এই মুহূর্তে আমরা একটা পচে ধ্বসে যাওয়া মৃত সমাজের পরজীবীর মতো। পচে যাওয়া দেহে খাবার খাচ্ছি, মরে যাচ্ছি, আবার সেই পচা দেহতে নতুন পরজীবী জন্মাচ্ছে। এমন একটা মৃতদেহের সমাজ, যেখানে অতিমারীর আশংকা সমেত খিদে পেটে শ্রমিক ও শ্রমিকের পরিবার বাড়ি ফিরতে চেয়ে কয়েকশো মাইল হেঁটে যায়, যেখানে মৃত সন্তানকে কোলে নিয়ে মা কাঁদতে কাঁদতে পথে দৌড়ায়, যেখানে পাঁচ সন্তানকে খেতে দিতে না পারায় মা তাঁদের গঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়। আমরা তখন আরেক শ্রেণীর পরজীবী পচা দেহে খাদ্য সঞ্চয় করে হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটিতে নিমগ্ন। আমাদের বড় অংশেরই আর কোন প্রতিক্রিয়া নেই, এই পচা দেহ পচা সিস্টেমের বিরুদ্ধে। কিন্তু এই প্রতিক্রিয়াহীন নির্লিপ্ত পরজীবী সমাজের খাদক অংশ একদিনে তৈরি হয়নি। দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে ওঠা এই অনুভবহীন মৃত সমাজটাকে নিয়ে কথা বলতে হবে। এ কিভাবে মারা গেছে এই অনুসন্ধানটুকু জারি রাখতে হবে। অবশ্যই এই সময়ে সব থেকে জরুরী মানুষের খিদে নিয়ে কথা বলা। কিন্তু অসংখ্য মানুষ যে ঘোরের মধ্যে থেকে খিদের কথা, অধিকারের কথা , একসাথে বাঁচার কথা বলতে ভুলে গেল সেই নেশার দ্রব্যটি নিয়েও কথা হোক।
প্রথম পর্ব
এই মুহূর্তে দেশে গোদি মিডিয়া ও বিদ্বেষী সরকারের যৌথ উদ্যোগে ইসলামোফোবিয়াকে প্রত্যন্ত সাধারণ মানুষের মনের মধ্যে রোপণ করা সম্ভব হয়েছে। আর মানুষের সহজ প্রবৃত্তি যে তারা একটি দৃশ্যমান শত্রু খোঁজে যাবতীয় বঞ্চনা রাগ হিংসা মেটানোর জন্য। তাই গোদি মিডিয়া ও বিদ্বেষী সরকারের যৌথ উদ্যোগে এই অদৃশ্য করোনা ভাইরাসের অতিমারীর সময়েও ইসলামোফোবিয়াকে প্রচার, প্রসার ও রোপণের কাজটা দারুণভাবে সম্পাদন করে ফেলল। এমন সময়ে আমি অন্য কিছু নিয়ে লিখতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম কোনও এক বিপ্লবী ডাক্তারের হিন্দুত্ববাদের প্রচারক হয়ে ওঠার কথা, বা তথাকথিত ভদ্রলোকদের একটা বড় অংশ নিজামুদ্দিন নিজামুদ্দিন করে যারা সমাজ-মাধ্যম কাঁপিয়ে ঘৃণ্য মুসলমানদের শায়েস্তা করার দাবি জানাচ্ছেন তাঁদের নিয়ে লিখব। কিন্তু এসব কিছুই লিখলাম না। দুটো পর্বে লেখার কথা মাথায় এলো। প্রথম পর্বের লেখাটা যা অর্ধেক লিখে বৃহস্পতিবার দিন রেখে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আর লিখবো না। কিন্তু বাড়ির উঠোন থেকে লেখাটা শুরু হওয়া উচিত বলে মনে হল। তাই প্রথম পর্বের লেখাটা চোখের সামনে আত্ম-ধর্ম কিভাবে বাজার-ধর্ম ও রাজনৈতিক-ধর্ম হয়ে উঠলো সেটুকু দেখা বোঝাকে কেন্দ্র করে শুরু করলাম।
