পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

মিসড কল দিলে বা ফোন করলেই আপনি লক্ষ্যবস্তু হয়ে যাবেন--- তাই সাবধান।

  • 02 February, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 2678 view(s)
  • লিখেছেন : সুমন সেনগুপ্ত
বিজেপির তরফ থেকে যে প্রচার চালানো হচ্ছে, সেই প্রচারপত্রে একটি ফোন নম্বর থাকছে। বলা হচ্ছে ওই নম্বরে ফোন করলে নাগরিকত্বের কার্ড দেওয়া হবে। একবার ভুল করেও যদি ওই নম্বরে কেউ ফোন করে ফেলেন তাহলেই আসল খেলা শুরু হবে। আজকের সময়ে ফোন নম্বর হচ্ছে একটি মারাত্মক মাধ্যম। আর সেটাকেই ওঁরা ব্যবহার করছে।

নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ হয়েছে সংসদে বেশ কিছুদিন হ ল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এনআরসি এবং এনপিআর নিয়ে বিতর্ক। এটা মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে যে সরকার জনগণনার নাম করে যে এনপিআর লাগু করার চেষ্টা করছে তা এনআরসির প্রাথমিক ধাপ। ২০১৫-র ২১ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী হরিভাই চৌধুরী বলেছিলেন, ‘‘এনপিআর’, ‘এনআরসি’-র প্রথম স্তর ও সংগৃহীত তথ্য প্রত্যেক নাগরিকের প্রত্যেক বসবাসীর ব্যক্তিগত তথ্যের ভিত্তিতে।’’ ২০১৮-১৯এ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বার্ষিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় বসবাসীর তালিকা’, ‘ভারতীয় নাগরিকদের জাতীয় রেজিস্টারতৈরির প্রথম ধাপ। ২০১৭-১৮য় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বার্ষিক রিপোর্টে বলা হয়েছে— ‘এনআরসি তৈরি হয়েছে ২০১১-র সেন্সাস তথ্যের ভিত্তিতে২০১৯-এর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নোটিসে বলা হয়েছে, ২০০৩-এর রুল ও সাবরুল মোতাবেক কেন্দ্রীয় সরকার জনসংখ্যা রেজিস্টার তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে দেশজুড়ে এর বিরোধিতাও চালু হয়েছে।

দেশবাসীর মূল আপত্তি তো এনআরসি ও এনপিআর থেকে মুসলমানধর্মীয়দের বাদ রাখার বিরুদ্ধে ও প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তৃতাগুলির নিহিত ও প্রকাশ্য মুসলিম বিরোধিতা নিয়ে। তাঁরা যে তেমন মুসলিম-বিরোধী নন, তা প্রমাণ করার সোজা রাস্তা তো এই সংশোধিত নতুন আইনে মুসলিমশব্দটি জুড়ে দেওয়া। কি প্রধানমন্ত্রী, কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কি অন্যান্য নেতা মন্ত্রীরা কেউই কিন্তু এই কথাটির উত্তর দিচ্ছেন না। তাতে এই বিভ্রান্তি আরও বেড়ে যাচ্ছে যে, তাঁরা ভারতকে মুসলিমহীন এক হিন্দু রাষ্ট্র বানাতে চান। সংসদের ভিতরে যদি তাঁরা সেই হিন্দু রাষ্ট্রের প্রাথমিক ছক তৈরি করতে পারেন ও পাশ করিয়ে নিতে পারেন, তা হলে সংসদের বাইরে এই বিপুল বিশাল বিচিত্র বহুধর্মীয় দেশও তো জানাতে পারে, এই সংশোধিত আইন আমরা মানব না। কেনই বা মানবেন? তাই বিপুল সংখ্যক মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছেন। আর এই সংখ্যাকেই সরকার ভয় পাচ্ছেন। তাই নেমে আসছে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন। এখনও অবধি যা খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে যে প্রায় ২৫ জন মানুষ সারা দেশে মারা গেছেন এবং অসংখ্য মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছেন।

