সংরক্ষণ যেদিন থেকে "স্বাধীন ভারতের" আইনে এসেছে সেদিন থেকেই সংখ্যালঘু "জেনারেল ক্যাটাগরি" বা "সাধারণ বর্গ "(!?) (একদম ডাহা মিথ্যে বর্গবিভাজন) ভুক্ত মানুষরা খুব গোঁসা করে চলেছে। তাদের যাবতীয় অধিকার নাকি ছোটলোকেরা কেড়ে নিয়েছে। উল্টো দিকে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ মুসলমানদের সংরক্ষণকে গ্রহণ করেন নি কারণ তাঁর ধারণা ছিল, ভারতে মুসলমানদের যা সম্পত্তি আছে আর প্রতি বছর ওয়াকফ বোর্ডের কাছে যে জাকাত থেকে প্রাপ্ত অর্থ জমা পরে তা দিয়ে মুসলমানদের শিক্ষা এবং চাকরি একদম উচ্চতম স্তর পর্যন্ত সুনিশ্চিত করা যাবে। তথাকথিত "সাধারণ বর্গের" সুবিধাভোগীরা বেঁচে গেছিলো সেই দিন থেকে। চিত্তরঞ্জন দাস কলকাতার মেয়র থাকাকালীন তৎকালীন ধর্মীয় বিভাজনের নিরিখে কলকাতায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের জন্যে সরকারি চাকরি এবং প্রতিনিধিত্বের শতকরা ভাগ ৬০% করতে বলেছিলেন, অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্যে সংরক্ষণের এক ফর্মুলা দিয়েছিলেন। সে সব করা যায় নি। হিন্দু "সাধারণ বর্গীয়"রা তীব্র আপত্তি তুলেছিল। কিন্তু সে তো ধর্মভিত্তিক বিভাজন আর সংরক্ষণের গল্প। এই আলোচনা অন্য প্রসঙ্গ। আজকে আমরা সংখ্যালঘিষ্ঠ মানুষদের জন্যে বেশি সংরক্ষণ করছি আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের জন্যে এক তৃতীয়াংশ বা তার নিচে সংরক্ষণ করে রেখেছি।
অনুসূচিত জনজাতি/ ব্রাত্য জনগোষ্ঠী আর পিছিয়ে থাকা জাতগোষ্ঠী মিলিয়ে ভারতে ২০১৯-২০২১ সালের অসম্পূর্ণ সরকারি হিসেবে অনুযায়ী সমগ্র ব্রাত্যকুল ৬৭% আমাদের জনসংখ্যার অংশ (তাদের মধ্যে পশ্চাৎপদ বর্গ বা ওবিসি ৪১% অনুসূচিত জনজাতি ৮.৬% আর অনুসূচিত জাতিগোষ্ঠী ১৬.৭%) এই বিভাজন মোটেই বাস্তবসম্মত নয়, কিন্তু সরকারি হিসেবে আর ৩৩% মাত্র "সাধারন বর্গ", অথচ সংরক্ষণ ঠিক তার উল্টো অর্থাৎ ৬৭% মানুষের জন্যে আছে ৩৩% সংরক্ষণ আর ৩৩% মানুষের জন্যে আছে ৬৭% কাজের সুবিধা। এবার পাঠক নির্ধারণ করুন সংরক্ষণ কার জন্যে। সংখ্যালঘিষ্ঠদের জন্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন সংরক্ষিত নয় কি? জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য পরিষদের একটা হিসেব থেকে প্রায় কাছাকাছি হিসেবই পাওয়া যাচ্ছে (যদিও এই হিসেবে মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়, যার প্রমান বিভিন্ন রাজ্যের হিসেবে যোগ করলে একেবারে কাছাকাছিও যাবে না , যাই হোক আমরা এই নিয়েই না হয় কথা চালাই) প্রশ্নটা এই উল্টো বিচার নিয়ে।
তাহলে প্রশ্নটা কোথায় ?