বেশ কয়েক বছর ধরে নিয়ম করে শবেবরাত নিয়ে লিখি। ওইটুকুই আপাতত পারি হয়তো। আমার অনেক বন্ধু ইদের দাওয়াত চাইত আগে; ইদের বিরিয়ানি গোস্তের দাওয়াত। তখন যেটা হতো, উগ্রভাবে বন্ধুদেরকে আঘাত করে ফেলতাম। সহজেই মাথা গরম হয়; তাই প্রতিবারই খুব অসংলগ্ন হয়ে জবাবে জানাতাম, মুসলমান মানেই গরুর গোস্ত আর বিরিয়ানি সেটা তোমাকে কে বলেছে? আমার মা কোনোদিন বিরিয়ানি বানায়নি , তিনি বিরিয়ানি বানাতে জানেন না। আর কিছু বিশেষ কারণে আমাদের বাড়িতে গরুর মাংস আসে না। আমার স্কুল কলেজের কোন অমুসলমান বন্ধু কোনদিনও শবেবরাতের দাওয়াত চায়নি; কেন চায়নি কে জানে। সব সময় মনে হতো আমার পড়শিরা, আমার বন্ধুরা আমাদের উৎসব নিয়ে উদাসীন। তবুও কত সময় ইচ্ছে করত, প্রিয় বন্ধুকে বলি, ঈদের থেকেও আমার প্রিয় শবেবরাতের ওই নরম আলোর রাত। তাঁদের বলা হয়নি ‘শাবান’ মাসের ১৪-১৫ তারিখ একটা একটা মায়া জোছনা রাতে আমার গ্রামটা কেমন করে বদলে যায়। মোমবাতি মাটির প্রদীপে আমাদের চালা ঘরের দাওয়াগুলো, আমাদের উঠোনের সামনে নরম হলদে আলোতে মাখামাখি করা, রজনীগন্ধা, রোজ, আর চন্দনের ধূপের গন্ধে ভারী হাওয়া আমাদের পাড়ার এগলি ওগলি ছুটে বেড়াত; সেই সন্ধ্যেগুলো ঠিক কেমন ছিল; আমার প্রিয় বন্ধুকে কোনদিন বোঝাতে পারিনি।
আজকাল এই কয়েক বছরে নিজেকেই বোঝাতে পারি না; মনে হয় যেন অন্য একটা সময় আর জীবনকে ফেলে এসেছি; যেখানে আমার নিজেরই এই শবেবরাতকে স্মৃতি খুঁড়ে দেখতে হয়; অনুভবে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। সেই সময়গুলোকে, যে সময়ে আমাদের কাঁচা বাড়ি ঘরগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে উঠোনে গোবর লেপে ন্যাতা দেওয়ার ধুম পড়ত মা, চাচিদের। আর দুপুর থেকে জড়োকে মিলে মুরগী ছাড়িয়ে তারা চুলো লেপে, বসে যেতেন চালের রুটি, সিমুই আর মুরগীর পাতলা ঝোল বানাতে। আমাদের ব্যস্ততার শেষ ছিল না, কবরের জংলা জঙ্গল সব কাটা হল কিনা তার তদারকি। মসজিদ ঝাঁট দিয়ে সকলে মিলে আমাদের রঙচটা হলদে শ্যাওলা পড়া একতলা মসজিদের দালানে, পাঁচিলে মোমবাতি সাজিয়ে আসতাম। বিকেলের মধ্যে আমরা লেগে যেতাম যে যার উঠোন মাটির দাওয়াতে প্রদীপ বা মোমবাতি দিয়ে সাজাতে। সাঁঝ নামতেই জোছনা রাতে হলদে আলোতে মুড়ে যেত আমাদের পুরো গ্রামটা। আমরা তার আগেই অবশ্য যেতাম আমাদের আপনজনের কবরে। বাড়ির বড়রা আমাদের নিয়ে যেত সেখানে আমাদের আপনজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে তাঁদের স্মৃতিকথা বলত। যাঁরা মাটির তলায় আছেন তাঁদের কবরে ধূপ জ্বালাতাম কবরের কিছু প্রদীপ দিয়ে, বছরভর ধরে জমা নানা কথা, কত গল্প করে ফিরতাম নিজের নিজের বাড়ি।
