সম্প্রতি উদয়নিধি স্ট্যালিনের একটি মন্তব্য ঘিরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ভাবাবেগ আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে। উদয়নিধি স্ট্যালিন হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন কুসংস্কার আচার বিচারের সঙ্গে সনাতন ধর্মকেও উপড়ে ফেলার নিদান দিয়েছেন। স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় হিন্দু ধর্মের স্বঘোষিত রক্ষকরা আক্রমণ শানাচ্ছেন। উদয়নিধির সঙ্গে সম মত পোষণকারী মানুষেরাও চুপ করে নেই। এইসব প্রশ্ন ও প্রতি প্রশ্নের মূল বিষয়টা হচ্ছে হিন্দু ধর্ম এবং সনাতন ধর্ম কি সমার্থক? কিন্তু এই প্রবন্ধে আমি তৈলাধার কি পাত্র অথবা পাত্রাোধার কি তৈল এই কূট তর্কে যাব না। মোটামুটি ভাবে এইসব তর্ক-বিতর্কের মূল যেটা নির্যাস সেটা হলো সনাতন ধর্ম বলতে মোটের উপর বোঝায় জাত পাত ব্যবস্থা সম্বলিত হিন্দু ধর্মের যে পরিচিত কাঠামো। হিন্দু ধর্মের আরো কিছু রূপভেদ আছে। যেগুলি সনাতন ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেনা। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে সনাতন ধর্মের প্রতিনিধিরা এরকম সমালোচনা কি প্রথম শুনলেন? যেহেতু বাংলা ভাষাতেই লিখছি তাই বাংলা ভাষার একজন সাহিত্যিকের লেখা কিছুটা উদ্ধৃত করার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। শিবরাম চক্রবর্তী তার মস্কো বনাম পন্ডিচেরি গ্রন্থে বলছেন, "সনাতন আমাদের ব্রাহ্মণেরা, ব্রহ্মচিন্তার সঙ্গে অর্থ চিন্তার কি অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন! একাধারে যেমন উপনিষদ, গীতা অন্য ধারে তেমনি মনুসংহিতা। একদিকে যেমন বড় বড় তত্ত্ব, অপরদিকে তেমনি ব্যক্তি নির্বিশেষে অন্নপ্রাশন থেকে শুরু করে বেচারার শ্রাদ্ধ পর্যন্ত নিত্যনৈমিত্তিক ট্যাক্স আদায়। এমনকি বহুকাল আগে খতম হয়ে গেলেও তার পুত্র পৌত্রাদি ক্রমে ন্যাড়া মাথার উপর বংশানুক্রমিক জিজিয়া। দুর্গ্রহক্রমে এই দুগ্রহে জন্মাবার ও মরবার পাপের শাস্ত্রসম্মত প্রায়শ্চিত্ত"।
এবারে চলুন উদয়নিধির নিজের রাজ্যে যাই। আমাদের বিন্ধ্যপর্বতের এপারের জাত পাতের সমীকরণ বিন্ধ্য পর্বতের ওপারের ধর্মাচরণ, জাত পাতের সমীকরণ কিন্তু অনেকটাই আলাদা। সেখানে ১০০ বছর আগে ই ভি রামস্বামী যাকে আমরা পেরিয়ার বলে চিনি তিনি সনাতন ধর্মকে তুলোধোনা করেছিলেন। এবং উদয়নিধির থেকে অনেক চাঁছাছোলা ভাষায়। আসলে আমাদের রাজনীতি চর্চা মূলত উত্তর ভারতকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়, তাই আম্বেদকার আমাদের কাছে যতটা প্রাসঙ্গিক পেরিয়ার ততটাই অপরিচিত। পেরিয়ারের সবথেকে বিখ্যাত রচনা সত্য রামায়ণ গ্রন্থে তিনি লিখছেন, "এখানে আমরা আর্যদের বাস্তবিকভাবে বুঝে নিতে চাইবো। তাই আমরা দেবতাদের, ঋষিদের দেবরাজ ইন্দ্র ও তথাকথিত সাধকদের মানুষ হিসেবে ভূমিকা ও গুনাগুনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করব। আর্যরা যখন দ্রাবিড়দের প্রাচীন ভূমির উপর আক্রমণ করেছিল তখন তারা এখানে বসবাসকারী লোকেদের সঙ্গে অত্যন্ত খারাপ আচরণ করেছিল। তাদের সামনে আর্যরা হাজির হয়েছিল বহিরাগত শত্রুর মতো। তারা অন্যায় ভাবে স্থানীয় অধিবাসীদের অপমান করেছিল এবং যুদ্ধ করে তাদের উচ্ছেদ করেছিল তারপর ধীরে ধীরে আর্যরা একদিন মিথ্যে আর বিভ্রান্তিতে ভরা কল্পিত ইতিহাস লিখেছিল যার নাম তারা দিয়েছিল রামায়ণ। যেখানে রাম লক্ষণ সীতা ও তাদের সহযোগী লোকেদের আর্য, আর দ্রাবিড় ভূমির রাজা রাবণকে রাক্ষস এবং হনুমান সুগ্রীব বালি ইত্যাদিদের বানর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া মহামন্ত্রী জাম্বুবান কে ভাল্লুক, বৃদ্ধ জটায়ুকে শকুন এবং মহাবিদ্যান কাকভূষণ্ডি কে কাক ইত্যাদি সাথে তুলনা করা হয়েছে। শুধু তাই নয় এর মাধ্যমে আর্য রচয়িতারা অনার্যদের ঘৃণার যোগ্য ও নিম্ন স্তরের প্রাণী বলে চিহ্নিত করেছে"।