সংরক্ষণ মানে চাকরি এবং বিশেষতঃ সরকারি চাকরিতে কোন বর্গের কতটা সুযোগসুবিধে দেওয়া হয়েছে বা আজও হয়ে চলেছে? এবারের নির্ধারিত জনগণনা হলো না। তা "কাজের চাপ" মার্কা অজুহাতের কারণে মোটেই নয়, এটা একটা গভীর চক্রান্ত। জনগণনাতে অনেক কিছুই বেরিয়ে আসার কথা, তাকে বন্ধ করার জন্যেই এই নির্ধারিত কাজ কে পিছিয়ে দেওয়া -- ব্যাপারটা আরো একটু পরিষ্কার করা যাক। জনগণনা প্রতি দশ বছর করলে অনেক সংখ্যাতত্ত্ববিদই সহজেই সমাজের ছোট থেকে বড়ো বিভাজনগুলো বার করে ফেলতে পারতেন। পারতেন ক্রমবর্ধমান/ক্রমহ্রাসমান হার বুঝতে। ২০২৪ এর নির্ধারিত নির্বাচনের আগে এক বড়ো ইস্যু কায়েমী সরকারের বিরুদ্ধে চলে যাওয়ার প্রভুত সম্ভাবনা। তাই পিছিয়ে দাও, নির্বাচন উৎরে যাক, পরে দেখা যাবে, এটাই উদ্দেশ্য। সবচেয়ে বড়ো প্রশ্নটা উঠতো এই "সাধারণ বর্গের" "অসাধারণ সুযোগ সুবিধা" ভোগ করা নিয়ে।
সমস্ত পৃথিবীতেই মিশ্র জনবিন্যাসের দেশগুলোতে জনবিভাজনের ভিত্তিতে সরকারি সুযোগ বন্টন করার একটা নিয়ম আছে। ভারতবর্ষে যে সেই নিয়মকে ভেঙেচুরে উল্টো করে সম্পূর্ণ উল্টো "যাথার্থ" করে দেওয়া হচ্ছে , তা করতে গেলে হিসেবেগুলোকে সুচতুর কৌশলে গুলিয়ে দিতে হবে, তার একটা কাঠামো বা ফ্রেমওয়ার্ক বানাতে হবে। এটাই ভারতের আইনসভার একচ্ছত্রবাদ বা পার্লামেন্টারি অলিগারকি(!)র (নামকরন, কিন্তু এখন বিশ্বের স্বীকৃত সারস্বত পরিমণ্ডল এবং সরকারগুলো বলতে শুরু করেছে, কোনো ধরণের গণতন্ত্র যে এই ব্যবস্থায় নেই সেই বাস্তবতা কে মান্যতা দেওয়ার জন্যে এই নামকরন) কর্মপ্রকরন।
গভীর বিষয়টা মূলতঃ কি ?
মূল বিষয়টি সবসময়েই লুকোনো থাকে "প্রকট" করানো হয় না, এটাই কায়দা। সংখ্যালঘু সরকারকে "সংখ্যাগুরুর মত" বলে চালাতে গেলে এই অপ্রকটতা কার্যকরী করতেই হবে, এই বিষয়টি হলো মেরিট বা "গুণ"। ধরেই নেওয়া হয় যে যারা সংরক্ষণের মধ্যে দিয়ে নির্বাচিত হয়, তারা কম মেধা সম্পন্ন এবং তারা তাদের নির্দিষ্ট শৈলী ব্যবহার করতে অপারগ হবে। যদিও তারা নির্বাচনের পরে একই শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে, তবুও তাদের প্রারম্ভিক নির্বাচনের সময়ের একটা বিশেষ শর্তে বদ্ধ ও বন্দি করে রাখা হবে। যারা এই সব গালভরা মেধা/শৈলীর কথা বলেন, তারা মূলতঃ অন্য একটি বিষয়কে বা চাতুর্যকে ঢেকে রাখার জন্যেই এটা করেন। বিশ্লেষকের উচিত সেগুলোকে খুঁজে বার করা। উচ্চবিত্ত "সাধারণ বর্গের" মানুষরা ধর্ম, জাত এবং অর্থের সুযোগ নিয়ে (যা তারা বংশপরম্পরায় হাসিল করে এসেছে) তাদের অপটু এবং নিম্নমেধার সন্তানদের অর্থের বিনিময়ে পড়ানো বা চাকরির সুযোগ নেয়, সেই সন্তানদের মেধা/ শৈলী বা