দ্বিতীয় পর্ব
খুব শৈশবে আমরা বয়স্কদের কাছে শুনেছিলাম এই শাবান মাসের এই সময়ে আসমানের সাত মনজিল খুলে যাওয়ার কথা; সারাটা রাত গ্রামে ধূপের ভারী সুবাসের মধ্যে নাকি ভেসে বেড়াত ফেরেশতা আর রূহ । এ ছাড়াও বুড়ো বুড়িরা আমাদেরকে বলতেন এই দিনে তো তোমার আগামী বছরের বরাতের(ভাগ্য)-খাতা লেখা হয়; তাই ইবাদত করা উচিত রাত জেগে। আমাদের এসবের থেকেও হাজার গুণ বেশী মন থাকতো এই রোমাঞ্চকর হলদে আলোর রাতে সাত মনজিল খুলে যাওয়ার দরুণ রূহদের বাতাসে অনুভব করা কল্পনা। কতবার মৃত দাদি যাকে কোনোদিনও চোখে দেখিনি, যার কবরের সাথে আলাপ; ওই রাতে মনে হতো দাদি আব্বাকে দেখতে আসে, আমাদের দেখতে আসে। মরে যাওয়া আপনজনেরা তাই বেশি দূরে নয় যেন; প্রতিবছর তারা কবরে , বাতাসে ফিরে আসে; দেখে যায় তাঁদের গ্রাম, কাছের মানুষদের।
আমাদের যে পুরনো মুরুব্বী মৌলানারা ছিলেন তারা পালা করে এই দিনে কিছু কিছু বাড়িতে মিলাদ পড়তে যেতেন। সেই মিলাদের কোরাসের শব্দ আল্লা-হুমা-সাইয়ে-দেনা মৌলানা মোহম্মদ …… সব মিলিয়ে একটা ছমছমে আনন্দ ও স্মৃতি-মুখর আলো রাত। এই রাতটা আমার বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কী করে বদলে গেল। আর এই বদলে যাওয়াটার রাজনীতিকে যদি ধরতে না পারি তাহলে খুব ভুল হয়ে যাবে।
এখন আমাদের শবেবরাতে মাইকের উচ্চ স্বরে এই দেশের ও বাংলাদেশের ওয়াজের লেকচার ভেসে আসে। যেগুলো পাঁচ মিনিট শুনলে গা ঘিনঘিন করবে, অসুস্থ লাগবে। এবং ইসলামের নামে কিছু ধর্ম ব্যবসায়ী এই ওয়াজ মেহেফিলের ক্যাসেট বের করে বিক্রি করেন। নিজেদের ধর্মগুরু ধর্মবোদ্ধা এই উপাধি দিয়ে তারা তাঁদের উগ্র ওয়াজ গুলোর মধ্যে দিয়ে এক নতুন ইসলামের ধারণা মানুষের যাপনের মধ্যে প্রবেশ করাতে সফল হলেন।
বছর দশ আগে দেখতাম একদল করে নতুন নতুন লোক, ফেজ টুপি, জোব্বা সাদা পাঞ্জাবি পরে মসজিদে আসতে থাকলেন; তারা নিজেদের খুব বড় মাপের ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবী বলে পরিচয় দিতেন। ঝকঝকে এই লোকগুলোর নানা দল অসংখ্যবার আমাদের মসজিদে এসে তিন দিন সাত দিন নয় দিন এমন সময় ধরে এসে ধর্ম প্রচার, মানুষকে নামাজমুখী করার কথা বারবার বলে যেতেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মসজিদে নামাজ পড়তে আসার দাওয়াত দিয়ে আসতেন এদের অনেকে। এরাই মূলত আমাদের গ্রামের ধর্মভীরু মোড়ল, মুরুব্বী, মৌলানাদেরকে সহি মুসলমানের পাঠ দিতে শুরু করলেন। এদেরকে গ্রামের লোকে জামাত বলতো। দিল্লী বোম্বে কলকাতা কত জায়গা থেকে সব সুদর্শন পুরুষেরা এসে গ্রামের মসজিদগুলোতে সহি মুসলমানের ধারণা বুনতে শুরু করলেন। সেই সহি মুসলমান হওয়ার তাগিদে মানুষ নামাজমুখী হতে শুরু করলেন বেশি বেশি।
