রতম মানুষটির মুখ মনে কোরো আর ভেবো এই প্রকল্পে তাঁর কি কোনও উন্নতি হবে? যদি উত্তর 'হ্যাঁ' হয়, তা হলে প্রকল্পের কাজ শুরু কোরো, আর যদি উত্তর 'না' হয়, তা হলে এড়িয়ে যেও।"
চারদিকে ক্রমশ প্রকট হয়ে ওঠা বিভেদ আর বৈষম্যের জাল ছিঁড়ে কল্যাণকামী রাষ্ট্রের এই মুখটা কি আর কোনওদিন দেখতে পাব?