মেরিট নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা হয় না। কয়েক কোটি টাকা দিয়ে প্রাইভেট শিক্ষায় উৎরে যাওয়া ডাক্তারদের কাছে তাদের যেতে নাকি কোনো বাধো বাধো ঠেকে না, বা প্রাইভেট কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শংসাপত্র নিয়ে বেরিয়ে আসা প্রকৌশুলীদের বানানো সেতুর ওপরে তাদের অগাধ বিশ্বাস, কিন্তু সংরক্ষণের মধ্যে দিয়ে নির্বাচিত ছাত্রদের কষ্ট করে প্রশিক্ষিতদের ওপরে তাদের বড়ো সন্দেহ। এই মানসিকতা কিন্তু উপমহাদেশ এর বাইরে অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না, সেখানে বরং সংরক্ষণে শিক্ষিত মানুষদের দাম কম তো নয়ই বরং বেশিই বলতে হবে, কারণ সেই দেশের মানুষজন জানেন যে এই সন্তানরা অনেক বেশী পরিশ্রম করেছে প্রশিক্ষার সময়ে।
এই ধরণের অবান্তর সব চিন্তা এসেছে আমাদের জাতিভিত্তির ধর্মীয় অনুশাসন এবং ধর্ম থেকে। অর্থাৎ ভারতে নিহিত ব্রাহ্মণ্যবাদ বা মনুবাদ এবং তার ফলে বংশানুক্রমিক দাসপ্রথা এবং অধস্তন কে বংশানুক্রমিক ভাবে অধস্তন রেখে দেওয়ার মতাদর্শ থেকে। কোনো না কোনো ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কে ক্ষমতাহীন প্রান্তিকীকরণে করতে করতে একধরণের অবৈধকরনের দিকে নিয়ে যায়। উত্তরপ্রদেশ, এবং গোবলয়ে তো ডাক্তার, উকিল এবং প্রকৌশলীদের নামফলকে রীতিমতো জাত এর নাম দেখতে পাওয়া যায় অনেক জায়গায়, কিছু ক্ষেত্রে আবার ব্রাত্যমানুষদের প্রবেশে অনুৎসাহিত করা হয়। আরো ভয়ঙ্কর যখন ধর্মীয় বিভাজনে কাউকে প্রবেশ করতে না দেওয়া। এই দেশে যেমন বংশপরম্পরায় শৈলী সংরক্ষণের নামে কাজ কে বংশপরম্পরায় বিশেষ কারিগরির মধ্যে বেঁধে রাখবার জন্য প্রথমে "অর্থসাহায্য" কে প্রচুর ঢক্কানিনাদ করিয়ে বিশেষ "সুযোগ" দেয় সরকার, তাতে যে একই শৈলীতে বেঁধে রেখে তাদের জীবনে "উন্নত" শিক্ষা বা অধ্যয়নের সুযোগকে কেড়ে নেওয়া হয়, তা কিন্তু আমাদের সম্প্রচার মাধ্যমের পরিমণ্ডল থেকে গোপনে রেখে দেওয়া হয় সেটা কিন্তু আমরা "সাদা চোখে" দেখতে পাই না। আর নিজেদের রাজনীতি বুঝি না,করি না বলে এড়িয়ে গিয়ে এই চিরবিভাজনকেই টিঁকিয়ে রাখি। আমরা খুব পরিষ্কার ভাবেই জন্মের দাগের ভিত্তিতেই মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন কারাগারে বেঁধে রাখি , কিন্তু সংখ্যালঘু "সাধারণ বর্গ" কে প্রভূত সুযোগ সুবিধা এবং স্বাধীনতা দিয়ে তাদের শাসন কায়েম করি। বিষয়টা ঠিক এইখানেই। "Tyranny of Merit" এখন একটি বিখ্যাত বইয়ের নাম মাইকেল স্যান্ডেল তার লেখক। আর আছে ফ্রেডরিক দি বয়ের এর লেখা বই। সংরক্ষণ এদেশে উল্টো।
কেন জাত ভিত্তিক জনগণনা খুব বেশি প্রয়োজন?
