পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

পুরোনোতুন ভাবনা

  • 12 October, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 3030 view(s)
  • লিখেছেন : রোহিণী ধর্মপাল
ভালো লাগে যখন অন্য ধর্মের ছেলেমেয়েরাও এগিয়ে আসে। মুসলিম ছেলে জাভেদ মহানন্দে সপ্তপদীর আলপনা আঁকে, নিজেই। বাংলায় স্তোত্র বলে। মাতৃভাষায় মন্ত্র বলার মজাই আলাদা। বিশেষ করে যখন বোঝে সেই মন্ত্রের মধ্যে কিভাবে পরিবেশের কথা বলা হচ্ছে, কিভাবে প্রেমের কথা বলা হচ্ছে! মহিলাদের দিয়ে পুজো করা, বিবাহ দেওয়া, শ্রাদ্ধ করা, কিভাবে দেখে সমাজ। আজকে কি কোনও পরিবর্তন হয়েছে? লিখলেন রোহিণী ধর্মপাল।

ছোটবেলায় বাড়িতে একমাত্র সরস্বতী পুজো হতে দেখেছি। বৈদিক মন্ত্রে। সরস্বতী মানে জ্ঞানের প্রবাহ, বিদ্যার প্রকাশ। আর মা ছিলেন বিদ্যার আরাধক। বোধহয় সেই জন্যই একমাত্র এই একটি মূর্তি পুজো হত। মাকে আর কখনো কোনো সময় কোনো মূর্তি পুজো করতে দেখিনি। আমাদেরও কখনো করতে বলেন নি, আবার আলাদা করে বারণও করেন নি। নিজের মতো করেই দুর্গা পুজোয় ঘুরতাম খেতাম আনন্দ করতাম, কখনো অঞ্জলি দিই নি। ভালোই লাগত না। তাই দিই নি। মাকেও দেখিনি। মা তো পুজোর সময় নিজের সত্যি পুজোই করতেন। অর্থাৎ লেখালেখির কাজ। আসলে মায়ের কাছে পরোক্ষে এটাই শিখেছি যে কোনো কাজ নিষ্ঠা আর ভালোবাসা সহ করলে তাইই পুজো। আর আমাদের বাড়িতে কখনো বিসর্জন বলে কিছু ছিল না। দীর্ঘ বছর পরে যখন মাটির মূর্তি যখন আপনি ভেঙে পড়ে যেত, তখন তা টবের মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হত। দিব্যি সকালে চা পাঁউরুটি খেয়ে বাকি কাজ করতাম। আর পিরিয়ড হলে? কী আবার! ওই সময় পুজো করতে নেই জাতীয় অর্থহীন কথা মায়ের কাছে কখনো শুনিনি!

মা গৌরী ধর্মপাল ছিলেন বেদজ্ঞ। শুকনো বেদের পণ্ডিত নন। চেয়েছিলেন বেদের কথা সবাই জানুক। সংস্কৃত না জানলেও। বৈদিক ভাষা না জানলেও। তাই ঋক আর অথর্ব বেদের একাধিক সূক্ত অনুবাদ করেছিলেন সহজ বাংলায়। তার মধ্যে বিবাহ সূক্তও ছিল।

বৈদিক মন্ত্রের সঙ্গে তার বাংলা, ছন্দময় বাংলা বলে গৌরী বিয়ে দিতে শুরু করলেন। সঙ্গে বেদের বিবাহ সূক্তের কিছু মন্ত্রের শব্দও পাল্টে দিলেন। সেই সময়ে যা একটা বিপ্লবের মত ছিল। সেই সময়ে কেন, এখনও। বরের মন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত করলেন বধূর জন্যেও মন্ত্র।

আমরা সেখানে আরো একটু এগোতে চাইলাম। যদিও এই কাজে এসে বুঝছি, প্রতিটা পদক্ষেপে তথাকথিত শিক্ষিত আধুনিক মানুষও সংস্কারের হাতে কতখানি বদ্ধ! তবু, আমাদের সঙ্গে বিয়ের অনুষ্ঠান করবে বলে ওই বিয়ের দিন, শুভ অশুভ দিন, লগ্ন -- এইসব থেকে বেরোচ্ছেন অনেকেই। এখনও পর্যন্ত কেউ জিজ্ঞাসা করেন নি আমাদের দলে সবাই ব্রাহ্মণ কিনা। বিয়ে দেওয়ার সময় পিরিয়ড হলে কিছু হবে কিনা!!

কিন্তু বিয়ের সময় ছেলের মা থাকতে পারবেন কিনা, জিজ্ঞাসা করেন! মেয়েরাও কেউ কেউ চায় পানপাতা দিয়ে মুখ ঢেকে আসতে, পিঁড়িতে চেপে বরকে প্রদক্ষিণ করতে! কন্যাদান বৈদিক বিবাহে নেইই, সুতরাং সেই কন্যাদানের প্রশ্নও ওঠে না। আর এটি যে বর্জনীয়, তা বেশ অনেকেই বুঝছেন। এখন আমাদের কাজ হচ্ছে বোঝানো সিঁদুর পরাটাও বর্জনীয়।

মন্ত্রের খানিক বদল আমরাও করেছি। যেমন একটি মন্ত্রের বাংলা ছিল কন্যা বাপের বাড়ি ছেড়ে স্বামীর ঘরে চলেছে। মা বাবার বাড়ির সঙ্গে মায়ের বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে, সেই কথাটি যোগ করেছিল। আমার ছেলে বলল সবসময় মেয়ে ছাড়বে কেন! ঠিকই তো! তাই এখন একটি গৃহ থেকে আরেক গৃহে চলেছে বলা হয়। আর প্রকৃতপক্ষে কথাটি দুজনের জন্যই প্রযোজ্য। দুজনেই তো আরেকটি বাড়ি, আরেকটি পরিবার পাচ্ছে।