দেশের সর্বোচ্চ আদালতের কাছে যদিও আপিল করা হয়েছে, কিন্তু আদালতের ইদানীংকালের যা রায় দেখা গেছে তা দেখেশুনে মনে হচ্ছে না এই বিষয়েও খুব কিছু আশাব্যাঞ্জক রায় পাওয়া যাবে। তাই এবার সরকারের তরফ থেকে সংখ্যা দেখানোর খেলা শুরু হয়েছে। প্রথমে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভোট দেওয়ার একটা খেলা চালু করা হয়েছিল। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের তরফ থেকে এই নাগরিত্ব সংশোধনী বিলের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট নেওয়া হয়েছে। তার প্রায় সবকটিতেই সরকারের এই নীতি দেখা গেছে হেরে গেছে। তারপরে এসেছে আরও একটি পদ্ধতি। বিজেপির সভাপতি একটি ফোন নম্বর ট্যুইট করে বলেছেন যে এই নম্বরে মিসড কল দিলেই যে কেউ এই সরকারী নীতিকে যে সমর্থন করছেন তা বোঝা যাবে। তারপর থেকেই শুরু হয়েছে বিপত্তি। বিজেপির তরফেও ওই নম্বর প্রচার করা হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সেই একই নম্বর থেকে একাকিত্ব কাটাতে বন্ধুত্ব-যৌনতার আমন্ত্রণ, নিখরচায় বিনোদন অ্যাপের সাবস্ক্রিপশন, এমনকি চাকরির প্রস্তাব দিয়ে বলা হচ্ছে ওই নম্বরে ফোন করতে। টুইটারেই বিরোধীরা অনেকে অভিযোগ তুলেছেন, ভুয়ো পরিচয়ে এই নাগরিকত্ব আইনের পক্ষে বিপুল সমর্থন জোগাড় করতেই এমন কৌশল নিয়েছে বিজেপির আইটি সেল। অর্থাৎ সম্পূর্ণ অন্য কারণে ওই নম্বরে কেউ মিসড কল দিলে তা এই আইনের পক্ষেই যাবে। হু হু করে বাড়বে সমর্থকের সংখ্যা। ভবিষ্যতে এই সংখ্যাকে সর্বোচ্চ আদালতের সামনে পেশ করা যাবে এই বলে যে এই দেখুন এই বিপুল সংখ্যক মানুষ এই আইনকে সমর্থন করছেন। বিরোধীদের দাবি, যে কোনও উপায়ে জনসমর্থন টানতেই বিজেপি এই রাস্তা নিয়েছে। তাঁদের দাবি, সম্প্রতি #IndiaSupportsCAAএই হ্যাশট্যাগে কার্যত গণভোটের ঢংয়ে টুইটারে সমর্থন চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রধানমন্ত্রীর আর্জি রিটুইট করে আসরে নেমেছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। কিন্তু বিরুদ্ধ স্বর হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ায় পাল্টা আসে#IndiaDoesNotSupportCAA-সহ বেশ কয়েকটি হ্যাশট্যাগ। অনেক সময়ই তা ছাপিয়ে গিয়েছে সরকারি প্রচারকে। প্রকাশ্যে গণভোটেহেরেই মরিয়া বিজেপি এই কৌশল নিয়েছে বলে বিরোধীদের দাবি। বিজেপি অস্বীকার করেছে যদিও কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার সময়ে যেমন হাজার হাজার বিদ্যাসাগর কলেজের প্রাক্তনির আবির্ভাব হয়েছিল, এখনও ঠিক তেমনটাই দেখা গেছে। মানুষের কাছে সত্যি মিথ্যে গুলিয়ে দেওয়াটাই যেন লক্ষ্য। এমনিতেই সমাজের খুব কম মানুষই ফেসবুক বা ট্যুইটার ব্যবহার করেন, কিন্তু হোয়টাসআপ ব্যবহার করেন প্রচুর মানুষ। আর এটা তো সর্বজনবিদিত যে বিজেপি সারা দেশে নামে বেনামে গ্রুপ চালায়। সেই গ্রুপে যদি এই নম্বর একবার দিয়ে দেওয়া যায় তাহলে তো এই আইনের সমর্থনকারীর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে। আর তারপর যদি দেশের সব সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় দেশের প্রধানমন্ত্রীর মুখের ছবি দিয়ে একটা পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন দেওয়া যায় যে দেশের এত কোটি, এত লক্ষ, এত হাজার মানুষ এই আইনকে সমর্থন করছেন তখন যারা এর বিরোধিতা করছেন তাঁদেরও মনে হতে পারে, সত্যিই তো কোথাও কি তবে ভুল হচ্ছে? দেশের রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা মানুষকে বিভ্রান্ত করার এই খেলায় নেমেছেন। একবার একজন বলছেন যে দেশব্যাপী নাগরিকপঞ্জী হবে বা এনআরসি হবে আবার অন্যজন বলছেন এমন কোনও চিন্তাভাবনা নেই। একদিকে বলছেন ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ সব কা বিশ্বাস” আবার অন্যদিকে বলছেন একটি ধর্মের মানুষজনদের জন্য এই আইন নয়। একবার বলছেন দেশের মুসলমানদের জন্য এই আইন নয়, তাহলে তো এটাকে নাগরিকত্ব আইন না বলে শরণার্থী আইন বলতে পারতেন। তাহলে কি সচেতন ভাবে এই বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে? কিন্তু কেন?