তাহলে আমরাও কেন জাত ভিত্তিক জনগণনার কথা বলবো? উত্তরটা সোজা। সবার কাছ থেকে যা গোপনে রাখা হয়েছিল তা প্রকাশিত হবে, অর্থাৎ এটা "প্রকট" হবে বা প্রকাশ পাবে যে কি ভাবে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে সংখ্যালঘিষ্ঠ সুযোগ দিতে দিতে তাদের একেবারে সুযোগহীন, ক্ষমতাহীন করে রেখেছি। আমরা অনুসূচীত জনগোষ্ঠী বা জনজাতির কথা বলতে বাধ্য হয়েছি আম্বেদকরের দৌলতে কিন্তু ৪১% পিছিয়ে থাকা জাতসমূহ, তাদের কথা বলাটাই নাকি অপরাধ, প্রায় দেশদ্রোহীর মতো। তারা তো যে কোনো অন্য বর্গের থেকে অনেক বেশি। এদিকে আমরা সুবিধা মতো সরকারের চালে সুযোগসন্ধানীদের জায়গা করে দিচ্ছি যেমন মনিপুরে মেইতেইদের অনুসূচিত ঘোষণা করিয়ে কুকি, নাগা, জো জনগণ এবং টিপরাদের নিজের বাসভূমিকে এতদিন ব্রাত্য করে রেখেছিলাম এখন তো মায়ানমার থেকে আসা অনুপ্রবেশকারী বলছি। অথচ এই মেইতেইরা কতটা সেই ভূমির আদি জাতি তা মোটেই প্রশ্নের উর্দ্ধে নয়। সমগ্র উত্তর ভারতে জাত বিভাজনে সংখ্যালঘুদের খোলা সুযোগ দিয়ে আর তার সঙ্গে জাতিবিভাজনের মাধ্যমে বহিরাগত তৈরী করা সাধারণ এবং মূলনিবাসী বলে চালিয়ে আরও এক বিশেষ সংখ্যালঘু অংশকে খোলা সুযোগ দেওয়া হচ্ছে এই দেশে। ইহাই হিন্দুত্ববাদ বা মনুবাদ যা গণতন্ত্রের নামে চালানো হচ্ছে। সংখ্যালঘুকে "সাধারণ" বলে চালিয়ে দেওয়ার হাতিয়ার হচ্ছে জাতভিত্তিক আদমশুমারি কে বন্ধ রাখা। "জাত" আছে অথচ স্বীকৃতি দেব না মেরিট আর এথিক্স বা চলে আসা নিয়মের নামে কয়েক বছর পরে কিছুতেই বলা যাবে না যে কোন জাত বা জাতির মানুষকে কতটা সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল আর কাকে না। "সত্য" বা "তথ্যের" অভিধায় অবাস্তব কল্পিত বিভাজনকে "বাস্তবতা বলে চালানো যায় যদি জাত ভিত্তিক আদমশুমারি না হয়. তখনি ৩৩% জনগণকে ৬৭% সুযোগ দেওয়াকেই যথার্থ বলে চালানো যায়. অবাস্তব এবং অযথা কে বাস্তব বা সত্য বলে চালানোটাই গণতন্ত্রের বদলে পার্লামেন্টারি অলিগারকি বা পলিটিকাল টাইরানির কর্মপ্রকরণ। ফ্যাসিবাদ এর জন্ম হয় যখন এর সঙ্গে যুক্ত হয় ধর্মীয় মেরুকরণের বিষাক্ত ধারণা যখন জনমানসে সেঁধিয়ে দেওয়া যায়.
জনগণনাকে পিছিয়ে দিয়ে, জাতভিত্তিক জনগণনাকে বন্ধ করেই "সাধারণ বর্গ" নতুন করে পুনর্গঠন করা যায়। এরপর আসবে ইচ্ছে মতো জনবিন্যাসের বিষয়, তবে তা কিছুটা প্রসঙ্গান্তর। একের পর এক নিত্য নতুন বিভাজনের খেলা অথচ বাস্তব বিভাজনগুলোকে গায়ের জোরে অস্বীকার করে কিছু বানানো বিভাজনে পুনর্গঠন করাটা বর্তমান সরকারের প্রশাসন পদ্ধতি। দ্বান্দ্বিকতা কখন যে কি কৌশলে প্রধানকে অপ্রধান বানিয়ে, উল্টোটা করে সমাজ কে বিষাক্ত করবে তার প্রয়োগ কৌশল রাষ্ট্র বা সংখ্যালঘু সরকার নিজের কাছেই রাখবে ,তথ্য গোপন করার ফিকির খুঁজে চলবে অনন্তর । তথ্য যেমন অনেক কিছুকে প্রকাশ ও প্রকট করার কাজে লাগে, তেমনি আবার অনেক কিছুকে ঢেকে রাখার কাজেও শাসকরা চালিয়েই যাবে।
এই বিষয়ে অন্য লেখাটিও থাকলো নীচের সূত্রে।
বিহারের জাতশুমারি - সম্ভাবনার যে দিকটি সামনে এলো
সাম্প্রতিক সময়ে বিহারে একটি জাতিভিত্তিক জনগণনা করা হয়েছে, তার ফলাফলটি
এখানে রাখা হলো, যা এই বিষয়টিকে বুঝতে সাহায্য করবে।