অগ্নিতে ঘৃতাহুতিকে আজ্যাহুতি বলে। সেখানে দুটি মন্ত্র। একটি বরকে দিয়ে বলাই, অন্যটি বধূকে দিয়ে। আর সবথেকে ভালো লাগে যখন বর বধূ দুজনেই সজোরে বাংলায় বুঝে কথাগুলি বলে। বাংলার বাইরের, বা বিদেশিদের জন্য ইংরেজিও আছে।

ভালো লাগে যখন অন্য ধর্মের ছেলেমেয়েরাও এগিয়ে আসে। মুসলিম ছেলে জাভেদ মহানন্দে সপ্তপদীর আলপনা আঁকে, নিজেই। বাংলায় স্তোত্র বলে। মাতৃভাষায় মন্ত্র বলার মজাই আলাদা। বিশেষ করে যখন বোঝে সেই মন্ত্রের মধ্যে কিভাবে পরিবেশের কথা বলা হচ্ছে, কিভাবে প্রেমের কথা বলা হচ্ছে!

বিয়ের প্রতিটি পদক্ষেপে কতখানি অদ্ভুত সব নিয়ম জড়িয়ে আছে, আর আমাদের বিয়ের ক্ষেত্রে নিয়ম প্রায় কিছু নেই বললেই চলে। অনেক সময় লোকজনের সব গুলিয়ে যায়! একটি মেয়ে ফোন করে জিজ্ঞাসা করল, দিদি যেখানে বিয়ের বাজার করতে যাচ্ছি, দোকানে সবাই অবাক হয়ে যাচ্ছে! বলছে, জোড় লাগবে না, লজ্জা বস্ত্র লাগবে না, এ কেমন বিয়ে! মেয়েটি ভয়ানক কনফিউজড হয়ে আবার ফোন করছে এই বলে যে সত্যি এসব লাগবে না, নাকি আমি বলতে ভুলে গেছি! আসলে বৈদিক বিবাহ পদ্ধতিতে উপকরণ অত্যন্ত কম। মূল প্রয়োজন পরস্পরকে ভালোবাসা দুটি মানুষ।

একইভাবে মা গৌরী ধর্মপাল শ্রাদ্ধ বা স্মরণসভাতে কঠোপনিষদের কিছু নির্দিষ্ট অংশ সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলা করে পাঠ করতেন। সেই পাঠের সঙ্গে আরোও কিছু কথা, মায়ের পছন্দের রবিগান, আর ঋগ্বেদের অসাধারণ একটি সূক্ত, পুনর্জন্ম সূক্ত সহ মায়ের চলে যাওয়ার পর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করলাম। শেষে একটি যজ্ঞ রাখলাম, যেখানে আহুতি দিলেন উপস্থিত সবাই। দেখলাম, সবাই পুরো কাজটির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেলেন। কেউ কেউ এগিয়ে আসতে লাগলেন এইভাবে স্মরণসভা করার জন্য। বাহুল্যহীন আড়ম্বরহীন এমন একটি অনুষ্ঠান, যেখানে সবাই একাত্ম হতে পারেন। আর ভালো লাগে, যে এই ডাক বেশি আসছে মেয়েদের থেকে। বিয়ে আনন্দের উৎসব। সেখানে নিয়ম ভাঙা তত কঠিন নয়, যতটা মৃত্যু পরবর্তী অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে হয়। মানুষ ভয় পায়। এই ভয়টা তৈরি করা হয়েছে, যে অমুক অমুক নিয়ম মেনে কাজ না করলে তোমার প্রিয় মানুষটি শান্তি পাবে না! এই ভয় থেকেই মানুষ তথাকথিত শ্রাদ্ধ করে, যেখানে শ্রদ্ধা ভালোবাসা কিছুই থাকে না। কতগুলো শুষ্ক নীরস নিয়মের ফাঁস ছাড়া।

এই যে পুরোনো আর নতুনকে এক সূত্রে গাঁথা, এই যে বৈদিক স্তোত্র পাঠের মধ্যে পরিবর্তন, এই যে মাতৃভাষায় অনুষ্ঠান; এই ছিল গৌরীর স্বপ্ন। যে সমাজ বলে মেয়েদের বেদ পাঠে অধিকার নেই, যে সমাজ বলে ব্রাহ্মণ না হলে পূজার্চনা করা যাবে না, যে সমাজ বলে মেয়েরা অশুচি, সেই পুরোনোকে বাতিল করো। কিন্তু যেই পুরোনোতে নারী ঋষিরা সূক্ত লিখতেন, গাড়োয়ান রৈক্ক ব্রহ্মর্ষি বলে প্রণম্য ছিলেন, সত্যকাম নিজের মায়ের নামে পরিচিত হতেন-- সেই পুরোনোকে মনে রাখতে হবে। সঙ্গে নতুনের আগমনকে সাদর অভ্যর্থনা জানাতে হবে। গৌরীর সেই ভাবনাকে আমরা চেষ্টা করছি এগিয়ে নিয়ে যেতে। যতখানি বৈষম্য দূর করা যায়, যতখানি অর্থহীন নিয়মকে ছুঁড়ে ফেলা যায়, যতখানি ভ্রান্ত ধারণাকে থেকে সরানো যায়! সামাজিক চাপের ঊর্ধ্বে উঠে আনন্দ হয়ে উঠুক যে কোনো অনুষ্ঠানের আসল ভাবনা।

0 Comments

Post Comment