পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ওয়াকফ আইন সংশোধনের বিরোধিতার সাত-পাঁচ

  • 22 November, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 501 view(s)
  • লিখেছেন : মনসুর মণ্ডল
ওয়াকফের উদ্দেশ্যে দান ধর্মীয় গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, অর্থাৎ যে কোন ব্যক্তি, তিনি মুসলিম হতে পারেন অথবা অন্য কোন ধর্মাবলম্বী হতে পারেন, ওয়াকফের উদ্দেশে দান করতে পারেন, যা বর্তমান আইনে স্বীকৃত। কিন্তু সংশোধনী বিলে ধারা 3(r) যুক্ত করে এমন বাধ্যবাধকতা নিয়ে আসা হয়েছে, যেখানে অমুসলিম কেউ ওয়াকফ তৈরি করতে পারবেন না, এমনকি আদ্যন্ত ধার্মিক মুসলিম না হলে তিনিও ওয়াকফ তৈরি করতে পারবেন না।

“এক হাতে কুরআন আর এক হাতে কম্পিউটার” – মোদি সরকার-2.0 জমানায় প্রধানমন্ত্রীর বাগাড়ম্বরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তখনকার কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু মন্ত্রকের মন্ত্রী মুক্তার আব্বাস নাকভি ওয়াকফ সম্পত্তিগুলো ডিজিটাইজড করার কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, দেশের যাবতীয় ওয়াকফ সম্পত্তির সঠিক হিসাব রাখা প্রয়োজন। কারণ সরকারের নাকি ইচ্ছে হয়েছিল -- ঐসব সম্পত্তিতে স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, মুসলিমদের জন্য কমিউনিটি সেন্টার, মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য ছাত্রাবাস, এসব বানানো হবে। ফ্রী কোচিং সেন্টার বানিয়ে মুসলিম ছেলেমেয়েদের ইউপিএসসি, ব্যাঙ্ক ও সরকারি চাকরির কোচিং করানোর ইচ্ছেও জেগেছিল নাকি। এজন্য ‘প্রধানমন্ত্রী জন বিকাশ কার্যক্রম’ (PMJVK) থেকে অর্থ বরাদ্দ করা হবে, বলা হয়েছিল। এখন মোদি সরকার-3.0 বলছে, ওয়াকফ আইনের বদল চাই। কেন আইন বদল? আগের ঘোষণা অনুযায়ী কাজ করতে গিয়ে আইনের দিক থেকে বাধা পেয়েছে সরকার? না, তা নয়। কোন্ মুখে বাধার কথা বলবে? কাজটাই তো সেভাবে শুরু করা হয়নি। ফলে এখন ধুয়ো – ওয়াকফ আইনে আরও স্বচ্ছতা আনতে, কার্যধারায় গতি আনতে এবং আইনের  ফাঁকফোঁকরে অনিয়ম করার সুযোগ বানচাল করতে সংশোধন চাওয়া হচ্ছে।

সাচার কমিটির রিপোর্টের এক ভালো অংশ জুড়ে আছে ওয়াকফের পরিচালনা ও উপযোগিতা সংক্রান্ত প্রস্তাবনা। উদ্দেশ্য ছিল যাতে দেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের কল্যাণ ও প্রগতিতে ওয়াকফ সংস্থানের সর্বাধিক ব্যবহার করা যায়। রিপোর্টে স্পষ্ট হয়েছিল, ওয়াকফ সম্পত্তির কাঙ্ক্ষিত সদ্ব্যবহার করা যাচ্ছিল না তার পরিচালনা ব্যবস্থার ত্রুটি ও উপযোগিতা সম্পর্কিত অস্বচ্ছতার কারণে। আইন সংশোধনের কথা সাচার রিপোর্টে বলা হয়নি। প্রস্তাবনার রূপায়ণে যদি আইন সংশোধন প্রয়োজন হয় অথবা আইন সংশোধন প্রয়োজন কিনা, সে’ সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব সাচার কমিটির ছিল না, সেটি প্রকৃতপক্ষে লোকসভা/বিধানসভা তথা দেশের আইনসভার এক্তিয়ারভুক্ত বিষয়। কে. রেহমান খানের নেতৃত্বাধীন কমিটির সুপারিশক্রমে ২০১৩ সালে  ‘ওয়াকফ আইন ১৯৯৫’-এর কিছু সংশোধন করেছিল দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার। সে সম্পর্কে সবিস্তারে না গিয়ে এইটুকু বলা যায়, তাতে সাচার কমিটির প্রস্তাবনার কিছু প্রতিফলন ছিল। মোটের ওপর বলা যায়, যতদূর সম্ভব ওয়াকফ কার্যবিধির ভালোর দিকেই ছিল সংশোধনের উদ্দেশ্য। ২০২২ সালেও কিছু সংশোধন হয়েছে। তাতে সাচার কমিটির প্রস্তাবনার কোন ছাপ না থাকলেও সেরকম বদ মতলব কিছু দেখা যায়নি, যেমনটা আছে কেন্দ্র সরকার প্রস্তাবিত ওয়াকফ আইনের সংশোধনী বিল ২০২৪ এ (‘ইন্টিগ্রেটেড ওয়াকফ ম্যানেজমেন্ট, এমপাওয়ারমেন্ট, এফিসিয়েন্সি অ্যাণ্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাক্ট-এ')।