আমাদের হলদে রঙচটা শ্যাওলা ধরা চুনসুরকির মেঝের একতলা মসজিদ বদলে গেল, দোতালা সাদা পাথরের মেঝের মসজিদে। গ্রামের মানুষ বাইরে খেটে যে উপায় করে মসজিদ নির্মাণে দেয়, বেহেস্তের জমি কেনার জন্য(জামাতের কিছু ওয়াজে এমনটা বলা হতো)। এতেই হল না গ্রামের মানুষ প্রচুর চাঁদা তুলে লক্ষ টাকার উপর খরচা করে জলসা ডাকতে শুরু করল। সেখানেও শেখানো হয় পুরনো ইসলামের চর্চা অনেক ভুল, সহি মুসলমান হতে হবে…। এর পর হাজার হাজার লোকেরা আঞ্চলিক মারকাসের সঙ্গে যুক্তও হন, এস্তেমা করেন, শোয়াব অর্জনের জন্য কাজ কাম ফেলে জামতের অংশ হন। চেল্লা করে সহি ইসলাম, আর হাদিসের প্রচারে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘোরেন।
আমাদের গ্রামের এই জামাত চেল্লার বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জলসার প্রভাব বাড়ছিল; গ্রামের পুরনো মিলাদ দেওয়ার রীতি কমে গেল ক্রমশ। আর ধর্ম মানে ক্রমশ তার উদ্ধত প্রকাশ, সম্প্রচার, আর সহি-ইসলাম মানে উপর মহলে থেকে আসা এক নয়া অনুকরণ রীতি। এই নয়া প্রচারের মধ্যেই ছিল শবেবরাত নিয়ে মৌলানাদের নতুন ফরমান। এতদিন আমরা যে শবেবরাত পালন করেছি তা সহি ইসলাম নয়। কবরে ধূপ প্রদীপ এসব জ্বালানো গুনাহ কাজ। ওই দিন আমাদের কবরে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হল। পুরনো আমলের মানুষগুলো দ্বিধায় পড়ে গেলেন। এতদিন তারা যে পাপ করেছেন, সেই পাপের কাজ যাতে লঘু হয় সে জায়গা থেকে অনেকে সহি ইসলামের প্রতি নির্বিরোধ আনুগত্য দেখিয়ে জামাতের সব ফরমান মেনে নিলেন। জামাত থেকে মোমবাতি ধূপ এসব শেরেক অ-ইসলামী কাজ বলে বন্ধ করা হল ঠিকই কিন্তু গত দশ বছরে শবেবরাতে বাজির পটকার দাপট ক্রমে বাড়তে শুরু করল। এই বাজি-পটকার বাজার ফুলে ফেঁপে উঠলো, ক্রমে আমাদের শবেবরাত হয়ে উঠলো বাজির উৎসব। আমাদের মৌলানারা চেষ্টা করেও এই বাজি উৎসবকে অ-ইসলামিক আখ্যা দিয়ে বন্ধ করতে পারলো না। এই কয়েক বছরে আমাদের শবেবরাতের হাওয়া ভারী হয়ে উঠলো বারুদের গন্ধে। শৈশবের শবেবরাতের অলীক সাত মনজিল যদিও খোলে, তবু আপনজনের রূহ আমাদের কাছে আসতে পারবে না হয়তো। কারণ আমরা এক নতুন মনজিল আসমানে তৈরি করে দিচ্ছি এই কয়েক বছর ধরে গাঢ় বারুদের ধোঁয়া দিয়ে বানানো সেই মনজিল।