রামস্বামীর তাঁর রাজনৈতিক যাত্রাপথের একটা পর্যায়ে কংগ্রেস দলের সঙ্গে যুক্ত হলেও কিছুদিনের মধ্যেই তিনি উপলব্ধি করেন কংগ্রেস হচ্ছে একটি "ব্রাহ্মণ ও বেনিয়াদের" দল। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্পষ্ট ভাবে বলেন এটা জোর দিয়ে বলা যায় যে যতদিন এই বিষাক্ত জাতপাত বিভেদের মূল বর্ণাশ্রম প্রথাভিত্তিক ধর্মটি বিলোপ করা না যাচ্ছে ততদিন পর্যন্ত ব্রাহ্মণদের দ্বারা জোর করে কঠোরভাবে প্রযুক্ত তাকে শেষ করা যাবে না।...... ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের আগে, তিনটি ভয়ানক শত্রুকে নিকেশ করা দরকার প্রথম কংগ্রেস দল দ্বিতীয় জাতপাত যুক্ত হিন্দু ধর্ম এবং তৃতীয় ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ্যবাদীরা"।
শুধু সনাতন ধর্ম নয় সমস্ত ধর্মের ওপরেই পেরিয়ারের অনাস্থা ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠছিল। তাঁর সারা জীবনের সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের অনুশীলনের মাধ্যমে তিনি যা বলতে চেয়েছিলেন তা হলো একটি বৈষম্যযুক্ত সমাজে ধর্ম হল একটি সংগঠিত সামাজিক ক্ষমতা। যা সমাজের বিত্তবান সুবিধাবী অংশকে সুরক্ষা দেয় এবং ঠিক সেই কারণেই ধর্ম সমাজের বেশিরভাগ মানুষের নিরাপত্তা ও সুযোগ সুবিধা বিঘ্নিত করার কাজ করে চলে, এক বিপুল অংশের মানুষকে ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত রেখে তাদের মর্যাদাহীন অধিকারহীন দাস বানিয়ে রাখাই ধর্মের কাজ। ধর্ম হল শোষণ প্রক্রিয়াকে আড়াল করার জন্য শাসকদের পড়া মুখোশ। তিনি হিন্দু ধর্মের পাশাপাশি ইসলাম এবং খ্রিস্টান ধর্মকেও ব্যঙ্গ বিদ্রুপে সমালোচনা করেছেন। বুদ্ধদেবের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধা থাকলেও তিনি বৌদ্ধ ধর্মকে গ্রহণ করেন নি। এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিরিশ্বরবাদী হয়েই থেকে গেছেন।
স্বাভাবিকভাবেই এরকম একজন ব্যক্তিত্বকে হজম করা হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষে খুবই কঠিন কাজ ছিল এবং তারা প্রথম থেকেই আদাজল খেয়ে রামাস্বামী পেরিয়ার এবং তার মতবাদের বিপক্ষে যা যা করা যায় সবই করেছেন। তার বিভিন্ন লেখা পত্র, তার তৈরি করা সংগঠনের বিরুদ্ধে আদালতে গেছেন, তামিলনাড়ুতে বিভিন্ন জায়গায় তাঁর যেসব মূর্তি আছে তাতে জুতোর মালা পরিয়েছেন, কালি লেপেছেন। কারণ ১০০ বছর পরেও তার মতবাদের ঝাঁজ কমে তো নিইই বরং অনেকটাই বেড়েছে তাই নাগপুরীদের পক্ষে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। উদয়নীতির বক্তব্যের মধ্যে তারা তাই সিদুরে মেঘের ছায়া দেখছেন।অন্যদিকে কিছুটা সুযোগও দেখছেন। রাজনৈতিকভাবে বিজেপির অবস্থা এখন অত্যন্ত করুণ। একের পর এক প্রতিশ্রুতি এবং সেটা পালন না করা, জনগণকে বিভ্রান্ত করা, কৃষক শ্রমিকদের অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত করে দেওয়া সবকিছুই এখন সবার চোখের সামনে চলে এসেছে কিন্তু এদিকে সামনে পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন, লোকসভা নির্বাচন ও একেবারে দোরগোড়ায়। এই কঠিন পরিস্থিতিতে বৈতরণী পার হওয়ার জন্য, হাতে রয়েছে একটি মাত্রই পেন্সিল সেটি সনাতন ধর্ম।
গ্রন্থ সাহায্য:
সত্য রামায়ণ ও অন্যান্য রচনা, সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়
মস্কো বনাম পন্ডিচেরি: শিবরাম চক্রবর্তী