পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

অমর্ত্য সেনকে কেন এই হেনস্থা?

  • 27 April, 2023
  • 1 Comment(s)
  • 1351 view(s)
  • লিখেছেন : মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯৯৯ সালে বাজপেয়ী জমানায় যে মানুষটিকে ভারতে শ্রেষ্ঠতম খেতাব ভারতরত্নে ভূষিত করা হয়েছিল এখন তাঁকে সেই বাজপেয়ীর দলেরই কিছু লোক চোর প্রমাণ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। যেহেতু এই রাজনৈতিক দলটি গোয়েবলসীয় কায়দায় বারবার মিথ্যা বলে তাকে সত্যে পরিণত করতে চায় এখন এদের সমস্ত প্রচার যন্ত্র এই কথাটাই বলবার চেষ্টা করছে।

হাউই কহিল, মোর কী সাহস, ভাই,

তারকার মুখে আমি দিয়ে আসি ছাই!

কবি কহে, তার গায়ে লাগে নাকো কিছু,

সে ছাই ফিরিয়া আসে তোরি পিছু পিছু।

 

শ্রী অমর্ত্য সেন নোবেল ওয়েবসাইটে তাঁর নিজের সম্পর্কে লিখেছেন যে আমার জন্ম হয়েছিল একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এবং সারা জীবনই আমি একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়িয়েছি।
এই মুহূর্তে যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এই মহান ব্যক্তিত্বের জন্ম সেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে চূড়ান্ত হেনস্থা করে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করার হুমকি দিয়ে চলেছে। বিষয়টা সারা দুনিয়ার কাছে আমাদের মাথা হেঁট করছে কিন্তু কর্তৃপক্ষ অনড়। কয়েক ছটাক জমির জন্য তাঁরা যে আচরণটি করছেন সেটি অত্যন্ত অশোভন এবং নিম্ন রুচির পরিচায়ক কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা এটি যে দূরভিসন্ধিমূলক তার প্রমাণ পদে পদে পাওয়া যাচ্ছে।

 ১৯৯৯ সালে বাজপেয়ী জমানায় যে মানুষটিকে ভারতে শ্রেষ্ঠতম খেতাব ভারতরত্নে ভূষিত করা হয়েছিল এখন তাঁকে সেই বাজপেয়ীর দলেরই কিছু লোক চোর প্রমাণ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। যেহেতু এই রাজনৈতিক দলটি গোয়েবলসীয় কায়দায় বারবার মিথ্যা বলে তাকে সত্যে পরিণত করতে চায় এখন এদের সমস্ত প্রচার যন্ত্র এই কথাটাই বলবার চেষ্টা করছে। একটি নেহাতি আভ্যন্তরীণ বিষয় যা সম্মানের সাথে আলাপ আলোচনায় মিটিয়ে ফেলা যেত সেটিকে এই আকার দেওয়ার পিছনে যে ভাবনা কাজ করছে তা একটি বিশেষ মতাদর্শকে পুষ্ট করে। সেন পরিবারের দখলে ১৩ ডেসিবেল জায়গা আছে কি নেই সেই বিতর্কের সাথে তিনি আদৌ নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন কিনা এ ধরনের প্রসঙ্গ উত্থাপন অন্য একটি অভিসন্ধির দিকে নির্দেশ করে।
অমর্ত্য সেন প্রসঙ্গে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আন্নান বলেছিলেন, 'বিশ্বে গরীব ও নিঃস্ব মানুষদের হয়ে কথা বলার জন্য অর্থনীতিবিদদের মধ্যে অমর্ত্য সেনের চেয়ে জোরালো ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।" ভারতীয় উপমহাদেশে জনকল্যাণ অর্থনীতির ভাবনাকে সার্থক করার ক্ষেত্রে অমর্ত্য সেন জীবনভর অনন্য ভূমিকা পালন করে চলেছেন।‌ স্পষ্টতই যারা কল্যাণের চেয়ে মুনাফাকেই প্রাধান্য দিতে চান, তারা অবশ্যই রাষ্ট্র উন্নয়ন বলতে বোঝেন পুঁজিপতির উন্নয়ণ, সেখানে মানব উন্নয়ন সূচকের প্রবক্তা অবশ্যই তাদের বিপ্রতীপে অবস্থান করেন। প্রাথমিক শিক্ষা ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য নিয়ে যে মৌলিক কাজ প্রতীচি ট্রাস্ট করে চলেছে যার ফলশ্রুতিতে মিড ডে মিলের মত প্রকল্প, মেয়েদের পুষ্টির মত বিষয় বারবার শিরোনামে উঠে আসে, যা মৌলিক অধিকারের সাথে গণতন্ত্র কে মজবুত করে অবশ্যই বর্তমান শাসক তা নিয়ে ভাবতে চান না।  

 