আর কয়েক বছর কবরে কেউ ধূপ, প্রদীপ জ্বালিয়ে আসে না আর। নতুন শৈশবের সঙ্গে মাটির তলার আপনজনদের যোগাযোগ আর নেই। আজিজুল হকের আগুন-পাখীতে সেই মানুষটার মাটি দেশ ছেড়ে না যাওয়ার বড় কারণগুলোর মধ্যে একটা ছিল দীঘির পারে সন্তানের, প্রিয়জনের কবর। এই মাটিতে আপনজন আছে, এই মাটির সঙ্গে যে গভীর সম্পর্ক সেটা ক্রমে কমতে শুরু করল, কী এক অদৃশ্য দূরত্ব। কবর জিয়ারত করা যাবে না ফরমান দিয়ে আপন মানুষের কবর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়াটা যে আসলে ষড়যন্ত্র ছিল আগে বুঝিনি। এটা বাজারের ষড়যন্ত্র, যা ধর্মের মোড়কে আমাদের ফরমান দিয়েছিল। এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে মাটি জমি ক্রমশ যেন অনুভূতিহীন শুধুমাত্র সম্পদ আর অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। কবর থেকে বিচ্ছিন্নতা আসলে কিছুটা হলেও মানসিকভাবে মাটি, নিজের মাটি থেকেও বিচ্ছিন্নতা। এই বিচ্ছিন্নতার কারণে অনেক ধরণের বাজার সুবিধা অর্জন করতে পারে। পুরনো সমস্ত বিশ্বাসকে ধ্বসিয়ে দেওয়ার মধ্যে আরও নানা পরিকল্পনা মাফিক বাজার রাজনীতি কাজ করে। আর এদের দালাল হয়ে কাজ করে কখনো সহি ইসলামের প্রচারক, কখনো সহি-হিন্দুর প্রচারকেরা।
নাস্তিকতার নাম নিয়ে আমি কোনভাবেই কোন ধর্মীয়ে বিশ্বাসের বিরুদ্ধে নই। প্রশ্ন সমেত আমি শিখেছি সব ধর্মকে সম্মান দিতে। তাই আমার কাছে আমাদের পুরনো হলদে শ্যাওলা ধরা সুরকির মেঝের, ঘন গাছের ছায়াঘেরা মসজিদ, আজান এসব যেমন আমার যাপনের অংশ, তেমনই আমার গ্রামে যে বিবির দরগা ছিল, যেটাকে বিলুপ্ত করা হয়েছে সেটাও আমার যাপনে অংশ থাকা উচিত ছিল বলে মনে করি। তেমন ভাবেই আমাদের এলাকাতে শাক্ত বিশ্বাস বৈষ্ণব বিশ্বাসের দুই প্রবহমান ধারা আমার যাপনের অংশ হওয়াটাও স্বাভাবিক। এগুলো অস্বীকার করলে আমার মাটি, মানুষ, তাঁদের বোঝাপড়াগুলোকে অপমান করা হবে। কিন্তু প্রশ্ন করা জরুরী সেই বিবর্তনকে যা এই কয়েক বছরে আমাদের যাপনগুলোকেই উল্টেপাল্টে দিয়েছে। আমাদের কথা বলতেই হবে । আমাদের ইসলামের বিশ্বাসের থেকে সহি-ইসলাম বলে যারা ইসলামকে মাটি থেকেই বিচ্যুত করে দিচ্ছে তাঁদের ষড়যন্ত্রের কথা। আমাদের লিখে যেতেই হবে হিন্দু আর হিন্দুত্ববাদ এক নয়। একটি মানুষের বিশ্বাসের সহজ যাপন, অন্যটি রাজনৈতিক ধান্দাবাজদের ধর্ম নিয়ে বজ্জাতি।
এই লেখাটা যখন লিখছি, দেখলাম আমার দেখাটা আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে মৌসুমি দির লেখাটা পড়ে। মৌসুমি দি যেভাবে পড়শি দেশের প্রেক্ষাপটে অনুভব করেছেন তা এখানেও সমান সত্য। মৌসুমি দির লেখা কোট করছি