‘ওয়াকফ’ হল স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির বিশাল ব্যবস্থা (Establishment)। এককথায়, কোন ব্যক্তির দ্বারা ইসলামীয় আইন অনুসারে ইসলাম ধর্মের ধার্মিক ও ধর্মীয় কাজে, মুসলমান সম্প্রদায়ের সামাজিক কল্যাণ ও দাতব্য উদ্দেশ্যে দান করা স্থাবর অথবা অস্থাবর সম্পত্তি ও তার ব্যবস্থাপনকে ‘ওয়াকফ’ বলা হয়। ওয়াকফ সম্পত্তি মুসলমান সম্প্রদায়ের নিরঙ্কুশ স্বার্থবিশিষ্ট নিজস্ব সম্পদ। ঠিক সেই কারণেই ওয়াকফ সংবিধান স্বীকৃত একটি স্বশাসিত ব্যবস্থা – আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, কিন্তু সরকার অধীনস্থ নয়। স্বাভাবিকভাবে এ সংক্রান্ত আইন, তার সংশোধন, পরিচালনায় স্বায়ত্ততার দিকটিতে বিশেষ যত্ন নিতে হয়। এদিক থেকে বলতে হয়, ১৯৯৫ সালের আগে ওয়াকফ আইনে গোড়ায় গলদ ছিল; ‘ওয়াকফ আইন, ১৯৯৫’ এনে তা শুধরে নেওয়া হয় – ওয়াকফকে পূর্ণ স্বায়ত্ত শাসন দেওয়া হয়। এখন যখন ওয়াকফ আইন সংশোধনে কেন্দ্র সরকার হাত লাগিয়েছে এবং যখন মুসলমান সম্প্রদায় থেকে সর্বতোভাবে ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো থেকে সেই নিয়ে বিরোধ শুরু হয়েছে, তখন তার কেন্দ্রে আছে এই স্বায়ত্ততার প্রশ্নটিই। ওয়াকফ পরিচালনা নিয়ে অভিযোগ-অনুযোগ কমবেশি শোনা গেছে, দুর্নীতি নিয়েও কাউকে কাউকে কথা বলতে দেখা গেছে, কিন্তু এতদিন রাজনৈতিক বা সামাজিক কোন দিক থেকে তার স্বায়ত্ততা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে দেখা যায়নি। এই প্রথম এটা হল; হল এমন এক মন্ত্রীসভার মন্ত্রণায়, যেখানে মুসলিম প্রতিনিধিত্ব শূন্য। ফলে ভাবনার বিষয় যে, সমস্যাটা সহজ নয়।