অন্যদিকে যে বিশ্ববিদ্যালয় ভূমিতে এই বরেণ্য মানুষটির জন্ম তার স্রষ্টা যে বহু সংস্কৃতি ও বহুমতের উপস্থিতিকে উদযাপন করতেন সেই ভাবনা বর্তমান কর্তৃপক্ষ এবং তার পিছনের মূল শক্তির কাছে বিপজ্জনক।  রবীন্দ্রনাথ আজীবন এমনকি প্রখরতম জাতীয়তাবাদী যুগেও পরাধীন ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে এক জাতীয়তার বিপদ কি বারে বারে তুলে ধরেছিলেন। ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যা বহুমাত্রিক, তার অন্বেষণ ও প্রতিষ্ঠা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম কাজ হতে পেরেছিল এবং  অমর্ত্য সেনের মাতামহ ক্ষিতিমোহন সেন এই কাজে সুযোগ্য ব্রতী হয়েছিলেন। এদের অনবরত অন্বেষণের ফলেই বাংলায় সেই সংস্কৃতি আলোচিত হতে পেরেছে যা একই সাথে লোকায়ত এবং বহুত্ববাদী। এদেশের বর্তমান শাসক দল প্রসঙ্গে অমর্ত্য সেন বারবার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন যে এই শাসন বিপজ্জনক,  গণতন্ত্র বিরোধী এবং যে হিন্দুত্বকে তারা প্রতিষ্ঠা করতে চান তা সবদিক থেকে অনৈতিক।  স্বাভাবিকভাবে এদেশে যারা হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন তাদের পক্ষে অধ্যাপক সেন কে হজম করা সহজ নয়। অমর্ত্য সেন মনে করিয়ে দেন "যে সাংস্কৃতিক রক্ষণশীলতা এবং বিচ্ছিন্নতাবোধ মাঝে মাঝেই ভারতকে কবজা করতে চেয়েছে তার সঙ্গে শান্তিনিকেতনের এই সংস্কৃতি বৈচিত্রের উৎসবের পার্থক্য অতিশয় প্রকট।" বহুমাত্রিক সংস্কৃতির উদযাপনের পৌষ মেলা যেভাবে বন্ধ করা হল, যেভাবে ভিন্ন মতকে চুড়ান্ত দমনের সামনে এখানে পড়তে হয়, ছাত্র, অধ্যাপক, প্রাক্তনী আশ্রমিক সবাই যেখানে হেনস্থার শিকার তার বিপ্রতীপে অমর্ত্য সেন যা কিছু রবীন্দ্র দর্শন তার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছেন।

 

তাই বৃহৎ জনসমাজে তাকে  হেয় করার জন্য কুৎসা ও অপপ্রচার প্রয়োজন। মুশকিল এই যে প্রচার সর্বস্ব বাঙালি সমাজের একাংশ  ইদানিং সংবাদ ও সমাজ মাধ্যমের প্রভাবে এমন সব কুৎসাকে সত্য বলে ধরে নিচ্ছে যেখানে সমস্ত যুক্তি বুদ্ধি লোপ পায়।  অর্থাৎ যেখানে ভাবা হয়েছিল যে অমর্ত্যের  অপমানে আপামর  শিক্ষিত বাঙালি প্রতিবাদের ঝড় তুলবে সেখানে অনেকেই দেখা যাচ্ছে খানিকটা গা বাঁচানোর জন্য 'হলেও হতে পারে' গোছের ভাবনা নিয়ে এরকমটাও বলে ফেলছেন যে ওইটুকু জমি দিয়ে দিলেই তো হয।  প্রশ্নটা যে জমি ফেরানোর নয় সেটুকু ধারণ করার ক্ষমতা অনেকেরই নেই।

আজ  প্রতীচি শুধুমাত্র অমর্ত্য সেনের বাড়ি বলে পরিচিত নয়, এটি বিশ্বভারতীর ঐতিহ্যবাহী একটি স্মারক। আজ যারা দূরদূরান্ত থেকে শান্তিনিকেতনে আসেন রবীন্দ্রভবন দেখার পর তারাই দুদন্ড দাঁড়িয়ে যান প্রতীচির সামনে, শুধু এক মহৎ প্রজ্ঞাকে শ্রদ্ধা জানাতে। অমর্ত্য সেনের আত্মজীবনীর ছত্রে ছত্রে লিপিবদ্ধ আছে সেই শান্তিনিকেতন যা বিবিধতাকে  ধারণ করার ঐতিহ্যকে  লালন করেছে।  যে বহুত্বের  ধারক রবীন্দ্রনাথ, অমর্ত্য সেনের নিজের লেখা ও কাজে তাকেই রূপ দিয়েছেন । তিনি একই সাথে এই মাটি থেকেই জাত এবং তিনিই এই ভাবনার প্রয়োগ করে আজ বিশ্ববরেণ্য। প্রতীচি আজ কেবল একটি আবাসস্থল নয় , যে অসহিষ্ণুতা আজ গোটা দেশকে গ্রাস করতে চায়, প্রতীচি তার বিরোধীতার অন্যতম উৎস। যে মানুষটি ভারতীয়ের বিশেষণে তর্কপ্রিয় শব্দটি যুক্ত করে মতভিন্নতা ও বিতর্কের বিপুল বিস্তৃত পরিসরকে তুলে ধরেন, তাঁকে অসম্মান করতে গিয়ে আজ বিশ্বভারতীর কতৃপক্ষ তার নিজের ঐতিহ্যের বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছে। যে দেশ বা জাতি তার শ্রেষ্ঠ সন্তানের সাথে এমন আচরণ করে তার পরিণাম ভয়াবহ । এখন নিরপেক্ষতা নয়, সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর সময়।

 

 

1 Comments

Saptarshi Biswas

08 May, 2023

Ki sanghatik! Poushmela kobe bandho kora holo? Kothao khnuje pelam na to khabor ta!

Post Comment