“এ বিষয়ে আমার শুধু অস্পষ্ট কিছু ধারণাই আছে, অন্যেরা আমার চেয়ে অনেক ভাল বলতে পারবেন। আমি শুধু বলতে চাইছিলাম, আমার মনে হয়, এখানে যেমন মাইনরিটির প্রেক্ষিত থেকে আলোচনার সূত্রপাত হলও, তেমনি যেখানে মুসলমানের সংখ্যাই হয়তো বেশি, সেখানেও এই দরগা বনাম মারকাজের দ্বন্দ্ব বোধহয় রয়েছে। এসব খুবই জটিল বিষয়, কিন্তু গত দশ বছরে বাংলাদেশে কেন বাউল ফকিররা ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে চলেছেন? তাহলে কি এই শাসন ব্যবস্থার আসলে টিঁকে থাকার জন্য মারকাজের মতন, বিশ্ব ইস্তেমার মতন জমায়েতের প্রয়োজন হয়? ধর্মীয় আর রাজনৈতিক মতাদর্শের সম্পর্কের কথা বলছি। ....I am thinking of the connection between the power of market capitalism and the power of these institutions. কোনো সরাসরি সম্পর্ক আছে কি? নিজামুদ্দীন মারকাজ নিজামুদ্দিন দরগাকে ঢেকে দিলে বাজার অর্থনীতি আর এই সমাজব্যবস্থার কোনো স্বার্থসিদ্ধি হয় কি? ওগুলো না হয় বড় বড় জায়গা, কিন্তু ছোট ছোট মাজার, পীরের দরগা গ্রামের মসজিদ দিয়ে replace করা, এমনকি দরগার নিজস্ব চেহারাটাই ভিতর থেকে পাল্টে যাওয়া--এসবের ব্যাখ্যা কীভাবে করবো? এর সঙ্গে টাকা আর ক্ষমতার কোনো সরাসরি সম্পর্ক আছে কি?
একেবারে দৃষ্টান্ত দিয়েই বলছি, সেই ২০০৪-এ প্রথম ইব্রাহিম বয়াতিকে ফরিদপুরে রেকর্ড করছিলাম আমরা। ইব্রাহিম ভাইকে প্রথম দেখেছিলাম ১৯৯৮-এ, তারেক মাসুদের মুক্তির কথার শুটিং-এর সময়। ফরিদপুরে খোকা পীর বলে এক পীরের মুরিদ ছিলেন ইব্রাহিমভাই, আগে গান গেয়ে ওষুধ বেচতেন, গলা শুনে অন্ধ ইব্রাহিমকে খোকা পীর তুলে এনেছিলেন। ২০০২-এ ওঁর সঙ্গে মাটির ময়নার সময় কাজ করেছি আমি। (মাটির ময়নায় একটা গান ছিল, পাল্লা গানের আসরে গাওয়া হয়েছিল, 'যদি বেহেস্তে যেতে চাও গো অন্তরে রাইখো আল্লার ডর,/যদি আল্লাহর সন্ধান চাও গো প্রেম রাখিও অন্তরের ভিতর')। তারপর নিজের ফিল্ড রেকর্ডিং-এর কাজ শুরুর পর ২০০৪-এর ডিসেম্বর মাসে ইব্রাহিম ভাইয়ের কাছে যাই।
এক কনকনে শীতের রাতে তারেকের ভাই সাঈদ আর আমি একটা অটোতে করে মেম্বার গোট্টি বলে একটা গ্রামে যাচ্ছিলাম, কারণ সেখানে ইব্রাহিম বয়াতি খোকা পীরের হয়ে মিলাদ মেহফিল পরিচালনা করছিলেন কারও একজনের বাড়িতে। সাঈদ মেম্বার গোট্টি জায়গাটা কোথায় জানতো না ভাল মতন। অটো চালক আমাদের নিয়ে যাচ্ছিলেন পথ খুঁজে খুঁজে। সেদিন খুব জ্যোৎস্না ছিল। চার পাশে কেউ ছিল না, আমাদের অটো ধান ক্ষেত চিরে চিরে এগিয়ে চলেছিল। অটোর শব্দ ছাড়া তেমন কোনো শব্দও ছিল না। তারপর দূর থেকে মিলাদের শব্দ ভেসে এলো। সেই শব্দকে অনুসরণ করে করে গিয়ে আমরা ইব্রাহিমভাই-এর কাছে পৌঁছলাম। আধা অন্ধকারে ভাল করে কিছু দেখা যায় না। ইব্রাহিম ভাইয়ের ভাঙা, চেরা, ইউনিক কন্ঠস্বরে বলে চলেছেন, 'মনে করেন আপনারা নৌকায় যাচ্ছেন, আপনারা তখন কীভাবে নাও চালাবেন? নৌকা বাইচ মনে করেন। এত মৃদুভাবে বললে হবে? বলেন আললাহ, আললাহ আললাহ আললাহ...' সবাই দুলে দুলে বলছিল, 'আললাহ, আললাহ আললাহ আললাহ...' তারপর সেখান থেকে আরো কথা, গান, কথা... সকলে মিলে দরিয়া পার হবার রাত ছিল সেটা।