ওয়াকফ পরিচালনার জন্য প্রতিটি রাজ্যে ওয়াকফ বোর্ড আছে। ওয়াকফ বোর্ডে একজন মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক নিযুক্ত থাকেন এবং প্রয়োজনে এক বা একাধিক সহকারী নির্বাহী আধিকারিক নিযুক্ত থাকেন। আইনী বিধানে বোর্ড ও নির্বাহী আধিকারিকের মধ্যে নির্বাহী ক্ষমতা বন্টন করা আছে। কিন্তু কেন্দ্র সরকারের প্রস্তাবিত ওয়াকফ সংশোধনী বিলে ধারা 3(d)(a)-তে বলা হয়েছে -- বোর্ডের উপর ন্যস্ত ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট কালেক্টর (অন্যনামে জেলা শাসক) প্রয়োগ করবেন। ওয়াকফ এস্টেটের স্বায়ত্ততা খোয়ানোর আরও ফন্দি আঁটা হয়েছে সংশোধনীতে। ওয়াকফ সম্পত্তির নিবন্ধন ওয়াকফ বোর্ড দ্বারা প্রদত্ত প্রবিধান দ্বারা নির্ধারিত। সংশোধনীর ধারা 36-এ ওয়াকফ সম্পত্তির নিবন্ধনে বোর্ডের ক্ষমতা অনেকাংশে খর্ব করে কালেক্টরের হাতে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ধারা 3(c)-তে বলা হয়েছে, ওয়াকফ বোর্ড সরকারের অধীনে থাকা কোন সম্পত্তি ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত বা ঘোষণা করলেও কালেক্টর দ্বারা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তা ওয়াকফ হিসেবে গণ্য হবে না। এভাবে বোর্ডের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া তো হলই, উপরন্তু বহু ওয়াকফ সম্পত্তি সরকারের কুক্ষিগত হয়ে আছে বলে যে অভিযোগ আছে, যা অনেক ক্ষেত্রেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না, সেসব অভিযোগের ন্যায়সঙ্গত নিষ্পত্তি অথবা সেসব উদ্ধার করার সুযোগ বা সম্ভাবনা একপ্রকার রদ করে দেওয়া হল। এরকম সরকারি জবরদখল নিয়ে সরকারের তরফে আপত্তি থাকতে পারে; তার নিষ্পত্তির জন্য ওয়াকফ ট্রাইব্যুনাল আছে, সেখানে যাওয়াও নিষ্ফল করে দেওয়া হল।

বর্তমান আইনে রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডে একজন মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক (সিইও) নিযুক্ত হন, যিনি রাজ্য সরকারের উপসচিব পদমর্যাদাসম্পন্ন অথবা সমতুল্য পদমর্যাদার মুসলিম কর্মকর্তা। বিলে সিইও-র মুসলিম হওয়ার আবশ্যকতা রাখা হয়নি। বিপরীতে অন্যান্য ধর্মীয় তথা দাতব্য প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত আইনে সিইও ও সমতুল্য প্রশাসকদের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হওয়া বাধ্যতামূলক। যথা ‘অন্ধ্রপ্রদেশ চ্যারিটেবল অ্যাণ্ড হিন্দু রিলিজিয়াস ইন্সটিটিউশনস অ্যাণ্ড এনডাউমেন্টস অ্যাক্ট, ১৯৮৭’-তে বিধান আছে – নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবশ্যই হিন্দু হতে হবে, ‘কর্ণাটক হিন্দু রিলিজিয়াস ইন্সটিটিউশনস অ্যাণ্ড চ্যারিটেবল এনডাউমেন্টস অ্যাক্ট, ১৯৯৭’-এ বিধান আছে – কমিশনার ও নির্বাহী কর্মকর্তা, যাঁরা সরকারী কর্মচারী, তাঁদের অবশ্যই হিন্দু হতে হবে।

