আমার স্মৃতিতে ‘শবেবরাত’ মানে আলো আর সুগন্ধির এক মায়াবী রাত; পূর্বপুরুষদের স্মৃতিচারণার রাত। আসমানের সাত-মঞ্জিল খোলা ও আল্লার কাছে সরাসরি ইবাদত পৌঁছানোর রাত। ফেরেশতা, মৃত আপনজনের রূহদের সাথে কাটানো একটি অলৌকিক রাত। তাই সারা বছর এই রাতের অপেক্ষায় থাকতাম, সেদিন আমাদের ছোট ছোট দাওয়াগুলো সারিবদ্ধ মোমবাতির নরম আলোয় ভিজে থাকতো। সেদিন কবরস্থানের হাওয়ায় সুগন্ধি ধূপ আর আতরের সুগন্ধে মৃদু আলোয় মাখামাখি। এই রাতেই নাকি আল্লাহ্-পাক আগামী বছরের ভাগ্যখাতা লেখেন আর সমস্ত রাত ধরে ফেরাস্তা আর পাক্ রুহুরা পৃথিবীর বুকে আসেন প্রিয় মানুষের জন্য দুয়া করেন। ৭ বৈশাখ ১৪২৬ ছিল এ বছরের শবেবরাত।
এমনিতে এই বাংলায় মুসলমান উৎসবগুলি বড়ই মলিন। দারিদ্র্য, বঞ্চনার দাস্তানে যে সমাজ আজও সম্পৃক্ত; সেখানে প্রতিবছর শাওয়াল মাসে ও জিলহজ্ মাসে চাঁদের নিয়ম মেনে নীরবে কাগজ ফুলে সাজানো উৎসবের উৎযাপন আসে।এদেশে এই উৎসবের আগমন ও প্রস্থান হয় চুপিসারে বা ন্যূনতম কয়েক লাইনের খবরে। ঈদ, বকরি-ঈদের নামাজ শেষে সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়ালেই আতরের সুবাস ও কাগজ ফুলের রং ফিকে হতে থাকে, তৈরি হয় গভীর শূন্যতা। তবে আমাদের এককালের গ্রামঘরে উল্লেখযোগ্য উৎসব উৎযাপনের অন্যতম একটি ছিল শবেবরাত। শব (রাত) বরাত (ভাগ্য)— শাবান মাসে ১৪ তারিখে যার আগমন। রাতের অনুষ্ঠান হওয়াতে আলোয় ভেজা এক অন্য মায়া তৈরি হতো। মোমবাতির হলদে আলোতে মনে হতো ওই দীঘির পাড় দিয়ে হেঁটে আসছে ফেরস্তা, ভয় লাগতো না, একটা অজানা পৃথিবীর কথা ভেবে শিহরিত হতাম আমরা ছোটরা। আর নিজেদের অসম্ভব কল্পনা দিয়ে বুনে নিতাম সেই অজানা পৃথিবীটাকে।
বড়রাও এই কল্প পৃথিবীতে বিশ্বাসীই ছিল; তারাই তো আমাদের দিয়ে প্রতি বছর শাবান মাসের প্রথম সপ্তাহে গ্রামের কবরস্থান পরিষ্কার করাতো। আর শবেবরাতের দিন পড়ন্ত বিকেল থেকে আমাদের ছোটদের কবরস্থানে নিয়ে যেতেন, গল্প শোনাতেন; দাদা, দাদি, নানা নানী, বড়আব্বা, বড়মা ও মৃত সব আপন মানুষের কবরে পায়ের কাছে মোমবাতি ধূপ জ্বালিয়ে আসতে সাহায্য করতেন।সেদিন আমরা কবরের পাশে বসে মৃত মানুষদের সাথে কতো সুখ-দুঃখের কথা বলতাম। আমি কোনোদিন দাদিকে দেখিনি; তবু দাদির কবরের পাশে সেদিন কি একটা মায়া জড়িয়ে থাকতো। ঐ দিন সন্ধ্যে রাতে মৃতদের স্মৃতি কথার গুঞ্জনে ভেঙে যেত কবরের নিস্তব্ধতা।মৃত আত্মীয়দের স্মরণে রাখার ও আগামী বছর আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, ধূপ ও মোমবাতি জ্বালিয়ে ফিরে আসতাম আমরা ছোটরা। নিজেদের ছোট কুঁড়েঘরগুলোর দাওয়া টালির চালা মোমবাতির আলোতে সাজিয়ে যে জান্নাতি সৌন্দর্য আনতে হবে। সেদিন গ্রামের যে কোনো মুসলমান বাড়িতেই যাওয়া হোক; সব বাড়িতেই সারিবদ্ধ ছোট মোমবাতি চোখ জুড়ানো আলোর সমাহার ও ধুপের খুশবুতে যেন মায়া ধরানো আবেশ।চারিধারে বাতাসেগুনগুন শব্দ হয়ে অনুরণিত হতো বিভিন্ন সুরের কলমা, সূরা। গ্রামের কারও বাড়িতে মিলাদ দেওয়া হতো, সেখান থেকে সমস্বরে ভেসে আসতো ‘আল্লা হুমা্...সাইলে আলা... সাইয়া দেনা... মৌলানা মোঃহামাদ!’ আর ছিল বাঙালী মুসলমানের এই উৎসবের প্রধান খাদ্য, আলো-চালের রুটি, মুরগির মাংস, পায়েস বা সিমুই।