২০০৬-এ ইব্রাহিম ভাই আমাদের জন্য গেয়েছিলেন, 'কোন দিন খুলিবে রে নৌকা মাঝি, তাই আমারে কইয়ো, পিছনে পড়ে যাই যদি মাঝি, আমায় ডেকে নিও।' বিজয় সরকারের গান। তারপর অনেক দিন দেখা হয়নি। ২০১৩তে ইব্রাহিম ভাই কে দেখলাম যখন, সেই ফরিদপুরের খোকা পীরের মাজারেই, ইব্রাহিমভাই যেন কিছুটা পাল্টে গেছেন। মাজারের অভ্যন্তরও হয়তো বা পাল্টে গেছিল। আমাদের দেখে ইব্রাহিমভাই স্পষ্টতই অপ্রস্তুত হয়েছেন। সহজে কথা বলতে পারছেন না। আমরা প্রায় conspiracy 'r মতন করে ওঁর সঙ্গে পর দিন রেকর্ডিং-এর সময় আর জায়গা ঠিক করলাম। যে মানুষটার খোলা গলা আমাদের তাঁর কাছে পৌঁছে দিয়েছিল দশ বছর আগে, তিনি দশ বছর পর গান গাইবার আগে বললেন, জানালাটা বন্ধ করে দিন। এই সব ডিটেল আমাদের ট্র্যাভেলিং আর্কাইভের ওয়েবসাইটে লেখা আছে। আমি ভাবি, আঠারো শতক থেকেই এই বিভাজন থাকলেও, নানা মত থাকলেও, আজ কি ইব্রাহিমভাইয়ের ভয়ের কোনো বিশেষ রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে? এর পর কি ইব্রাহিম ভাই ওয়াজ পড়বেন পুঁথি পাঠের সুরে? একেবারেই আনাড়ির মতন লিখলাম, এইসব কমপ্লেক্স বিষয়ে কিছু বলা খুব কঠিন। তবু এই নির্বাসনের দুপুরে কেউ কোত্থাও নেই, তাই সাহস করে লিখে ফেললাম।"
পরিশেষে এটুকুই, আমাদের অনেকেই এখন বলছেন এই অতিমারির সময়ে ধর্ম নিয়ে কথা বলবো কেন? কিন্তু এই কথা না বলতে বলতে আমাদের বিশ্বাসের জায়গাগুলো যখন বাজার আর রাষ্ট্র যে যার স্বার্থে ব্যবহার করছে; কিছু পুরনো বিশ্বাস ধ্বংস করছে কিছু নতুন বিশ্বাস রোপণ করছে, নিজেরদের খুশি মতো। তখন আমাদের কথা বলা প্রয়োজন। অনেক বিতর্ক গভীরভাবে তুলে আনা, গভীরে গিয়ে বিশ্লেষণ করা। এই সময়টা পেরলে পৃথিবী আর আগের মতো থাকবে না আমরা জানি। হয়তো আমরাও কতদিন আছি জানি না। কেবল এই মুহূর্তে কিছু সনদ লিখে যাবো যা দেখেছি, যেটুকু বুঝছি সেগুলো ধরে। যদি বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়, তার আগে লিখে যাবো কিছু কিছু করে। এই উঠোন পেরিয়ে গ্রাম পেরিয়ে একটা বড় সমাজ আর দেশ আছে, দেশের মানুষেরা এখন কী ভাবে ভাবছে? পড়শি দেশের মতোই কি তার আত্ম-ধর্ম কখন যে বাজার আর রাষ্ট্র গ্রাস করে নিজেদের মতো করে বিবর্তিত করে দিয়েছে, দিলে কোন কোন পথে তারা সফল হল সেসব কথা বলে যেতে হবে আমাদের।