বিলের ধারা 9-এ কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলের গঠনে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসা হয়েছে। বর্তমান নিয়ম – ২২ জন কাউন্সিল সদস্যের মধ্যে একমাত্র চেয়ারপার্সন (যিনি কেন্দ্রীয় ওয়াকফ মন্ত্রকের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী) ছাড়া আর সমস্ত কাউন্সিল সদস্যকেই বাধ্যতামূলকভাবে মুসলিম হতে হবে। সংশোধনীতে বলা হয়েছে --বাধ্যতামূলকভাবে দুজন অমুসলিম সদস্য রাখতে হবে, উপরন্তু ১২ জন সদস্যের যোগ্যতার জন্য ‘মুসলিম হতে হবে’ এমন নির্দেশ রাখা হয়নি, অর্থাৎ এক্ষেত্রে অমুসলিম রাখতে বাধা নেই। রাজ্য ওয়াকফ বোর্ড সম্পর্কে নতুন বিধান বাতলানো হয়েছে বিলের ধারা 14-তে। এখানেও অবস্থা তথৈবচ। বর্তমান আইনে বিধান আছে -- ১২ জন বোর্ডের সদস্যের মধ্যে ৮ জন নির্বাচিত হবেন ও ৪ জন মনোনীত হবেন এবং সকলকেই মুসলিম হতে হবে। সংশোধনীতে বলা হয়েছে, বোর্ডের সদস্য সংখ্যা হবে ১১। সকল সদস্যই মনোনীত হবেন এবং বাধ্যতামূলকভাবে দুজন অমুসলিম সদস্য থাকবেন। এখানেও ৭ জন সদস্যের বেলায় ‘মুসলিম হতে হবে’ বলা হয়নি। যেখানে বর্তমান আইনে আছে, কাউন্সিলে ও বোর্ডে কমপক্ষে দুজন করে মহিলা সদস্য রাখতে হবে, সে’ জায়গায় বিলে বলা হয়েছে,  কাউন্সিলে (ধারা 9)  ও বোর্ডে (ধারা 14) দুজন করে মহিলা সদস্য রাখতে হবে। অর্থাৎ বর্তমান আইনে দুজনের অধিক মহিলা সদস্য থাকার সুযোগকে (কমপক্ষে দুজন) দুই সংখ্যায় বেঁধে দেওয়া হয়েছে সংশোধনীতে। এ এক  অদ্ভুত ব্যাপার যে, মুসলিমদের নিজস্ব ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয় ব্যবস্থাপন ও পরিচালনার জন্য সম্প্রদায়গত স্বকীয়তাকে অস্বীকার করা হচ্ছে। ওয়াকফ মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের অংশ। ওয়াকফ পরিচালনাকারী সংস্থাগুলোতে অমুসলিমদের প্রবেশাধিকার সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন, যেখানে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নিজস্ব বিষয়গুলো পরিচালনা করার মৌলিক অধিকার প্রদান করে। অন্যদিকে, ওয়াকফের মতো ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সেগুলোর স্বকীয়তা বজায় আছে। যথা, ‘কর্ণাটক হিন্দু রিলিজিয়াস ইন্সটিটিউশনস অ্যাণ্ড চ্যারিটেবল এনডাউমেন্টস অ্যাক্ট, ১৯৯৭’-এ রাজ্য ধর্মিকা পরিষদের (বোর্ডের) গঠন সম্পর্কে বলা হয়েছে, সকল সদস্যকেই হিন্দু হতে হবে। ‘শিখ গুরুদ্বার আইন, ১৯২৫’-এর বিধান – বোর্ডের সকল সদস্যকে শিখ হতে হবে।

ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য প্রত্যেক রাজ্যে ওয়াকফ ট্রাইব্যুনাল আছে। তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল একজন প্রথম শ্রেণির বিচারক, একজন অতিরিক্ত ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বা সমতুল্য সরকারি আধিকারিক ও একজন মুসলিম আইন বিশেষজ্ঞ নিয়ে গঠিত। বিলে ধারা 6-এ ট্রাইব্যুনালকে দুই সদস্যবিশিষ্ট করা হয়েছে, যেখানে মুসলিম আইন বিশেষজ্ঞের পদ লোপ করা হয়েছে। বর্তমান আইনে সাধারণভাবে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হয়। কেবলমাত্র বোর্ড বা প্রতিপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়ের গুরুত্ব বিবেচনায় উচ্চ আদালত আপীল গ্রহণ করতে পারে। সংশোধনীতে বলা হয়েছে, সব ক্ষেত্রেই ট্রাইব্যুনালের রায়ের উপর উচ্চ আদালতে আপীল গ্রাহ্য হবে।  