একটু একটু করে এই গ্রামটাকে মরে যেতে দেখলাম। ওনারা প্রচার শুরু করলেন, সেই প্রবল প্রতিক্রিয়াশীল আলোড়নে মসজিদের নামাজীরা প্রথমে কট্টর হলেন, বললেন আমাদের ধর্মে কবর জিয়ারত জায়েজ নয়। এর পর গ্রামের মানুষদেরকে হাদিস কোরানের উল্লেখ করে, নানা ধর্মীয় কাহিনীর মাধ্যমে ভয় দেখিয়ে কবর জিয়ারত বন্ধ করানো হয়।ক্রমশ পাল্টে গেল শবেবরাত উৎযাপন প্রণালী। পল্লী মুসলমান সমাজের প্রথাকেন্দ্রিক একটি উৎযাপনকে গোঁড়া ধর্মহোতাগণ রক্তচক্ষু দেখিয়ে খুন করলো। খুন করলো সেই সংবেদনশীলতার জায়গাগুলো যেখানে, একটি শিশু মৃত দাদির কবর ছুঁয়ে মাটিকে ভালবাসতে শিখতো। সুপরিকল্পিত ভাবে শিকড় টেনে তুলে বিচ্ছিন্ন করবার প্রচেষ্টা সফল হল।
এই গত কয়েক বছরে শবেবরাত মানে এক সপ্তাহ ধরে গ্রামের আকাশে আতশবাজির আলো, ফুলকি, বাতাসে শব্দবাজি ও বারুদের কটু গন্ধ। বাড়ি গুলো সেজে ওঠে টুনি লাইটে, এই আলোতে ফেরেস্তা আর রূহ-দের অনুভব করা যায় কিনা জানি না। আজকাল নিঃসঙ্গ এক খোঁজতালাশ চালিয়েও গ্রামের কোথাও খুঁজে পাই না অনতিদূর অতীতে ফেলে আসা সেই শবেবরাতকে।সারাটা গ্রাম ঘুরে সেই মিঠে আলোর মোমবাতি দেখা যায় না আর।গোরস্থানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় অনুভব করি, অতীতের অসংখ্য কাহিনী নিয়ে মৃতদের কবরগুলো জংলায় ভর্তি, আর সেখানে রয়েছে জমে ওঠা একাকীত্বের অন্ধকারে মোরা ঝিঁঝিঁ পোকা, আর পেঁচার ঝিমধরা গুঞ্জন।গত কয়েক বছরে কলমা-সুরার মৃদু অনুরণনকে ছাপিয়ে গ্রামে এসেছে উদ্দাম সাউন্ডবক্স এর শব্দ; সেখানে ধর্মকথা আর বাজারি গান একসাথে চলে।অনেকদিন আগে পুরাতন প্রথা নির্ভর শবেবরাতকে গিলে নিয়েছিল গোঁড়াধর্ম। আর যে বাজার কেন্দ্রিক শব্দ-বাজির একটি অনুভূতিহীন, প্রাণহীন আতিশয্যে মোড়া উৎসবের অনেক আলোর এই অন্ধকার রাত, তার ভিত্তি প্রস্থ থেকে নির্মাণ সবেতেই একনিষ্ঠ সাহায্য করে গেছে গোঁড়াধর্মের হোতারা।
পশ্চিমবঙ্গের প্রান্তিক মুসলমান অধ্যুষিত গ্রামগুলোর আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটটা বদলাচ্ছে। তার সাথে তালমিলিয়ে বদলাচ্ছে মানুষের জীবনযাপন সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আচার। পুরাতন থাকবন্দী সমাজ, একটি গ্রাম নতুন পরিকাঠামোয় প্রবেশ করছে, এই অবস্থান পরিবর্তনের ঘটনাগুলো সে সময় ঘটে চলেছে নীরবে নিভৃতে। বছর দুই আগে আমার গবেষণা কাজের জন্য যখন নদীয়া-মুর্শিদাবাদ জেলার বিভিন্ন মুসলমান অধ্যুষিত গ্রামে দিনের পর দিন পড়ে থাকতাম সেই সময়ে দেখি গ্রাম, গ্রামের মানুষ, গ্রামীণ সমাজ— যাবতীয় কিছু মিলে যে চিরাচরিত নিসর্গ চিত্রের বর্ণনা আমাদের চোখে ভাসে, সেই গ্রাম নামক ধারনাটার খোলনলচে বদলে যাচ্ছে ক্রমাগত। তার সাথে পাল্লা দিয়ে ধর্মপ্রচার আর ধর্মীয়শিক্ষা ধরণগুলো পাল্টে যাচ্ছে। গ্রামীণ মানুষের পুরাতন লোকসংস্কৃতির সাথে, মাটির সাথে যে নিবিড় সম্পর্ক সেগুলোকে সুপরিকল্পিতভাবে বিনাশ করতে, সন্ধি পেতেছে গোঁড়াধর্মসংস্কৃতি আর বাজার সভ্যতা। আমাদের প্রজন্ম এই সময় মূল্যের নিরিখে মাটি বোঝেন। কারণ তাঁদের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করবার প্রচেষ্টায় গোঁড়া ধর্ম ও বাজার অনেকখানি সফল হয়েছে।
0 Comments
Post Comment