আরও একটি বিষয় ইদানীংকালে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গ্রামে গঞ্জে বিশেষ করে এটা চলছে। বিজেপির তরফ থেকে যে প্রচার চালানো হচ্ছে, সেই প্রচারপত্রে একটি ফোন নম্বর থাকছে। বলা হচ্ছে ওই নম্বরে ফোন করলে নাগরিকত্বের কার্ড দেওয়া হবে। একবার ভুল করেও যদি ওই নম্বরে কেউ ফোন করে ফেলেন তাহলেই আসল খেলা শুরু হবে। আজকের সময়ে ফোন নম্বর হচ্ছে একটি মারাত্মক মাধ্যম। কোনও মানুষের কাছে যদি তাঁর অঞ্চলের ১০০টি নম্বর থাকে, তাহলেই তিনি একটি হোয়াটাসয়্যাপ গ্রুপ তৈরি করে ফেলবেন এবং তারপর সেই নম্বরে বেছে বেছে যদি মেসেজ পাঠানো যায়, তাহলে কোনও মানুষকে প্রভাবিত করা কি কঠিন হবে?


bjp propaganda

এর বিপরীতে আরও একটা মারাত্মক বিষয় শুরু হয়েছে। অনেকে বলা শুরু করেছেন অন্য একটা নম্বর সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করা হোক যেখানে মিসড কল দিলে বোঝা যাবে যে কতজন মানুষ এর বিরুদ্ধে আছেন। কিন্তু অনেকেই এটা ভুলে গেছেন বা যাচ্ছেন যে এটাও একটা ফাঁদ। যদি খেয়াল করা যায় যে সময়টাতে সারা দেশ জুড়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠেছিল, যে সময়টাতে আন্না হাজারে গান্ধী সেজে অনশনে বসেছিলেন তখনও কিন্তু একটা নম্বর বাজারে ছাড়া হয়েছিল যাতে মিসড কল দিতে বলা হয়েছিল যা দেখে বোঝা যায় যে কারা কারা কংগ্রেসের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আছেন। ওটাও ছিল ডেটা বা তথ্য নেওয়ার জন্য, আজও এই বিপরীত বা উল্টো দিকের নম্বরে কারা মিসড কল দিচ্ছেন সেটা বোঝা কি খুব কষ্ট কঠিন হবে?

যেখানে দেখাই যাচ্ছে যে সব ধর্মের সব বয়সের সব জাতির মানুষ রাস্তায় নেমে এর বিরোধিতা করছেন, যেখানে সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা টিভি চ্যানেলের বিতর্কে দেখা যাচ্ছে যে শাসকদল ব্যাকফুটে বা পশ্চাদপসারণ করছে, যখন দরকার মানুষের সঙ্গে আরও বেশী বেশী করে কথা বলার, মানুষের দরজায় পৌঁছে যাওয়ার সেখানে এই ধরনের একটি উদ্যোগ কি সরকারের হাতকেই শক্তিশালী করবে না? যখন মানুষের মনে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে সেই আতঙ্ককে একটা সংগঠিত চেহারা দেওয়ার সময়, যখন সোশ্যাল মিডিয়ার থেকে বেরিয়ে মানুষের কথা শোনা এবং বোঝা জরুরী নয় কি?

0 Comments

Post Comment