ওয়াকফের উদ্দেশ্যে দান ধর্মীয় গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, অর্থাৎ যে কোন ব্যক্তি, তিনি মুসলিম হতে পারেন অথবা অন্য কোন ধর্মাবলম্বী হতে পারেন, ওয়াকফের উদ্দেশে দান করতে পারেন, যা বর্তমান আইনে স্বীকৃত। কিন্তু সংশোধনী বিলে ধারা 3(r) যুক্ত করে এমন বাধ্যবাধকতা নিয়ে আসা হয়েছে, যেখানে অমুসলিম কেউ ওয়াকফ তৈরি করতে পারবেন না, এমনকি আদ্যন্ত ধার্মিক মুসলিম না হলে তিনিও ওয়াকফ তৈরি করতে পারবেন না। বলা হয়েছে, ওয়াকফে সম্পত্তি দান করতে হলে ওয়াকিফের (যিনি ওয়াকফে সম্পত্তি দান করেন) পাঁচ বছর ইসলাম পালনের দৃষ্টান্ত থাকতে হবে। মানেটা তো এই দাঁড়ায় যে, ওয়াকিফ কেবল নামে মুসলিম হলেই হবে না, তাঁকে  অন্তত পাঁচ বছর যাবৎ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজী, রোজাদার, সুন্নাহ্ পালনকারী হতে হবে ( টুপি ব্যবহারকারী, দাড়ি আছে, এরকম আরকি)। এইসব আগডুম বাগডুম করে আসলে ওয়াকফের সংকীর্ণতামুক্ত উৎসমূলে বিষজল ঢেলে দেওয়ার ছক কষা হয়েছে। যদি অমুসলিম দ্বারা ওয়াকফ তৈরির সামাজিক প্রভাবের দিক বিবেচনা করি, তা হলে দেখতে পাব, এই দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হেতু প্রান্তিক অবস্থানে থাকা একটি জনগোষ্ঠীর হিতার্থে ধর্মীয় ভেদবুদ্ধির গণ্ডি ছাড়িয়ে  অবদান রাখার সুযোগ, সে’ হল সম্প্রদায়গত সহাবস্থানের খোলা হাওয়া এবং  এক বৃহত্তর মানবিক সমাজের দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রেরণা। মুসলিমদের দিক থেকে ওয়াকফ তৈরির সুযোগ যেমন আছে, তা নিঃসন্দেহে ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে মুক্ত। এসব কিছুকে হেলায় তুচ্ছ করে দেওয়ার মনোবৃত্তি ধর্মীয় অবদমন ও বিভাজনের কসরৎ। এর পাশাপাশি যদি রাখি সংশোধনীর ধারা 36, তা হলে বিভেদকামী দৃষ্টিভঙ্গি কতটা কপট, তা স্পষ্ট হয়ে যায়। এই ধারায় বিধান দেওয়া হয়েছে – দলিল ব্যতীত কোন ওয়াকফ সৃষ্টি করা যাবে না। এর ফলে ওয়াকফের একটি ধরন ‘ব্যবহারকারীর দ্বারা ওয়াকফ’ (Waqf by Users) বাতিলের খাতায় চলে যাবে। সংশোধনীর ধারা 36 দান সংক্রান্ত ইসলামীয় আইনকে (মুসলিম পার্সোনাল ল’) প্রশ্নের মুখে টেনে এনেছে। ইসলামীয় আইনে মৌখিক দান (দলিল সম্পাদন ব্যতিরেকে) বৈধ; শর্ত একটিই – প্রাপককে দান গ্রহণ করতে হবে। সেই সুবাদে ওয়াকফে ‘ব্যবহারকারীর দ্বারা ওয়াকফ’ প্রবিধান এসেছে। যেসব মসজিদ, মাদ্রাসা, মক্তব, মাজার, পীরস্থান, কবরস্থানের সম্পত্তি দলিল ব্যতিরেকে সুদীর্ঘকাল ভোগদখলের ইতিহাস আছে , দখলীস্বত্বের সুবাদে সেসবে ‘ব্যবহারকারীর দ্বারা ওয়াকফ’ প্রবিধানে ওয়াকফ স্বত্বাধিকার বর্তেছে।

3(r) ও 36 – সংশোধনীর এই দুই ধারার সামাজিক প্রতিক্রিয়া বড় রকমের সামাজিক বিশৃঙ্খলার ইঙ্গিত বহন করে। দেশে এমন বহু মসজিদ, মাদ্রাসা, মক্তব ইত্যাদি ইসলামীয় প্রতিষ্ঠান অথবা ব্যবস্থাপনা রয়েছে, যেগুলোর অনুকূলে সম্পাদিত দলিল নেই, সুদীর্ঘকাল ব্যবহারের সুবাদে ওয়াকফ হিসেবে স্বীকৃত ও নথিভুক্ত। এই সংশোধনী দুটির ইন্ধনে এসব নিয়ে বিরোধের নতুন নতুন ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হবে এবং পুরনো বিরোধে বাতাস দেওয়া হবে, যা বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদ নিয়ে, মথুরার শাহি মসজিদ নিয়ে বিরোধের মতো অতিমাত্রায় সংবেদনশীল অবস্থা পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। বিজেপি সহ সংঘ পরিবার তো বাবরি মসজিদ নিয়ে বিরোধের সময় থেকেই আওয়াজ তুলে আসছে, ‘অযোধ্যা সির্ফ ঝাঁকি হ্যায়, মথুরা-কাশী বাকি হ্যায়’। এরকম আইন হ‌লে এই আওয়াজ তখন গগন-বিদারী হবে। এমন সম্পত্তির সংখ্যা নেহাত কম নয়, যেখানে হিন্দু মালিকানাধীন জায়গায় দরগা, মাজার, কবরস্থান ইত্যাদি ইসলামীয় কাঠামো অথবা ব্যবস্থাপনা রয়েছে, যেগুলোর অনুকূলে কোন-না-কোন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আইনসম্মত দখলদারিত্ব থাকলেও ওয়াকফ হিসেবে ঘোষিত বা নথিভুক্ত নয়। অনেক ক্ষেত্রেই সেসবের মালিক জীবিত নেই। (আবার এমন দৃষ্টান্ত অনেক মিলবে, যেখানে মুসলিম মালিকানাধীন জায়গায় হিন্দু মন্দির, শ্মশান ইত্যাদি রয়েছে।) উত্তরাধিকার সারিতে জীবিত মালিকের বা মালিকদের মধ্যে সে’ নিয়ে অসন্তোষ থাকতে পারে কিংবা অসন্তোষ উস্কে দেওয়া হতে পারে। সেক্ষেত্রে সামাজিক অশান্তি সৃষ্টি হবে।

ওয়াকফের একটি ধরন ‌হল ‘ওয়াকফ-আলাল-আওলাদ’ – যা ওয়াকিফের এক বা একাধিক উত্তরাধিকারীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। সংশোধনীর ধারা 3A-তে বলা হয়েছে, এরকম ওয়াকফ তৈরিতে নারীসহ উত্তরাধিকারীদের উত্তরাধিকারের অধিকার অস্বীকার করা যাবে না। দান একটি স্বেচ্ছাধীন ব্যাপার, সেই জায়গায় এরকম ওয়াকফের জন্য আইন নির্দেশ দিতে পারে না – তুমি ওই ওই উত্তরাধিকারীদের সম্পত্তি উৎসর্গ করো। এরকম ওয়াকফ তৈরির উদ্দেশ্য হল ওয়াকফের বিধান অনুযায়ী সম্পত্তির আয় থেকে ধর্মীয় ও সামাজিক কল্যাণে ব্যয় করা এবং একইসঙ্গে এই কর্মকাণ্ডে যুক্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণের ভরণপোষণ বন্দোবস্ত করা। সেক্ষেত্রে ধার্মিকতা, মানসিকতা, পরিচালনার দক্ষতা সম্পর্কে ওয়াকিফের বিবেচনা খুবই প্রাসঙ্গিক বিষয়। বিষয়টিকে আর এক দিক থেকে দেখা যায় – সাধারণভাবে কোন ব্যক্তি তার সম্পত্তির একাংশ তার পছন্দের ব্যক্তির নাম বরাবর, সে তার সন্তান, স্ত্রী/স্বামী কিংবা অন্য কেউ হতে পারে, দানপত্র/হেবানামা সম্পাদন করতে চাইলে এমন কোন আইন নেই, যা দিয়ে স্বাভাবিক উত্তরাধিকারের প্রসঙ্গ তুলে সেটিকে আটকে দেওয়া যাবে। তা হলে এক্ষেত্রে উত্তরাধিকারীদের উত্তরাধিকারের অধিকারের ধুয়ো তোলার মানে কী? আসলে এরকম বাধ্যবাধকতার কথা বলে ওয়াকফ-আলাল-আওলাদ-এর উদ্দেশ্যকেই জটিল ও খণ্ডিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। উপরন্তু এই ধারার প্রস্তাবনায় ওয়াকফ-আলাল-আওলাদ নিয়ে  ধর্মীয় নৈতিকতার দ্বন্দ্ব সৃষ্টির অবকাশ থেকে যাচ্ছে। আবার শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো নারীর অধিকারের মতো সংবেদনশীল কথা বলে মহত্ব দেখানো হয়েছে। মজার ব্যাপার হল, এখানে নারীর অধিকারের প্রসঙ্গ টেনে আনা যে কতখানি চালাকি, তা বোঝা যাবে কাউন্সিল ও বোর্ডে নারী সদস্যের অন্তর্ভুক্তি প্রসঙ্গ খেয়াল করলে। ওয়াকফ-আলাল-আওলাদ সম্পর্কে আরও একটা গোলমেলে ধারা প্রস্তাব করা হয়েছে, ধারা 3(r)(i-v)-তে বলা হয়েছে – উত্তরাধিকার ব্যর্থ হলে (অর্থাৎ ওয়াকফের উপভোক্তার অবর্তমানে কোন উত্তরাধিকারী না পাওয়া গেলে ) ওয়াকফ থেকে আয় এতিম (অনাথ শিশু), সম্বলহীন বিধবা ও তালাকপ্রাপ্ত মহিলাদের কল্যাণে ব্যয় করতে হবে। ক্ষেত্রবিশেষে উত্তরাধিকার ব্যর্থ হতেই পারে। এক্ষেত্রে কী করণীয়, সে সম্পর্কে বর্তমান আইনে কিছু বলা নেই। তাতে অসুবিধার কিছু নেই। ওয়াকফ-আলাল-আওলাদ-এর অধীনস্থ সম্পত্তি থেকে অর্জিত আয়ের একাংশ (অর্ধেকের কম) ধর্মীয় ও দাতব্য কাজে ব্যয়ের বিধান আছে। সেক্ষেত্রে উত্তরাধিকারের অনুপস্থিতিতে এই দিকের বরাদ্দ ধর্মীয় ও দাতব্য কাজে ব্যবহার করা যাবে -- এটি স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার। প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য, ইসলামীয় ফারায়েজ আইনে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত নিয়ম বিস্তৃত সম্ভাব্যতাকে নির্দেশ করে। যথা, একজন পুরুষ বা মহিলা নিঃসন্তান হলে বা বিবাহ না করলে তার ত্যক্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকার রক্ত সম্পর্কের নিকট আত্মীয় থেকে দূরবর্তী আত্মীয় পর্যন্ত বর্তায় -- যতদূর সম্পর্ক-সূত্র নিরূপণ করা সম্ভব ততদূর; একটি সূত্র অনুপস্থিত হলে পরবর্তী সূত্রে এগোনো -- এরকম পর্যায়ক্রমিক। এখন ঘটা করে উত্তরাধিকার ব্যর্থতার বিষয় টেনে আনা হচ্ছে, তাতে ইসলামীয় ফারায়েজের (উত্তরাধিকার) নিয়ম নিয়ে জটিলতা পাকানোর গোপন সুযোগ রাখা হচ্ছে বলে আশঙ্কা হয়।

ওয়াকফ আইনে চল্লিশটি সংশোধনী নিয়ে সংশোধনী বিল তুমুল বিতর্কের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। সংশোধনী প্রস্তাবগুলোর মধ্যে কোথাও কোন ইতবাচক দিক থাকলেও উপরে আলোচিত ধারাগুলোর সামনে তা অর্থহীন হয়ে পড়ে। এই সংশোধনী সংখ্যালঘু অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে অনেক প্রশ্ন, উদ্বেগ ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। তার ন্যায়সঙ্গত সমাধান না হলে শুধু মুসলমান সম্প্রদায়ের ক্ষতি হবে না, দেশের সংবিধানে কালো দাগ পড়বে।   

0 Comments

Post Comment